Saturday, August 2, 2014

বিএনপির আন্দোলন, আওয়ামী লীগের আস্ফালন- সহিংসতার আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত জনতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির ঈদ পরবর্তী আন্দোলন এখন সর্বাধিক আলোচ্য বিষয়। গত মাসের ১৬ তারিখে বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে ঈদের পর কঠিন আন্দোলনের ঘোষণা আসার পর থেকেই এটা রাজনীতির মুখ্য আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঈদ ইতোমধ্যেই শেষ। ঈদের আমেজও ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। জনজীবন হয়ে উঠছে স্বাভাবিক। নাড়ির টানে ঘরে ফিরে যাওয়া মানুষগুলোও অনেকেই ফিরে এসেছে রাজধানীতে। তবে সবার মনেই দানা বাঁধছে এক গুপ্ত আশঙ্কা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন নিয়ে কম-বেশি সবাই চিন্তিত। বিশেষ করে যারা গত বছরের শেষ অবধি বিএনপি জোটের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের কবলে পড়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা বিএনপির ঘোষিত এই আন্দোলনকে ছোট করে দেখতে নারাজ।
বিএনপি নেত্রীর আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিচিত্র সব মন্তব্য করে চলেছেন রাজনীতিকরা। সরকারি দলের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বিএনপির গত বছরের আন্দোলনে ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বিএনপিকে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করা হচ্ছে অনেক। তবে যদি সত্য সত্যই বিএনপি গত বছরের আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কৌশলে মাঠে নামে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ১৬ জুলাই একটি অনুষ্ঠানে আন্দোলনের ঘোষণা দেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরদিনই তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি ইফতার মাহফিলে বলেন- তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন না। তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চান। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণার পর হতেই যেন নড়েচড়ে বসেছেন আওয়ামী লীগসহ সরকারের জোট নেতারা। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তারা বক্তব্য দিচ্ছেন নানা ঘোষণা সহকারে। তবে সেসব বক্তব্য কতটুকু দলীয় মত প্রকাশ করছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। ঠিক একইভাবে বিএনপি নেতারাও আন্দোলনের কথা বলে মাঠ গরম করতে চাইছেন।
বিশ্লেষকদের ধারণা- বিএনপি আন্দোলন শুরু করার বহু পূর্ব থেকেই এত উচ্চ-বাচ্চ করে মূলত সরকারের উপর একটি পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এতে সংলাপের দরজা খুললেও খুলতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা যে খুব একটা নেই, সম্প্রতি তা নিশ্চিত করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লন্ডনে ভ্রমণরত অবস্থায় বিবিসি বাংলাকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেন- বিএনপির সাথে আলোচনার কথা ঘুরে ফিরে কেন বলা হচ্ছে তা তার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন- বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল করেছে তার মাশুল তাদেরকে দিতেই হবে।’ বিএনপি যতই হুমকি দিক না কেন, সরকার যে সেটাকে খুব একটা দাম দিতে ইচ্ছুক নয়, তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে। লন্ডন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মাঠের খেলা মাঠেই হবে। ফুটবল মাঠে কে কয়টা গোল দেয়, সেটা সেখানেই দেখা যাবে। মাঠে নামুক না। মাঠে আওয়ামী লীগ আছে-যুবলীগ আছে। মানুষও আছে।’ এদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই কথার জবাবে বিএনপির অপর একটি ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আন্দোলন মানে মারধর, জ্বালাও পোড়াও নয়। ঈদের পরে আমাদের আন্দোলন হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক। আমরা শুনতে পারছি, ঈদের পর আওয়ামী লীগও পাল্টা রাজপথে নামবে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, আপনারা রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভালো। তবে পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনী নিয়ে অস্ত্র হাতে রাজপথে নামবেন না। এটা করা হলে পাল্টা জবাব দেয়া হবে। এর পরিণতি ভালো হবে না।’ বস্তুত বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে যে, সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনকে বান্চাল করতে অবৈধভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। তাদের ধারণা- বিগত বছরে সরকার যদি প্রশাসনকে তাদের দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মতো ব্যবহার না করতো তাহলে বিএনপির আন্দোলন কখনোই ব্যর্থ হতো না। তবে এবার সব ধরনের আটঘাট বেঁধেই রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সাথে রয়েছে স্বভাবজাত যুদ্ধংদেহী মনোভাব। সরকারকে হুঁশিয়ার করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নির্বাচন আয়োজনে বিএনপির আহ্বানকে দুর্বলতা ভেবে অগ্রাহ্য করলে তাতে তুমুল যুদ্ধেরই পদধ্বনি শোনা যাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হামলা-মামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, হরতাল-অবরোধ ইত্যাদি নতুন কোনো বিষয় নয়। এরশাদ পরবর্তী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবার পর থেকে এদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রধান দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের ধারা বহুদিনের। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের শেষ অবধি আন্দোলনের নামে হরতাল-অবরোধ, সহিংস কর্মসূচি পরিচালনা করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮ দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গত বছরের শেষ তিন মাস কাটে তুমুল অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। একদিকে চলে হরতাল-অবরোধের নামে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, মানুষ খুন, চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা, আরেকদিকে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, জেল-জরিমানা। এই তিন মাসের অধিকাংশ সময় রাজধানী ঢাকা শহর সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল। বহু-হতাহত, বহু প্রাণক্ষয় আর জাতীয় সম্পদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির উপর দিয়ে শেষ হয় বিএনপির ঐ সরকার বিরোধী আন্দোলন। বিএনপি এ আন্দোলনের সুফল ঘরে তুলতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষ যে অশেষ ভোগান্তির শিকার হয়েছিল তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে নতুন নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে যে আন্দোলনের ঘোষণা আসছে তাতে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কায় কার্যত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে দেশের আপামর জনতা।
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের শেষ অবধি ৫৫ দিনই কেটেছে তৎকালীন বিরোধী জোটের হরতাল বা অবরোধের মধ্যে। এর মধ্যে বছরের শেষ তিন মাসের আন্দোলন-সহিংসতার পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে যে, বছরের শেষে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- এই তিন মাসেই রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৪৭ জন, আর আহত হয়েছেন প্রায় ১২,৬৪৬ জনের অধিক। এই সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র আগুনে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৯৪ জন ব্যক্তি। ককটেলের বিস্ফোরণে নিহত হয় ৬ শিশু, আহত হয়ে অঙ্গ হারায় কমপক্ষে ২২ শিশু। শেষ তিন মাসের সহিংসতায় ১১ জন পুলিশ সদস্যও তাদের জীবন হারান। ৬৭৪ টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। তখন নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস ঘটনায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩১৫টি মামলায় অন্তত ৬৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছিল। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে পড়েছিল মারাত্মক প্রভাব। শুধুমাত্র এই তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি হয় ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এই ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ আয়ের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অতি দুর্যোগময় সময় অতিক্রম করেছে সাধারণ জনগণ। এত ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানী আর আতঙ্কের জন্ম দিয়েও বিএনপির আন্দোলন সফল হয় নি। তাই এবার সাফল্য পাওয়ার আশায় আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে- এমনটাই বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। আর তা সাধারণ জনগণের ভাগ্যে যে অতি করুণ বার্তা বয়ে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুনভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে জনজীবন সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত হবে। তেমন স্থিতি কারও কাম্য নয়। এমন সম্ভাবনা যেন কখনোই বাস্তবতার মুখ না দেখে- তেমনটাই আশা করছে আন্দোলনের ভারে ভীত-সন্ত্রস্ত আপামর জনতা।

আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ

প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও খুন-খারাবি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অতীতেও ঘটতো, তবে বর্তমানের মতো এত বেশি নয়। তাছাড়া সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা এতটাই নৃশংস ও হৃদয়বিদারী যে, তা পুরো দেশবাসীর মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে যখন ঘটনাগুলোর সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার খবর মিলছে। তাছাড়া কিছু ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত না থাকলেও সেই অপরাধের সাথে তাদের যোগসূত্রতা ও পরোক্ষভাবে মদদ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাগুলোর সম্পূর্ণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারের উপর, যার মোকাবেলায় সরকার কার্যত সফলতার পরিচয় দিতে পারছে না। অথচ প্রথম থেকেই সরকারের কিছু সদিচ্ছা এরকম পরিস্থিতির মোকাবেলায় যথেষ্ট ছিল। কিছুদিন ধরে যে গুম-খুন-অপহরণের ঘটনায় দেশ উত্তাল রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে তা নতুন নয়, কম বেশি সব সময়ই ছিল। তবে যেটা নতুন তাহলো- তা প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত ও বর্তমানের এমনই কিছু অকল্যাণকর সিদ্ধান্ত আলোকপাত করেই মূলত এই লেখাটি।
ক. রাজনৈতিক স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা এদেশে নতুন নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রায়ই আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম প্রথমে আসতে দেখা গেছে। এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট সরকারকেই দায়ী করা যায় না। বিএনপি আমলে ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের অন্যতম একটি কারণ ছিল মূলত পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া এবং তা থেকে বের করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়া। তাছাড়া জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের মাত্রা অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাবার কারণে তৎকালীন সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই র‌্যাব গঠন করেছিল। এটা ঠিক যে, প্রাথমিক পর্যায়ে র‌্যাব কিছু কার্যকারী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা খুব বেশিদিন টিকে নি। পরবর্তীতে তাদের সামগ্রিক কার্যকলাপ প্রকাশ্য ও গোপন, ভালো ও খারাপ এই দুই ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ যখন ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসে তখন পুলিশ বাহিনীর মতো র‌্যাবও সবেমাত্র কিছু কিছু ব্যাপারে বিতর্কিত হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় সরকার এই বাহিনীগুলোর উপর কোনো রকম রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার না করে ও বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারতো। আইনের শাসন বলতে যা বোঝানো হয় তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে পারতো। কিন্তু তা না করে, আওয়ামী লীগ সরকারও স্রোতের জলে গা ভাসায়। সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনে। বিএনপি সরকারের মতো আওয়ামী লীগও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হবার পথে এগিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থাকা অবস্থায় এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে টিআইবি একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রকাশিত উক্ত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়। সহস্রাধিক মানুষের মধ্যে জরিপ করে ঐ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন টিআইবির এই প্রতিবেদনটিকে গুরুত্ব তো দেনই নি, উল্টো তিনি টিআইবির বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বিভিন্ন বক্তৃতা প্রদান করেন। সেই সাথে চলে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের প্রতি বাহবা প্রদান। বলা হয় অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত। এতে করে যেখানে যে প্রভাবই পড়–ক না কেন, পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারগুলো যে যথেষ্ট উৎসাহ পেয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন যুক্তিতে সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে কঠিন হস্তে দমন করে নি শুধুই রাজনৈতিক স্বার্থে। এই ধারা অব্যাহত রেখে প্রশাসনের কাছ থেকে অপরাধ দমনে এবং আইনের শাসন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজে যথাযোগ্য ভূমিকা পাওয়া যতটা অসম্ভব, ততটাই অবাস্তব।
খ. প্রশাসনই যখন শেষ ভরসা: গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত সরকারকে বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক আন্দোলন-সহিংসতা, হরতাল, অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াও এর মোকাবেলা করতে হয়েছে। বাস্তবতা হলো এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকার একচেটিয়াভাবে আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। র‌্যাব-পুলিশ, বিজিবি কখনও স্বতন্ত্রভাবে আবার কখনও যৌথভাবে অপারেশন চালিয়ে বিরোধী পক্ষের সহিংসতা-সন্ত্রাস বা আন্দোলন, যাই বলা হোক না কেন তার মোকাবেলা করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বিরোধী পক্ষের বহু নেতা-কর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে। বিরাট সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। অনেকে এখনও জেলে আছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, সহিংস আন্দোলনকারীদের আক্রমণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকেও প্রশাসন আন্তরিকভাবে সরকারের আনুগত্য করে গেছে। সে সময় র‌্যাব-পুলিশের সামান্য দায়িত্বহীনতা বা উদাসীনতাও সরকারের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারতো, কিন্তু তেমনটি হয় নি। প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রশাসন হচ্ছে এই সরকারের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহু। আর এটাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‌্যাব-পুলিশ ভালোভাবেই জানে যে, তাদের যে কোনো বিপর্যয়কে সরকার নিজের বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করবে। তারাই সরকারের একমাত্র ভরসা। এই বাস্তবতা প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। তারা হয়ে পড়ছেন অনিয়ন্ত্রিত। জবাবদিহিতা হচ্ছে অনিশ্চিত।
গ. অভিযুক্ত র‌্যাবের বিচারে উদাসীনতা: নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার খ্যাত নৃশংস ঘটনাটির পেছনে সর্বপ্রথম র‌্যাবের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশিত হলে অনেকেই বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুরের অভিযোগ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলোর কারণে অল্প দিনেই অভিযোগটি যৌক্তিকতা ফিরে পায়। মিডিয়ার কল্যাণে অনেক সাড়া জাগানো তথ্য বের হতে শুরু করে। জানা যায়, ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা এই জঘন্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছে। হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন। উঠে আসে এমন কয়েকজন র‌্যাব কর্মকর্তার নাম যাদের মধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতাও রয়েছেন। অভিযোগ উঠার পর র‌্যাবের এই তিন কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের আইনের অধীনে আনা নিয়ে শুরু হয় সরকারের কার্যত গড়িমসি। বোঝা যাচ্ছিল যে, সরকার কয়েকটি তদন্তকমিটি গঠন করেই দায়িত্বের ইতি ঘটাতে চাচ্ছে। অর্থাৎ র‌্যাবের ঐ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের অনাগ্রহ প্রকট। এমতাবস্থায় এই ঘাটতি পূরণ করে আদালত। র‌্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় আদালত। নির্দেশ প্রদানের পর কয়েকদিন র‌্যাবের এই কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে গড়িমসি করা হলেও শেষ বিচারে সরকারের সবুজ সংকেত আসে। ফলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আদালতের এই নির্দেশকে সরকার যে মোটেও সোজাভাবে নেয় নি, তার প্রমাণ মিলেছে পরবর্তীতে আদালতের এই সিদ্ধান্তকে ইঙ্গিত করে আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। র‌্যাবের এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আসা সত্ত্বেও সরকারের গড়িমসি ও তাদেরকে গ্রেফতারে অনিচ্ছা প্রকাশ কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। এতে সরকারের ভাবর্মূতি ক্ষুণœ হয়েছে ব্যাপকভাবে। আবার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও আসামি নূর হোসেনও এত নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পেছনেও অনেকে সরকারের শিথিলতাকে দায়ী করছেন। খুন হওয়া নজরুল ইসলাম, প্রধান আসামি নূর হোসেন উভয়ই সরকার দলীয় স্থানীয় নেতা। আবার যে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেই র‌্যাবকেও পরিচালনা করছে সরকারই। সব মিলিয়ে সরকার পড়েছে বিরাট সঙ্কটে। অথচ সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এবং দলের মধ্যে সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকলে এই সব বিপর্যয়-ই সরকার দাপটের সাথে মোকাবেলা করতে পারতো। হয়তবা এমন কোনো ঘটনার সূত্রপাতই হতো না।
ঘ. জনমত উপেক্ষা ও দলীয় ক্যাডার সৃষ্টি: যে কোনো সরকারের প্রাণ বা আত্মা হচ্ছে জনসমর্থন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থনকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে সরকারের জন্য ইতিবাচক কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে যে কেউ বুঝতে পারেন যে, ঐ নির্বাচনটি একটি স্বাভাবিক, সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল না। অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচনই হয়নি; বেশির ভাগ ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাননি। অনেকে নিরাপত্তার অভাবে সুযোগ পেলেও ভোটকেন্দ্রে যায় নি। এমনই একটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। তাদের জনসমর্থন কতটা আছে, এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের পরিণতি কী হবে তা তাদের অজানা নয়। গত বছরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটা নিুমুখী। বস্তুত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঐ অশনিসংকেত অনুধাবন করেই আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত ছিল তাদের বিশাল কর্মী বাহিনীকে ব্যবহার করে ব্যাপক জনকল্যাণকর কাজ সম্পাদন করা এবং তার মাধ্যমে জনসমর্থন পুনরুদ্ধার করা। তাছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে হত্যা, দখল, টেন্ডারবাজী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদির অভিযোগ উঠে থাকে তার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্ত বাস্তবতা হলো সরকার সে পথে হাঁটে নি। জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে না গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তার বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দল দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিরোধী দল দমনে কার অবদান কতটুকু, কাকে এলাকার সকল দলের লোক ভয় পায়, কে ভালো সহিংসতা চালাতে পারে এগুলোই দলীয় কর্মীদের পদমর্যাদা বণ্টনে বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বিরোধী দল দমনে সরকার সফল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন যেন নিজের দলই নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। নিজ দলকে নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের জন্য অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের নেশায় আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে কথা বলছে না। সুযোগ পেলেই শেষ করে দেয়া হচ্ছে প্রতিপক্ষকে। আগে যে প্রতিযোগিতা চলতো জনপ্রিয়তাকেন্দ্রিক, এখন দলের জাতীয় চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবার কারণে তা রূপ নিয়েছে শক্তি প্রদর্শনকেন্দ্রিক। কাজেই এটা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, বর্তমান আওয়ামী লীগের এই দুরাবস্থার পেছনে আওয়ামী লীগের অতীত রাজনীতির ধারা অনেকাংশেই দায়ী।
মাত্র চারটি প্রেক্ষাপট আলোচনা করলাম যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয় নি। আওয়ামী লীগ এদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। বিজয় এনে দিয়েছে। এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্নের দল ছিল আওয়ামী লীগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার পিতার মতোই আওয়ামী লীগকে জনগণের দলে পরিণত করার কথা বলেন। তিনিই এখন ঐতিহ্যবাহী এই দলটির কাণ্ডারী। কিন্তু বাস্তবে তিনি বা তার দল আওয়ামী লীগ যা করছে তা এদেশের জনগণের আশার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে যে, জনপ্রিয়তা ছাড়া কোনো দলই চলতে পারে না। সরকারের সামনে যতই বাধা আসুক যদি জনগণ সরকারের পাশে থাকে তাহলে সরকারের কোনো ভয়ের কারণ নেই। বিরোধী দল যদি জনকল্যাণ পরিপন্থী কোনো কাজ করে, তাহলে তাদের দমনে র‌্যাব-পুলিশের দরকার নেই, দলীয় ক্যাডার সৃষ্টির দরকার নেই, এর জন্য আপামর জনতাই যথেষ্ট। কিন্তু তার জন্য আওয়ামী লীগকে তাদের হারানো জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে হবে। যে আওয়ামী লীগের জন্য গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ রোজা রেখে মানত করতো, সেই আওয়ামী লীগ আর আজকের আওয়ামী লীগ যে এক নয় তা প্রধানমন্ত্রী ভালোভাবেই জানেন। কাজেই যদি আওয়ামী লীগ সরকার তাদের হারানো জনপ্রিয়তা যে কোনোভাবে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় তাহলেই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ রক্ষা হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা যায় অনায়াসেই।

