Monday, February 23, 2015

মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া যখন শাস্তি!

(শুনুন হিন্দু পুরানের একটি কাহিনী)

রানী গঙ্গা সদ্য প্রসূত সন্তানকে নদীর জলে ফেলতে উদ্যত, 

আড়ালে দেখছেন রাজা শান্তনু

আমরা ছোটবেলায় সংখ্যা গণনা শেখার সময় অনেকেই পড়তাম একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ . . . আটে অষ্টবসু ইত্যাদি। হ্যাঁ, ঘটনাটা এই অষ্টবসুকে নিয়ে। তখন অষ্টবসু অর্থাৎ আটজন বসু ছিলেন স্বর্গের বাসিন্দা। দেব-দেবীদের সাথে থাকতেন, ঘুরতেন, বেড়াতেন, আনন্দ-খুশি করতেন। একদিন তাদের ইচ্ছা হলো পৃথিবীতে ঘুরতে আসার। সত্যি সত্যিই তারা পৃথিবীতে আসলেন নিজেদের বউদের সঙ্গে করে। তারা পৃথিবীর এমন একটি বনে পৌঁছলেন যেখানে বশিষ্ঠ নামের একজন অতি শক্তিধর ঋষির আশ্রম ছিল। ঋষি বশিষ্ঠ ছিলেন ঋষিদের সেরা, শক্তিমান রাজাধিরাজেরও রাজা। তার কাজে ব্যাধাত সৃষ্টি করার কথা কোনো মহাশক্তিধর রাজা-মহারাজাও চিন্তা করতে পারতেন না। ঋষি বশিষ্ঠের একটি গরু ছিল, যার নাম ছিল সুরভী। গরুটি অন্যান্য গরুদের মতো সাধারণ কোনো গরু ছিল না। সে একাই দশ হাজার মানুষের প্রয়োজনীয় দুধ প্রদান করতে পারতো। যাই হোক, অষ্টবসু যখন ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমে আসলেন তখন বশিষ্ঠ সেখানে ছিলেন না। কেবল তার গরুটি ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই গরুটি দেখে অষ্টবসুর মধ্যে অনত্যম বসু দ্যু এর স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে গেল। তিনি গরুটিকে নিয়ে যাবার জন্য স্বামী দ্যু এর কাছে অনুরোধ জানালে অন্যান্য বসুরাও আর অমত করলেন না। হয়তো ভাবলেন- কী আর হবে, একজন ঋষির গরু নিলে তিনি কী আর করতে পারবেন? এই ভেবে তারা গরুটিকে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। আর এতেই ঘটল বিপত্তি!
ঋষি বশিষ্ঠ আশ্রমে এসে যখন গরু পেলেন না তখন যোগমারফত জানতে পারলেন সব ঘটনা। তারপর তিনি শুধু গরুটিকে ফিরিয়ে এনেই ক্ষান্ত হলেন না বরং অভিশাপ করে বসলেন যে, তোমাদের সবাইকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে এবং পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে। এ কথা শুনে তো অষ্টবসুর দফা রফা। পৃথিবী? কত কষ্টের জায়গা। কত অন্যায়, অবিচার হয় সেখানে। অশান্তিময় ওই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে? বসবাসও করতে হবে? তারা শুরু করলেন কান্নাকাটি। আকাশ-বাতাস, পশু-পক্ষী, গাছ-পালাও সে কান্নায় কষ্ট অনুভব করলো। এক পর্যায়ে ঋষি বশিষ্ঠের দয়া হলো। তিনি একটি উপায় বাতলে দিলেন যে, যদি কোনো স্বর্গের দেবী তোমাদেরকে পৃথিবীতে জন্ম দিতে রাজী হন তাহলে কেবল দ্যু ছাড়া অন্য সাতজনের পৃথিবীতে জন্ম নিলেই হবে, বসবাস করতে হবে না। তবে দ্যু-এর পাপ বেশি হওয়ায় তাকে বসবাস করতেই হবে।
অষ্টবসু এবার স্বর্গের দেবী গঙ্গার শরনাগত হয়ে ঘটনা খুলে বললে দেবী রাজী হলেন। কিন্তু কার ঔরষে অষ্টবসু পৃথিবীতে জন্ম নেবে? যার তার ঔরষে তো আর জন্ম নেয়া যায় না। এরা যে স্বর্গবাসী। অনেক খুঁজে ঠিক করা হলো কুরুবংশের প্রজাহিতৈষী রাজা শান্তনুর ঔরষে অষ্টবসু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে। অচিরেই গঙ্গার সাথে শান্তনুর সাক্ষাৎ ঘটল একটি নদীর কিনারায় যখন রাজা শান্তনু শিকারে বের হয়েছিলেন। রাজা শান্তনু দেবী গঙ্গার রূপ মাধুর্য দেখে অভিভূত হয়ে সেখানেই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। দেবী গঙ্গাও অমত করলেন না তবে কয়েকটি শর্তের কথা জানালেন।
  1. রাজা তাঁর কোনো বংশপরিচয় জানতে চাইবে না,
     
  2. তাঁর কোনো কাজের ব্যাখ্যা রাজা জানতে চাইবেন না,
  3.  তাঁর কোনো কাজে রাজা বাধা প্রদান করতে পারবেন না, যদি এর একটি শর্তেরও লঙ্ঘন করা হয় তাহলে গঙ্গা দেবী চলে যাবেন।
রাজা এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি তাতেই রাজী হলেন। বিয়ে হলো। বছর ঘুরতেই গঙ্গার গর্ভে রাজার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে রানী সাথে সাথে শিশুটিকে নদীতে ফেলে দিলেন। রাজা অবাক হলেন, মনকষ্টে ভুগলেন কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না, কারণ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না। এভাবে যে সন্তানই জন্ম নেয় রানী সাথে সাথে সন্তানকে পানিতে ফেলে দেন। রাজা কিছুই বলতে পারেন না। তিনি ক্রমেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সব সন্তানকে পানিতে ফেলে মেরে ফেললে বংশের ধারা রক্ষা হবে কী করে? সব থেকে বড় কথা হলো এমন কাজ কোনো মা করতে পারে? এক পর্যায়ে সাত সন্তানের মৃত্যুর পর অষ্টম সন্তানটি যখন ভূমিষ্ঠ হলো এবং রানী তাকে নদীতে ফেলার উদ্দেশ্যে নদীর ধারে গেল তখন আর রাজা শান্তনু চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি প্রতিবাদ করলেন, কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আর তখনই রানী শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে অষ্টবসুর শেষ বসু অর্থাৎ দ্যু’কে রাজার হাতে সোপর্দ করে সেখান থেকে চলে গেলেন। যাবার আগে অষ্টবসুর ঘটনা বর্ণনা করে নিজের পরিচয়ও প্রদান করলেন।

রানী গঙ্গা অষ্টম সন্তানকে জলে ফেলতে গেলে রাজা শান্তনুর বাধা প্রদান



শিক্ষনীয়: 

এখন শুনুন ঘটনাটি বলার তাৎপর্য। পুরানের এই দ্যু’কেই আমরা মহাভারতের কাহিনীতে ভীস্ম হিসেবে জানি। তিনি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শাস্তি হিসেবে, যে শাস্তি তাকে পেতে হয়েছিল দীর্ঘ জীবনে একটু একটু করে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে করতে। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে যিনি কখনও সত্যের পক্ষ নিয়ে কৃতার্থ হয়েছেন আবার কখনও অজ্ঞতাবশত মিথ্যার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তবে সবশেষে তিনি সত্যকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন যার দরুন এত কষ্ট সত্ত্বেও তার জনম স্বার্থক হয়েছিল। কিন্তু আমাদের জনম কি স্বার্থক হবে? আমরা কি সত্যের ধারক? হলেও কতটুকু? বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে। দ্যু’ বসু পৃথিবীতে স্বেচ্ছায় আসেন নি, এসেছিলেন বাধ্য হয়ে। হয়তো আমরাও স্বেচ্ছায় আসি নি। অশান্তিময় এই পৃথিবীতে কেই বা স্বেচ্ছায় আসতে চায়? কিন্তু আজ আমাদের অবস্থা এই যে, আমরা অনেকেই ভাবি পৃথিবীই সব, আর অধিকাংশ মানুষ সরাসরি তা না ভাবলেও কার্যত তারা পৃথিবীর জীবন নিয়েই ব্যস্ত। কী ভয়ানক ব্যাপার!
পৃথিবী বড়ই কঠিন। এখানে শুধুই পরীক্ষা আর পরীক্ষা। এটা আরাম-আয়েশে বেঁচে থাকার জায়গা নয়। এটা সংগ্রামের জায়গা, দুঃখ-কষ্টের জায়গা। যারা পৃথিবীকেই সককিছুর আধার ধরে নিয়ে পার্থিব ভোগ-বিলাসে মত্ত রয়েছে তারা বিপথগামী ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তো- যুগে যুগে আমরা কত ঋষি-মুণি, দরবেস, পীর-ফকির, সন্ন্যাসী, ভিক্ষুর কথা জানতে পাই যারা এই জগৎ সংসারের মায়া ত্যাগ করে, পার্থিব কাজ-কর্ম ত্যাগ করে কেবল স্রষ্টাকেই খুঁজে ফিরেছেন, আত্মিক উন্নতি করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সমাজ-সংসার থেকে বের হয়ে বনে-জঙ্গলে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওটাও কোনো স্বাভাবিক জীবন নয়, মুক্তির পথ নয়। প্রকৃত মুক্তির পথ আমরা পাই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে। যেমন গীতায় আছে কর্মযোগ। কর্মযোগের মাধ্যমে কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব, পার্থিব জগতে বাস করেও, অন্য আর দশজন মানুষের সাথে জীবনযাপন করেও, সংসারধর্ম পালন করেও সন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব। তার জন্য বনে-জঙ্গলে যাবার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নিঃস্বার্থভাবে মানবতার কল্যাণে কাজ করা। নিজের জন্য নিজের সুবিধার জন্য কিছু না করে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সমাজসংসারে বসবাস করেও সন্ন্যাসধর্ম পালন করা যায়। এতে যেমন স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাওয়া যায় তেমন পৃথিবীকেও সুন্দর করা যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে যখন অর্জুনের দৃঢ়তার খুঁটি নড়বড় করছিল তখন মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা শ্রীকৃষ্ণ তাকে এই মুক্তির পথই দেখিয়েছিলেন।
ইসলাম ধর্মও একই কথা বলে। আল্লাহর রসুল নিঃস্বার্থভাবে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঘর-বাড়ি ত্যাগ করাকে অর্থাৎ জেহাদকে ইসলামের বৈরাগী বলে অভিহিত করেছেন। মহামতি বুদ্ধকেও আমরা দেখি এককালে সংসারের মায়া ত্যাগ করে তিনি সমাজ-সংসার ছেড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে সত্য পাওয়ার পর সমাজ-সংসারেই ফিরে এসেছেন ভিন্নভাবে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে।
আবারো বলছি পৃথিবী মোটেও ভালো জায়গা নয়। কিন্তু তাই বলে আমরা পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যেতেও পারি না। আমাদের জন্য তাই সবচেয়ে ভালো হবে যদি নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে একে অপরের কল্যাণে সংগ্রাম করি, যেটা সকল নবী-রসুল-অবতার করেছেন। তাতে পৃথিবীও সুন্দর হবে, পরকালও সুন্দর হবে।

