![]() |
আজকাল সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, পানির জন্য হাহাকার। শত শত মানুষ পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, এমনকি পানির গাড়ি পর্যন্ত ছিনতাই করতে বাধ্য হচ্ছে। খরার মৌসুমে রাজধানীতে পানির সমস্যা প্রতি বছরই প্রকট হারে দেখা দেয়। ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে এর পুরো প্রতিকার করাও সম্ভব হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এটাও দেখতে পাই যে, প্রতিনিয়ত যে মসজিদগুলো তৈরি করা হচ্ছে তাতে পানির সুবিধা প্রচুর। ঢাকা শহরের অলি-গলিতে বড় বড় মসজিদ আমাদের সবারই দৃষ্টিতে পড়ে। কোথাও পানি না থাকলেও মসজিদে সব সময় ঠিকই পানি থাকে। এর কারণ হল মসজিদে পানির ব্যবস্থা করা হয় অনেক লোকের জন্য। কিন্তু সারাদিন মসজিদ বন্ধ থাকায় সে পানি অব্যবহৃতই থেকে যায়। যারা নামাজে আসে তাদের অধিকাংশই বাড়ি থেকেই ওজু করে আসে। আর এ কারণে মসজিদের পানির রিজার্ভ ট্যাংকি সব সময় ভরা থাকে। অথচ মসজিদের পাশের যে বাড়িটি রয়েছে, যে বস্তিটি রয়েছে, তাদের রান্না বন্ধ হয়ে থাকে শুধুমাত্র পানির অভাবে। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ছটফট করে কোলের শিশু। ট্যাংক ভর্তি পানি অব্যবহৃত রেখে যখন মোয়াজ্জিন-ইমাম সাহেব মসজিদে তালা ঝুলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরছেন, তখন তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হাড্ডিসার মানুষগুলো সীমাহীন কষ্টের মাঝে সময়ক্ষেপণ করছে। এটাই কি ধর্মের শিক্ষা? ধিক এই নিচু মানসিকতাকে! বিদ্রোহী কবি বলেছিলেন-
কোথা চেংগিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুরি-শাবল চালা!
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বিদ্রোহী উক্তির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক রূঢ় বাস্তবতা। স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ঐ মসজিদ, ঐ খানকা, ঐ এবাদতখানা এসব তো মানুষেরই জন্য। কাজেই ওসবের উপর সবার সমান অধিকার আছে। এই অধিকার আল্লাহ দিয়েছেন, কোনো মানুষ সে অধিকারকে কেড়ে নিতে পারে না তা সে যত বড় আলেম, পুরোহিত, ইমাম সাহেবই হোন না কেন। আমরা দাবি করি যে, আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত। তাঁর আদর্শের অনুসারী। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? রসুলাল্লাহর যামানায় কবে কোন মসজিদের গেটে তালা দেয়া হয়েছে আমাদের ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবরা বলবেন কি? বরং মসজিদেই সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যাদি সম্পন্ন হতো। এখান থেকেই রাষ্ট্রীয় অনুদান বিতরণ করা হতো, বৈদেশিক দূতদের সাথে আলাপ হতো, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। মসজিদে বসেই চার খলিফা অর্ধ পৃথিবী পরিচালনা করেছেন। আর্ত মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য আল্লাহর ঘর মসজিদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ আর কোনো ঘর আছে কি? তাহলে সেই ঘরে আজ তালা কেন? বস্তুত আজকের এই মসজিদ, এই খানকা, এই এবাদতখানা প্রকৃত এসলামের মসজিদ নয়। এটা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত বাণিজ্যকেন্দ্র। রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘যে কেউ সৃষ্টিজীবের প্রতি সদয় হয় আল্লাহও তার প্রতি সদয় হন। অতএব পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি দয়ালু হও, সে ভালো হোক বা মন্দ।’ আমাদের মধ্যে এই শিক্ষা কোথায়? বরং বাস্তবে আমাদের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রের প্রতিফলন ঘটেনি কি? রসুলাল্লাহর খেজুর পাতার ছাউনী দেয়া মাটির ঘরের মসজিদে আল্লাহ ছিলেন, ঐ মুসল্লিরা মোমেন ছিলেন, মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সৈনিক ছিলেন; আর আজ জাকজমকপূর্ণ এসি, সোনার ডোমওয়ালা প্রাসাদসম মসজিদে আল্লাহ নেই, আর নামাজীরাও পথভ্রষ্ট বিশৃঙ্খল জনসংখ্যা। কারণ যে ঘরে আর্তপীড়িত মানুষের ঠাঁই হয় না, সে ঘর আত্মাহীন জড়গৃহ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে ঘরের আত্মা নেই সে ঘরে স্রষ্টাও নেই। কাজেই সে ঘরে যতই এবাদত-উপাসনা করা হোক না কেন তা স্রষ্টার কাছে পৌঁছে না। তা কেবলই পণ্ডশ্রম। কবির ভাষায়-
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি
No comments:
Post a Comment