যে মসজিদে আত্মা নেই, সে মসজিদে স্রষ্টাও নেই


আমাদের দেশের মসজিদগুলোর গেটে প্রায়শই কিছু আদেশ বা উপদেশমূলক লাইন লিখিত থাকে। যেমন- মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা হারাম, রাজনৈতিক কথা বলা নিষিদ্ধ, মসজিদের কল থেকে পানি তোলা নিষেধ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় সব মসজিদই নামাজের ৫/১০ মিনিট বাদ দিয়ে বাকি সময় তালাবদ্ধ থাকে, ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না মসজিদের শৌচাগার, অজুখানা ও পানির কলও। কোনো বিদপগ্রস্ত মানুষও বিপদের মুহূর্তে মসজিদে আশ্রয় পায় না। সর্বদাই মসজিদগুলো সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব প্রাণহীন জড়গৃহ হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। বিকৃত এসলামের যাজক-পুরোহিত শ্রেণির কব্জায় পড়ে মসজিদগুলো নিতান্তই নামাজকেন্দ্রিক উপাসনালয়ে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মসজিদে বসে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোনো আলোচনা-পরামর্শ করাও ইমাম সাহেবরা হারাম ফতোয়া দিয়ে রেখেছে। আর সাধারণ মানুষ চোখ-কান বুুঁজে তাদের মনগড়া ফতোয়াকেই ধর্মের বিধান জ্ঞান করছে। তারা বিসমিল্লাহ বলে চুপচাপ মসজিদে ঢুকছে, নামাজ পড়ছে, আর আলহামদুলিল্লাহ বলে চুপচাপ বের হয়ে আসছে। বুদ্ধি-বিবেকহীনতার কি ন্যাক্কারজনক পরিণতি!
আজকাল সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, পানির জন্য হাহাকার। শত শত মানুষ পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, এমনকি পানির গাড়ি পর্যন্ত ছিনতাই করতে বাধ্য হচ্ছে। খরার মৌসুমে রাজধানীতে পানির সমস্যা প্রতি বছরই প্রকট হারে দেখা দেয়। ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে এর পুরো প্রতিকার করাও সম্ভব হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এটাও দেখতে পাই যে, প্রতিনিয়ত যে মসজিদগুলো তৈরি করা হচ্ছে তাতে পানির সুবিধা প্রচুর। ঢাকা শহরের অলি-গলিতে বড় বড় মসজিদ আমাদের সবারই দৃষ্টিতে পড়ে। কোথাও পানি না থাকলেও মসজিদে সব সময় ঠিকই পানি থাকে। এর কারণ হল মসজিদে পানির ব্যবস্থা করা হয় অনেক লোকের জন্য। কিন্তু সারাদিন মসজিদ বন্ধ থাকায় সে পানি অব্যবহৃতই থেকে যায়। যারা নামাজে আসে তাদের অধিকাংশই বাড়ি থেকেই ওজু করে আসে। আর এ কারণে মসজিদের পানির রিজার্ভ ট্যাংকি সব সময় ভরা থাকে। অথচ মসজিদের পাশের যে বাড়িটি রয়েছে, যে বস্তিটি রয়েছে, তাদের রান্না বন্ধ হয়ে থাকে শুধুমাত্র পানির অভাবে। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ছটফট করে কোলের শিশু। ট্যাংক ভর্তি পানি অব্যবহৃত রেখে যখন মোয়াজ্জিন-ইমাম সাহেব মসজিদে তালা ঝুলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরছেন, তখন তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হাড্ডিসার মানুষগুলো সীমাহীন কষ্টের মাঝে সময়ক্ষেপণ করছে। এটাই কি ধর্মের শিক্ষা? ধিক এই নিচু মানসিকতাকে! বিদ্রোহী কবি বলেছিলেন-
কোথা চেংগিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুরি-শাবল চালা!
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বিদ্রোহী উক্তির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক রূঢ় বাস্তবতা। স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ঐ মসজিদ, ঐ খানকা, ঐ এবাদতখানা এসব তো মানুষেরই জন্য। কাজেই ওসবের উপর সবার সমান অধিকার আছে। এই অধিকার আল্লাহ দিয়েছেন, কোনো মানুষ সে অধিকারকে কেড়ে নিতে পারে না তা সে যত বড় আলেম, পুরোহিত, ইমাম সাহেবই হোন না কেন। আমরা দাবি করি যে, আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত। তাঁর আদর্শের অনুসারী। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? রসুলাল্লাহর যামানায় কবে কোন মসজিদের গেটে তালা দেয়া হয়েছে আমাদের ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবরা বলবেন কি? বরং মসজিদেই সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যাদি সম্পন্ন হতো। এখান থেকেই রাষ্ট্রীয় অনুদান বিতরণ করা হতো, বৈদেশিক দূতদের সাথে আলাপ হতো, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। মসজিদে বসেই চার খলিফা অর্ধ পৃথিবী পরিচালনা করেছেন। আর্ত মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য আল্লাহর ঘর মসজিদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ আর কোনো ঘর আছে কি? তাহলে সেই ঘরে আজ তালা কেন? বস্তুত আজকের এই মসজিদ, এই খানকা, এই এবাদতখানা প্রকৃত এসলামের মসজিদ নয়। এটা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত বাণিজ্যকেন্দ্র। রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘যে কেউ সৃষ্টিজীবের প্রতি সদয় হয় আল্লাহও তার প্রতি সদয় হন। অতএব পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি দয়ালু হও, সে ভালো হোক বা মন্দ।’ আমাদের মধ্যে এই শিক্ষা কোথায়? বরং বাস্তবে আমাদের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রের প্রতিফলন ঘটেনি কি? রসুলাল্লাহর খেজুর পাতার ছাউনী দেয়া মাটির ঘরের মসজিদে আল্লাহ ছিলেন, ঐ মুসল্লিরা মোমেন ছিলেন, মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সৈনিক ছিলেন; আর আজ জাকজমকপূর্ণ এসি, সোনার ডোমওয়ালা প্রাসাদসম মসজিদে আল্লাহ নেই, আর নামাজীরাও পথভ্রষ্ট বিশৃঙ্খল জনসংখ্যা। কারণ যে ঘরে আর্তপীড়িত মানুষের ঠাঁই হয় না, সে ঘর আত্মাহীন জড়গৃহ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে ঘরের আত্মা নেই সে ঘরে স্রষ্টাও নেই। কাজেই সে ঘরে যতই এবাদত-উপাসনা করা হোক না কেন তা স্রষ্টার কাছে পৌঁছে না। তা কেবলই পণ্ডশ্রম। কবির ভাষায়-
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি

Tuesday, June 3, 2014

রম্যরচনা- রাজনীতিতে ফরমালিন!

[লেখাটি দৈনিক দেশেরপত্র ছাড়াও দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়]