সেই জঙ্গিবাদ এই জঙ্গিবাদ

২০০৪/২০০৫ সাল। সময়টি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বাংলাদেশ তখন বোমাবাজদের অভয়ারণ্য। আদালতে বোমা, রাস্তায় বোমা, বাসে বোমা, ট্রেনে বোমা, মিটিং-এ বোমা, সমাবেশে বোমা; চোরাগোপ্তা বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত জাতি। শত শত স্বজন হারানো মানুষের নিরূপায় আহাজারি ও কোটি কোটি মানুষের আতঙ্কমিশ্রিত দিনাতিপাত- বাংলাদেশে জঙ্গি-উত্থানলগ্নের সার্বিক চিত্র ছিল এমনই। কিন্তু জাতির সৌভাগ্য যে, সে ভয়াবহতা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কেন হয় নি সেটা সকলেরই জানা।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশবাসী ওই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল বিধায় বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। সারা দেশের মিডিয়া একযোগে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীরাও ওই দুর্যোগময় মুহূর্তে করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন একের পর এক সেমিনার, আলোচনা, কনফারেন্স বা বৈঠকের মাধ্যমে। ছিল আন্তর্জাতিক তৎপরতাও। লাখো মানুষের ক্ষোভ ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছিল ওই সব মানুষের প্রতি যারা মানবতার কবর রচনা করে জনজীবনকে দুর্বিসহ ও বিপর্যস্ত করে তোলে, বিনা অপরাধে সাধারণ মানুষের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। জঙ্গিদের অমন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দেশের অনেক আলেম-ওলামাকেও তখন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে ও জঙ্গিদের বিচারের শক্ত দাবি ওঠাতে দেখা গেছে। জঙ্গি দমনে সরকারের আন্তরিকতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। দেশবাসী দেখেছে প্রশাসনের সার্বিক প্রচেষ্টায় কীভাবে একের পর এক জঙ্গি গ্রেফতার হয় এবং দ্রুত বিচারে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়। খুব অল্প দিনের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন জঙ্গিকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
হ্যাঁ, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যা করণীয় ছিল বাস্তবে আন্তরিকতার সাথে সেটাই করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রশ্ন নেই। আমাদের প্রশ্ন হলো- যে সন্ত্রাসী কাজ করার কারণে জেএমবি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল আজকের কথিত গণতান্ত্রিক দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য দিবালোকে ও রাতের আঁধারে ওই একই সন্ত্রাসী কাজ করার পরও এদের বিরুদ্ধে সকলে তৎপর নয় কেন? ধর্মের কথা বলে বোমা মারলে সেটা জঙ্গিবাদ, আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চলন্ত গাড়িতে বোমা মেরে জীবন্ত মানুষ পোড়ালে তা নিছক রাজনৈতিক সঙ্কট- এ দ্বিচারিতার কারণ কী?
আজকাল পত্রিকার পাতা খুললে, টেলিভিশনের খবর দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। মানুষ কত নির্মম হতে পারে! নৃশংস হতে পারে! পথে-ঘাটে হুটহাট বোমা ফুটছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামছে। নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে নিরীহ ঘুমন্ত পরিবহনকর্মীকে, বাসযাত্রীকে; নির্বিচারে ভেঙ্গে চুরমার করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যানবাহন। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু চেহারায় উচ্ছ্বাস নেই, আছে কেবল ভয় ও শঙ্কা। আগুনের ভয়, বোমার ভয়, ইট-পাটকেলের ভয়। অফিসগামীরা অফিস যাচ্ছে, কিন্তু মনে শঙ্কা- ঠিকঠাক ফিরে আসতে পারবে তো? কেউবা পরিস্থিতি বুঝে অফিস ছুটি নিয়ে গ্রামের পথে রওনা দিচ্ছে, যদিও জানে না কবে এ যুদ্ধাবস্থা পরিবর্তন হবে, শান্তি ও স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা আদৌ ফিরে আসবে কি না।
সাধারণ মানুষের কথা থাক, যে বিচারালয়ে আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয় মানুষের আস্থার প্রতীক সেই বিচারালয়েরই বইয়ের ভেতর থেকে যখন বোমা উদ্ধার করা হয়, বাথরুম থেকে গুলিসহ পিস্তল উদ্ধার করা হয় তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ওই জাতির নিরাপত্তার খুঁটি কতটা নড়বড়ে। জেলা প্রশাসকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অনেক জেলাতে বিজিবি মোতায়েন করেছে অনেক আগেই। ওদিকে ব্যাপক সন্ত্রাসের সামনে র‌্যাব-পুলিশের অবস্থা লেজে-গোবরে। সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি শান্ত হবার কথা শোনা যাচ্ছিল মাসখানেক ধরে। সেই সাত দিন আর অতিবাহিত হচ্ছে না। সহিংসতার দেড় মাস অতিক্রান্ত হলেও আজও দেশের অচলাবস্থা অপরিবর্তিত। অবস্থাটা বিবেচনা করুন। সারা দেশ নিরাপত্তহীনতায়। হয় হরতাল-অবরোধ, নয়তো সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ- প্রতিদিনই দেশে কিছু না কিছু ঘটেই চলেছে। ঘটছে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, দেশজুড়ে, এক সাথে, এক দিনে। কিন্তু আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো এই যে, এ সহিংসতা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধ নয়, মিডিয়া দায়িত্বশীল নয়, বুদ্ধিজীবী-সুশীলরাও এই সহিংসতা-সন্ত্রাসকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে, ভিন্ন প্রিজমে। তাদের অনেকে কৌশলে সন্ত্রাসকে এক প্রকার সমর্থনই করছেন। ওদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও থাকছে আড়ালে-আবডালে।
এমনটা হবার কারণ কী? জেএমবি বোমা মারায় যারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল, সকলে মিলে একযোগে জঙ্গিবাদকে রুখে দিল, সেই তারাই গণতান্ত্রিক বোমাবাজদের বিরুদ্ধে শৈথিল্য প্রদর্শন করছেন কেন? এর কারণ কি এই যে, চলমান সন্ত্রাস ধর্মের নাম হচ্ছে না, হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে?
আমি বলছি না যে, ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে যারা সন্ত্রাস করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। তারা অবশ্যই আইনানুগ শাস্তির যোগ্য। অন্যায় করলে তার শাস্তি তাকে পেতে হবে, তা যেই করুক না কেন, যে উদ্দেশ্যেই করুক না কেন। ধর্মের জন্য করেছে তাই সে জঙ্গি, উগ্রবাদী, আর গণতন্ত্র আনয়নের জন্য করেছে তাই সে উদারবাদী-সম্মানিত- তা তো হতে পারে না। উভয়ক্ষেত্রেই একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। আজ কি জেলায় জেলায় বোমা ফুটছে না? পুলিশ মরছে না? আদালতে, সম্মানিত ব্যক্তির বাসায় বোমা ফুটছে না? বাস-ট্রাক, ট্রেনে নাশকতা হচ্ছে না? জনমনে আতঙ্ক, ভয়, ভীতির উদ্রেক হচ্ছে না? ছেলে-মেয়েদের শিক্ষায় বাধা আসছে না? ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘœ ঘটছে না? আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে না? এসব যদি ন্যায় হয়, উচিত কাজ হয় তাহলে তো জঙ্গিদেরও কোনো দোষ দেয়া যায় না। তারা তাহলে কী দোষ করেছিল? কোন দোষে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হলো? আর যদি এসব কাজকে অন্যায় ও সন্ত্রাস বলা হয় তাহলে যারা এসব করছে তাদেরকেও সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থী বলতে হবে। এদের বিরুদ্ধেও সারা দেশের ফুঁসে ওঠা উচিত।
শুধু আজ নয়, বছরের পর বছর ধরে আমাদের রাজনীতিক টাইমলাইনে এ ধরনের কর্মকাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। অতীতে হয়েছে, আজ হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে না তা বলা যাচ্ছে না। কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো প্রায় সব দলকেই আমরা কোনো না কোনো সময় এ ধরনের সন্ত্রাসী কাজ-কর্মে লিপ্ত হতে দেখেছি। কিন্তু তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখা তো দূরের কথা মানুষ হাসিমুখে ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে, প্রকারান্তরে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পথ তৈরি করে দিয়েছে। কেন এ জনবিরোধী কাজ অনায়াসে চলে আসছে আর আমরা ষোল কোটি বাঙালি তা মাথা পেতে নিচ্ছি? গণতন্ত্রের নামে এ প্রতারণা আর কতকাল দেখব?

সংলাপে নয়, স্থায়ী সমাধান জনগণের ঐক্যে

১. ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ বা ‘গণতন্ত্র হত্যা’ যাই বলা হোক দিবসটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভয়াবহ অস্থিরতা বাসা বেঁধেছে তা যেন কিছুতেই কাটছে না। গত ৩ জানুয়ারির পর থেকেই কার্যত সারা দেশ অবরুদ্ধ। প্রথম দুই দিন সরকারি দলের অঘোষিত অবরোধ এবং তারপর থেকে বিরোধী আন্দোলনকারী জোট বা ২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালীন অবরোধ কর্মসূচিতে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সরকার বিরোধী আন্দোলন কার্যত রূপ নিয়েছে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় যার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে সাধারণ নিরীহ জনগণ। আতঙ্ক বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সন্ত্রাস ও নাশকতা সীমা ছাড়াচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমজীবী, কবি, সাহিত্যিক, চাকুরিজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়াকর্মী কেউই এ সহিংসতার ভুক্তভোগী হতে বাকি নেই। সাধারণ মানুষের অসীম দুর্ভোগ, ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর অনিশ্চিয়তা, জাতীয় অর্থনীতির ক্রমাবনতি, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, রাস্তা-ঘাটে অনিরাপত্তা, বোমাতঙ্ক ও বার্ন ইউনিটের বীভৎসতা মানুষের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বারবার। সমাধান যেন সুদূরে অবস্থিত আকাশের চাঁদ। সর্বত্র একই অভিব্যক্তি, একই প্রশ্ন- কেন এই জাতিবিনাশী আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড? রাজ-রাজড়াদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় সাধারণ মানুষকে জীবন হারাতে হবে কেন?
২. বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ২০১৪’র ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিল। বিএনপির দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ২০১৩ সালের শেষ দিনটি পর্যন্ত হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতা চালিয়েও বিএনপি দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে পারে নি। ফলে দলটির ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যে নির্বাচনটি করেছিল সেটা ছিল কার্যত প্রতিপক্ষহীন, যা সংবিধান অনুযায়ী ঠিক থাকলেও গণতন্ত্রের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ২০১৪ সালব্যাপী দল গোছানোর কাজ করে ২০১৫ সালে এসে বিএনপি শুরু করল কথিত গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। আবারও জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, হরতাল, অবরোধের কবলে পড়ল সারা দেশ। গত ২৩ দিন যাবৎ সারা দেশ অবরুদ্ধ। অবরোধের মধ্যেই কখনো কখনো আসছে হরতালের ডাক। সহিংসতায় এ পর্যন্ত অগ্নিদদ্ধ হয়ে ও অন্যান্যভাবে ৫৩ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ সময়ে প্রায় ৭৬৯টির মতো যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে ও ভাঙচুর করা হয়েছে। রেলে নাশকতা চালানো হয়েছে কমপক্ষে ৯ দফায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। কিন্তু এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বিএনপি ক্রমশই হার্ডলাইনে প্রবেশ করছে। এতে করে দেশব্যাপী বিএনপির জনসমর্থন নিয়ে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। ক্রমেই বিএনপির উপর থেকে সাধারণ মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। জনপ্রিয়তা হারিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দলটি। ওদিকে সরকারের তরফ থেকেও ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হওয়ায় বিএনপির আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিকভাবেই। অনেকেই মনে করছেন- বিএনপির এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বিএনপির পক্ষে যাবে না। কারণ, প্রথমত দলটি আন্দোলনের কথা বলে যা করছে তাকে সাধারণ মানুষ আন্দোলন ভাবতে পারছে না, ওটা সহিংসতা। দ্বিতীয়ত, বিএনপির এ আন্দোলনের পক্ষে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো স্বার্থ নেই। গণতন্ত্র রক্ষা বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ইত্যাদির সাথে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোনো লাভ-ক্ষতি জড়িয়ে নেই। ফলে জনস্বার্থহীন আন্দোলন রূপ নিয়েছে জনসম্পৃক্ততাহীন আন্দোলনে। আর এটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় জনগণের সহযোগিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছাড়া কোনো সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল হতে পারে না। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- এ ধরনের জনসম্পৃক্ততাহীন সহিংস আন্দোলন থেকেই কিন্তু বিভিন্ন দেশে অতীতে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যার সুফল ভোগ করেছে একমাত্র বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা।
৩. আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটা ছিল তা বোঝার উপায় ছিল না। কেননা কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় নির্বাচনের পূর্বেই ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন এবং যে কয়টি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানেও বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনের কারণে খুব বেশি মানুষ ভোট দিতে পারে নি। ফলে ওই মুহূর্তে সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা ছিল কিনা তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও বিভিন্ন জরিপের ফলাফল বিবেচনা করলে বোঝা যায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটা কমে গিয়েছিল। এ অবস্থা যে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে তা নয়। আজও মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের উপর ততটা আস্থাশীল নয় যতটা ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়। এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির অপপ্রচার। বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে একটি শ্রেণি আওয়ামী লীগ সরকারকে ইসলামবিদ্বেষী বা নাস্তিক্যের পৃষ্ঠপোষক বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অপপ্রচার চালিয়েছিল যার রেশ আজও জনমনে গেড়ে আছে। তবে এটা ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি, রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, অঙ্গ সংগঠনের টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস এবং সর্বপরি দলীয় অনৈক্যসৃষ্ট অন্তর্ঘাত অনেকাংশেই সরকারের জনপ্রিয়তা ক্ষুণœ করেছে। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যেভাবে বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলোকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাকেও খুব ভালোভাবে নিচ্ছে না দেশের বোদ্ধামহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ। আসছে বৈদেশিক চাপও। বিশেষ করে বছরের শুরুতেই নিরাপত্তা প্রদানের নাম করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে বালু ও ইটের ট্রাক এনে খালেদাকে অবরুদ্ধ করে রাখা, খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের উপর পেপার ¯েপ্র নিক্ষেপ করা, ঢাকায় ও গাজীপুরে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়া, তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মির্জা ফখরুল ও একুশে টিভির চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার, দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা, সহিংসতা নির্মূলে যা যা করার প্রয়োজন প্রশাসনকে তা করতে নির্দেশ দিয়ে তার দায়িত্ব নেবার মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রিজভী-মোসাদ্দেক আলীকে গ্রেফতার, বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, টেলিফোন যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রীদের লাগামছাড়া বক্তব্য-বিবৃতি ইত্যাদিকে সাধারণ মানুষ দেখছে বাড়াবাড়ি হিসেবে। বর্তমানে সারাদেশে অবরোধ ও হরতাল দিয়ে যে জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতা করা হচ্ছে এবং জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে তার জন্যও বিএনপির পাশাপাশি সরকারকেও দোষারোপ করছে সাধারণ জনগণ। সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারছে না বরং দিনকে দিন পরিস্থিতি সরকারের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশের অনেক জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে, পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, শত শত সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, স্থানে স্থানে তল্লাশি চলছে, সহিংসতাকারীদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, থানায় থানায় সরকার সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মানুষ এখনও নিজেদের অনিরাপদ ভাবছে। আর এ ব্যর্থতা যে সম্পূর্ণ সরকারের উপরই বর্তাবে তা আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না।
৪. সমাধানের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা দেশ। গণমাধ্যমে বা টেলিভিশন টক শো’তে যদিও এক শ্রেণির ব্যক্তিত্ব সমাধানের স্রোত বইয়ে দিচ্ছেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- ওসব তত্ত্বকথা সরকার বা বিরোধী দল কাউকেই প্রভাবিত করছে না। প্রভাবিত করলেও যে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত তাও নয়। যে সংলাপের জন্য এক শ্রেণির মানুষ রীতিমত জান-প্রাণ উজার করে রাজনীতিকদের ডেকে চলেছেন প্রথমত বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সংলাপ হবার সামান্যতম পরিবেশও বজায় নেই, দ্বিতীয়ত সংলাপ হলেই তো হবে না, ফলপ্রসূও হতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখলে ফলপ্রসূ সংলাপের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এসব কারণে সাধারণ জনগণ এখনও দিশাহীন। কেউই জনগণের সম্মুখে সত্যিকার অর্থে কোনো আশার আলো তুলে ধরতে পারছেন না। যারা তৃতীয় পক্ষের ধুয়া তুলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা করছেন তাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতাও মানুষের অজানা নয়। কাজেই এভাবে যে সমাধান আসবে না তা সহজেই অনুমেয়।
৫. এমতাবস্থায় কোনো সমাধানের পথ সত্যিই আছে কি? আমি বলব আছে, একটিমাত্র পথ আছে এবং এটাই অনিবার্য পথ, চিরন্তন, শাশ্বত ও সনাতন পথ। সেটা হচ্ছে ঐক্য। দেশের ষোল কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যে মতবাদ, যে তত্ত্ব, যে তন্ত্র বা যে গোষ্ঠী মানুষের ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, মানুষকে অনৈক্য শেখায়, দলাদলী ও হানাহানি শেখায়, নিজ জাতির মানুষকে আগুনে পোড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, ক্ষমতার লোভে অন্ধ করে দেয় তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গুলি দিয়ে নয়, পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি দিয়ে নয়, জেল-ফাঁসির ভয় দেখিয়ে নয় সহিংসতা ও রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ করতে হবে ‘ঐক্য’ নামক অস্ত্র দিয়ে। জাতির অতীত দেখুন- ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এ জাতি যে যে সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সেই সেই সময় জাতি বিজয় অর্জন করেছে, একইভাবে যে যে সময় এ জাতি অনৈক্যে পতিত হয়েছে পরাজয় ও দুঃখ-দুর্দশা দ্বারা সে সময়গুলো কলঙ্কিত হয়ে আছে। এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদেরকে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আজ দেশে বিভীষিকাময় অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় অনৈক্যের কারণে। ভয় দেখিয়ে বা চাপ প্রয়োগ করে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে এক টেবিলে বসাতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না, সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাবে মাত্র। আজ নয়তো কাল যে কোনো ইস্যুতে যে কোনো স্বার্থে আবারও দেশকে মৃত্যুখাদের উপত্যকা বানানো হবে। সুতরাং জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদেরকে দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিতে পারবে না, বরং তাদের কথা মোতাবেকই রাজনীতি চলবে। যারা দিবা-রাত্রি হাসিনা-খালেদার আলোচনা বা সংলাপের অবাস্তব আশ্বাস প্রদান করে অর্ধঘুমন্ত জাতিকে বেঘর ঘুমে নিমজ্জিত করার পথ করে দিচ্ছেন তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে- যদি সত্যই জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে কিছু করার আশা থাকে তাহলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা করুন। ১৬ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে পৃথিবীর বুকে কারও সাধ্য থাকবে না মানুষের জীবন ও সম্পদ নিয়ে নোংরা খেলায় মত্ত হবার। সুতরাং শুধু টিভি-টক শো, পত্র-পত্রিকা ও আলোচনা-বিবৃতির কথার ফুলঝুড়ি, সংলাপের তাগিদ বা উদ্বেগ প্রকাশের মধ্য দিয়ে নয়, দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটুক জাতির ঐক্যপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।