ফরমালিনযুক্ত খাদ্যদ্রব্যের আতঙ্কে ভোগেন না এমন কোনো ব্যক্তি অন্তত বাংলাদেশে নেই। সাধারণত পচনজাত খাদ্য-দ্রব্যকে স্বাভাবিক পচনের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রাসায়নিকটি ব্যবহৃত হয়। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে এটা ব্যবহার করে। আর আমরা আম পাবলিক চোখ বন্ধ করে বাজারে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস আগের ফরমালিন মেশানো দুধ, ফলমূল বা মাছ-মাংস কিনে নিশ্চিন্ত মনে বাড়িতে ফিরি। অতঃপর ঘাম মুছতে মুছতে চিৎকার করি- ‘কই গেলা মন্টুর মা, টাটকা থাকতেই রান্না করো।’ শুধু তাই নয়, এক মাস আগের ফরমালিনযুক্ত টাটকা মাছ-মাংস খাওয়ার সাথে সাথে তার পুষ্টিগুণও হিসাব করি। প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছি মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। কিন্তু কথায় বলে, পাপ ছাড়ে না বাপকে। ফলে দেখা যায় আজ গৃহকর্ত্রীর লিভারের সমস্যা, তো কাল মেয়ের কিডনির সমস্যা, পরশু নিজেরই ক্যান্সার। বোধহয় এজন্যই বিজ্ঞজনরা বলেন- আজকাল মানুষ খাবার খাচ্ছে না, আয়ু খাচ্ছে। স্বভাবসুলভ বলতে পারেন- একটু সচেতন হলেই এ থেকে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু না, সম্ভব নয়। আলাদিনের চেরাগের দৈত্য নাকি সব কিছু অনায়াশেই করে ফেলতে পারতো। কিন্তু তাকে যদি আজকের যাত্রাবাড়ীর মাছের আড়তে এনে ফরমালিনযুক্ত আর ফরমালিনমুক্ত মাছগুলোকে পৃথক করতে বলা হয়, নিশ্চিতভাবেই সে ব্যাটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবে; আমরা তো সাধারণ মানুষ। কাজেই সচেতনতাই এখানে যথেষ্ট নয়।
প্রথমেই বলছি- ফরমালিন নিয়ে জনতাকে সচেতন করার মহৎ উদ্দেশ্যে এই লেখা নয়। ওসব নিয়ে বহু লেখা হয়েছে, ক্যাম্পেইন হয়েছে, এমনকি প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমগুলোতে এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনার ঝড় কম চলছে না। এগুলো মহৎ ব্যক্তিদের কাজ। আমার দ্বারা ওমন মহতী কাজ হবে না। কারণ আমি মহামানব নই। আমি বর্তমানে যে ফরমালিন নিয়ে চিন্তিত আছি সেটা খাদ্য-দ্রব্যের ফরমালিন নয়, রাজনীতির ফরমালিন। শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই, অবাক হবারই বিষয়। আমাদের দেশের রাজনীতি বেশ বৈচিত্রকর। গত কয়েকমাসের মধ্যে এদেশের রাজনীতি ট্রেনভ্রমণ, ট্রেনমিস, চুলাচুলি থেকে শুরু করে ইতিহাসের পাতা ঘুরে সর্বশেষ শাড়ি-ব্লাউজে এসে থেমেছে। আর সম্প্রতি তাতে যুক্ত হলো ফরমালিন। এই ফরমালিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি, তাতেই এত নাম-ডাক। আশ্চর্যের বিষয় হলো এর কোনো ক্ষতিকর দিক একখনও জানা যায় নি, অর্থাৎ নেতা-নেত্রীরা এখনও এর অপব্যবহারে আতœনিয়োগ করেন নি। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এই ফরমালিন সরকারপক্ষের হাতেই আছে, বিরোধীশিবিরেও পৌঁছে নি। সরকার নাকি এটাকে বিরোধী পক্ষকে তাজা রাখতে ব্যবহার করছে। বিষয়টা যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি-
রাজনীতিতে কবে যে পচা-গলা শুরু হয়ে গেছে তা আমরা অনেকে টেরই পাই নি। ঘটনাটি সর্বপ্রথম নজরে আনেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারে পচন ধরেছে। আরেকটু পচুক, গলুক, তারপরই আমরা নতুন কর্মসূচি দেবো।’ তাঁর এই কথার খাঁটি বাংলা করে বেশি কিছু না বুঝলেও এটা অন্তত বুঝেছিলাম যে, তিনি ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ দেবার মতো একটা কিছু চিন্তা করছেন। সম্ভবত ফরমালিনের ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য ছিল না। ফরমালিনের খবর সর্বপ্রথম ফাঁস করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেই পচে গেছেন। এখন তো সব জায়গায় ফরমালিন। আমরা ফরমালিন দিয়ে বিএনপিকে তাজা রাখার চেষ্টা করছি। আর সে কারণেই তিনি এত কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন।” বিষয়টি নিয়ে খানিকক্ষণ মাথা-ঝাড়াঝাড়ির পর যা বুঝলাম তাহলো, রাজনীতিবিদদের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। কোনো এক অজানা কারণে তাদের মধ্যে পরোপকারিতা নামক গুণটির অনুপ্রবেশ ঘটছে, যা রীতিমত অকল্পনীয় বটে। যেখানে বিএনপি নেত্রী সরকারকে পচাতে চাচ্ছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী কিনা বিএনপিকে ফরমালিন দিয়ে পচা থেকে রক্ষা করে চলেছেন! ভাবা যায়? যারা বলে “এদেশের রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন না, দু’ভাগ হয়ে কাবাডি খেলেন” তাদের দেখে যাওয়া উচিত আমাদের রাজনীতিবিদদের পরোপকারিতা। কবি জসীম উদ্দীন বৃথা লেখেন নি- ‘আমার একূল ভাঙিয়াছে যেবা, আমি তার কূল বাঁধি’।
তবে এই ‘রাজনৈতিক ফরমালিন’ এর ব্যবহার কেবল বিরোধীপক্ষের উপর প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সর্বশেষ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন ‘সরকার সবকিছুতেই ফরমালিন দিয়েছে’।  ভাবছি ব্যবসায়ীরা তো ফরমালিন মেশায় তাদের ব্যবসায়িক লাভে, কিন্তু সরকার কেন সবকিছুতে ফরমালিন দিতে যাবে? তাহলে কি সবকিছুই পচে যাবার উপক্রম হয়েছে? নাকি সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের মতো ফরমালিন ব্যবসা করবে? শুনলাম আগামী জুন মাসে নাকি দেশে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ হতে যাচ্ছে। তাহলে ঐ আইনেরই বা কী হবে? নাহ্, বাঙালির ঐ এক স্বভাব। কোনো জিনিসকেই তারা সোজা চোখে দেখতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে যে ফরমালিন ব্যবহার করছেন সেটা কি ক্ষতিকর হতে পারে? একে দিয়ে তিনি মরতে বসা দলগুলোকে তাজা করছেন মাত্র। কে জানে হয়ত এই ফরমালিনই চারিদিকের চাপে পড়ে চ্যাপ্টা হওয়া সরকারি দলকেও পচা-গলার হাত থেকে রক্ষা করছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রী যদি সত্য সত্যই পচা-গলা থেকে রক্ষা করার মতো কাক্সিক্ষত কোনো ফরমালিন আবিষ্কার করে থাকেন তাহলে সমস্যা কী? তবে তাঁর কাছে জোর দাবি জানাই তার একটি অংশ আমাদের আমজনতার জন্যও বরাদ্দ করার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! বিশ্বাস করুন। আমাদের কোনো মা-বাপ নেই, যতœ-পরিচর্যা নেই, আমাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার কেউ নেই। আমরা আম জনতারা পচে যাচ্ছি, গলে যাচ্ছি, নষ্ট-ভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছি। আমাদের জন্য কিছু করুন। আমাদেরকে পচা-গলা থেকে রক্ষা করুন। আমাদেরকে তো চাল-গম-আটা সবই দিলেন, এবার একটু ফরমালিন দিয়ে তাজা করুন। 

সাম্প্রতিক রাজনীতি- যে কারণে আইনমন্ত্রীর মন্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে


‘প্রচলিত আইনে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা সম্ভব নয়’- আইনমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। অবশ্য আলোচনার তুলনায় সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। যারা সর্বদাই আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন, সরকারের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন তারাও এই সমালোচনার বৃত্তের বাইরে নেই। বস্তুত, পরপর দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে থেকে এমন মন্তব্য অনেকেই আশা করে নি। তাই আইনমন্ত্রীর মন্তব্যটি শুনে অনেকেই আকাশ থেকে পড়েছেন। বিশেষভাবে গণজাগরণ মঞ্চ ও তৎসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে। আবার অনেকে ‘সরকারের সাথে জামায়াতের গোপন সমঝোতা হয়েছে’ এমন সন্দেহের আবর্তেও ঘুরপাক খাচ্ছেন। এ সবকিছুকেই আমি স্বাভাবিক হিসেবেই ধরছি। শুধু আমি কেন, আইনমন্ত্রী নিজেও নিশ্চয়ই জানতেন যে, তাঁর এমন মন্তব্য দেশের একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করবে। কিন্তু তিনি সেটাকে গুরুত্ব দেন নি। হয়তবা অন্য কোনো বিষয়কে এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে এটার গুরুত্ব কমে গেছে। তেমন কোনো রহস্য আদৌ আছে কিনা তা খুঁজে বের করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি মূলত একটু অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো। কে জানে, হয়ত অতীত-ই বর্তমান ও ভবিষ্যতের সিংহভাগ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে!
২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষ জামায়াতে ইসলামীর দল হিসেবে বিচার করার ঘোষণা দিয়েছে- এমন কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না, যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্র“তি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। অতঃপর জয়ী হয়ে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্র“তি মোতাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কার্যক্রম হাতে নেয়। গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বেশ ক’জনকে অভিযুক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এই যে এত কিছু হচ্ছে, এসময় দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের প্রসঙ্গ মূলত আলোচনাতেই আসেনি।
এরপর ২০১৩ সালে এসে ট্রাইব্যুনাল প্রথম রায় ঘোষণা করে- কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু সে রায় মনোপূর্ত না হলে দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচী ঘোষণা করে। গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সেখানে এসে একত্রিত হয় কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে। ফলে সরকারও বেশ নড়েচড়ে বসে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ না থাকায় এবার সরকার সংসদে আইন সংশোধন করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেখানে দল হিসেবে কোনো সংগঠনের বিচার করার আইনও পাশ হয়েছিল, তবে সে অপরাধী সংগঠন বা দলের শাস্তি কী হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ না থাকায় সে আইন কার্যকর করা মোটেও সহজ ছিল না। বিষয়টিকে তৎকালীন সময়ে খুব বেশি গুরুত্বও দেয়া হয় নি। বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসেবে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণ নীরব ছিল। ফলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন জায়গা থেকে কদাচিৎ সেই দাবি উঠলেও খুব বেশি চড়াও হবার সুযোগ পায় নি। এরপর জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, কামারুজ্জামান, গোলাম আযমসহ আরও বেশ কয়েকজন অভিযুক্তের রায় প্রদান করা হয়। তবে দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা বা বিচারের মুখোমুখি করা নিয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয় নি।
কিন্তু সরকার হঠাৎ করেই তাদের এই নীরবতা ভেঙে ফেলে গত বছরের শেষ পর্যায়ে এসে। এই প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত বছরের ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ঘড়-বাড়ী লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তদন্ত শুরু হয়। এরপর একাত্তরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও এর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে সংশ্লিষ্টদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ জানায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। গত ২৭ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে ৩৭৩ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনসহ ৯ হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কাছে দাখিল করা হয়। আবার এর আগে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের দাবিতেও মামলা হয়, যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এই যে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ, এটা সরকার বাধ্য হয়ে করেছে এমনটা বলার উপায় নেই। এর জন্য অপর একটি গণজাগরণ মঞ্চেরও দরকার পড়ে নি। সরকার স্বতস্ফূর্তভাবেই এই পদক্ষেপ নেয়। ফলে এতদিন যারা দল হিসেবে জামায়াতের বিচার হবার ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আশাবাদী ছিল তারা পুর্ণদ্যোমে আশান্বিত হয়। সরকারের উপর জামায়াতবিরোধী বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী এই বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সমর্থন এসে যায়।
এই জনসমর্থন সরকার সুযোগমতো ব্যবহারও করেছে। দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় এসে সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে তার মোকাবেলায় এই জনসমর্থন ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী কার্যত সরকারের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাগ্রহণের প্রশ্নে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। এটি সরকারের টিকে যাবার পেছনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ আজ সরকার কেনই বা ভোল পাল্টে ফেলছে তা বলা যাচ্ছে না নিশ্চতভাবে। আইনের যে মারপ্যাঁচের কথা মাননীয় আইনমন্ত্রী বললেন এবং তাঁর মন্তব্যের স্বপক্ষে তিনটি যুক্তি তুলে ধরলেন সেগুলো ফেলে দেবার নয়। অবশ্যই তাঁর কথাগুলো বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু কথা হলো এই আইন তো আর হঠাৎ করেই তৈরি হয় নি। একই আইন তখনও ছিল যখন তারা জামায়াতের বিচারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। তাহলে এতদিন যে তদন্ত করা হলো, অভিযোগ গঠনের চেষ্টা করা হলো সেগুলো কি শুধুই আই-ওয়াশ ছিল? একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে তা অনুমান করে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্যই কি এটি নিছক একটি রাজনৈতিক চতুরতার আশ্রয়? পূর্বেই বলেছি- সরকারের বা আইনমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে আজ কারোরই কিছু আসত-যেতনা যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিরোধী একটি পক্ষকে আশান্বিত করে রাখা না হতো। সরকার যেটা করেছে তা অনেকটা গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়ার মতো। কাজেই এর প্রতিক্রিয়া আসবেই। এই পদক্ষেপে সরকারের বেশ কিছু সুবিধা আছে বটে, কিন্তু একুল-ওকুল দু’কুলই হারানোর একটি শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। আবার যে কথা আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে- অর্থাৎ ‘জামায়াতের সাথে সরকারের সমঝোতার বিষয়’ সেটাই যদি বাস্তব হয়ে থাকে তাহলে সেটা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য যে কতবড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আইনমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে, জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের মিলবন্ধন কোনোদিনই সম্ভব নয়, কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী যে বিরাট সংখ্যক জামায়াত কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করছে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিচ্ছে তাতে ঐ সন্দেহকে অসার বলে ফেলে দেয়াও যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আসল ঘটনা যাই ঘটুক, বাস্তবতার আলোকে বলতে গেলে- আওয়ামী লীগ সরকার নিজের হাতেই সমালোচকদের কাছে বিতর্কের খোরাক তুলে দিচ্ছে।
আইন প্রণয়ন করা সরকারের কাজ। কখন কোন আইন প্রয়োজন, কোন আইনের সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধন প্রয়োজন তাও দেখার দায়িত্ব সরকারেরই। রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে মন্তব্য করা শোভনীয় নয়। আমি তা করবও না। কিন্তু সরকারের উদ্দেশ্যে যে কথাটি বলব তাহলো, সরকার যদি প্রথম থেকেই দল হিসেবে জামাতের বিচারের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার রাখতে পারতো তাহলে আজ আইনমন্ত্রীর এই মন্তব্যে কোনো প্রশ্নই উঠার কারণ থাকতো না। তাই সরকারের সর্বাগ্রে উচিত হবে এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে একটি যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সে ব্যাপারে জাতিকে সর্বদাই পরিষ্কার ধারণা দেওয়া। এছাড়া কোনো রকম জটিলতার সৃষ্টি করলে সে জটিলতার জালে সরকারের নিজেরই জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

Saturday, May 31, 2014

অভিমত: চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতা

লেখাটি ৩১-০৫-১৪ ঈসায়ী তারিখের দৈনিক দেশেরপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে

দেশে নিরাপত্তাহীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা কমবেশি সবারই জানা আছে। এও জানা আছে যে, দিন যতই যাচ্ছে ততই আমরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে এগিয়ে চলেছি। ভয় দেখানোর জন্য বলছি না, আবেগের বশবর্তী হয়েও নয়; নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে এড়ানোর কোনো উপায় দেখছি না বলেই কথাটা বলা। বাংলাদেশের দুর্যোগ বহুমাত্রিক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধকল কাটাতে হয় প্রায় প্রতিবছরই। এছাড়া অধিক জনসংখ্যা ও তার অনুপাতে কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা হচ্ছে আরেক নীরব দুর্যোগ যার কোনো মৌসুম নেই। বছরের বারোটা মাসই আমাদেরকে এই দুর্যোগের মোকাবেলা করে কাটাতে হয়। আর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হলো রাজনৈতিক দুর্যোগ যা সভ্য ভাষায় রাজনৈতিক সঙ্কট বা রাজনৈতিক বিপর্যয় নামে পরিচিত। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা প্রমাণ করছে যে, এবার রাজনৈতিক বিপর্যয় বেশ শক্তপোক্তভাবেই বাংলাদেশে খুঁটি গেড়েছে। মাসের পর মাস যাচ্ছে কিন্তু রাজনৈতিক যে বিপর্যয় আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে তার কোনো ছেড়ে কথা নেই। বোঝা যাচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে এ বিপর্যয় কেটে যাবারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে কেউ আশা রাখলে তাকে দোষ দেব না।
কথা বলতে চাই প্রচলিত সিস্টেমে সরকার, বিরোধী দল, গণমাধ্যম, রাষ্ট্র ও জনগণ নিয়ে। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যে রাজনৈতিক সঙ্কটগুলোর উত্থান ঘটেছে তার সাথে এই শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এই শব্দগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা উদাহরণসহ অতি সহজভাবে বিন্যাস্ত রয়েছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সে ব্যাখ্যার সাথে খুব কমই মিল পরিদৃষ্ট হয়। আমাদের দেশে সরকার, বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও বিরাট আকারের জনগণ এ সবই আছে, যা নেই তাহলো তাদের কাজের সুনির্দিষ্ট ভারসাম্য। শক্তিশালী সরকার ও বিরোধী দল, স্বাধীন গণমাধ্যম ও জনগণ নিয়েই তো গণতন্ত্র, তাই নয় কি? তাহলে আসুন আমাদের দেশের গণতন্ত্র দেখা যাক।

ক. সরকার ও বিরোধী দল: 


সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সহিংসতা-সংঘাত ইত্যাদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে।
এগুলো মূলত গণতন্ত্রেরই ফসল। 