সাধু ভাষায় সাধু কথা

দিন কয়েক পূর্বেও যাহারা বিএনপির আন্দোলনের সামর্থ্য লইয়া গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করিতেছিলেন এবং দলটির সর্বাঙ্গে নিরীহ-নির্বিবাদী জাতীয় কালিমা লেপন করিতে উদ্যত হইতেছিলেন আজ তাহারা কী ভাবিতেছেন কে জানে। খোদ সরকারবাবুরাই যে হারে বিএনপি’র পুরুষত্ব লইয়া টানাটানি করিল, হাসিতে হাসিতে লুটিপুটি খাইল তাহাও তো ভুলিবার নহে। এই তো গত মাসেই সরকারের জনৈক মন্ত্রী গর্বসহকারে বচনামৃত প্রসব করিলেন যে, আন্দোলন কত প্রকার কী কী বিএনপি তাহার কিছুই জানে না। সুতরাং বিএনপি’র উচিত হইবে সরকারের নিকট বিনীত প্রার্থনাপূর্বক আন্দোলনের ঘাট-ঘুট শিখিয়া লওয়া। পরবর্তীতে অবশ্য জানা যায় নাই যে, বিএনপি আন্দোলনের এই গুঢ় রহস্যজ্ঞান অর্জনহেতু সরকারের শরণাপন্ন হইয়াছিল কি না। যাহাই হউক, আজ নিশ্চয়ই তাহারা বুঝিতে পারিতেছেন ইহারা নপুংসক নহে, ইহারাও মানুষ মারিতে পারে।
যুগের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। আগে আন্দোলন করিত মানুষে, এখন দেখিতেছি ভিন্ন দৃশ্য। গুটিকতক পাড়া-মহল্লার ছিচকে সন্ত্রাসীর বরকতে ও পেট্রোল বোমা, ককটেলাদির সৌজন্যে বিনে মানুষেই দিব্যি কঠোর আন্দোলন চলিতেছে। সে আন্দোলনের কি ধার! আহ- কি ধার! দেশ-বিদেশে তুমুল তোলপাড় হইতেছে। পুলিশ, র‌্যাব ফেল মারিল দেখিয়া বিজিবি নামানো হইল, সবাই ভাবিল- বিজিবি ফেল মারিলে সেনা অনিবার্য। সত্য সত্যই বিজিবি ফেল মারিল, কিন্তু এ কি (!) সেনা নামিল না, নামিল আনসার- সংখ্যা ১২ হাজার। লাখো পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি তলিয়া যাইবার পরে আনসার কতটা ভাসিয়া রইবে তাহা সময়ই বলিয়া দিবে। আমি শুধু এইটুকুই বলিব যে, ইহা সমাধানের পথ নহে, ইহা আত্মহননের পথ। শক্তিবলে সমস্যার সমাধান হয় না- তাহা বলিতেছি না, তবে সব সমস্যার নহে। দয়া করিয়া এমন কিছু করিবেন না যাহার কারণে নিরীহ নিরাপরাধ ১৬ কোটি জনতাকে মরিতে হয়। শান্ত হউন। সহিংসতা-বোমাবাজী জনগণ চায় না। কিন্তু যাহারা উহা করিতেছে তাহাদের কার্যে বাধা প্রদান করিবার মনোবাসনাও তাহারা দেখাইতেছে না, কারণ প্রতিবাদ করিলে পাছে জীবনও হারাইতে হইতে পারে। এমতাবস্থায় যাহারা প্রকৃতই সমাধান চাহেন তাহাদের জন্য একমাত্র করণীয় দাঁড়ায়- ‘দেশ রক্ষার্থে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, র‌্যাব-পুলিশ-আনসার নহে, পারিলে সাধারণ মানুষগুলিকে রাস্তায় নামান, তাহা হইলে এমন কোনো সমস্যা থাকিবে না যাহা সমাধানের অযোগ্য।’

রাজনীতিতে বহুল আলোচিত সংলাপের কার্যকারিতা কতটুকু?

১. ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ বা ‘গণতন্ত্র হত্যা’ যাই বলা হোক দিবসটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভয়াবহ অস্থিরতা বাসা বেঁধেছে তা যেন কিছুতেই কাটছে না। গত ৩ জানুয়ারির পর থেকেই কার্যত সারা দেশ অবরুদ্ধ। প্রথম দুই দিন সরকারি দলের অঘোষিত অবরোধ এবং তারপর থেকে বিরোধী আন্দোলনকারী জোট বা ২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালীন অবরোধ কর্মসূচিতে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সরকার বিরোধী আন্দোলন কার্যত রূপ নিয়েছে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় যার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে সাধারণ নিরীহ জনগণ। আতঙ্ক বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সন্ত্রাস ও নাশকতা সীমা ছাড়াচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমজীবী, কবি, সাহিত্যিক, চাকুরিজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়াকর্মী কেউই এ সহিংসতার ভুক্তভোগী হতে বাকি নেই। সাধারণ মানুষের অসীম দুর্ভোগ, ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর অনিশ্চিয়তা, জাতীয় অর্থনীতির ক্রমাবনতি, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, রাস্তা-ঘাটে অনিরাপত্তা, বোমাতঙ্ক ও বার্ন ইউনিটের বীভৎসতা মানুষের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বারবার। সমাধান যেন সুদূরে অবস্থিত আকাশের চাঁদ। সর্বত্র একই অভিব্যক্তি, একই প্রশ্ন- কেন এই জাতিবিনাশী আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড? রাজ-রাজড়াদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় সাধারণ মানুষকে জীবন হারাতে হবে কেন?
২. বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ২০১৪’র ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিল। বিএনপির দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ২০১৩ সালের শেষ দিনটি পর্যন্ত হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতা চালিয়েও বিএনপি দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে পারে নি। ফলে দলটির ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যে নির্বাচনটি করেছিল সেটা ছিল কার্যত প্রতিপক্ষহীন, যা সংবিধান অনুযায়ী ঠিক থাকলেও গণতন্ত্রের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ২০১৪ সালব্যাপী দল গোছানোর কাজ করে ২০১৫ সালে এসে বিএনপি শুরু করল কথিত গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। আবারও জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, হরতাল, অবরোধের কবলে পড়ল সারা দেশ। গত ২৩ দিন যাবৎ সারা দেশ অবরুদ্ধ। অবরোধের মধ্যেই কখনো কখনো আসছে হরতালের ডাক। সহিংসতায় এ পর্যন্ত অগ্নিদদ্ধ হয়ে ও অন্যান্যভাবে ৩৮ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ সময়ে প্রায় ৭৬৯টির মতো যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে ও ভাঙচুর করা হয়েছে। রেলে নাশকতা চালানো হয়েছে কমপক্ষে ৫ দফায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। কিন্তু এত বিপর্যয়ের মধ্যেও বিএনপি ক্রমশই হার্ডলাইনে প্রবেশ করছে। এতে করে দেশব্যাপী বিএনপির জনসমর্থন নিয়ে শুরু হয়েছে টানাপোড়েন। ক্রমেই বিএনপির উপর থেকে সাধারণ মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। জনপ্রিয়তা হারিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দলটি। ওদিকে সরকারের তরফ থেকেও ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হওয়ায় বিএনপির আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিকভাবেই। অনেকেই মনে করছেন- বিএনপির এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বিএনপির পক্ষে যাবে না। কারণ, প্রথমত দলটি আন্দোলনের কথা বলে যা করছে তাকে সাধারণ মানুষ আন্দোলন ভাবতে পারছে না, ওটা সহিংসতা। দ্বিতীয়ত, বিএনপির এ আন্দোলনের পক্ষে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো স্বার্থ নেই। গণতন্ত্র রক্ষা বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ইত্যাদির সাথে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোনো লাভ-ক্ষতি জড়িয়ে নেই। ফলে জনস্বার্থহীন আন্দোলন রূপ নিয়েছে জনসম্পৃক্ততাহীন আন্দোলনে। আর এটা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় জনগণের সহযোগিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছাড়া কোনো সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল হতে পারে না। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- এ ধরনের জনসম্পৃক্ততাহীন সহিংস আন্দোলন থেকেই কিন্তু বিভিন্ন দেশে অতীতে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যার সুফল ভোগ করেছে একমাত্র বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদীরা।
৩. আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটা ছিল তা বোঝার উপায় ছিল না। কেননা কোনো প্রতিপক্ষ না থাকায় নির্বাচনের পূর্বেই ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন এবং যে কয়টি নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানেও বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনের কারণে খুব বেশি মানুষ ভোট দিতে পারে নি। ফলে ওই মুহূর্তে সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা ছিল কিনা তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ওই নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও বিভিন্ন জরিপের ফলাফল বিবেচনা করলে বোঝা যায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটা কমে গিয়েছিল। এ অবস্থা যে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে তা নয়। আজও মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের উপর ততটা আস্থাশীল নয় যতটা ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়। এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির অপপ্রচার। বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে একটি শ্রেণি আওয়ামী লীগ সরকারকে ইসলামবিদ্বেষী বা নাস্তিক্যের পৃষ্ঠপোষক বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে অপপ্রচার চালিয়েছিল যার রেশ আজও জনমনে গেড়ে আছে। তবে এটা ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি, রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা, ব্যাংক কেলেঙ্কারি, অঙ্গ সংগঠনের টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস এবং সর্বপরি দলীয় অনৈক্যসৃষ্ট অন্তর্ঘাত অনেকাংশেই সরকারের জনপ্রিয়তা ক্ষুণœ করেছে। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যেভাবে বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলোকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাকেও খুব ভালোভাবে নিচ্ছে না দেশের বোদ্ধামহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ। আসছে বৈদেশিক চাপও। বিশেষ করে বছরের শুরুতেই নিরাপত্তা প্রদানের নাম করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে বালু ও ইটের ট্রাক এনে খালেদাকে অবরুদ্ধ করে রাখা, খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের উপর পেপার ¯েপ্র নিক্ষেপ করা, ঢাকায় ও গাজীপুরে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়া, তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মির্জা ফখরুল ও একুশে টিভির চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার, দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মন্ত্রীদের লাগামছাড়া বক্তব্য-বিবৃতি ইত্যাদিকে সাধারণ মানুষ দেখছে বাড়াবাড়ি হিসেবে। বর্তমানে সারাদেশে অবরোধ ও হরতাল দিয়ে যে জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতা করা হচ্ছে এবং জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে তার জন্যও বিএনপির পাশাপাশি সরকারকেও দোষারোপ করছে সাধারণ জনগণ। সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারছে না বরং দিনকে দিন পরিস্থিতি সরকারের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশের অনেক জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে, পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, শত শত সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, স্থানে স্থানে তল্লাশি চলছে, সহিংসতাকারীদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, থানায় থানায় সরকার সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করেছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মানুষ এখনও নিজেদের অনিরাপদ ভাবছে। আর এ ব্যর্থতা যে সম্পূর্ণ সরকারের উপরই বর্তাবে তা আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না।
৪. সমাধানের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা দেশ। গণমাধ্যমে বা টেলিভিশন টক শো’তে যদিও এক শ্রেণির ব্যক্তিত্ব সমাধানের স্রোত বইয়ে দিচ্ছেন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- ওসব তত্ত্বকথা সরকার বা বিরোধী দল কাউকেই প্রভাবিত করছে না। প্রভাবিত করলেও যে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত তাও নয়। যে সংলাপের জন্য এক শ্রেণির মানুষ রীতিমত জান-প্রাণ উজার করে রাজনীতিকদের ডেকে চলেছেন প্রথমত বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সংলাপ হবার সামান্যতম পরিবেশও বজায় নেই, দ্বিতীয়ত সংলাপ হলেই তো হবে না, ফলপ্রসূও হতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখলে ফলপ্রসূ সংলাপের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এসব কারণে সাধারণ জনগণ এখনও দিশাহীন। কেউই জনগণের সম্মুখে সত্যিকার অর্থে কোনো আশার আলো তুলে ধরতে পারছেন না। যারা তৃতীয় পক্ষের ধুয়া তুলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা করছেন তাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতাও মানুষের অজানা নয়। কাজেই এভাবে যে সমাধান আসবে না তা সহজেই অনুমেয়।
৫. এমতাবস্থায় কোনো সমাধানের পথ সত্যিই আছে কি? আমি বলব আছে, একটিমাত্র পথ আছে এবং এটাই অনিবার্য পথ, চিরন্তন, শাশ্বত ও সনাতন পথ। সেটা হচ্ছে ঐক্য। দেশের ষোল কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যে মতবাদ, যে তত্ত্ব, যে তন্ত্র বা যে গোষ্ঠী মানুষের ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, মানুষকে অনৈক্য শেখায়, দলাদলী ও হানাহানি শেখায়, নিজ জাতির মানুষকে আগুনে পোড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, ক্ষমতার লোভে অন্ধ করে দেয় তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গুলি দিয়ে নয়, পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি দিয়ে নয়, জেল-ফাঁসির ভয় দেখিয়ে নয় সহিংসতা ও রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ করতে হবে ‘ঐক্য’ নামক অস্ত্র দিয়ে। জাতির অতীত দেখুন- ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এ জাতি যে যে সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সেই সেই সময় জাতি অর্জন করেছে, একইভাবে যে যে সময় এ জাতি অনৈক্যে পতিত হয়েছে পরাজয় ও দুঃখ-দুর্দশা দ্বারা সে সময়গুলো কলঙ্কিত হয়ে আছে। এ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদেরকে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আজ দেশে বিভীষিকাময় অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় অনৈক্যের কারণে। ভয় দেখিয়ে বা চাপ প্রয়োগ করে দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে এক টেবিলে বসাতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না, সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাবে মাত্র। আজ নয়তো কাল যে কোনো ইস্যুতে যে কোনো স্বার্থে আবারও দেশকে মৃত্যুখাদের উপত্যকা বানানো হবে। সুতরাং জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদেরকে দুর্বিষহ জীবনের দিকে ঠেলে দিতে পারবে না, বরং তাদের কথা মোতাবেকই রাজনীতি চলবে। যারা দিবা-রাত্রি হাসিনা-খালেদার আলোচনা বা সংলাপের অবাস্তব আশ্বাস প্রদান করে অর্ধঘুমন্ত জাতিকে বেঘর ঘুমে নিমজ্জিত করার পথ করে দিচ্ছেন তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে- যদি সত্যই জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে কিছু করার আশা থাকে তাহলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা করুন। ১৬ কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে পৃথিবীর বুকে কারও সাধ্য থাকবে না মানুষের জীবন ও সম্পদ নিয়ে নোংরা খেলায় মত্ত হবার। সুতরাং শুধু টিভি-টক শো, পত্র-পত্রিকা ও আলোচনা-বিবৃতির কথার ফুলঝুড়ি, সংলাপের তাগিদ বা উদ্বেগ প্রকাশের মধ্য দিয়ে নয়, দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটুক জাতির ঐক্যপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।
২৮.০১.১৫

তবে জঙ্গিরা কী দোষ করেছিল?