গত বছরের শেষ মাসের শেষ দিনটি অবধি আমাদের দেশে কথিত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলেছে। প্রধান প্রধান গণতান্ত্রিক দলগুলো নাকি তখন দেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের সঙ্কট দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যেই শুরু করলো হানাহানি-মারামারি, নৈরাজ্য ও দমন-পীড়ন। প্রশ্ন হলো উভয়েরই দাবি যখন গণতন্ত্র, তখন এত পরস্পরবিরোধী সহিংসতার কারণ কী? প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর দেশের ষোল কোটি মানুষ পেয়েছে কিনা আমি তা জানি না, কিন্তু আমি আজও এর কোনো কূল-কিনারা করতে পারি নি। যাক সে কথা। এরপর একটি নির্বাচন হলো। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই সেটি অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল আবার সে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করল। তাদের দাবি- তারা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। যুক্তি হলো সরকারের উপর তাদের বিশ্বাস নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দিল। কেননা কোনো দল যদি সরকারের উপর বিশ্বাস করতে না পারে তাহলে তাদের মধ্যে বিশ্বাস সঞ্চার করতে হবে- এমন কোনো ধারা বাংলাদেশের সংবিধানে নেই। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এখন পুনরায় সরকারে। অপরদিকে বিরোধী পক্ষে রয়েছে নির্বাচন প্রত্যাখ্যানকারী বিএনপি-জামাত। তারা বিরোধী দলে নেই ঠিকই কিন্তু সরকারের বিরোধিতা মোটেও থেমে নেই। যতভাবে পারা যায় সরকারের সমালোচনা চলছেই। সেই সাথে চলছে কীভাবে সরকারের টুঁটি চিপে ধরে সরকারকে কার্যত অচল করে ফেলা যায় এবং ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা যায় তার অবিরাম প্রচেষ্টা। সরকার কোনো ত্র“টি করলে তাদের নীরব-নিথর শরীরে প্রাণের সঞ্চার হয়; যেন সরকার একটি ভুল সিদ্ধান্ত নেবে এবং তাতে জনগণের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হওয়ায় সরকার জনসমর্থন হারাবে- এই আশাতেই তারা বসে ছিল। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার ও ফেনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে- এবিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। এমন কি সরকারেরও কোনো দ্বিমত নেই। ঘটনাটির পর যে অভিযোগগুলো উঠেছে তার মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগানো অভিযোগ উঠেছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে। র‌্যাবের যে কর্মকর্তাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা র‌্যাবে এসেছে সেনাবাহিনী থেকে। এই বাহিনীর নিজস্ব বিচারালয় রয়েছে। কাজেই তাদের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উঠলে তার বিচার করার ব্যাপারে সরকার হুট করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এটি একটি জটিল বিষয় যা বিএনপি-জামাতসহ সব দলেরই জানা আছে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? তারা যেহেতু একটি ইস্যু পেয়ে গেছে কাজেই শুরু হলো সরকারকে নাজেহাল করার তীব্র ও তির্যক বাক্যব্যয়। শুধু শক্তির অভাবে রাজপথে আন্দোলন করা বাদে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করা হলো এই ইস্যুটিকে নিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলার। ওদিকে সভা-সমাবেশের আয়োজন তো চলছেই। গুঞ্জন উঠেছে- বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অধঃপতনের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে নাকি বিদেশেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটিই, সরকারকে চাপে রাখা। কিন্তু সরকার চাপে পড়লেই যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে যাবে, গুম-খুন-অপহরণ বন্ধ হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা সাধারণ মানুষ পাবে কীভাবে?

খ. গণমাধ্যম:


আসা যাক গণমাধ্যমের বিষয়ে। গণমাধ্যমের কাজ যেহেতু জাতির সম্মুখে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা এবং
এতদ্বারা জাতিকে সচেতন করে তোলা কাজেই তাদের কাজ-কর্ম সার্বিক বিচারে জনহিতকর হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। গণমাধ্যমকে পুঁজি করে যে যা খুশি তাই বলছে, যা খুশি তাই করছে। সাধারণ মানুষকে উস্কানী দিয়ে বিভিন্নভাবে উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছে। মিথ্যা-বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত খবর ছাড়া এক শ্রেণির গণমাধ্যমের দিন অতিবাহিত হয় না। এদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে গণমাধ্যমের যোগসাজস পাওয়া যায়। কাবার গেলাফ পরিবর্তনের ছবিকে ছাপানো হয় মানববন্ধনের ছবি হিসেবে। আর তাদের এই অমানবিক অন্যায় কাজে সরকার বাধা দিলেই তা হয়ে যায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। সাংবাদিকরা তাদের কাজের পরিধির বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাড়াটে কর্মী হিসেবে কাজ করছে, স্বীয় ভাবমূর্তি সৃষ্টি বা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের আস্তানায় ঢুকে পড়ছে; যে তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব গোয়েন্দা সংস্থার সেই তথ্য উদ্ধারের জন্য বিপদসংকুল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু এই অযাচিত কাজের পরিণতিসরূপ যখন প্রাণ হারাতে হয় তখন দোষ দেয়া হয় সরকারের উপর। পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয় অমুক সরকারের আমলে এতজন সাংবাদিক খুন হয়েছে, এতজন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

গ. জনগণ:



বাকি থাকলো কোটি কোটি আপামর জনতা। চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয় সাধারণ জনগণ। গণতন্ত্র তাদের আশ্বাস দিয়েছে যে, তারাই রাষ্ট্রের পরিচালক, বিধায়ক ও সার্বভৌমত্বের মালিক। জনগণের সেবা করার জন্য, জনগণের সমর্থন নিয়ে কতিপয় ব্যক্তি সরকার গঠন করে মূলত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দেশ্যে। এই যে আশ্বাস, এই যে মন ভোলানো আদর্শ; এটা জনগণের মনে-মস্তিষ্কে পোক্ত রয়েছে বেশ ভালোভাবেই। তাই যখনই কোন দল সরকার গঠন করে তখনই তারা হাজারও দাবি-দাওয়া ও চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষতে শুরু করে। তাদের এই হিসাবে সামর্থ্যরে তুলনায় আকাক্সক্ষার পরিমাণ কখন যে আকাশছোঁয়া হয়ে যায় সে খেয়াল তাদের থাকেনা মোটেও। ফল হয় এই যে, কোনো সরকারই জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয় না। কেন হয় না এর উত্তর জনগণের কাছে অদ্বিতীয়। তাদের মতে সরকারের অযোগ্যতাই এর জন্য দায়ী। কিন্তু তারা ভুলেও একবার জাতি হিসেবে তাদের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে না। সব দোষ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা পবিত্র থাকার এই রীতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে।
এখন কথা হলো, এই যে বিরোধী দল, গণমাধ্যম, এমনকি জনগণ পর্যন্ত সরকারের উপর বিরূপ ধারণা লাভ এবং সর্বদাই সরকারের সমালোচনা, সরকার বিমুখতা এবং সব দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে, এটাই কি প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাস্তবতা নয়? চারিদিকে এত বিরোধিতা, সমালোচনা, সীমাবদ্ধতা ও বাধা-বিঘেœর মধ্যে কোনো সরকারই কি জাতিকে উন্নতির সোপানে আরোহন করাতে সক্ষম হবে? না, হবে না। আজ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দেশের যে অবস্থা, বিএনপি থাকলেও এর চেয়ে ভালো অবস্থা বিরাজ করতো এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তাদের শাসনকাল জাতি এখনও ভোলে নি। কাজেই সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। অতি শীঘ্রই আমাদের মধ্যে এই বাস্তবতাবোধ জাগ্রত হোক- এমনটাই কামনা করি।

যে ভয় তাড়া করছে আওয়ামী লীগকে

একদিকে নৈর্বাচনিক দুর্বলতা ও বহির্বিশ্বের স্বীকৃতিহীনতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, হত্যা, গুম, অপহরণ, সন্ত্রাস; সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থা এখন খুব একটা ভালো নেই। এটা ঠিক যে, এই ভালো না থাকার পরিবেশ আজকে হঠাৎ করেই তৈরি হয় নি। এটা গত প্রায় এক বছর ধরে চলে আসা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক সঙ্কটের একটি পর্যায় মাত্র। গত এক বছর যাবৎ বিভিন্ন ইস্যু তাড়া করে বেড়াচ্ছে সরকারকে। ফলে কখনও সঙ্কটাপন্ন, কখনও বিপর্যস্ত, আবার কখনও খেইলুপ্ত বিশেষণে বিশেষায়িত হয়েছে সরকার। কেউ শুনতে পেয়েছে সরকারের পতনধনি, আবার কেউ শুনেছে জয়ধ্বনী। এমনই একটি বহুল আলোচিত ইস্যু হলো ৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম। 
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যকর করার উদ্যোগ সরকারের সাহসী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকারকে যত বাধা-বিঘœ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা মোটেও অপ্রতুল নয়। এর জন্য সরকারকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর সাথে সরকারের সম্পর্কের অবনতির পেছনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অন্যতম একটি কারণ। পশ্চিমারা যে স্বার্থেই হোক সর্বাত্মকভাবে চেয়েছে এই বিচার বন্ধ করতে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের মিডিয়ার দৌরাত্ম্যও এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত। যদিও সরকারের দৃঢ়তার সামনে সে চেষ্টা তেমন একটা সুবিধা করতে পারে নি, কিন্তু সরকারকে ক্রমাগত চাপের মোকাবেলা করে আসতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে একই ইস্যুতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের চাপও কম পোহাতে হয় নি সরকারকে। গত বছর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধের দাবিতে যে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি হয়েছে তার সম্পূর্ণ নেতীবাচক প্রভাব পড়েছে সরকারের উপর। উপর্যুপরি আন্দোলন-সহিংসতার কবলে পড়ে দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়েছিল। জনমানসে বাসা বেঁধেছিল তীব্র অস্বস্তি ও অসহায়ত্ব। একদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার ক্রমাগত চাপ, অন্যদিকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চলা অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা- এই উভয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সরকারের জন্য মোটেও সহজ ছিল না, বলা যায় অসম্ভবই ছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকার উভয় চাপকেই দক্ষতার সাথে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। কীভাবে হয়েছে সেটা একটু পরে বলছি। 
দ্বিতীয়ত যেটা আলোচনায় আসে তাহলো তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রায় সবক’টা রাজনৈতিক দল জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় হরতাল-অবরোধ আর সহিংসতার মহোৎসব। নিরাপত্তাহীনতার চূড়ান্ত পর্যায় পরিদৃষ্ট হয়েছে সেসময়। কথিত আন্দোলনের নামে শুরু হয় অরাজকতা। যত্রতত্র ঘটতে থাকে প্রাণহানি, অঙ্গহানি। হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, হামলা-মামলা, সংঘর্ষ বাঙালির নিত্য সিডিউলে স্থান করে নেয়। বাসের মধ্যে ছোঁড়া হয় ককটেল বোমা ও পেট্রোল বোমা। মুহূর্তের মধ্যে জ্বালিয়ে অঙ্গার করা হয় তরতাজা সাধারণ মানুষকে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকে খেলনা সদৃশ ককটেল। খেলনা ভেবে তুলে নেয়ায় ঝলসে যায় অবুঝ শিশুর শরীর। এক কথায় বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি নিকৃষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয় গত বছরের শেষের কয়েকটি মাসে। বলা বাহুল্য, এই সবকিছুই হচ্ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পতন বা সরকারকে নমনীয় করার উদ্দেশ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এখানেও নমনীয়তার কোনো চিহ্ন রাখে নি, যা ছিল অবাক করার বিষয়।
শুধু তাই নয়, প্রধান প্রতিপক্ষকে বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং স্বাভাবিকভাবেই পুনরায় নির্বাচিত হয়ে এখন তারা ক্ষমতাসীন। আবার এই সময়ের মধ্যেই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। কিন্তু বলতে গেলে সরকার বিরোধীরা এবার তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় নি। ফলে নির্বাচন পরবর্তী প্রায় ৪/৫ মাস পেরিয়ে গেলেও বিরোধী পক্ষটি সরকারকে মোকাবেলা করার জন্য রাজপথে নামে নি। তাদের যাবতীয় সরকার বিরোধিতা ও সমালোচনা সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রচার প্রচারণা, বক্তব্য-বিবৃতি ও জনসমাবেশের ভেতরেই। এখন আর কথায় কথায় হরতাল হয় না, অবরোধ হয় না। বিরোধী পক্ষের ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও এর খবরও তেমন একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য তেমনটি করার সক্ষমতাই বা কতটা আছে তাও বিবেচনার বিষয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই স্তব্ধ পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বলা বাহুল্য আওয়ামী লীগ সরকার এখন পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে কম চাপ মোকাবেলা করছে- এমনটা বলার উপায় নেই। চলমান ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আওয়ামী লীগ এখন এক অজানা আতঙ্কে ভুগছে, ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। কিসের ভয়? ব্যাখ্যা করছি। 
একটি প্রশ্ন ঝুলিয়ে রেখেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ কীভাবে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সরকার বিরোধী সহিংস আন্দোলন শক্তভাবে প্রতিরোধ করল? উত্তর হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের যত বিপর্যয়ের কথা বলে আসলাম তা কাটিয়ে উঠতে তারা একচেটিয়াভাবে আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। র‌্যাব-পুলিশ, বিজিবি কখনও স্বতন্ত্রভাবে আবার কখনও যৌথভাবে অপারেশন চালিয়ে বিরোধী পক্ষের সহিংসতা-সন্ত্রাস বা আন্দোলন, যাই বলা হোক না কেন তার মোকাবেলা করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বিরোধী পক্ষের বহু নেতা-কর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে। বিরাট সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। অনেকে এখনও জেলে আছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, সহিংস আন্দোলনকারীদের আক্রমণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকেও প্রশাসন আন্তরিকভাবে সরকারের আনুগত্য করে গেছে। সে সময় র‌্যাব-পুলিশের সামান্য দায়িত্বহীনতা বা উদাসীনতাও সরকারের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারতো, কিন্তু তেমনটি হয় নি। তাই অনেক সরকারপক্ষের বুদ্ধিজীবীর মুখেও শোনা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আন্তরিক আনুগত্যই সরকারের টিকে যাবার মূল কারণ। অর্থাৎ প্রশাসন হচ্ছে এই সরকারের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহু। বিষয়টি প্রশাসনও ভালোভাবেই জানে। আর এটাই সরকারের জন্য ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‌্যাব-পুলিশকে আলাদা করে বলার দরকার হচ্ছে না যে, তাদের যে কোনো দাবি বা চাহিদা পূরণে সরকার বাধ্যতামূলকভাবেই অগ্রাধিকার দেবে। তাছাড়া এই সরকারের কতটা জনসমর্থন রয়েছে তাও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা নয়। 
এই বাস্তবতা প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। তারা হয়ে পড়ছেন অনিয়ন্ত্রিত। জবাবদিহিতা হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। ফল হয়েছে এই যে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পরিমাণ অনেক বেশি। সাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের সাথে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী উত্থাপিত অভিযোগগুলো প্রমাণ করে যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন সরকারের গলার কাঁটাতে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় বর্তমান সরকার না পারছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি কঠোর হতে, না পারছে তাদের অপকর্মকে ঢেকে রাখতে। কঠোর হতে গেলে প্রশাসনের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ও আনুগত্য থেকে সরকার বঞ্চিত হয়ে যেতে পারে যা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয়। আবার যদি তাদের সকল স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ন্ত্রিত অপকর্মকে চলতে দেয়া হয় তাহলে ক্রমেই জনগণের মধ্যে সরকার-বিদ্বেষ বাড়তে থাকবে এবং এক পর্যায়ে তার গণবিস্ফোরণ ঘটাও অস্বাভাবিক কিছু হবে না। অর্থাৎ সরকার এখন উভয় সঙ্কটে। এরই মধ্যে আবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বান্ধব কংগ্রেসের ভরাডুবি আওয়ামী লীগ সরকারের দুশ্চিন্তার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 
বিশ্লেষকদের ধারণামতে, একটি সরকার কখনও সম্পূর্ণ প্রশাসন নির্ভর হয়ে থাকতে পারে না। যে কোনো সিস্টেমেই সরকারের জন্য জনসমর্থন অপরিহার্য। জনসমর্থনকে উপেক্ষা করে শুধু প্রশাসনকেই শক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে গুটিকতক সঙ্কট মোকাবেলা করা যায় বটে, কিন্তু এর করুণ পরিণতি এড়ানো সম্ভব হয় না। এই পরিণতি শুধু সংশ্লিষ্ট সরকারকেই নয়, জনগণকেও ভোগ করতে হয়। এমতবস্থায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে একটি পথই খোলা রয়েছে, তথা জনসমর্থন পুনরুদ্ধার। কিন্তু সেটা আওয়ামী লীগের জন্য যে মোটেও সহজ হবে না, তা আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই অবগত আছে। এখন দেখার বিষয় ভয়কে জয় করার পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ কতদূর যেতে পারে।

সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনী, ফেনী থেকে লক্ষ্মীপুর; ঘুরে ফিরেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে অপহরণ, গুম, খুন, সহিংসতা, নৃশংসতা ও বর্বরতার হৃদয়বিদারী চিত্র। কিছুদিন আগেও বলা হচ্ছিল- নারায়ণগঞ্জ এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। এরপর নারায়ণগঞ্জের শোকের ছায়া কাটতে না কাটতেই যোগ হলো ফেনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড। অন্যদিকে গণমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে যে, এ সমীকরণ থেকে পিছিয়ে নেই লক্ষ্মীপুরসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোও। ক্ষমতার দাপট, আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থকেন্দ্রিক লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা এখন সারা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে। অর্থাৎ গোটা দেশই এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে- এমনটা বলা মোটেও অতিরঞ্জন হবে না। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টিকে সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের জন্য সাম্প্রতিক সময়টি মোটেও ভালো যাচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই দুঃসময়। দিন যতই এগোচ্ছে ততই যেন আওয়ামী লীগের চলার পথ সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। আর এই সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠার সম্ভাবনাও ম্লান করে দিচ্ছে যে ঘটনাগুলো তার মধ্যে সাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর নৃশংসতা অন্যতম। এই দু’টি ঘটনার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নাম। ঘটনাগুলোর ভিক্টিম ও অপরাধী উভয় খাতাতেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নাম শোভা পাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার দায়ী তাতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। আর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকাণ্ডের পেছনেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই ইন্ধন যুগিয়েছে এমন খবরও আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। একইভাবে লক্ষ্মীপুরের দুই আওয়ামী লীগ কর্মীর খুনের পেছনেও যদি আওয়ামী লীগেরই কেউ জড়িত থাকে তাহলেও অবাক হবার কিছু নেই। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সাম্প্রতিক এই হত্যাকাণ্ডগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো তো দূরের কথা এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের প্রতি জনতা তাদের ন্যূনতম আস্থাও হারাতে বসেছে, এটা উপলব্ধি করার সক্ষমতা নিশ্চয়ই সরকারের আছে। এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারকে আরও করুণ ভবিষ্যতের মোকাবেলা করতে হবে।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর আশা করা হচ্ছিল যে, “নব্য এই সরকারের প্রধান ত্র“টি অর্থাৎ নৈর্বাচনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে তারা ব্যাপকভাবে জনহিতকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণে পূর্বের তুলনায় আরও সচেতন হবে। এছাড়া বিগত বছরগুলোতে বহু বিতর্কের জন্ম দেওয়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি অঙ্গসংগঠনসমূহকে ভালোভাবে ঢেলে সাজাবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, আধিপত্যের লড়াই, হত্যা, ধর্ষণসহ যত অভিযোগ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে উঠেছে তা বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাদেরকে দিয়ে জনহিতকর বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব ঘোঁচানোর চেষ্টা করা হবে।” হয়তবা চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ফলাফল যা আশা করা হচ্ছিল তার বিপরীত দৃশ্যই দেখতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, লাগামহীন দৌরাত্ম্য, আধিপত্য বিস্তারের আত্মঘাতী লড়াই ইত্যাদি প্রমাণ করেছে যে, তারা নিজেদের দলীয় সুবিধা-অসুবিধা, সুসময় বা দুঃসময় অনুধাবন করতে সম্পূর্ণ অপারগ। 
দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারকে সর্বপ্রথম নির্বাচনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। বিভিন্ন মহল থেকে সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন সরকার হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বেশ কিছু দেশের সমর্থন নিয়ে পথচলা শুরু করে নবনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার। তারপর থেকে গত কয়েক মাসের মধ্যে অপর যে ঘটনাটির কারণে সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাহলো বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্চের সেভেন মার্ডার। ঘটনাটির সাথে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠায় তা আরও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সেই সাথে সরকারের জন্য বয়ে আনে ব্যাপক অস্বস্তি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রীয় এই এলিট বাহিনীর অপব্যবহার নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে। অতঃপর অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও আইনের অধীনে আনার মাধ্যমে সরকার কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থন করার প্রয়াস পায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের এই আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাটির রেশ কাটার আগেই ফেনীতে ঘটে যায় সরকারের জন্য আরও একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে রাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে গুলি করে এবং আগুনে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এ ঘটনাতেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের নগ্ন নেশা প্রধানত দায়ী। ফলে আওয়ামী সরকারের জন্য ঘটনাটি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতই পরিদৃষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ এখন নিজের হাতে নিজেই নিরাপদ নয়, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো পরের বিষয়। এমতবস্থায় সরকারের ভবিষ্যৎ কতটা স্বচ্ছ হতে পারে তা পরিষ্কার নয়। 
যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে কোনো একটি সংগঠন, দল বা জাতির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঐক্য। আর আওয়ামী লীগের এত করুণ অবস্থার সৃষ্টিই হয়েছে ঐক্যের অভাবে। তাই, চলমান দুর্গতি থেকে সরকারের সহসা মুক্তি মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এখনও সফলতা লাভ সম্ভব হতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি দল হিসেবে তাদের আশু বিপর্যয় মোকাবেলা করতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম তাদেরকে দলীয় ঐক্যের প্রতি নজর দিতে হবে। অপরদিকে যদি জাতীয়ভাবে সমস্যার মোকাবেলা করতে চায় তাহলে দরকার হবে জাতীয় ঐক্য। এখন প্রশ্ন হলো আওয়ামী লীগ সরকার কি পারবে সারাদেশে চলমান নিরাপত্তাহীনতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এবং দলীয় ও জাতীয় ঐক্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে? সময়-ই এর উত্তর দেবে।

যে কারণে ভারতের “বাংলাদেশ নীতি” পরিবর্তন জরুরি

ভারতে সদ্য অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশে চলছে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে চলতি মাসের ১২ তারিখে শেষ হওয়া নির্বাচনটির ফলাফল প্রকাশিত হয় গত ১৬ মে’। ভারতের লোকসভা নির্বাচন বরাবরই এই উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের জন্যই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ফলে বিগত নির্বাচনটি বাংলাদেশের জন্যও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুরু থেকে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত তাই পুরো নির্বাচনের গতিবিধি নিবিড়ভাবে মনিটরিং করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। বের করার চেষ্টা করেছে দলীয় সুবিধা আদায়ের ফাঁক-ফোকর। ভারতের সরকার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে কিনা বা সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশের সরকারি দল ও বিরোধী দলের লাভ-লোকশান কোন ক্ষেত্রে কতটুকু তার হিসাব নিকাশ কষা হচ্ছে নির্বাচনের পূর্বে থেকেই। আর এ আলোচনা-পর্যালোচনার অন্যতম খোরাক এনে দেয় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর বিতর্কিত কিছু উক্তি। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হয়ে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে ১৬ মে’র পর বাংলাদেশিদের তল্পীতল্পা গুটিয়ে ঝেঁটিয়ে ভারত থেকে বিদায় করা হবে বলে এক জনসভায় তিনি হুঁশিয়ারি দেন। এর আগে এক বিজেপি নেতা বিহারের একটি জনসভায় বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড দাবি করে বসেন। এ সকল কারণে নির্বাচনে জয়ী হলে বিজেপির বাংলাদেশ বিষয়ক অবস্থান নিয়ে শঙ্কায় পড়েন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কারণ, ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কটাই এমন যে, ভারতের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়া এক প্রকার দুঃসাধ্য ব্যাপার। বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর একটি বিরাট অংশ রয়েছে যেগুলোর সমাধানে ভারতের সহযোগিতা বাঞ্ছনীয়। আবার ভারতের সামান্য অসহযোগিতাই এদেশে শত শত সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট। 
যাই হোক, নির্বাচনের ফলাফল মোতাবেক বিজেপি এখন ক্ষমতা গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে। সুতরাং সেই নরেন্দ্র মোদীই হতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখার বিষয় ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেমন হতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে মতামতেরও কোনো অন্ত নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চিন্তাবিদরা মনে করছেন না যে, ভারতের নতুন সরকারের অধীনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে। তাদের মতে, বিগত কংগ্রেস আমলের বাংলাদেশ নীতিই বিজেপি অনুসরণ করবে। একই মনোভাব বাংলাদেশ সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিরও। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বললেন, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসলেও পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন না আসাটাই বা বাংলাদেশের জন্য কতটুকু সুবিধাজনক হবে? বিগত কংগ্রেস আমলে ভারত বাংলাদেশ বিষয়ক যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তার কতটুকু সুফল আমরা পেয়েছি? বিজেপি সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে বিগত কংগ্রেস সরকারেরই পদচিহ্ন অনুসরণ করবে- এমনটাই যদি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় তাতেও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের পার পেয়ে যাবার কোনো উপায় আছে কি?
বিগত বছরগুলোতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক আমরা দেখেছি তাকে কোনোভাবেই পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ও ভারসাম্যযুক্ত সম্পর্ক বলা যায় না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তার অধিকাংশই ছিল একপেশে, যার দ্বারা বাংলাদেশের স্বার্থ খুব কমই অর্জিত হয়েছে। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাটিতে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে ভারত বিপুল পরিমাণ সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পেয়েছি? কিছুই না। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জী যখন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো এই মমতা ব্যানার্জীই টিপাইমুখ ইস্যুতে বাংলাদেশের তীব্র বিরোধিতা করেন, এমনকি এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পর্যন্ত বসতে রাজী হন নি। বাংলাদেশ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “সম্পর্ক গড়া যত কঠিন, ভাঙ্গা তার চেয়েও সহজ।” বাংলাদেশ ও ভারতের অভীন্ন ৫৪ টি নদীর উপর ৫৩ টি বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে বছরের পর বছর ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে, এখানকার কৃষকরা ফসল ফলাতে না পেরে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে সেই পানির গতিপথ ঘুরিয়ে ভারত নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করছে। বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে ভারতের এমন আচরণ বাংলাদেশের জনগণের কখনই কাম্য ছিল না। অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা চলছেই। বারবার আলোচনা করার পরও এই সমস্যার কোনো যথাযোগ্য সমাধান আজ পর্যন্ত আসে নি। তাছাড়া মিডিয়া, খেলাধূলা, বিনোদন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছে থেকে কার্যত বন্ধুভাবাপন্ন সাড়া পায় নি। সুতরাং এই একই নীতি যদি নব্য বিজেপি সরকারও অটুট রাখে তাহলে আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো কারণ আছে কি? দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদ ও সুশীলরা বিজেপি সরকার কর্তৃক কংগ্রেস সরকারের নীতি পরিবর্তন না হওয়ার জন্য আশা প্রকাশ করছেন। তারা অনেকটা ধরেই নিয়েছেন যে, বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলে বাংলাদেশ যে বৈষম্যগুলোর সম্মুখীন হয়েছে তা বিজেপি সরকারের আমলেও হবে। কাজেই ও ব্যাপারে কথা বলে কোনো লাভ নেই। এই বৈষম্য যাতে বিগত দিনের চেয়ে বেড়ে না যায় সেটার জন্যই তারা মূলত চিন্তিত। কিন্তু এ হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা না করলে স্রষ্টাও সে ব্যক্তির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। কাজেই আমাদের চাওয়া-পাওয়া, সুবিধা অসুবিধাকে যদি আমরা তুলে না ধরি, নিজেদের অধিকার আদায় করতে সত্যিকার অর্থে সচেষ্ট না হই তাহলে আমাদের স্বার্থ ভারত নিজে উদ্যোগী হয়ে যাচাই-বাছাই করবে না। তাই, আমাদেরকে আগে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে। পার্শবর্তী দেশ হিসেবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক ও সৌহাদ্র্যপূর্ণ আচরণ আমরা অবশ্যই করবো কিন্তু সে সম্পর্ক যাতে হয় সমমর্যাদা ও সমঅধিকার বাস্তবায়নের ভিত্তিতে- এ বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ভালোভাবে স্মরণ রাখতে হবে। আমাদের উচিত হবে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা, উভয় দেশের স্বার্থকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এ কাজে কতটা সফল হবেন তা প্রশ্নাতীত নয়। অন্যদিকে ভারতেরও উচিত হবে, এতদিন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীন নীতি বজায় ছিল তা থেকে অচিরেই বেরিয়ে আসা। এই নীতি আধিপত্যকেন্দ্রিক না হয়ে হোক উভয় দেশের শান্তি ও সৌহার্দ্র্যপ্রেমিক জনগণের ভারসাম্যপূর্ণ স্বার্থকেন্দ্রিক- ভারতের নব্য সরকারের কাছে এমনটাই কাম্য।

বিএনপির নবযাত্রা কোন পথে?