আদালতে বোমা, হাটে-বাজারে বোমা, রাস্তায় বোমা, ব্রিজে বোমা, বাসে বোমা, ট্রেনে বোমা, টিভি সেন্টারে বোমা, শত শত স্বজন হারানো মানুষের নিরূপায় আহাজারি, ভয় আর আতঙ্কের মাঝে করুণ দিনাতিপাত- পাঠক, এই ছিল দেশে ২০০৪ সালের জেএমবি জঙ্গিদের সহিংস উত্থানলগ্নের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। সে দিনগুলো ভুলে যাবার নয়। দেখা গেছে ওই সময় সারা দেশবাসী এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ফুঁসে উঠেছিল। সারা দেশের মিডিয়া একযোগে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিল এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিল। পিছিয়ে ছিল না বুদ্ধিজীবীরাও। তারা জাতির ওই দুর্যোগময় মুহূর্তে করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন একের পর এক সেমিনার, আলোচনা, কনফারেন্স বা বৈঠকের মাধ্যমে। ছিল আন্তর্জাতিক তৎপরতাও। লাখো মানুষের ক্ষোভ ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়েছিল ওই সব মানুষের প্রতি যারা মানবতার কবর রচনা করে জনজীবনকে দুর্বিসহ ও বিপর্যস্ত করে তোলে, বিনা অপরাধে সাধারণ মানুষের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। জঙ্গিদের অমন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে দেশের অনেক আলেম-ওলামাকেও তখন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে ও জঙ্গিদের বিচারের শক্ত দাবি ওঠাতে দেখা গেছে। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সামনে সরকারের টনক নড়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ ও সচেতন হয়েছিল। প্রশাসন চাইলে কত বড় পরিস্থিতির সুষ্ঠু মোকাবেলা করতে পারে তার প্রমাণও আমরা তখন পেয়েছি। আমরা দেখেছি প্রশাসনের সার্বিক প্রচেষ্টায় কীভাবে একের পর এক জঙ্গি গ্রেফতার হয় এবং দ্রুত বিচারে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়। খুব অল্প দিনের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন জঙ্গিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। হ্যাঁ, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যা করণীয় ছিল বাস্তবে আন্তরিকতার সাথে সেটাই করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে আমার প্রশ্ন নেই। আমার প্রশ্ন হলো- যে সন্ত্রাসী কাজ করার কারণে জেএমবি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল আজকের কথিত গণতান্ত্রিক দলের নেতাকর্মীরা আগাম ঘোষণা দিয়ে, দিন-তারিখ ঠিক করে প্রকাশ্য দিবালোকে ওই একই সন্ত্রাসী কাজগুলো করার পরও এদের বিরুদ্ধে সকলে নীরব কেন? ২০০৪ সালের জেএমবি সহিংসতার সাথে ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার পার্থক্য কী ছিল? আবার আজ ২০১৪ সালের প্রথম থেকেই দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তার সাথেই বা ২০০৪ সালের পার্থক্য কোথায়?
পত্রিকার পাতা খুলুন, দেখুন দেশব্যাপী কী ভয়ানক পরিস্থিতি বিরাজমান। ভয়াবহ সব সংবাদে খবরের পাতা আবৃত। আগাম ঘোষণা দিয়ে টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি করে পরিকল্পিতভাবে জনজীবনকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে। পথে-ঘাটে হুটহাট বোমা ফুটছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামছে। নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে নিরীহ ঘুমন্ত পরিবহনকর্মীকে, বাসযাত্রীকে; নির্বিচারে ভেঙ্গে চুরমার করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যানবাহন। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু চেহারায় উচ্ছ্বাস নেই, আছে ভয় ও শঙ্কা। আগুনের ভয়, বোমার ভয়, ইট-পাটকেলের ভয়। অফিসগামীরা অফিস যাচ্ছে, কিন্তু মনে শঙ্কা- ঠিকঠাক ফিরে আসতে পারবে তো? কেউবা পরিস্থিতি বুঝে অফিস ছুটি নিয়ে গ্রামের পথে রওনা দিচ্ছে, যদিও জানে না কবে এ যুদ্ধাবস্থা পরিবর্তন হবে, শান্তি ও স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা আদৌ ফিরে আসবে কি না। গ্রাম-গঞ্জের অবস্থাও কি ভালো? মোটেও নয়। আজকাল রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে মুক্ত নয় গ্রাম-গঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষগুলোও।
সাধারণ মানুষের কথা থাক, যে বিচারালয়ে আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয় মানুষের আস্থার প্রতীক সেই বিচারালয়েরই বইয়ের ভেতর থেকে যখন বোমা উদ্ধার করা হয়, বাথরুম থেকে গুলিসহ পিস্তল উদ্ধার করা হয় তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ওই জাতির নিরাপত্তার খুঁটি কতটা নড়বড়ে। শোনা যাচ্ছে সারা দেশ থেকে জেলা প্রশাসকগণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিজিবি চেয়ে আবেদন করেছেন, তাতে সাড়া দিয়ে সরকার অনেক জেলাতে বিজিবি পাঠিয়েছেও। অবস্থাটা বিবেচনা করুন। সারা দেশ নিরাপত্তহীনতায়। খুব প্রয়োজন ছাড়া অনেকে বাড়ির বাইরে আসছেন না। হয় হরতাল-অবরোধ, নয়তো সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ, সংঘর্ষ- প্রতিদিনই দেশে কিছু না কিছু ঘটেই চলেছে। ঘটছে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, সারা দেশজুড়েই, এক সাথে, এক দিনে। কিন্তু আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে মানুষ নীরব, মিডিয়া নীরব, বুদ্ধিজীবী নীরব, আন্তর্জাতিক অঙ্গন নীরব। কেন নীরব? কারণ যা হচ্ছে তা ইসলামের নামে বা ধর্মের নামে হচ্ছে না, হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে। এখানেই আসল বিষয়। ভাবখানা এমন যে, বোমা মারো, মানুষ মারো, জ্বালাও-পোড়াও করো, উগ্রবাদী মিছিল, হামলা, সংঘর্ষ, মারামারি-কাটাকাটি সবই করো, কিন্তু করো গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। তাহলেই কোনো সমস্যা হবে না, বাধা দেওয়া হবে না। বাধা তো আসবেই না, বরং মানুষের সমর্থন মিলবে, পশ্চিমাদের আশীর্বাদ মিলবে, মিডিয়া পক্ষে লিখবে। কিন্তু খবরদার। ভুলেও এসকল কাজ ধর্মের জন্য করো না। করলে মহাঅন্যায় হবে। মিডিয়া ব্যাপক-প্রচার প্রচারণা চালাবে, মাথার উপর পশ্চিমা যুদ্ধবিমান উড়বে, দেশের মানুষে একযোগে ফুঁসে উঠবে, আলেম-মোল্লারাও ক্রুদ্ধ হবে, তেড়ে আসবে, মারবে, জেলে দেবে, ফাঁসি দেবে।
আমি বলছি না যে, ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে যারা সন্ত্রাস করে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো যাবে না। তারা অবশ্যই আইনানুগ শাস্তির যোগ্য। অন্যায় করলে তার শাস্তি তাকে পেতে হবে, তা যেই করুক না কেন, যে উদ্দেশ্যেই করুক না কেন। ধর্মের জন্য করেছে তাই সে জঙ্গি, উগ্রবাদী, আর গণতন্ত্র আনয়নের জন্য করেছে তাই সে উদারবাদী-সম্মানিত- তা তো হতে পারে না। উভয়ক্ষেত্রেই একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। আজ কি জেলায় জেলায় বোমা ফুটছে না? পুলিশ মরছে না? আদালতে, সম্মানিত ব্যক্তির বাসায় বোমা ফুটছে না? বাস-ট্রাক, ট্রেনে নাশকতা হচ্ছে না? জনমনে আতঙ্ক, ভয়, ভীতির উদ্রেগ হচ্ছে না? ছেলে-মেয়েদের শিক্ষায় বাধা আসছে না? ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘœ ঘটছে না? আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে না? এসব যদি ন্যায় হয়, উচিত কাজ হয় তাহলে তো জঙ্গিদেরও কোনো দোষ দেয়া যায় না। তারা তাহলে কী দোষ করেছিল? কোন দোষে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হলো? আর যদি এসব কাজকে অন্যায় ও সন্ত্রাস বলা হয় তাহলে যারা এসব করছে তাদেরকেও সন্ত্রাসী বা উগ্রপন্থী বলতে হবে। এদের বিরুদ্ধেও সারা দেশের ফুঁসে ওঠা উচিত।
শুধু আজ নয়, বছরের পর বছর ধরে আমাদের রাজনীতিক টাইমলাইনে এ ধরনের কর্মকাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। অতীতে হয়েছে, আজ হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে না তা বলা যাচ্ছে না। কোনো নির্দিষ্ট দল নয়, গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো প্রায় সব দলকেই আমরা কোনো না কোনো সময় এ ধরনের সন্ত্রাসী কাজ-কর্মে লিপ্ত হতে দেখেছি। কিন্তু তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখা তো দূরের কথা মানুষ হাসিমুখে ভোট দিয়েছে, নির্বাচিত করেছে, প্রকারান্তরে আরেকটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পথ তৈরি করে দিয়েছে। কেন এ জনবিরোধী কাজ অনায়াসে চলে আসছে আর আমরা ষোল কোটি বাঙালি তা মাথা পেতে নিচ্ছি? গণতন্ত্রের নামে এ প্রতারণা আর কতকাল দেখব?

ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে ‘পিকে’র অবস্থান প্রশংসনীয়