এরশাদ পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাকিতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি গুরুত্বপূূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এই সময়ের মধ্যে বিএনপি দুইবার জনগণের ভোটে ক্ষমতা লাভ করে সরকার গঠন করেছে। দশটি বছর দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিএনপি নেতৃবৃন্দের। সে হিসেবে তারা অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক ভিত্তি, রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা ইত্যাদি দিক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চাইতে কোনো অংশে পিছিয়ে রয়েছে এমনটি বলা যায় না। তাই বিএনপির কাছ থেকে দেশের জনগণ সর্বদাই জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ আশা করে। উন্নয়নশীল এই দেশটিকে যাবতীয় অন্যায়-অন্ধত্ব, বৈষম্য, দুর্নীতি, নিপিড়ন ও নিস্পেষণহীন একটি ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিএনপি অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে- এমনটাই আশা করে দেশের ষোল কোটি জনতা।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই আশার কতটুকু প্রতিফলন বিএনপি ঘটাতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় অনায়াশেই। ২০০১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি। অতঃপর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বিএনপির নেতৃত্বে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে খোদ বিএনপির বেশ কিছু প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাও হঠাৎ করে যেনো মাথা তুলে দাঁড়ায়। আবার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তো ছিলই। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখতে পারে নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এরপর ওয়ান-ইলেভেনের ধকল কাটিয়ে আবারও নির্বাচনে যায় দলটি। কিন্তু জনগণের হারানো আস্থা ফিরে না পাওয়ায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট। কিন্তু আওয়ামী লীগের বেশ কিছু মন্ত্রী-এমপির লাগামহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিডিআর বিদ্রোহ, হলমার্ক কেলেংকারি, শেয়াবাজার ধ্বস, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, রানা প্লাজা ট্রাজেডি, বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ড, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বেশ কিছু জাতীয় ইস্যু মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ার কারণে ক্রমেই আওয়ামী লীগ সরকার সাধারণ মানুষের আস্থা হারাতে থাকে। তাছাড়া আস্তিক-নাস্তিক ইস্যুতে একটি মহলের অবিরাম অপপ্রচার আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা শুন্যের কোঠায় নামিয়ে দেয়। 
ফলে স্বাভাবিকভাবেই একদিকে যে গতিতে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে, অন্যদিকে বিএনপির জনপ্রিয়তা সেই গতিতেই বাড়তে থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল বিগত বছরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে। মানুষ অনেকটা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপির ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছিল। যাই হোক, এটা ছিল বৃহৎ এই রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য অন্যতম একটি টার্নিং পয়েন্ট। বিএনপি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, জনতার সমর্থন এখন তাদের প্রতি। এসময় সরকারের যাবতীয় জনস্বার্থ পরিপন্থী কাজের যৌক্তিক সমালোচনা করে তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা আরও উর্ধ্বে উঠিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু জনগণ দেখলো তার বিপরীত চিত্র। সে সময় বিএনপি যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল সেটাকে বোদ্ধা মহলের অনেকেই নিজ পায়ে কুড়াল মারার মতোই মনে করেন। ধারাবাহিক হরতাল-অবরোধ ঘোষণা করে ও ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে বিএনপি। সেই দিনগুলোর ভয়াবহতা এখনও বাংলাদেশের ষোল কোটি জনতা ভুলতে পারে নি। বিগত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পূর্ব পর্যন্ত গত বছরের একটি উল্লেখযোগ্য সময় জুড়েই তারা দেশব্যাপী এক প্রকার সহিংসতা ও নৈরাজ্যের আবহ সৃষ্টি করে রেখেছিল। সে সময় কথায় কথায় হরতাল-অবরোধসহ কঠোর আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনমনে তীব্র নেতীবাচক প্রভাব ফেলা হয়। জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, পিকেটিং, ককটেল বিস্ফোরণ, যানবাহনে আগুন ইত্যাদি করে দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত করা হয়। এমনকি একটি পর্যায়ে কার্যত দেশ অচল হয়ে পড়ে। বাসের ভেতরে পেট্রল বোমা ছুড়ে মারা হয়, দগ্ধ হয় বহু সাধারণ মানুষ, যাদের সাথে রাজনীতির সামান্য পরিমাণ সম্পর্কও নেই। বিএনপি জোটের ঐ আন্দোলনের ধকল সইতে গিয়ে বহু প্রাণ ক্ষয়েছে, অনেকে আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, যে সংখ্যা থেকে বাদ পড়ে নি পথের শিশুও। একটি রাজনৈতিক দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল তা আজও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয় নি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে মারাত্মকভাবে। ফল হয়েছে এই যে, বিএনপির যে বিরাট জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকাংশেই এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে যার জন্য এতকিছু সেই নির্বাচনকেও তারা ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় নি। অনেকেই তাই বলছেন যে, বিএনপির একুল-ওকুল দু’কুলই গেছে। বাস্তবেই বিএনপি কুল হারিয়েছে কিনা তা বিতর্কাতীত না হলেও দলটি যে এখন ভারসাম্যহীনতায় পড়েছে এ বিষয়ে সকলেরই ঐক্যমত রয়েছে।


যাই হোক, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী দিনগুলোতে বিএনপি আর কোনো রকম সহিংসতা, হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি পালনের কার্যত চেষ্টাও করেনি। কেন করেনি, সে বিষয়ে বিশ্লেষকদের ভেতরেই মতের অন্ত নেই। তবে মতবিরোধ যাই থাকুক, গোড়ার কথায় গেলে এর কারণ হতে পারে দু’টি। হতে পারে- নিরবচ্ছিন্ন শক্তি ক্ষয় ও সহিংস আন্দোলন করার দরুন সাংগঠনিকভাবে বিএনপির মধ্যে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় অতিবাহিত হচ্ছে। হয়তবা নেতাকর্মীদের মধ্যে পুনরায় কর্মচঞ্চলতা ও আন্দোলনের মনোভাব দৃঢ় করার কাজ চলছে। এছাড়া আনুষঙ্গিক যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সেটা সম্পন্ন হলেই পুনরায় শুরু হবে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন যার দ্বারা সরকারকে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা সোপর্দ করে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে। 
আবার এও হতে পারে যে, ‘বিএনপির পলিসি এখন পাল্টে গেছে। সরকারের অস্ত্র-সজ্জ্বিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়, গ্রেফতার, মামলা ও হয়রানির সামনে তারা এখন অসহায়। তাছাড়া তাদের বর্তমানে প্রধান যে চাওয়া অর্থাৎ সরকার পতন ও নতুন নির্বাচন সেটা বাস্তবায়নে সহিংসতা করে সফলতা আনয়ন সম্ভব নয়। কাজেই এখন তারা অন্য উপায় তালাশ করছে। সে উপায় কোনটা তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। তবে বর্তমানে বিএনপিকে অনেকাংশেই কুটনীতিমুখর হিসেবে দেখছেন অনেকে। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির অন্যতম একটি পদক্ষেপ হচ্ছে যে, কোনো রকমে বৈদেশিক পরাশক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে নতুন নির্বাচনের জন্য চাপ দেওয়া। সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখতে পারলে বিএনপির স্বার্থ আদায় অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। বাস্তবে সেরকমই আবহাওয়া বিরাজ করছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বরাবরই সরকারকে অবিলম্বে নতুন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। নতুন সরকার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে একমাত্র ভারত ব্যতীত বিশ্বের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দেশই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে সমর্থন দেয় নি। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বহু পূর্বেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নও সুযোগ পেলেই কার্যত জিএসপি বাতিল করার হুমকি দিতে দ্বিধা করে না। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক ঋণ তহবিল, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নেই। আল জাজিরা, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য ইকোনমিস্ট টাইমসসহ বিশ্বের বড় বড় মিডিয়াতেও বর্তমান সরকারের নেতীবাচক খবরাখবর ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ হতে দেখা যায় প্রায়শঃই। এক কথায় আন্তর্জাতিকভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। আর এটা বিএনপিরই ইচ্ছার প্রতিফলন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আবার অনেকে ধারণা করেন বিএনপিই কলাকাঠি নেড়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বহুল আলোচিত সেভেন মার্ডারের পরিপ্রেক্ষিতেও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে রয়েছে বহু পূর্ব থেকেই। আর এসবে আপাতভাবে লাভবান হচ্ছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির এই লাভ কি আখেরি সফলতা আনতে সক্ষম হবে, এমন প্রশ্নও আসছে স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপি যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, তাদের ইতিহাসও স্বচ্ছ নয়। বলা হচ্ছে, বিএনপি পশ্চিমাদের ব্যবহার করতে গিয়ে কার্যত নিজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বৈদেশিক পরাশক্তিগুলোর কাছে গণতন্ত্র, মানবতা, আইনের শাসন ইত্যাদি কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর বহু দেশ রয়েছে যেগুলোতে মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন তো দূরের কথা পশ্চিমাদের বহুল আকাক্সিক্ষত গণতন্ত্রও চালু নেই। কিন্তু সে দেশগুলোর সাথে পশ্চিমাদের কোনো রেষারেষি তো নেই, বরং গলাগলির সম্পর্ক বিদ্যমান। বস্তুত, গণতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এই পশ্চিমাদের কোনো উদ্দেশ্য নয়, বাংলাদেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, এখানে মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত তাই তারা গণতন্ত্র তথা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসছে, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে মনোযোগী তাদের নিজ স্বার্থেই। আর এই স্বার্থে তারা বিএনপিকে সমর্থন দেবে ততক্ষণ কমন ইন্টারেস্ট থাকবে যতক্ষণ। কমন ইন্টারেস্ট ফুরিয়ে গেলে বিএনপির সাথে তাদের সখ্যতাও ফুরিয়ে যাবে। তাই বিএনপির উচিত হবে, তাদের ব্যাপারে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা অভ্যন্তরীণভাবেই মোকাবেলা করার চেষ্টা করতে হবে। আওয়ামী লীগকেও বিএনপির প্রতি সহনশীল হতে হবে কারণ বিএনপি শুধু একটি দল নয়, তারা একটি বিশাল সংখ্যক জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। আলোচনা-পর্যালোচনার ভিত্তিতে উভয়েরই স্বার্থ রক্ষিত হয় এমন একটি প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াতে হবে। পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষকে যতই বি¯তৃত করা হবে, যতই বাইরে ছড়ানো হবে ততই বাইরের পৃথিবী সুযোগে সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করবে। আমাদের নিজেদের শত্র“তা ও বিভেদের ফাঁক যতই বড় হবে ততই তাদের মঙ্গল, ততই তাদের স্বার্থ আদায় সহজ হয়ে যাবে। তাই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত হবে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও পরনির্ভরশীলতাকে উপেক্ষা করে চলমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা।

হেফাজতনামা- লাভের ফসল কার ঘরে?

‘আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী মসজিদ-মাদ্রাসায় সহযোগিতা করেন। জনাবা হাসিনার সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নাই। হাসিনাকে কোনোদিন গালি দেইনি, হাসিনার মানুষদেরকেও কোনদিন গালি দেইনি। তারা সবাই আমাদের বন্ধু।’- সম্প্রতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পার্বতী হাইস্কুল মাঠে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দানকালে এভাবেই মন্তব্য করেছেন কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তার এমন মন্তব্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে খোদ হেফাজতে ইসলামের ভেতরেই। এর আগেও তিনি গত ১১ এপ্রিল চট্রগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এক সমাবেশে ‘সরকার, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। তখন বিষয়টি নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, এমনকি অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। কিছুদিনের ব্যবধানে আবারও একই সুরে কথা বললেন হেফাজত নেতা। তাই ঘুরে ফিরেই একই প্রশ্নের উদয় ঘটছে- শত্র“ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসা তাদেরই কথিত ‘নাস্তিক সরকার’ হঠাৎ তাদের বন্ধু বনে যাবার কারণ কী? বেশ কিছুদিন যাবৎ মিডিয়াতে একটি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে, হেফাজত নেতাদের সাথে সরকারের নতুন কোন সমঝোতা হচ্ছে বা হয়েছে। যদিও বিষয়টি অপ্রমাণিত, তথাপি ঘুরে ফিরেই আলোচনার বৃত্তে পাক খাচ্ছে। কারণ, গুঞ্জন বলা হলেও বাস্তবতার সাথে বিষয়টির বেশ মিল পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এমনকি স্বয়ং হেফাজত আমিরের বক্তব্যের সাথেও তা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে।

গত বছরের ৫ মে’র হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী এবং সরকারি প্রতিবন্ধকতায় তা পণ্ড হয়ে যাবার পর থেকে আর সেভাবে মাঠে নামতে দেখা যায় নি সংগঠনটিকে। মাঝে দু’-একবার রাজধানীতে সমাবেশের ঘোষণা দিলেও অজানা কারণে নির্দিষ্ট দিনের পূর্বেই তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে মাঠে না থাকলেও হেফাজতে ইসলাম আলোচনার বাইরে ছিল না কখনোই। ৫ মে’ পরবর্তী সময়ে সরকারের বেশ ক’জন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি হাটহাজারীতে দেখা করতে যান হেফাজত নেতার সঙ্গে। দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শীর্ষ কর্মকর্তাও। এমনকি এ তালিকা থেকে বাদ নেই বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদও। তিনি নাকি হেফাজত আমিরের কাছে দোয়া নিতে গিয়েছিলেন যদিও তার ফেরার পর হেফাজত নেতারা বলেছিলেন যে, তিনি শফী হুজুরের কাছে থেকে অভিশাপ নিয়ে গেছেন। তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক, প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার হেফাজতে ইসলামের সাথে একটি সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে এটাও ঠিক যে, প্রাথমিকভাবে সে চেষ্টার চাহিদামাফিক ফল তারা আদায় করতে সক্ষম হয় নি। এরপর থেকে প্রকাশ্যে হেফাজত নেতাদের সাথে সরকারের আনাগোনার কোন খবর পাওয়া যায় নি।

কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবৎ খবরে আসছে যে, হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত রেলের বেশ কিছু জমি সরকার স্বেচ্ছায় হাটহাজারী মাদ্রাসাকে দান করে দিচ্ছে। গত ১৯ এপ্রিল দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘অবশেষে রেলওয়ের ৩২ কোটি টাকার জমি গিফট দেওয়া হচ্ছে হেফাজত ইসলাম নেতা আল্লামা শফীকে। হাটহাজারী মাদ্রাসার নামে দুই বছর আগেই জায়গাটিতে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। আর এখন রেলওয়ের জায়গাটি নিজেদের জন্য বরাদ্দ চেয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন আল্লামা শফী।’ 

যদিও এখনও জমিটি হেফাজত আমিরের হস্তগত হওয়াার কোন খবর জানা যায় নি, তবে শীঘ্রই তিনি জমির মালিকানা লাভ করবেন- এমনটিই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, এ ব্যাপারে বরাবরই সরকারের সবুজ সংকেত রয়েছে। অনেকের মতে, সরকারই জমিটি হেফাজত আমিরকে লিজ দিতে বেশি আগ্রহী। এদিকে হেফাজত আমিরের ব্যক্তিগত এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার অধীনে হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা সম্পদের পরিমাণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে গণমাধ্যমগুলোতে। অনেকে সরকারের সাথে যোগসাজশের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছেন হেফাজত নেতাদের অঢেল সম্পদের ফিরিস্তি। তবে হেফাজত আমিরের ছেলে সে দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে, এসকল সম্পদের উৎস মূলত বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং মাদ্রাসা কল্যাণে দেওয়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের অনুদান। যাই হোক, ৫ মে’র পরবর্তী দিনগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই পাওয়া যায় যে, হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা বাস্তবায়ন করতে না পারলেও অন্যান্য সবদিক দিয়ে তাদের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে সুযোগমত। অজানা-অচেনা মানুষগুলো দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। আজ তাদের সাথে বৈদেশিক হাইকমিশনারদেরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে দেখা যায়। হেফাজতের নেতারা একটি কথা বললেই মিডিয়া তা কাভারেজ দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগে। স্থানীয় চেয়ারম্যানের সাথেও যাদের খুব বেশি সম্পর্ক ছিল না, এখন তারাই বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তাদের বিদ্বেষের পাত্র গণজাগরণ মঞ্চ এখন সরকারি দলের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। সব মিলিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের ব্যর্থতার চেয়ে সফলতার পাল্লাই ভারী। আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে তারা তাদের স্বার্থ অনেকটাই আদায় করতে পেরেছে। 

এ তো গেল হেফাজতের স্বার্থ। এবারে আলোকপাত করা যাক, হেফাজতকে কেন্দ্র করে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ আদায়ের বিষয়ে। হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে অন্যান্যরাও যে লাভবান হয় নি, তা কিন্তু নয়। বরাবরই সংগঠনটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের বিবদমান সবক’টা রাজনৈতিক পক্ষই। একটি সময়ে সরকার পতনের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলগুলোর মধ্যে। তাদের মন্ত্রণায় হেফাজতের তেরো দফা সরকার পতনের এক দফায় পরিণত হয়েছিল, যে কথা পরবর্তীতে অনেক হেফাজত নেতাই স্বীকার করেছেন অকপটে। সে সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল সর্বাত্মকভাবে সমর্থন দিয়েছিল হেফাজতে ইসলামকে। সুযোগ বুঝে খালেদা জিয়া সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামও ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারি সিদ্ধান্তে ৬ মে ভোরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ অভিযানের সামনে হেফাজতিদের টিকতে পারে নি বলে সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। তথাপি শুরু থেকেই হেফাজতে ইসলামের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখায় দেশের একটি বিরাট সংখ্যক কওমী সমর্থকের রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করে বিএনপি। এছাড়া ৫ মে দিবাগত রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে হতাহত হেফাজত কর্মীর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগও উঠেছিল তৎকালীন বিরোধী দলীয় জোটের বিরুদ্ধে। এক কথায়, হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে যতভাবে ও যতটা সম্ভব রাজনৈতিকভাবে স্বার্থ আদায় করে তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ স্বার্থ আদায়ের ধারা থেকে সরকারি দলও বাদ নেই। সরকারও এ ইস্যু থেকে স্বার্থ হাসিল করেছে। প্রাথমিকভাবে হেফাজতে ইসলামকে হেনস্তা করে গণজাগরণ মঞ্চসহ অন্যান্য সেক্যুলার গোষ্ঠির সমর্থন আদায় করেছে। অতঃপর বিরোধী জোটগুলোর আন্দোলন-সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবার পথ সুগম করেছে। কিন্তু যেই না নির্বাচন হয়ে গেল, অমনি ভোল পাল্টে সরকার এখন হেফাজতে ইসলামের বন্ধু সাজার চেষ্টা করছে। সম্ভবত, জনগণের ম্যান্ডেট অর্জনের জন্যই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত। ফলে সেক্যুলারদের সাথে সরকারের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও হেফাজতের সাথে দূরত্ব ঘুঁচছে; অর্থাৎ সরকার ধর্মভীরু জনগোষ্ঠির সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। ফলে হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি এখন অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। জামাতের সাথে বিএনপির জোট তো আছেই, সেই সাথে আছে বিএনপির সাথে হেফাজতের পুরান সখ্যতা, আবার নতুন করে তৈরি হচ্ছে হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক- হেফাজত আমিরের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে বন্ধুত্ব। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-হেফাজত-বিএনপি-জামাত সব মিলে মিশে একাকার। যেমন সবাই তাদের নিজের নিজের স্বার্থে এতদিন দ্বন্দ্ব-সংঘাত, কুৎসা রটনা, রাজপথ দখল করেছে, তেমন নিজ স্বার্থেই আবার বন্ধুত্ব স্থাপন করছে। অর্থাৎ লাভের খাতাতেই সবার নাম।

কিন্তু ক্ষতির খাতায়? ক্ষতির খাতায় শুধু তাদেরই নাম উঠে এসেছে যারা এতদিন কথিত ১৩ দফা আদায়ের আন্দোলনের প্রাণ হারিয়েছে, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছে, ব্যক্তি-বিশেষকে মুক্ত করতে গিয়ে নাশকতার সৃষ্টির সময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে বা নাশকতার হাত থেকে সাধারণ জনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে অবরোধ, হরতালকারীর নির্মমতায় প্রাণ হারিয়েছে। তাদের কোন স্বার্থ অর্জিত হয় নি। হেফাজতের যে কর্মীরা প্রাণ হারিয়েছে (সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রাণহানি যে ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই) তাদের অনেকেই এতিম, যাদের জন্য দু-ফোঁটা চোখের পানি কেউ ফেলবে না, যাদের কথা আর কেউ ভুলেও স্মরণ করবে না; কিন্তু তাদের যারা ব্যবহার করেছে, তাদের মুখ দেখিয়ে বা মাথা গুণে গুণে যারা চাঁদা সংগ্রহ করেছে, তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছে, এখন তারা কোটিপতি, ক্ষমতাধর, প্রভাবশালী বনে গেছেন। রাতরাতি ফ্ল্যাট বানাচ্ছেন। তাদেরই প্ররোচনায় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে গিয়ে যারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছে, পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছে, ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়েও যারা দাবি আদায়ের স্লোগান দিতে দিতে পাখির মত গুলি খেয়ে প্রাণ হারিয়েছে তাদের নাম এখন আর রাজনীতিবিদদের মনে আসে না, তাদের পরিবার না খেয়ে মরলেও রাজনীতিকরা এসি রুম থেকে বের হয়ে তাদের সাক্ষাৎ দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন না। কারণ, তাদের প্রয়োজন শেষ। প্রশাসনের যে সাহসী দেশপ্রেমিকরা রাজনৈতিক কর্মীদের নৃশংসতা থেকে জনতাকে বাঁচাতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিল, প্রাণ হারালো, তারা যদি কোনো মন্ত্রবলে আবারও পৃথিবীতে আসতে সক্ষম হয় তাহলে কীভাবে তাদের রক্তের সাথে বেইমানী করা হচ্ছে তা দেখে ধিক্কার দেবে। সন্ত্রাসী-জঙ্গি-উগ্রপন্থী ট্যাগে বিদ্ধ করে যাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, এখন সে সন্ত্রাসী-জঙ্গিরাই বন্ধু হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। স্বার্থের প্রয়োজনে সব কিছু করা হচ্ছে। অর্থাৎ লাভের ফসল সবার ঘরেই উঠছে; ক্ষতি শুধু তাদের যারা কঠোর রৌদ্রোত্তাপ উপেক্ষা করে ফসলকে নিজের ঘামঝরা শরীরে বহন করে নেতাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে।

এই বক্তব্যের মানে এই নয় যে, আমরা বিবাদের মীমাংসা চাই না। দেশের ষোল কোটি জনতা এক হোক, একটি প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াক- এটা আমাদের চাওয়া। কিন্তু রাজনীতিকরা এক হচ্ছেন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নয়, তারা এক হচ্ছেন নিজ নিজ স্বার্থের খাতিরে। তাদের বন্ধুত্ব থাকবে ততক্ষণ, স্বার্থ বজায় থাকবে যতক্ষণ। তাছাড়া ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য এমন একটি স্ট্যান্ড দরকার যা হবে মানবতার কল্যাণে, কোন ব্যক্তি বা গোষ্টীবিশেষের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নয়। মানবতার কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হলে সেটা হতে হবে মিথ্যার বিরুদ্ধে, মিথ্যার সাথে আপোস করে নয়। মিথ্যার সাথে আপোস করে কোনদিন ঐক্য হয় না, ক্ষণিকের জন্য হয়তবা কিছুটা সুবিধা আদায় করা যায়। কিন্তু সে সুবিধাও যে ক্ষেত্রবিশেষে বুমেরাং হয়ে যাবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তখন লাভের গুঁড় পিঁপড়ায় খেলেও কিছু করার থাকবে না।

সরিষার ভেতরেই যখন ভূত! (অপহরণ-খুন-গুম প্রসঙ্গে)

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গুম-খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত বেশ কিছু প্রতিরোধমূলক তৎপরতা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বহুদিন যাবৎ বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এই ইস্যুটিকে নিয়ে এর আগে খুব কমই চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী থেকে শুরু করে তৎপরবর্তী বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং তাদের খুঁজে বের করতে প্রশাসনের কার্যত ব্যর্থতা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বারবার। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে এবারে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে নারায়নগঞ্জের সাত জনকে অপহরণ করে খুন করার ঘটনা। এর কয়েকদিন পূর্বে একই জেলার ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি’র নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিকের অপহৃত হওয়া এবং অজানা কারণে অক্ষত মুক্তি পাওয়ার ঘটনা ঘটে। কে বা কারা, মূলত কী উদ্দেশ্যে তাকে অপহরণ করেছিল তা জানা যায় নি আজও। সব মিলিয়ে নারায়নগঞ্জ পরিণত হয়েছে আতঙ্কপুরিতে।
এ ধরনের ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমনিতেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিকভাবে বহু বিতর্ক রয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও নতুন সরকারের স্থায়ীত্বের উপর কতটা আস্থা আনতে পেরেছে তা পরিষ্কার নয়। তাছাড়া এই ইস্যুটিকে বিরোধীপক্ষও যে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে তাও সরকারের অজানা নয়। সম্ভবত, এসব কারণে এবারে আন্তরিকভাবেই দেশ থেকে অপহরণ-গুম-খুনের ঘটনা দূরিভূত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এমনই কিছু নমুনা দৃশ্যমান হচ্ছে। যেমন- এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সরকারি পদস্থ ব্যক্তিরা। প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে তলব করেছেন, বৈঠক করেছেন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে ডিসি পর্যন্ত প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল এসেছে। এরই মধ্যে অপহরণ ও ৭ খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বাসায় তল্লাশী করে ১২ জন গ্রেফতার, রক্তমাখা গাড়ি জব্দ করেছে পুলিশ। এছাড়া অপহরণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে গাড়িতে রঙিন কাঁচ ব্যবহার ও বিনা অনুমতিতে সাদা পোশাকে পুলিশি অভিযান। 
তবে সবচেয়ে নতুন যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাহলো- ডিএমপির ৪০ জন চৌকশ পুলিশ সদস্যর সমন্বয়ে ‘এন্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড’ গঠন। এখন প্রশ্ন হলো, সরকারের এই উদ্যোগগুলো কতটা বাস্তবভিত্তিক, বিশেষত শেষের এই পদক্ষেপটি? নতুন নতুন বাহিনী গঠন করে এই ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে কি? স্বাধীনতা পরবর্তী গত ৪২ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কী পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম একটি কলঙ্কের নাম হলো দুর্নীতি। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতি-সন্ত্রাসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করে দেশকে কার্যত ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটি দেশের দুর্নীতি-সন্ত্রাস দমনের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেন তার উল্টোটা ঘটেছে। কারণ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম। যে বাহিনীর জন্মই হয়েছে আইনের শাসন বলবৎ রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য সে বাহিনী যখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সে দেশের অবস্থা যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা বিশ্বের অন্য কোন দেশের অধিবাসীরা না জানলেও আমরা জানি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো, এখানকার জনসাধারণ অতি ঠুনকো বিষয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা এ দেশে কোন ব্যাপারই নয়। এটা যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা থেকে জন্ম লাভ করেছে তা সহজেই অনুমেয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ঘুষ, ছিনতাই, চাঁদাবাজী, অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে চলায় আমজনতার মনে প্রশাসন সম্পর্কে সবসময় একটি নেগেটিভ চিন্তা-চেতনা কাজ করে থাকে। ফলে এমন বেগতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যতটা বন্ধু ভাবার কথা ঠিক ততটা ভয় পায়। তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে। একান্ত বাধ্য না হলে কেউ থানা-পুলিশ এলাকা মাড়াতে চায় না। এই বাস্তবতা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কাজেই এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই নতুন স্কোয়াড দিয়েই যে গুম-খুন-অপহরণ রোধ করা সম্ভব হবে- এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। 
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে চৌকশ বাহিনী হিসেবে পরিচিত ‘র‌্যাব’ গঠন করা হয় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ। অতঃপর একই বছরের ১৪ই এপ্রিল এই বাহিনী তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আশা করা হয়েছিল যে, বহু বছর যাবৎ বাংলাদেশের জাতীয় ইস্যুতে একের পর এক কলঙ্ক লেপন করে চলা ‘সন্ত্রাস’ প্রতিরোধে র‌্যাব যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানেই সে আশা নিরাশার চাদরে ঢেকে যায়। গুটিকতক সফলতা অর্জিত হলেও এই বাহিনী মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুইয়ে বসে। বর্তমানে বাহিনীটির ভাবমূর্তি সাংঘাতিকভাবে ক্ষুণ্ন। নানা সময়ে নানান অভিযোগ উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে, যা সাধারণ পুলিশ-প্রশাসনকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সাম্প্রতিক যে ঘটনাটি নিয়ে অপহরণ-গুম-খুন দমনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন ‘এ্যান্টি কিডন্যাপিং স্কোয়াড’ গঠন করা হয়েছে খোদ সেই ঘটনার সাথেই র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠছে। গত রবিবার নারায়ণগঞ্জের রাইফেল ক্লাবে সাংবাদিকদের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছেন- ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে র‌্যাব তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় র‌্যাবের সিও (অধিনায়ক) এবং আরও দুই মেজর মিলে ছয় কোটি টাকা নিয়েছেন।’ (সূত্র: প্রথম আলো)
সারা দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগের কোন শেষ নেই। প্রায় প্রতিটি সরকারের বিরুদ্ধেই র‌্যাবকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার দাবি উঠে এসেছে বারংবার। বস্তুত এভাবে নতুন নতুন বাহিনী সৃষ্টি করে বা কোন বাহিনীকে দমন করে চলমান সঙ্কটের কোন সমাধান করা যাবে না। অতীতে যায় নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। কেন এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না, তা জানতে হলে আমাদেরকে আগে জানতে হবে যে, কেন এই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে? কেন দেশের কল্যাণে কাজ করার তীব্র বাসনা নিয়ে বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশপ্রেমিক বাহিনীর সদস্যরা দুর্নীতিবাজ ও অপরাধী হয়ে যাচ্ছে? কেন তারা রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে নিজেদের বিবেক, মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিচ্ছে?
উত্তর একটিই- সিস্টেম। সকল সমস্যার শেকড় প্রোথিত রয়েছে প্রচলিত সিস্টেমে। প্রত্যেক মানবশিশু জন্ম নেয় ফেতরাতের (প্রকৃতির) উপর, অতঃপর সে সর্বপ্রথম পরিচিত হয় পরিবার নামক সিস্টেমের সাথে। এই সিস্টেমের প্রভাবে পরিবার থেকে যেভাবে একটি শিশুর প্রাথমিক চরিত্র নির্ধারিত হয়, ঠিক তেমনি সমাজব্যবস্থাও মানুষকে নিজস্ব কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলে। সমাজব্যবস্থা যদি বস্তুবাদী, ভোগবাদী হয়, মানুষও হবে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, মানুষগুলিও ধীরে ধীরে হবে দুর্নীতিগ্রস্ত। পক্ষান্তরে সমাজব্যবস্থা যদি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, মানুষগুলিও হবে ন্যায়নিষ্ঠ। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাদা মাটির ন্যায়। এই কাদামাটিকে যে ডাইসের মধ্যে ফেলা হবে, কাদা মাটি সেই ডাইসের রূপ, আকৃতি ধারণ কোরবে। সমাজব্যবস্থাও এমনই একটি ডাইস। কখনও কোন মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে চোর হোয়ে, ডাকাত হোয়ে, অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজ হোয়ে জন্ম নেয় না। কিন্তু অন্যায় সমাজব্যবস্থার প্রভাবে ধীরে ধীরে তারা এমন অপরাধী চরিত্রের হোয়ে যায়। যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি কোরতে যান তাদের অনেকেই এই অভিপ্রায় নিয়ে যান না যে ইচ্ছা মতো ঘুষ খাবেন, অপহরণ করবেন, গুম করবেন বা খুন করবেন, বরং সৎ জীবনযাপনের ইচ্ছা নিয়েই যান চাকুরিতে। কিন্তু সিস্টেমই তাদের অধিকাংশকে ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এবং খুনি বানিয়ে ফেলে। তারা এমন পরিস্থিতির শিকার হন যে অসৎ না হোয়ে তাদের কোন উপায় থাকে না। সুতরাং এমন সিস্টেম কার্যকর করে যতই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গঠন করা হোক বা যতই তাদেরকে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করা হোক, সেটা যে হিতে-বিপরীত হবে তার উদাহরণ আমাদের অতীত ইতিহাসেই পাওয়া যাবে। সরিষার ভেতরেই যদি ভূতের আবাস হয় তাহলে যেমন সে সরিষা দ্বারা কখনও ভূত দূরিভূত হবে না, তেমনি প্রচলিত ঘুণে ধরা সিস্টেমকে চালু রেখে কোনভাবেই অন্যায় অবিচার, গুম-খুন দূর করা সম্ভব হবে না। এটা আমরা যত দ্রুত অনুধাবন করতে সক্ষম হবো ততই আমাদের মঙ্গল।