রাজকুমার হিরানী পরিচালিত ও আমির খান অভিনীত ‘পিকে’ সিনেমাটি ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসে একমাত্র সিনেমা যেটার আয় দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ৫০০ কোটি রূপিতে পৌঁছেছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে এখনও ছবিটির হাউজফুল প্রদর্শনী অব্যাহত রয়েছে। মুক্তির আগে থেকেই আলোচিত এই ছবিটি আলোচনা-সমালোচনাতেও যেন রেকর্ড করতে চাইছে। ছবিটির বিষয়বস্তুই সকল আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আবার ওই বিষয়বস্তুর কারণেই ছবিটির এত প্রচার-প্রচারণা ও ব্যবসায়িক সফলতা আসছে। অভিযোগ উঠেছে যে, ছবিটিতে হিন্দু ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। এ অভিযোগে একের পর এক মামলা খেয়ে যাচ্ছেন ছবির পরিচালক রাজকুমার হিরানী ও আমির খান। ভারতের দিল্লি, আগ্রা, হায়দ্রাবাদ, আহমেদাবাদ, ভোপাল ইত্যাদি এলাকায় ছবিটির প্রদর্শনী বন্ধ করার দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতাও চালিয়েছে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী দল। কেউ ছবিটিতে হিন্দু ধর্মের অবমাননা দেখছেন, কেউ কথিত লাভ জেহাদের গন্ধ পাচ্ছেন, আবার কেউ হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাষ পাচ্ছেন। ছবির প্রধান চরিত্র ‘আমির খান’ মুসলিম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এবং একটি দৃশ্যে পাকিস্তানিদের সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করাকেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে অনেক হিন্দুত্ববাদী দলের নেতা-কর্মীরা।
যাই হোক, মূল আলোচনায় আসা যাক। পিকে সিনেমার মূল বিষয় হচ্ছে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা। ছবিটির মুক্তির আগেই পরিচালক হিরানী বলেছিলেন, তার ছবিটি ধর্মব্যবসায়ীদের খোঁচাবে। একই বিষয়বস্তুর ‘ও মাই গড’ নামের একটি সিনেমা এর আগেও ভারতে মুক্তি পেয়েছিল, যে ছবিটিতে ধর্মব্যবসায়ীদের স্বরূপ উপস্থাপনের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষ যাতে তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতারণার শিকারে পরিণত না হয় সে ব্যাপারে সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া হয়েছিল। পিকের কাহিনী কিছুটা ভিন্ন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ‘ও মাই গড’ সিনেমার ব্যবহার্য বেশ কিছু যুক্তি-তর্ক পিকেতেও ভিন্ন আঙ্গিকে স্থান পেয়েছে।
পিকে ছবিটির বিষয়বস্তু মোটামুটি এরকম যে, “একজন ভিন গ্রহের এলিয়েন (আমীর খান) পৃথিবীতে এসেছে। পৃথিবীতে এসে প্রথম সে যে ধাক্কাটি খায় তা হচ্ছে- তার লকেটসদৃশ রিমোট কন্ট্রোলার চুরি হয়ে যাওয়া। ওই রিমোট ছাড়া সে তার গ্রহে ফিরে যেতে পারবে না। শুরু হয় খোজা-খুজির পালা। এদিকে তার চলাফেরা, কথা-বার্তা অর্থাৎ হাবভাব দেখে লোকে তাকে (আমির খান) পিকে বলে ডাকতে শুরু করে। পিকে অর্থ মাতাল। ভিন গ্রহ থেকে আসায় পৃথিবীর মানুষের জীবনাচারের সাথে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। তার কাজকর্ম সাধারণ মানুষের চোখে অনেকটা মাতালের মতই দেখাচ্ছিল। যাই হোক, পিকে চোরের খোঁজে রাজস্থান থেকে দিল্লিতে পাড়ি জমায়। সেখানে এক পুলিশ স্টেশনে গেলে পুলিশ তাকে সাফ জানিয়ে দেয়- ওই চোর খুঁজে বের করা অসম্ভব। কারণ- পুলিশও মানুষ, ভগবান নয়। পিকে অবাক হয়। কিছুটা হতাশও। এরপর সে যেখানেই যায়, যাকেই জিজ্ঞাসা করে, সবাই এক কথাই বলে- ভগবানই কেবল তোমার সমস্যার সমাধান করতে পারবে, কাজেই ভগবানকে ডাকো, ভগবানের উপর ভরসা রাখো। পিকে এলিয়েন। সে জানে না ভগবান কে। তাই এবার সে ভগবানের সন্ধান করার চেষ্টা করল। কে জানে হয়তো ভগবানই তার হারানো রিমোট কন্ট্রোলার বের করে দিতে পারবে। সে নিশ্চিন্তে ফিরে যেতে পারবে নিজ গ্রহে।
অল্প দিনেই পিকে বুঝে গেল ভগবানের অনেক ঘর আছে যেগুলো মন্দির নামে পরিচিত। সে একটি মন্দিরে গিয়ে দেখল- হাজার হাজার মানুষ মন্দিরে যাচ্ছে নিজ নিজ সমস্যার সমাধান করে নিতে। মানুষগুলো মন্দিরে হুড়োহুড়ি করে ঢুকে টাকা রাখার বাক্সে টাকা রাখছে, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে। পিকে ভাবল- ভগবানের তো বিরাট কারবার। হাজার হাজার মানুষ তাঁর কাছে আসছে-যাচ্ছে, নির্দিষ্ট জায়গায় টাকা-পয়সা দান করছে, আর ভগবান সকলের সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন। যদিও পিকে কারও সমস্যার সমাধান হতে দেখেনি তবুও সে মনে করল- সমস্যার সমাধান না হলে এমনি এমনি তো আর এত মানুষ এখানে আসতো না। এই যুক্তিতে পিকেও চেষ্টা করল। কিন্তু তার সমস্যার সমাধান হলো না, মন্দিরে টাকা দান করে ও প্রসাদ অর্পন করেও রিমোট কন্ট্রোলার পাওয়া গেল না। ভগবানের প্রতি তার অভিমান হলো, কেননা ভগবান রিমোট কন্ট্রোলার দেয় নি, অথচ টাকা অগ্রিম নিয়ে নিয়েছে। সে হতাশ হলো। থানায় গেল ভগবানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করতে। কিন্তু থানায় মামলা নেওয়া হলো না। বরং তাকে গীর্জায় গিয়ে প্রার্থনা করতে অনুরোধ করা হলো। সে সরল মনে গীর্জায় গেল। কিন্তু নিয়ম-কানুন জানা না থাকায় সে মন্দিরে যা করেছিল তা গীর্জায় করায় তাকে বের করে দেওয়া হলো। একইভাবে সে যখন মসজিদে যেতে চাইল তখনও আনুষ্ঠানিকতায় ভুল করায় তার বিরুদ্ধে মুসলমানরা উত্তেজিত হয়ে গেল। সে জীবন বাঁচিয়ে পালালো। পিকের যেন হতাশা কাটছেই না। এ কোন পৃথিবীতে এসেছে সে? এখানকার মানুষগুলো এমন কেন? কেউ বলছে ঈশ্বর মন্দিরে থাকেন, কেউ বলছে গীর্জায় থাকেন, কেউ বলছে মসজিদে। এক এক সম্প্রদায়ের কাছে ঈশ্বর এক এক রকম। ঈশ্বরকে ডাকার রীতিও ভিন্ন ভিন্ন। যে রীতিতে মন্দিরে প্রার্থনা করা হচ্ছে সে রীতি গীর্জায় অচল, যে রীতি গীর্জায় কঠোরভাবে মেনে চলা হয় সে রীতি মসজিদে কল্পনাও করা যায় না। পিকে বারবার বিভ্রান্ত হতে থাকে। সব থেকে অবাক করা বিষয় হচ্ছে- মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী প্রতারণা করে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। এসব দেখে পিকে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায়।
পিকে আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করে- ‘হে ভগবান, আমি তো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। আমি হয়তো কোথাও কোনো ভুল করছি, যে কারণে আমার কথা তোমার কাছে পৌঁছুচ্ছে না। আমাকে পথ দেখাও ভগবান, প্লীজ। আমি ঘণ্টা বাজিয়ে তোমাকে জাগিয়ে প্রার্থনা করি, গীতার স্লোক পড়ি, কোর’আনের আয়াত পড়ি, বাইবেলের ভার্স পড়ি। কিন্তু তোমার আলাদা আলাদা ম্যানেজার ভিন্ন ভিন্ন পথ দেখায়। কেউ বলে সোমবারে উপবাস কর, কেউ বলে মঙ্গলবার। কেউ বলে সূর্য ডোবার আগেই খাবার খাও, আবার কেউ বলছে সূর্য ডোবার পর রোজা ভাঙ্গো। কেউ বলে গরুর পূজা করতে, কেউ বলে গরু বলি দিতে। কেউ বলে খালি পায়ে মন্দিরে যেও না, কেউ বলে বুট পায়ে চার্চে যাও। এর মধ্যে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল তা বুঝতে পারছি না। আমি তো হতাশ হয়ে গেলাম, আমাকে আমার গ্রহে ফিরে যেতে হবে। তুমি যা বলবে আমি তা-ই করব, শুধু আমার রিমোট কন্ট্রোলারটি ফিরিয়ে দাও।’
এরপর একদিন পিকে দেখল তার হারিয়ে যাওয়া রিমোট কন্ট্রোলার এক ধর্মগুরুর কাছে আছে। ওই ধর্মগুরু বলছে- ওটা সে তপস্যা করে পেয়েছে এবং ভগবান ওটাকে কোনো এক মন্দিরে স্থাপন করতে বলেছেন। ভগবান নাকি আরও বলেছেন যে, যে ভক্ত ওই বস্তুটি দেখবে তার দুঃখ দুর্দশা দূর হয়ে যাবে। পিকে ওই ধর্মগুরুর কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ করল ওই বস্তুটি তাকে দিয়ে দিতে। কিন্তু তাকে দেওয়া হলো না। দেওয়া তো হলোই না, উল্টো পিকে’কে বেদম প্রহার সহ্য করতে হলো। এদিকে পিকে’র জ¹ু (আনুশকা শর্মা) নামের একজন বন্ধু জোগাড় হয়ে গেল যে একটি টিভি চ্যানেলে কাজ করে। জ¹ু এগিয়ে এল পিকেকে সাহায্য করতে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে কীভাবে প্রতারণার জাল বিস্তার করা হচ্ছে তা টেলিভিশন চ্যানেলে তুলে ধরার চেষ্টা করল পিকে ও তার বন্ধু জ¹ু।
পিকে দাবি করল- মানুষ আজ ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য যে কাজগুলো করছে সেগুলো ‘রং নাম্বারে’ ফোন দেওয়ার মতোই অর্থহীন। ‘রং নাম্বারে’ ফোন দিলে যেমন কেউ কাক্সিক্ষত লোকের সাক্ষাৎ পায় না, তেমনি এসব করে কেউ ঈশ্বরের কাছে যেতে পারবে না। ঈশ্বর কোনোদিন বলবেন না যে, তোমার সমস্যা হয়েছে, এসো- আমার ঘরে এসে গড়াগড়ি দাও, সমস্যার সমাধান করে দেবো। ঈশ্বর এ কথা বলতে পারেন না যে, আমার গায়ে দুধ ঢালো তাহলে তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হবে। এ সবই রং নাম্বারের ফসল। সঠিক নাম্বারে যোগাযোগ হলে ঈশ্বর অবশ্যই এ কথা বলতেন যে, আমার মাথায় দুধ না ঢেলে তোমার আশে পাশে যে বুভুক্ষু শিশুটি না খেয়ে পড়ে আছে তাকে ওই দুধ খাওয়াও, তোমার মঙ্গল হবে।
পিকে বুঝল মানুষ ধর্মব্যবসায়ীদের কথা শুনছে এবং অর্থ-সম্পদ দিয়ে ধর্মব্যবসায়ীদের উদরপূর্তি করছে শুধুই ভয় থেকে। ধর্মব্যবসায়ীরা স্বর্গ ও নরকের ভয় দেখিয়ে এই মানুষগুলোকে তাদের কাছে আসতে বাধ্য করছে। জ¹ুর বাবার সামনে চাক্ষুস প্রমাণ দেওয়ার জন্য একদিন পিকে ও জ¹ু জ¹ুর বাবাকে একটি কলেজে নিয়ে গেল। সেদিন ছিল ওই কলেজের পরীক্ষা। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা নিয়ে খুব ভয়ে-আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছিল। পিকে কি করল, সে কলেজের গেটে পরিত্যাক্ত একটি পাথরখণ্ড ও তার মাথায় পানের পিক লাগিয়ে পাথরটিকে খাড়া করে বসিয়ে মন্দির খুলে বসল। সামনে রাখা হলো টাকা রাখার পাত্র। দেখা গেল শিক্ষার্থীরা ওই সদ্য বানানো কৃত্রিম মন্দিরে গিয়েই যে যতটা পারল টাকা-পয়সা দান করতে লাগল এবং প্রার্থনা করতে লাগলো। এক সময় সেখানে ভীড় জমল। টাকার পরিমাণও বাড়তে থাকলো ক্রমেই। পিকে এ দ্বারা প্রমাণ করল যে, মানুষ বিভিন্ন ধর্মব্যবসায়ীদের কথা শুনছে তার কারণ হলো ওই ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষকে জাহান্নাম বা নরকের ভয় দেখিয়ে রেখেছে। তারা বলেছে- আমাদের কাছে না আসলে, আমাদের কথা না শুনলে নরকে যেতে হবে, আগুনে দগ্ধ হতে হবে ইত্যাদি। ফলে ওই ভয় থেকে মানুষ অর্থ-সম্পদ দান করে আর তা আত্মসাৎ করে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী। যার ভয় বেশি সে দান করে বেশি, ফলে ধর্মব্যবসায়ী তার দ্বারা লাভবানও হয় বেশি।
এসব যুক্তি-প্রমাণ টিভিতে তুলে ধরার কারণে সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। মানুষ সচেতন হতে শুরু করল। ধর্মব্যবসায়ীদের অর্থপ্রদান করা বন্ধ করে দিল। দেখা গেল যে টাকার বাক্সে আগে মানুষ কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতো সেখানে টাকা তো পড়েই নি, বরং শত শত প্রশ্ন জমা পড়েছে, মানুষের ভুল ভাঙছে। ফেসবুক-ব্লগে ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে। এসব দেখে ধর্মব্যবসায়ী ওই গুরু বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। সে পিকেকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
টেলিভিশনে উভয়ের বিতর্কের আয়োজন হয়। বিতর্কে ওই ভণ্ড ধর্মগুরু অভিযোগ করে যে, পিকে চায় না ঈশ্বর থাকুন। সে আজ ঈশ্বরের সন্ধানে পোস্টার বিলি করছে, কাল এও বলতে পারে যে, ঈশ্বর মরে গেছেন। ঈশ্বর বলছেন- এই বস্তু (রিমোট কন্ট্রোলার) ঈশ্বরের দান, আর এ বলছে তার নিজস্ব সম্পত্তি, ঈশ্বর বলছেন- মন্দির বানাও আর এ বলছে মন্দির হঠাও। কাজেই এর মতো একজন মানুষের কথা শুনে আমি আমার ঈশ্বরের আদেশের লঙ্ঘন করতে পারি না। এক সময় ওই ধর্মগুরু পিকেকে উদ্দেশ্য করে বলে- তুমি কি জানো মানুষের কত দুঃখ, কত চাওয়া, কত মানুষের খাবার নেই, মাথার উপর চাল নেই, বন্ধু নেই। এই মানুষগুলোর একমাত্র বন্ধু হলো ঈশ্বর। তারা ঈশ্বরকে ভরসা করে বেঁচে থাকে, ঈশ্বরের ভালোবাসায় তাদের অন্তর সিক্ত হয়। আর তুমি কিনা তাদের ঈশ্বরকে কেড়ে নিতে চাইছো? তুমি তো সারাক্ষণ ‘রং নাম্বার রং নাম্বার’ কর। আচ্ছা এবার বল তো সঠিক নাম্বার কোনটা?
পিকে এবার মুখ খোলে। সেও যে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে এবং ঈশ্বরকে তার বন্ধু বলে মনে করে তা ব্যক্ত করে পিকে প্রশ্ন করে- কিন্তু কোন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করব? যে ঈশ্বর আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন তার ব্যাপারে আমার কোনো কথা নেই, কিন্তু যে ঈশ্বরকে আপনারা সৃষ্টি করেছেন সে ঈশ্বর আপনাদের মতোই মিথ্যুক, ঘুষখোর, পক্ষপাতী। (কাজেই ওই ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না)। আর সঠিক নাম্বারের কথা বলছেন? সঠিক নাম্বার খুব সোজা। সেটা হলো- যে ঈশ্বর আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সেই ঈশ্বরকে বিশ্বাস করা, আর যে ঈশ্বরকে আপনারা (ধর্মব্যবসায়ীরা) সৃষ্টি করেছেন তাকে সরিয়ে ফেলা।
চ্যালেঞ্জে ‘পিকে’ জয়ী হয়। তার হারানো রিমোট কন্ট্রোলার ফিরে পায়। এরপর পিকে তার বন্ধু জ¹ুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার নিজ গ্রহে ফিরে যায়। কিন্তু সে প্রমাণ করে যায় যে, আজ ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতি পদে পদে প্রতারিত হচ্ছে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠী জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে।” ভারতের চলচ্চিত্র জগতে ‘পিকে’ এক প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা বলাই যায়। এ আলোড়ন হচ্ছে কয়েক দিক দিয়ে। প্রথমত, ইতিহাসের সর্বাধিক ব্যবসায়িক সফলতা, দ্বিতীয়ত আলোচনা-সমালোচনা। ছবিটিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি শহরে ভাঙচুরও হয়েছে। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষই মনে করছেন যে, ছবিটিতে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো কোনো দৃশ্যের অবতারণা ঘটে নি। ছবিতে সকল ধর্মেরই ধর্মব্যবসায়ী ভণ্ড প্রতারক শ্রেণির বিরোধিতা করা হয়েছে। কাজেই ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের জন্য এ ছবি কোনো হুমকি নয়। ইতোমধ্যেই দিল্লি হাইকোর্টও জানিয়ে দিয়েছে যে, পিকে তে আপত্তিকর কিছু নেই।
ভারতীয় উপমহাদেশের জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবেই ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ভারতে যে দল ক্ষমতায় আসীন রয়েছে সেই বিজেপি’ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলের মানুষ সর্বদাই ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী মানুষের এই ধর্মবিশ্বাসকে ভুল পথে পরিচালিত করে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ কাজে মিডিয়াকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ‘ও মাই গড’ কিংবা ‘পিকে’ ছবিগুলো সেই দায়িত্ব যদিও কিছুটা হলেও পালন করছে, তবে এই গোলক ধাঁধা থেকে মুক্তির বাস্তবসম্মত পথ কিন্তু এই ছবিগুলোতে উঠে আসে নি। কারণ এমন পথনির্দেশ করা মোটেও সোজা কথা নয়। তবে সঠিক পথ যা-ই হোক, তা বাস্তবায়নের জন্য সমাজের সকল স্তরের সচেতন মানুষের যৌথ প্রয়াস আবশ্যক।

ফেতনা নয় যুদ্ধ চাই (রম্য)

প্রিয় রাজনীতিকবৃন্দ,
আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আমি আপনাদের শাসিত রাজ্যের এক ক্ষুদে প্রজা। আপনাদের শুভাকাক্সক্ষীও বটে। আমি জানি আপনারা নিজ নিজ দল ও দলের আগামী কর্মসূচি নিয়ে বেশ ব্যস্ত ও উত্তেজিত সময় অতিক্রম করছেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য রাজনৈতিক অভিধানের যত মাসলা-মাসায়েল ও ধারা-উপধারা আছে তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। কারণ কেউ জানে না কোন মাসায়েলে প্রতিপক্ষ নাস্তানাবুদ হবে। এমতাবস্থায় আপনাদের বিরক্ত করা এক প্রকার অপরাধই বটে। তাই অনাকাক্সিক্ষত বিরক্তির উদ্রেগ করার কারণে প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি। দয়া করে ক্ষমা মঞ্জুরপূর্বক এ অধমের কিছু কথা শুনবেন। আপনাদের আমাদের সকলের ভালোর জন্যই কথাগুলো বলা।
আসলে আমি একটি প্রস্তাবনা পেশ করতে চাই। তবে তারও আগে বলতে চাই কেন প্রস্তাবনা পেশ করতে চাচ্ছি। কারণ প্রজা হয়ে রাজার কাছে প্রস্তাব নিবেদন করা যা তা ব্যাপার নয়। উপযুক্ত কারণ না দেখাতে পারলে এ কাজকে রাজা তার অবমাননা হিসেবেও গণ্য করতে পারেন। তাই আমি রাজনীতিক মহোদয়গণের সুদৃষ্টি কামনা করে প্রস্তাব নিবেদনের কারণটি ব্যক্ত করছি। আশা করছি তা শোনার পর মহোদয়গণ আমার প্রতি সদয় হবেন।
নির্বাচনের এক বছর পর এসে আবারও আগামী ৫ জানুয়ারি নিয়ে আপনারা রাজনীতিকবৃন্দ ব্যাপক হম্বিতম্বি শুরু করেছেন। অনেকেই বলছেন এবার নাকি গত বছরের চেয়েও ভয়াবহ আন্দোলন (আমার আশঙ্কা হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, বাসে আগুন, মানুষ পোড়ানো ইত্যাদি) হবে। হাত ভাঙ্গা হবে, পাও ভাঙ্গা হবে, কল্লা কাটা হবে। যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই পুঁতে ফেলা হবে। অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ কথাগুলো শুনে ভয়ে-আতঙ্কে আমার গায়ের লোম তরতর করে খাড়া হয়ে যাচ্ছে। তীব্র শীতেও শরীর ঘেমে যাচ্ছে। সুরা, কেরাত, দোয়া-দরুদ তো কম পড়লাম না কিন্তু কিছুতেই যেন মনকে স্থির করতে পারছি না। কেন জানি বারবার ২০১৩ সালের কথা মনে পড়ছে। ওই দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়লে আজও ভয়ে আমার শরীর কেঁপে ওঠে। জানের ভয় কার নেই বলুন? বাঘ-সিংহেরও জানের ভয় আছে, আমি তো মানুষ, ভয়ই যার বড় শত্র“। কিন্তু এই ভয়ের মধ্যেই হঠাৎ আমার মাথায় একটি প্রশ্নের উদয় হলো; আর ওই প্রশ্ন থেকেই আসলো প্রস্তাবনা।
আমি ভাবলাম- এই যে আমাদের রাজনীতিক মহাশয়রা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এতদিন নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, বোমাবাজী, হামলা, সংঘর্ষ ইত্যাদি করলেন এবং আগামীতেও আরও ব্যাপকভাবে তা চালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই কর্মকাণ্ডকে আসলে কী নামে অভিহিত করা যায়? যুদ্ধ নাকি ফেতনা? যেমন ধরুন, যুদ্ধ হবার জন্য স্পষ্ট দু’টি পক্ষের প্রয়োজন। সেটা আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে সদা-সর্বদা বিদ্যমান। তেল ও জলের মিশ্রণের মতো একত্রে থেকেও যেন হাজার মাইলের দূরত্বের প্রতিফলন ঘটে তাদের কাজকর্মে। কাজেই যুদ্ধের প্রথম শর্ত অনুযায়ী পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। যুদ্ধের আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ হয়ে থাকে স্পষ্ট এবং তা অবশ্যই যুদ্ধের ময়দানে, লোকালয়ে নয়। যারা প্রকৃত যোদ্ধা তারা কেবল শত্র“পক্ষের সেনাকেই আক্রমণ করে, শত্র“ব্যুহ বিধ্বস্ত করাই থাকে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তারা কখনোই শত্র“র আক্রমণের জবাবে দস্যুবাহিনীর মতো সাধারণ নিরাপরাধ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে না, জান-মাল কেড়ে নেয় না। এখানে ওখানে চোরা গোপ্তা হামলা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে না। এসব কাজকে আর যাই হোক যুদ্ধ বলা চলে না। এগুলো নিঃসন্দেহে ফেতনা, যুদ্ধের চেয়েও যার ভয়াবহতা বহুগুণ বেশি। কারণ যুদ্ধের শেষ আছে ফেতনার শেষ নেই। কোনো কোনো যুদ্ধের পেছনে মহৎ উদ্দেশ্যও থাকে, কিন্তু ফেতনা হয় শুধুই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ আদায়ে।
এতসব চিন্তা করে অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে- আপনাদের কাজকর্মগুলোকে ফেতনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আপনারাও একবার ভাবুন। প্রায় সারা দেশ জুড়েই আপনাদের বিশাল কর্মী বাহিনী ছড়িয়ে আছে। আছে থাকুক, সমস্যা নেই। কিন্তু যেই না আপনারা তাদের গলায় কোনো গরম ইস্যু ঝুলিয়ে দেন, পকেট ভর্তি টাকা পয়সা আর ঝোলা ভর্তি ছোটখাট বিস্ফোরকের মাধ্যমে ফুল চার্জ করে মাঠে ছেড়ে দেন তারা মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয় ভয়ংকর ক্যাডার বাহিনীতে। তারা রাতের অন্ধকারে প্রতিপক্ষ দলের উপর হামলা করে, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়, মুহূর্তে হাওয়ায় মিশে যায়। আবার দেখা হয় রাজপথে, হাতে ককটেল কিংবা পেট্্রল বোমা। ছুঁড়েই উধাও। পাছে শত্র“পক্ষের হাতে ধরা পড়ে যেতে হয়। একবার ধরা পড়লে সাপ পেটানো থেরাপি উপভোগ করতে হবে তা সকলেই জানে। এদিকে আরেক পক্ষ তো জ্বলে-পুড়ে মরছে। ‘ধর শালারে মার শালারে’ ছাড়া মুখে কথাই নেই। এদের অতুলনীয় মেধা। সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা দেখে কোন পার্টির লোক তা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে। তারপর শত্র“পক্ষের হলে তো বুঝতেই পারছেন। এখন বলুন এদের এই দেশ কাঁপানো কর্মকাণ্ডকে কেউ যুদ্ধের মর্যাদা দিতে পারে? আচ্ছা, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। আমাকে এখন বলুন এই হামলা, সংঘর্ষ, বোমাবাজী, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, হত্যা- এসবের শেষ কোথায়? আগামী দশ বছর বা বিশ বছর পর আপনাদের এই ফেতনাবাজী শেষ হবে- এমন কোনো সময় বেঁধে দিতে পারবেন কি? পারবেন না। যেহেতু পারবেন না কাজেই শুনুন। আমি একটি ভালো আইডিয়া বের করেছি। এ আইডিয়া দ্বারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
আমি দেখলাম- আপনারা শুধু শুধুই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দলবাজী করে নিজেদেরই বদনাম কামাই করছেন। এর চেয়ে বরং একটি কাজ করুন- আপনারা দু’পক্ষ একে অপরের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে দিন। দেখুন আপনাদের কাজকর্মের ফলে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তাকে এক প্রকার যুদ্ধাবস্থাই বলা চলে। কিন্তু এতে কারোই কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ছে। এর চেয়ে কি এটাই ভালো নয় যে, আপনারা এই বিরোধকে একটি সুশৃঙ্খল ধারায় প্রবাহিত করবেন? আজ আপনারা যারা নিজেদের বীরত্ব দেখাতে এখানে ওখানে বোমা ফাটান অথবা বিরোধী পক্ষের একজনকে একা পেয়ে নিজেদের কব্জার জোর প্রদর্শন করেন তাদেরও একটি সুযোগ আসবে নিজেদের প্রকৃত শক্তি বা বীরত্ব প্রদর্শনের। কার হাতে কত জোর আছে আমরা আম পাবলিকরাও আরেকটু ভালোভাবে গ্যালারী থেকে দেখার সুযোগ পাব। যুদ্ধ করার মতো কারণের তো অভাব নেই। সকাল-বিকাল, ঘণ্টায় ঘণ্টায় কত ইস্যুই না সৃষ্টি হয়। ওরই একটিকে সূত্র ধরে যুদ্ধ শুরু করুন। হয়তো ভাবছেন কীভাবে যুদ্ধ করবেন, যুদ্ধের নিয়ম-শৃঙ্খলা কী হবে, ফলাফল কী হবে? এসব নিয়ে কোনো চিন্তার প্রয়োজন নেই। ওটা আমি প্রস্তুত করেই রেখেছি। যখন ভাবলাম আপনাদেরকে ফেতনা সৃষ্টি বন্ধ করে যুদ্ধ করার প্রস্তাব দেব তখন থেকেই আমি আর এক মুহূর্তও সময়ক্ষেপণ করি নি। কীভাবে যুদ্ধ হবে তার একটা রূপরেখা মোটামুটি নিজের মতো করে দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। এ নিয়ে আপাতত আপনাদের কোনো চিন্তা করতে হচ্ছে না। অবশ্য পছন্দ না হলে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন-পরিবর্ধন করে নিতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন প্রযোজ্য হবে না। এখন শুনুন প্রস্তাবিত সম্ভাব্য যুদ্ধের পালনীয় নিয়ম-শৃঙ্খলাসমূহ:
যুদ্ধ হবে লোকালয়ের বাইরে কোনো এক জনশূন্য স্থানে। এবার আর রাস্তা-ঘাটে বা হাটে-বাজারে যুদ্ধের সুযোগ পাবেন না। এ জন্য আপনারা সারা দেশ খুঁজে শুকিয়ে যাওয়া কোনো নদীর চর বেছে নিতে পারেন। এ যুদ্ধে যোগদান করার জন্য কোনো সাধারণ মানুষের উপর জোর করা যাবে না এবং যুদ্ধকালীন সময়ে এমন কিছু ঘটানো যাবে না যাতে যুদ্ধসংশ্লিষ্ট নয় এমন কারও সামান্য পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়। তবে যুদ্ধের পূর্বে উভয় পক্ষই নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী ক্যাম্পেইন করে, হাটে-বাজারে, বাড়ী-বাড়ী ঘুরে মানুষকে নিজেদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারবেন। কিন্তু মানুষ যাকে পছন্দ হয় কেবল তার পক্ষেই লড়বে। এমনও হতে পারে যে, যুদ্ধে প্রাণের ভয় আছে দেখে হয়তো খোদ নিজ দলের অনেক হোমড়া-চোমড়া নেতাও দল ত্যাগ করে নির্বিবাদী সাধারণ মানুষ হয়ে যেতে পারেন, আবার এমনও হতে পারে যে, দেশের ষোল কোটি মানুষই আট কোটি করে দু’ভাগ হয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাদের পছন্দের দলকে জয়ী করানোর জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। উভয় পরিস্থিতির জন্যই আপনাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এ যুদ্ধের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যুদ্ধে কোনো সরকারি বাহিনী জড়াবে না, কোনো সরকারি অস্ত্র ব্যবহৃত হবে না, রাষ্ট্রের এক পয়সাও কোনো পক্ষ খরচ করতে পারবে না। যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন করবেন আপনারা। যেহেতু সরকারি বাহিনী ও অস্ত্র-শস্ত্র কোনো নির্দিষ্ট দলের সম্পত্তি নয় কাজেই ওসব ব্যবহার করার অনুমতি কেউ পাবে না। যদি আপনারা প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহ করতে না পারেন তাহলে এতদিন ফেতনা সৃষ্টি করার জন্য যে উপাদানগুলো ব্যবহার করতেন যেমন- ইট-পাটকেল থেকে শুরু করে লগি-বৈঠা হয়ে ককটেল পর্যন্ত যা কিছু আছে এসব নিয়েই যুদ্ধ করবেন। যুদ্ধ শেষে অবশ্যই কোনো না কোনো পক্ষকে মৃত্যুবরণ করতে হবে অথবা বন্দী হয়ে যুদ্ধজয়ী পক্ষের করুণার উপর ভরসা করে বেঁচে থাকতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধ শেষে জয়ী হবে মাত্র একটি পক্ষ এবং এই বঙ্গরাজ্যের উপর খবরদারিও করবে সেই পক্ষটিই। তারা হবে রাজ্যের একচ্ছত্র সার্বভৌম ক্ষমতাধারী। কেননা যুদ্ধবিজয়ী জাতির সিদ্ধান্তই বিজিত রাজ্যের বৈধ সিদ্ধান্ত- এটাই ইতিহাস স্বীকৃত পন্থা। কাজেই দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিডিয়ার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলেই তখন ওই যুদ্ধজয়ী দলের আনুগত্য করতে বাধ্য থাকবে। ওই দল যদি কোনোদিন চায় তারা ক্ষমতা অন্য কোনো দলকে হস্তান্তর করবে তাহলেই কেবল অন্য কেউ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে, অন্যথা কেয়ামত পর্যন্ত ওই যুদ্ধজয়ী দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে।
এ হচ্ছে আমার প্রস্তাবিত যুদ্ধসংক্রান্ত নিয়ম-শৃঙ্খলা। আগেই বলেছি, আপনাদের পছন্দ-অপছন্দের নিরিখে এটাকে পরিবর্ধন-পরিমার্জন করতে পারবেন কিন্তু দয়া করে আমার প্রস্তাবনাটা বিবেচনা না করে অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দেবেন না। অনেক হয়েছে আর নয়। এবার অন্তত আমাদের মতো প্রজাসাধারণের প্রতি সদয় হোন।