জঙ্গিবাদ দমনকারীরাই যখন জঙ্গিবাদের উদ্গাতা!

খবরে প্রকাশ- মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বুধবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সক্রিয় ৫৪টি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনের এই তালিকায় বাংলাদেশের হরকাত-উল-জিহাদ-ই-ইসলামের (হুজি-বি) নামও রয়েছে, যা বাংলাদেশে হরকাতুল জিহাদ নামে পরিচিত। আজ থেকে নয় বছর আগে সংগঠনটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু তবুও তা নাকি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যাথার কারণ হিসেবে প্রতিয়মান হচ্ছে। (সূত্র: ইত্তেফাক, ০৩-০৫-২০১৪)।
ঐ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, ২০০৮ সালের পাঁচ মার্চ হুজি-বি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তালিকাভুক্ত হয়। আফগান ফেরত ৪০০ যোদ্ধার সমন্বয়ে সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল ১৯৯২ সালের এপ্রিলে। এছাড়াও মোট ৫৪ টি সংগঠনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক ঐ প্রতিবেদনে।
প্রথমেই বলে রাখি, এই ৫৪ টি সংগঠনের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের অবস্থান কাগজে কলমে একরকম হলেও বাস্তবতা যে অন্য রকম হবে না, তা সন্দেহাতীতভাবে বলা যাচ্ছে না। পরিষ্কার কথায় বলতে গেলে, সংগঠনগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করাই যদি মার্কিন প্রশাসনের লক্ষ্য হয় তাহলে মার্কিন প্রশাসন অবশ্যই কৃতীত্বের দাবিদার। কারণ এই সংগঠনগুলোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। এর প্রায় সবক’টি সংগঠনকেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। সুতরাং আপাতভাবে মার্কিন সরকারের এই উদ্যোগকে প্রশংসাসূচক বললেও ভুল হবে না। কিন্তু যদি তাদের উদ্দেশ্য সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করা না হয়ে এগুলোকে নিয়ে ব্যবসা বা আন্তর্জাতিকভাবে কোন স্বার্থ হাসিল করা হয়, তা হবে অতি গর্হিত কাজ। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ইতিহাস কিন্তু দ্বিতীয় সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে। 
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশেকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে। আমার আপত্তি এখানেই। যদি সত্য সত্যই মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এ উদ্বেগের কথা জানিয়ে থাকে, তাহলে তো কোন কথাই নেই। কিন্তু যদি তা না হয়ে (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছিল) অন্য কোন মতলব বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয়, সেটা তখন মার্কিন সরকারের উদ্বেগের কারণ না হয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণ হবে। এটা বলাই যায় যে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে আন্তরিকতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কোন অংশে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের যে সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আর এখন ঐ সংগঠনের কোন অস্তিত্ব বাংলাদেশে আছে কি না তাও যথেষ্ট সন্দেহের বিষয়। কিন্তু হঠাৎ করে কেনই বা এটাকে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মাথা ব্যাথা শুরু হলো তার কোন উত্তর আপাতত মিলছে না।
গত কয়েক দশক যাবৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব দরবারে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে শীতল প্রতিযোগিতা চলছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে তা শেষ হয়েছে দুই দশক আগে। ফলে এখন পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবেলায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে এমন কোন শক্তি নেই। আর এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র গত দুই দশক ব্যাপী এমন কিছু কর্মপদ্ধতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করেছে যা এই পরাশক্তিকে বিশ্বব্যাপী অনেকটাই নৈতিক প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তাদের এরূপ বার্ষিক প্রতিবেদন, বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠনকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি ইত্যাদি আখ্যা দান, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধের সূচনা, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলীতে অযাচিতভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড নিয়ে তুমুল বিতর্ক রয়েছে খোদ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতেই। 
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল কারা- তা বিশ্ববাসী জানে। তিলকে তাল বানিয়ে শত্র“কে ধ্বংস করার সা¤্রাজ্যবাদী নীতি আমাদের অজানা নয়। 
øায়ুযুদ্ধে সোভিয়েট ইউনিয়নের অধঃপতন হয় মূলত ১৯৭৯ সালে আফগান দখলকে কেন্দ্র করে। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য আফগানিদের পক্ষ হয়ে অর্থ, অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ, মোজাহেদীনদের রিক্রুট, প্রচার-প্রচারণার কাজগুলো করে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে তখন একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদের অতীত কার্যকলাপের ফল কিছুটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরই অর্থ ও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেহাদীরা হয়ে উঠে তাদের প্রধান শত্র“। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসকল মুসলিমকে সোভিয়েত পতনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে সেই মুসলিমগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে লড়ে নি, লড়েছিল সোভিয়েট ইউনিয়নের বিপক্ষে। আর কমন ইন্টারেস্টভোগী যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল পুরোপুরি সমর্থন, শিখিয়েছিল অস্ত্র চালাবার প্রশিক্ষণ। এমনকি তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহও করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এটা বোঝেনি, অথবা বুঝলেও মূল্যায়ন করে নি যে, আফগানযুদ্ধে সে যাদেরকে ব্যবহার করছে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে একটি আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে। সে আদর্শ হলো ইসলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তখন ইসলামের আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করলেও ওসামা বিন লাদেনসহ অন্যান্য যোদ্ধারা কিন্তু জঙ্গি বা সন্ত্রাসী খেতাব পায় নি, কারণ সে যোদ্ধারা কার্যত ছিল আমেরিকার শুভাকাংখী। কিন্তু পরবর্তীতে ঐ আদর্শগত কারণেই যখন ঐ লোকগুলোই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হয়ে উঠলো, তখন তারাই হয়ে গেলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জঙ্গি, সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থী ইত্যাদি। এখন যে হরকাতুল জিহাদের কথা বলা হচ্ছে- সেই সংগঠনটিকে অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই তৈরি বলে মতামত দিয়ে থাকেন। মার্কিন ঐ প্রতিবেদনেই স্বীকার করা হয়েছে যে, ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে আফগান ফেরত ৪০০ সদস্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল হরকাতুল জিহাদ (সূত্র: প্রাগুক্ত)। অর্থাৎ, এই সংগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ের সকল কর্মীই মার্কিন প্রশিক্ষিত ও মার্কিন অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হওয়ারই কথা; আর আজ যখন সংগঠনটি বিলুপ্তপ্রায় তখন নতুন করে আবার আমেরিকার মাথা ব্যাথা শুরু হচ্ছে। কাজেই সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেখেই যে মার্কিন পররাষ্ট্রদপ্তরের মাথা ব্যথা করছে না, সে যুক্তিও উড়িয়ে দেবার নয়।
যাই হোক, সোভিয়েত ধ্বংসের পর কথিত এই নতুন জঙ্গিদের ধ্বংস করার জন্য চালু করা হলো নতুন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হলেন তাদেরই প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ওসামা বিন লাদেন। এই জঙ্গীদের কিন্তু কোন অস্ত্রের কারখানা ছিল না। তাদের হাতের বেশিরভাগ অস্ত্রই ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই দেওয়া এবং কিছুটা ছিল রাশিয়ার হাত থেকে হস্তগত করা। এই লাদেন সম্পর্কে দু-চার কথা না বললেই নয়। ওসামা বিন লাদেন ১৯৫৭ সালের ১০ মার্চ সৌদি আরবে ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, তিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ পরিবারের ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নেন। সম্ভবত তখনই তার সঙ্গে তালেবান শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমরের পরিচয় ঘটে। আর সেই থেকেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। পরে লাদেন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হয়ে উঠেন। আর তখনই তাকে খেতাব দেওয়া হয় জঙ্গি। শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা, যার ভিলেন হিসেবে দাঁড় করানো হয় লাদেনকে। এই লাদেনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি সম্পর্কের রেশ ধরে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়। আজ ১০ বছর ধরে চেষ্টা করার পর একজন লাদেনকে মেরে যুক্তরাষ্ট্র দেখছে যে, আরও শত শত লাদেন ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে, যাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে ঐ যুক্তরাষ্ট্রই। শুধু তাই নয়, এখনও বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য প্রায় ৫০ টি জঙ্গিগোষ্ঠি পত্যক্ষভাবে সেখানে যুদ্ধে রত আছে যাদের রসদ যুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। বিষয়টি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে নাড়া ফেলেছে। বিশ্ববাসী আবারও প্রমাণ পেয়েছে যে, জঙ্গিদের ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিল করার কৌশল এখনও অপরিবর্তনীয় আছে। 
পশ্চিমা এই মোড়লদের কাছে মানবতা, সন্ত্রাস দমন ও জঙ্গি দমন ইত্যাদি যে শুধু মুখের বুলি, তা ক্রমেই বিশ্ববাসী অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছে। আমাদের নেতা-নেতৃরাও যে জানেন না, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশের ছেলে নাফিসকে তারা কথিত স্ট্রিং অপারেশনের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে আটক করলো, বিচার করলো, ৩০ বছর কারাদণ্ড দিল। আর তাদের ছেলে নরওয়ের ব্রেইভিক ৯২ জনকে গুলি করে হত্যা করল, বোমা ফাটাল, তাকে নামে মাত্র শাস্তি দিল- মাত্র ২১ বছর। এখন তাকে আবার বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে সভ্য করানো হচ্ছে। সকলের ভালই জানা আছে নাফিস কথিত যে অপরাধ করেছে তার পেছনে ‘অক্সিজেন’ যোগানোর কাজটি কিন্তু করেছে তাদেরই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, তাদের মিথ্যাবাদিতা, প্রতারণামূলক চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদেরকে জ্ঞান দিতে পারেন কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধ নই, আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থে দলাদলি এবং কোন্দলে ডুবে আছি। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করাতে পারলেই আমরা খুশি। কিন্তু এর ফল শেষতক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি আমাদের নেতা-নেত্রীরা ভেবে দেখেছেন? তারা কি ভাবেন জঙ্গিদের অস্ত্রের যোগান কোত্থেকে আসে? মনে রাখতে হবে এসব তারাই বিলি করছে যারা অদূর ভবিষ্যতে এসবের অজুহাতে আমাদের উপর আক্রমণ করে আমাদের ধ্বংস করবে- অন্তত নিকট অতীত আমাদের তাই জানাচ্ছে। তখন আমাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন বেরিয়ে আসবে হামিদ কারজাই, একজন নুরে মালেকী। এরপরও কি আমরা পশ্চিমা মোড়লদের দিকে মাছের মতো হা করে তাকিয়ে থাকবো? না, আমাদের এখন একমাত্র করণীয় হবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিদমন করতে পশ্চিমারা বছরের পর বছর যাবৎ চেষ্টা করেও সফল হতে পারে নি বরং আরও উস্কে দিয়েছে তা আমরা অনায়াশেই করে ফেলতে পারবো যদি ঐক্যবদ্ধ হই। জঙ্গিদেরকে আদর্শিকভাবে অনুপ্রাণিত করে থাকে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা-পুরোহিতরা। ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণে, মানুষের মুক্তির জন্য। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে মানবতার কল্যাণে কাজে না লাগিয়ে বৈষয়িক স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে, যার ফলে জন্ম হচ্ছে বিকৃত আদর্শের অনুসারী উগ্রপন্থী-জঙ্গির। সুতরাং আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও বৈদেশিক নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। গড়ে তুলতে হবে- ঐক্যবদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জাতির নেতারা কি পারবেন ১৬ কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে ধর্মব্যবসা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে যে দেশটি- যে কোন রকম বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার ক্ষমতা রাখবে?