পৃথিবীর ধর্ম-সঙ্কট ও আমাদের করণীয়

পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখুন- ধর্ম নামক ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে কী ভয়াবহ অস্থিরতা, নৈরাজ্য বাসা বেঁধেছে। হাহাকার আর কান্নার ধ্বনি পৃথিবীর আকাশ-বাতাসকে প্রকম্পিত করে তুলছে। এ কম্পন আজ আর ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লেবানন, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর ইত্যাদি হাতে গোনা কিছু দেশের মধ্যেই সীমিত নেই, ক্রমেই এ ব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীময়। বাদ নেই আমাদের এ উপমহাদেশসহ ইউরোপ, আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোও। স্বজনহারানো মানুষের আর্তনাদে পৃথিবীর বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কী নির্মম-নৃশংস ঘটনারই না অবতারণা ঘটছে এ ধরায়! কোথাও নিরাপরাধ ছেলের লাশ বাবাকে বইতে হচ্ছে, কোথাও বাবার লাশ ছেলেকে, কোথাও চোখের সামনে ভাসছে নির্যাতিতা বোনের ছবি, কোথাওবা গর্ভধারিণী মায়ের। এ কী উন্মাদনা? পৃথিবী আর কতদিন মানুষের এই পাপের বোঝা বহন করবে?
মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি- অতীতে যখনই এই জগৎ সংসারের কোনো অংশে এহেন অন্যায়-অবিচার, অনাচার, নৈরাজ্য ও যুদ্ধ-রক্তপাত সৃষ্টি হয়েছে সেখানেই স্রষ্টা তাঁর পক্ষ থেকে ত্রাণকর্তা পাঠিয়েছেন, যাদেরকে আমরা নবী-রসুল-অবতার ইত্যাদি নামে জানি। তাঁরা ওইসব জাতিকে ধর্ম শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাঁদের এমন শিক্ষায় সুশিক্ষিত করেছেন যাতে আগের পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র অর্থাৎ শান্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ আর কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই জ্বলছে অশান্তির আগুন, অন্যায়-অবিচারের একচ্ছত্র আগ্রাসন। এ থেকে পরিত্রাণ দেবে যে ধর্ম, সেই ধর্মই এখন প্রতারণা ও নির্যাতনের প্রধান কলে পরিণত হয়েছে।
এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ যুদ্ধ, রক্তপাত, হত্যা, অমানবিকতার অন্তর্নিহিত কারণসমূহের মধ্যে ধর্ম অন্যতম। মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করেই হিংসা ও প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে পৃথিবীময়। আর সে আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে-পুড়ে ছারখার হচ্ছে মানবতা নামক চির প্রত্যাশিত শান্তির শ্বেতকপোত।
আজ পৃথিবী নামে পরিচিত এই গ্রহে ‘প্রতারণা’ এক মহাব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতারণার কাজে কার্যকরি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে, আর নির্বিচারে প্রতারিত হচ্ছে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ। এমন বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী, যা অনুভব করার জন্য নিরপেক্ষ দৃষ্টিই যথেষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকান। দেখুন কীভাবে ধর্মকে স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের মতো সমৃদ্ধ দেশগুলোকে মৃত্যুকুপে পরিণত করা হলো। কোটি কোটি মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। লাখো মানুষের রক্তে আজও রঞ্জিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ধূসর বালুরাশি। স্বজাতির মধ্যে শুরু হয়েছে ভয়াবহ অন্তর্কোন্দল। চলছে উন্মাদনা, চলছে হত্যাযজ্ঞের নির্মম প্রতিযোগিতা। সকলেই জানে- এ সবই প্রতারণার ফসল। পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার আত্মা নেই। যদি থাকতো তাহলে নির্মম প্রতারণা করে মানুষের জীবন নিয়ে এত নোংরা খেলা করতে পারতো না।
ধর্মকে কীভাবে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থ আদায় করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে তা কারও অজানা থাকার কথা নয়। তালেবান, আল কায়েদা, আইএস- এসব কারা কার স্বার্থে সৃষ্টি করেছে এবং কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা তো এখন পরিষ্কার। এসব বিষয়ে আলোচনাই অবান্তর। আবার ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্ম নিয়ে যা করছে, মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে আখের গোছাচ্ছে তাও সীমা ছাড়িয়েছে বহু আগেই। আজকের পৃথিবীর প্রধান কয়েকটি সমস্যার কথা যদি বলা হয় তাহলে সবার আগে আসে জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় অন্ধত্ব বা গোঁড়ামী ইত্যাদি নামগুলো। অর্থাৎ পৃৃথিবীর প্রধান প্রধান সমস্যার কারণই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম। কিন্তু কেন? ধর্ম তো অশান্তির কারণ হতে পারে না। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ধর্ম বলে আজ যেটাকে পালন করা হচ্ছে তা প্রকৃত ধর্ম নয়, বিকৃত।
আজ পৃথিবীর সম্মুখে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধর্ম সঙ্কট উপস্থিত। পৃথিবী থেকে ধর্ম মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে আজ পর্যন্ত বহু চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু মুছা তো যায়-ই নি; উপরন্তু ধর্মই এখন পৃথিবীর এক নাম্বার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতির বাইরে নেই বাংলাদেশও। বাইরের কোনো আক্রমণকারী শক্তি নয়, আমাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমাদেরই ধর্মবিশ্বাস। কারণ, এ ধর্মবিশ্বাস এমনই একটি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে যা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

মানুষের ইতিহাসে ধর্মবিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শত প্রতিকূল পরিবেশেও মানুষ ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে রেখেছে। এতে যেমন কল্যাণ এসেছে, ক্ষেত্রবিশেষে এসেছে অকল্যাণও। এখন চলছে অকল্যাণের ধারা। আজ না ধর্মবিশ্বাস মুছে ফেলা যাচ্ছে, না তাকে এভাবে অকল্যাণের ধারায় প্রবাহিত হতে দেওয়া যাচ্ছে। এখন পরিত্রাণ পেতে হলে সমাধান মাত্র একটিই- ‘মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা। মানুষকে প্রকৃত ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করা। যুগে যুগে স্রষ্টা কেন ধর্ম পাঠিয়েছেন, কেন নবী-রসুল-অবতার এসেছেন, তার সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীদের ষড়যন্ত্রে ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধর্মের যে বিকৃত ব্যাখ্যা বা যুক্তি দিয়ে অকল্যাণকর কাজে আসক্ত করে তার প্রত্যুত্তরে ধর্মের সত্য আদর্শকে দাঁড় করানো।’

এ কাজ খুব সোজা নয়, আবার অসম্ভবও নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এ ছাড়া অন্য কোনো পথও নেই। শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে মানুষকে অবদমিত করা গেলেও মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে অবদমিত করা সম্ভব নয়। বহু বছর ওই চেষ্টা করা হয়েছে। কতটুকু সফলতা এসেছে তা সকলেরই জানা। বরং আদর্শের বিরুদ্ধে বিকল্প আদর্শ হাজির না করে শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অকল্যাণের ধারা বন্ধ করতে গিয়ে পশ্চিমারা সমস্ত পৃথিবীকেই অকল্যাণের পথে ঠেলে দিয়েছে। সুতরাং সমাধান একটাই- উপযুক্ত যুক্তি, প্রমাণ, তথ্য, উপাত্ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কল্যাণকর ধারায় প্রবাহিত করার মধ্য দিয়েই এ সঙ্কটকে মোকাবেলা করতে হবে। এমন পৃথিবী গঠন করতে হবে- যে পৃথিবীতে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস সবই থাকবে, কিন্তু তা মানুষকে অকল্যাণের পথে চালিত না করে মানবতার কল্যাণের পথে চালিত করবে। স্রষ্টা এমন পৃথিবী গঠন করার উদ্দেশ্যেই ধর্ম পাঠিয়েছেন।

ধর্মান্তরকরণের মধ্যে সার্থকতা নেই, সার্থকতা শান্তি প্রতিষ্ঠায়

বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়ানো বিষয়টি হচ্ছে ধর্মান্তরকরণ, যাকে ধর্মান্তরকারীরা নাম দিয়েছেন ‘ঘরওয়াপসি’। অতীতে যারা বা যাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম বা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিল তাদেরকে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনাকেই বলা হচ্ছে ঘরওয়াপসি। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘আরএসএস’ এর সহযোগী ‘জাতীয় হিন্দু পরিষদ’ নামক একটি সংগঠন প্রকাশ্যে এই কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে চালানো হচ্ছে এ কার্যক্রম। স্বাভাবিকভাবেই বেছে বেছে দরিদ্র বস্তি এলাকার মুসলিম বা খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীদেরকেই এর আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বেশ কিছু স্থানে সফলতাও এসেছে। উত্তর প্রদেশের আগ্রায় প্রায় দুইশ’র মতো মুসলিম ধর্মাবলম্বীকে এক প্রকার প্রতারণা করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ঘটনা তার মধ্যে একটি। সম্প্রতি গুজরাটেও প্রায় শ’ দুয়েক আদিবাসী খ্রিষ্টানকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলায় খবর প্রচারিত হয়েছে। এ কর্মসূচিকে ঘিরে ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠেছে।
এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, এ ধরনের ব্যয়বহুল ও বিতর্কিত একটি কর্মসূচি কোনো বৃহৎ শক্তির সমর্থন ছাড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কে তাদেরকে সমর্থন যোগাচ্ছে? অনেকের ধারণা- এ কাজে খোদ সরকারেরই সমর্থন রয়েছে। আরএসএস- এর সাথে বিজেপির ঐতিহাসিক সখ্যতাকেই এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে বেশি। আবার অনেকের ধারণা একটু ভিন্ন। তারা ধারণা করছেন- এ কর্মসূচির পক্ষে বিজেপির প্রত্যক্ষ সমর্থন নেই। কিন্তু তা বন্ধ করে দেবার মতো নৈতিক দৃঢ়তাও সরকার পাচ্ছে না। কারণ, বিজেপির ক্ষমতায় আসার পেছনে বিভিন্ন উদারপন্থী ধর্মীয় সংগঠনের সহায়তার পাশাপাশি আরএসএস- এর মতো উগ্রপন্থী সংগঠনেরও সমর্থন ও সহযোগিতা কাজ করেছে। কাজেই এখন ওদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে সরকারের জন্য কঠিন সময় উপস্থিত হতে পারে। ঘটনা যাই হোক, লক্ষণীয় বিষয় হলো সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বিরোধিতার কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত সরকার এ কর্মসূচির বিরুদ্ধে কার্যত শক্ত অবস্থানে অবতীর্ণ হয় নি। এমনকি সংসদে বেশ কিছুদিন যাবৎ বিষয়টি উত্তাপ ছড়ানোর পরও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেন নি, যদিও বিরোধী দলের সাংসদরা বারবার উল্লিখিত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির আশা ব্যক্ত করছেন।
এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে, ভারতের কোটি কোটি জনগণ বিগত নির্বাচনে তাদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট থেকেই বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এ দুইয়ের মধ্যে ভারতবাসী এবার বেছে নিয়েছে ধর্মকে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষকে শান্তির সন্ধান দিতে পারবে না তা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত। অশান্তি থেকে মুক্তি আসতে পারে একমাত্র ধর্মের অনুসরণ করে। এ কথা ভারতের মানুষ হয়তো কিছুটা হলেও বুঝেছে। যুগ যুগ ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে কার্যত ধর্মহীন সিস্টেম অনুসরণ করার ফলে জাতীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষের নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে ভারতবাসীর এই মানসিক পরিবর্তন একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু এখানেও যে বিপদ নেই তা কিন্তু নয়। বরং ধর্মের প্রকৃত রূপ জানা না থাকলে, ধর্ম আগমনের উদ্দেশ্য অজানা থাকলে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নামক বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে না পারলে এ ধর্মাশ্রয় কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। কল্যাণ তো হবেই না, বরং তা অকল্যাণের আধারে পরিণত হবে। বর্তমানে তারই কিছুটা আভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এটা মানতে হবে বর্তমান অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি আসতে পারে একমাত্র ধর্মের ছত্রছায়াতেই। ধর্মগ্রন্থের পাতাতেই রয়েছে চির প্রত্যাশিত শান্তির চাবিকাঠি। কিন্তু সেটা কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ নয়, স্রষ্টা প্রেরিত সকল ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থই এই শান্তির চাবি বহন করে চলেছে। এর কোনোটা গ্রহণ করব আর কোনোটা প্রত্যাখ্যান করব তা মোটেও সমীচীন নয়। এভাবে শান্তি মিলবে না। বৈষম্য কেবল বিরোধই বাড়াতে পারে, মৈত্রী তৈরি করতে পারে না। আর এটা জানা কথা যে, মৈত্রী ছাড়া শান্তি অসম্ভব। যারা ধর্মান্তরকরণের মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পান তাদের বোঝা উচিত পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে মানবজীবনে শান্তি আনয়নের উদ্দেশ্যে। যে কাজ করলে মানুষ শান্তি পায়, সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেটাই ধর্মের কাজ, ধর্মবিহিত কাজ। অন্যদিকে যে কাজ সমাজকে অস্থিতিশীল করে, মানুষের অধিকার হরণ করে সেই কাজ কখনও ধর্মের কাজ হতে পারে। ওই কাজ করে স্বর্গলাভ হবে না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান বলে কথা নয়, কে কতটা মানবতার কল্যাণ করতে পারল, সৃষ্টিজগতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার অবদান কত বেশি- এর উপর ভিত্তি করেই স্রষ্টা মানুষকে সম্মানিত করবেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এ কথা বলাই যায় যে, ভারত সরকার উভয়সঙ্কটে পড়েছে। একদিকে হিন্দু সেন্টিমেন্ট, অন্যদিকে সংখ্যালঘু অহিন্দু জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণের আশঙ্কা- এর মাঝেই গা বাঁচানো একটি অবস্থানে দাঁড়াতে চাচ্ছে সরকার। কিন্তু বিরোধী দল, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ সরকারের কাছে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় পেতে চায়। এমতাবস্থায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার কার্যত কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেটাই দেখার বিষয়। তবে বিজেপি সরকারের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে যদি তারা কোনোভাবে ধর্মীয় বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠিয়ে মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে পারে।

পাকিস্তানকে আরও কাঁদতে হবে

গত ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক নির্মম নৃশংস ঘটনা। নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৩২ শিশুসহ মোট ১৪১ জনকে। আহত হয়েছে আরও শতাধিক, যাদের অনেকেই এখনও আশঙ্কামুক্ত নয়। ভয়াবহ এই আত্মঘাতী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানি তালেবান গোষ্ঠীর ওই বর্বরতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে সারা বিশ্ব। যদিও পাকিস্তানে তালেবান হামলা এটাই প্রথম নয়, কিন্তু সরকারি বাহিনীর অভিযানের জবাব দিতে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে একসাথে এতগুলো শিশুর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো বর্বরতা এটাই প্রথম। এ ঘটনাটি সারা বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন মানুষের হৃদয়ে আঘাত করেছে। অবচেতন মনের গহীন থেকে ধিক্কার আসছে ওইসব মানুষের ওপর যারা মানবতার জন্য আসা ধর্মকে অজুহাত করে প্রতিনিয়ত মানবতার কবর রচনা করে আসছে। এসব নরপশুদের প্রতি ধিক্কার আসা স্বাভাবিক। অতীতেও তারা বহু কাজের জন্য ধিক্কৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের প্রতিটি মানবতাবিরোধী কাজের সমালোচনা করেছে সারা বিশ্ব। কিন্তু আমরা সকলেই জানি, শুধু সমালোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কোটি কোটি মানুষের ধিক্কার তাদেরকে অন্যায় থেকে নিবৃত করতে পারছে না, ভবিষ্যতেও পারবে না। আমাদেরকে আগে জানতে হবে, এদের উৎপত্তি হলো কীভাবে। এরা কি স্বতন্ত্রভাবেই সৃষ্টি হয়েছে নাকি তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি সৃষ্টি করা হয়েই থাকে তাহলে তা কোন স্বার্থে, কার স্বার্থে। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না, নিকট ইতিহাসের পাতাতেই হয়তো আমরা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবো। আর তখন সমাধানও পাওয়া যাবে সহজেই।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখি এ বিপর্যয় পাকিস্তান নিজ হাতে সৃষ্টি করেছিল। যে বিষবৃক্ষের বীজ পাকিস্তান সরকার ১৯৯৪-১৯৯৫ সালে বপন করেছিল, আজ তা বটবৃক্ষে রূপ পেয়েছে। তালেবানদের উত্থানের পেছনে মার্কিন স্বার্থ ও পাকিস্তানি স্বার্থ উভয়ই কাজ করেছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের তালেবান নামে পরিচিত গোষ্ঠী, তা পাকিস্তান তালেবান হোক অথবা আফগান তালেবান হোক, এদের উত্থানের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে সোভিয়েত পরবর্তী আফগানিস্তানকে ঘিরে। আফগান দখল পরবর্তী দশ বছরের যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী পরাজিত ও আফগান হতে বিতাড়িত হলে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা মোজাহেদিনদের মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ অন্তর্কোন্দল। ১৯৯২-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত চলা এ লড়াই ছিল মূলত আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকার শাসনক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে। এ গৃহযুদ্ধ এতটাই ভয়ানক রূপ ধারণ করেছিল যে তা বিগত সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে যেতে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সাধারণ মানুষের জন্য এ ছিল ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ এর মতো। ক্রমেই এসব যুদ্ধবাজ গোত্রের উপর সাধারণ মানুষ ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়ে। তারা নতুন কোনো শক্তির আশায় উদগ্রীব হয়ে পড়ে, যারা আর যাই হোক ভ্রাতৃঘাতী লড়াই বন্ধ করবে। আর এ শুন্যতাই পূরণ করে অখ্যাত, অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত, পৃথিবী সম্পর্কে অনবহিত মাদ্রাসার কিছু ছাত্র- তালেবান।
তালেবানদের প্রাথমিক উৎপত্তি আফগানিস্তানের অন্যান্য এলাকার মতোই কান্দাহার এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সূত্র ধরে। ১৯৯২-১৯৯৪ সালে গৃহযুদ্ধকালীন অবস্থায় কান্দাহারের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটাই নিুস্তরে পৌঁছেছিল যে, রাস্তা-ঘাটে, যেখানে-সেখানে মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতো। তাদেরকে সৎকার করার আগ্রহও কেউ দেখাতো না। ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, লুণ্ঠন হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনায়। মূলত এই নাজুক পরিস্থিতিতেই মাদ্রাসার কিছু ছাত্র এলাকার হাল ধরার জন্য সংগঠিত হলে তারা পরিচিত হয় তালেবান নামে। তালেব শব্দের অর্থ ছাত্র। তালেব থেকে তালেবান। তালেবানদের না কোনো প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিল, না দেশ শাসন করার মতো বড় কোনো উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যহীন, শক্তিহীন তালেবানই বৈদেশিক স্বার্থের ডাইসে পড়ে এক সময় আফগানিস্তানের নব্বই শতাংশ এলাকার শাসকে পরিণত হয়েছিল। তাদেরকে কে অস্ত্র যুগিয়েছিল, কে সমর্থন যুগিয়েছিল, কে দিক নির্দেশনা প্রদান করেছিল- সে দায় আজকে যদিও কেউ স্বীকার করতে ইচ্ছুক নয় কিন্তু ইতিহাসের পাতাতে আজও লিপিবদ্ধ আছে।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন- পাকিস্তানের তালেবান আক্রমণ নিয়ে লিখতে বসে আফগান তালেবানের আলোচনা কেন? এ আলোচনা এ কারণে আসছে যে, পাকিস্তান তালেবান ও আফগান তালেবান ভিন্ন ভূখণ্ডে তৎপর হলেও আদর্শগত দিক দিয়ে তারা অভিন্ন, এবং পাকিস্তান তালেবানের উত্থান ঘটেছে আফগান তালেবানের দুর্দশা থেকেই। আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও প্রধান প্রধান বিষয়ে এ দুই সংগঠনের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা সকলেরই জানা। আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান না ঘটলে পাকিস্তানে আজ ‘তেহরিক ই তালেবান পাকিস্তান’ (ঞঞচ) নামে কারও অস্তিত্বই থাকতো না। কাজেই তালেবান বলতে আমি আফগান তালেবান ও তার আদর্শে অনুপ্রাণিত ও তার সহযোগী অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীকেও বোঝাচ্ছি।
ইতিহাস বলছে, তালেবানদের উত্থানে পাকিস্তানের ছিল ব্যাপক সহযোগিতা আর যুক্তরাষ্ট্রের মৌন সমর্থন। কারণ, এ দু’টি দেশ তালেবান উত্থানের পেছনে নিজ নিজ স্বার্থ খুঁজে পেয়েছিল। আফগান যুদ্ধে হেরে যাবার পর এবং অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় মধ্য এশিয়াতে জন্মলাভ করে পাঁচটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের। তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান ও আজারবাইজান। এই দেশগুলো ছিল অতি সম্ভাবনাময় দেশ। এমতাবস্থায় পাকিস্তান এ দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের সাথে মধ্য এশিয়ার ওইসব দেশের যোগাযোগ তৈরি করা রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু তখন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আফগানিস্তানে চলছে চরম অস্থিতিশীলতা। এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে কোনোভাবেই আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পাকিস্তানের দরকার হয়ে পড়েছিল আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি যা পাকিস্তানকে মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে সাহায্য করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তান আফগানিস্তানে তেমন কোনো শক্তির সন্ধান পাচ্ছিল না যাদের ক্ষমতায় বসিয়ে সমগ্র আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল করা যায়।
পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল আফগানিস্তানের চমন, কান্দাহার, হেরাত, মাজার-ই শরিফ ও আসগাবাদের রাস্তার নিরাপত্তা। কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা না দেখায় অনেকটা অনিরাপত্তার মধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানি পণ্য নিয়ে বিশাল ট্রাকবহর মধ্য এশিয়ার পথে রওয়ানা হয়ে আফগান সীমান্ত শহর বোলদাকের নিকট স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতাতের হাতে আটকা পড়ে। আর ঠিক এই সময়টিতেই আফগানিস্তানে কার্যরত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ওঝও) কান্দাহারের তালেবান নামক শক্তির সন্ধান পায়। পাকিস্তানের আটক ট্রাকবহর উদ্ধার করতে ওঝও তালেবানকে কাজে লাগায়। শুরু হয় তালেবানের উত্থানের যুগ। এর পরবর্তী ইতিহাস পাকিস্তানের নেপথ্য সহযোগিতায় তালেবানের জয়ের ইতিহাস। ‘৫ নভেম্বর ১৯৯৪ সালে তালেবানরা কান্দাহার দখল করে। এর জন্য প্রায় কয়েক হাজার পশতুন ভাষাভাষী পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা হয় বলেও শোনা যায়। তালেবানদের এই উত্থান সীমান্ত পারের পশতুন যুবকদের আকর্ষিত করলে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মাদ্রাসায় অধ্যায়নরত ছাত্র যোগ দিলে তালেবানরা উত্তর পশ্চিমে এদের কর্তৃত্বকে আরও প্রসারিত করে।’ (ব্রি.জে. এম সাখাওয়াত হোসেন রচিত- তেল গ্যাস: নব্য উপনিবেশবাদ-কাবুল হতে বাগদাদ)। ‘পাকিস্তান সরকারের নিকট মোল্লা ওমরের দল অর্থাৎ তালেবানদের সংবাদ ওঝও এর মাধ্যমে পৌঁছলে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাক্তন জেনারেল নাসিরুল্লাহ বাবর এ নতুন দলকে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত করবার সংকল্পে সর্বপ্রকার সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে।’ (আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা: আফগানিস্তান হতে আমেরিকা)। এ সহযোগিতার মধ্যে অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ প্রদানও অন্তর্ভূক্ত করা হয়। (প্রাগুক্ত) এক কথায় পাকিস্তানের পূর্ণ সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতার মধ্য দিয়েই আফগানিস্তানের ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে সর্বশেষ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে তালেবানরা। আজ আমরা পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশারফকে বলতে শুনি- তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি, (ডন, ০৫.১২.১৪) কিন্তু বাস্তবে আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। আর পাকিস্তান সৃষ্ট ওই আফগান তালেবান আদর্শে উজ্জীবিত হয়েই আজকের ‘তেহরিক ই তালেবান পাকিস্তান’ মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতর অপরাধে মত্ত রয়েছে। এর দায় পাকিস্তান সরকার অস্বীকার করলে তা সত্যের অপলাপ হবে। বস্তুত পাকিস্তান সরকার সবচেয়ে বড় যে ঐতিহাসিক ভুলটি করেছিল তা হলো আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে জড়ানো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নকে পরিণত হওয়া। যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানের সাথে দহরম-মহরম বজায় রেখেছিল শুধুই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মাটিতে মোসলেমদের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে। আর তাই যখনই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। শুধু তাই নয়- ৯/১১ এর হামলার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চল নিয়ে কোনো কর্মপদ্ধতি ঠিক করেনি, জঙ্গি উত্থানকে রুখে দেওয়ার প্রয়াস চালায় নি। আফগানরা নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকে জয় এনে দিল, অথচ তাদের সবচেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্তেও যুক্তরাষ্ট্রকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সব দায়িত্ব এসে পড়ল পাকিস্তানের ওপর। ওদিকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে পাকিস্তানের তখন লেজেগোবরে অবস্থা। পাকিস্তানের গ্রামে গঞ্জে, হাটে-বাজারে, বিমান বন্দরে সবখানে তখন আফগান যুদ্ধের অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। সোভিয়েত সেনা পিছু হটার পর থেকে আফগানিস্তানে যে ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয় তার প্রভাব প্রায় এক দশকব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রহীন পাকিস্তান অনুভব করেছিল। তখন পাকিস্তানের নিজের স্বার্থেই আফগানিস্তানে একটি সরকারের অধীনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তান বেছে নিয়েছিল তালেবানদের। তখন হয়তো এটা কল্পনাও করা হয় নি যে, আজকের আফগানিস্তান সম্পর্কে অনীহায় ভোগা যুক্তরাষ্ট্র কাল তালেবান শাসনাধীন আফগানিস্তান নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে শুরু করবে এবং এক সময় আফগানিস্তানে সামরিক হামলা চালিয়ে পাকিস্তানকেও দ্বিতীয়বারের মতো বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করবে।
সবকিছু একত্র করলে আমরা যে সমীকরণ পাই তাতে দেখা যাচ্ছে- আজ পাকিস্তানে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার বীজ বপন করা হয়েছিল আজ থেকে কয়েক দশক আগে এবং তা হয়েছিল পাকিস্তানের সমর্থনেই। আজ পাকিস্তানে রক্তের বন্যা বইছে। প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা। জীবন দিতে হচ্ছে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সাধারণ নিরাপরাধ মানুষকে। ভয়াবহ নৃশংসতার খবর ছাপাতে গিয়ে পত্রিকায় লেখা হচ্ছে- ‘কাঁদছে পাকিস্তান’। হ্যাঁ, বিবেকবর্জিত ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উন্মত্ত রোষের শিকার হয়ে পাকিস্তান কাঁদছে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, এই পরিস্থিতি পাকিস্তান নিজ হাতে সৃষ্টি করেছে। এটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতের খেলনায় পরিণত হবার খেসারত। পাকিস্তান ভালোভাবেই জানে- এ বিপর্যয় সহজে কাটিয়ে উঠবার নয়। পাকিস্তানকে আরও কাঁদতে হবে। হারাতে হতে পারে আরও অনেক কিছুই।

না, একটা দেশ পাশে না থাকলে বাংলাদেশ মরে যাবে না

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের কিছু মন্তব্য। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ও বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা ড্যান মজিনা সম্পর্কে কটু মন্তব্য করে প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন বাংলাদেশ স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ ও ড্যান মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে সম্বোধন করায় বিতর্কের সূত্রপাত হয়। অনেকে মত প্রকাশ করেন যে, সৈয়দ আশরাফের এহেন বক্তব্যের জেরে হয়তো বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও শিথিল হয়ে পড়বে। কিন্তু আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ যুক্তিকে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না সরকার। সৈয়দ আশরাফের মন্তব্যকে ঘিরে সরকার কিছুটা বিব্রত হলেও, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে সরকারের মনোভাব যে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূল নয় তা প্রমাণিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও। সার্ক সম্মেলন থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান দুনিয়ার পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যের একটি পর্যায়ে তিনি বলেন,
‘একটা দেশ পাশে না থাকলে আমরা একেবারে শেষ হয়ে যাব? ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র বিরুদ্ধে ছিল। বাংলাদেশ শেষ হয়ে যায় নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি আমরা লড়াই করে টিকে থাকতে পারি তাহলে স্বাধীন দেশ হিসেবে এখনও পারব। প্রত্যেকটি নাগরিককে বলব, এটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সে মর্যাদা নিয়ে চলতে হবে। কেউ পাশে থাকলে বাঁচব, না থাকলে মরে যাব, এটা ঠিক না। ভালো থাকলে বন্ধুর অভাব হবে না। কাউকে ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে না- এমন চিন্তা না থাকাই ভালো।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, উল্টিয়ে-পেঁচিয়ে, বিচার-বিশ্লেষণ করছে দেশের গণমাধ্যম ও সনামধন্য বিশ্লেষকরা। অনেকেই অনেক কিছুর আভাস পাচ্ছেন। কারও মতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুণ্ঠ সমর্থন লাভের ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানোর পরও ব্যর্থ হবার কারণে সরকার এমনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। আবার কারও মতে, নিশা দেশাই সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া বাংলাদেশ সফরে এসে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথে আলোচনা করেছেন এবং বর্তমান সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের কাছে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন- এটাকেই বড় অপরাধ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ সরকার। আবার এসব কারণকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের রাশিয়ামুখী অগ্রগতিকে আসল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পছন্দ করছেন একটি মহল।
আসল ঘটনা কী তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারবে না। ওই চেষ্টা আমি করবও না। আমি একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করার চেষ্টা করব। যদি বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব সত্য সত্যই পশ্চিমা পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী হয় তাহলে ক্ষতির কোনো কারণ আছে কিনা- মূলত এটাই আমার আলোচনার বিষয়। অনেকেই বিষয়টিকে নিয়ে সরকারকে দায়ী করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে দেশটি যে স্ট্যান্ড নিয়েছে তাতে ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর এহেন বক্তব্য কি খুবই অযৌক্তিক?
১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল তা সকলের জানা। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়-অবিচার, অনাচার ও যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ আমাদের জন্য কোনো উচ্চাভিলাস ছিল না। নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য ও লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি। আমাদের ওই সংগ্রাম বৈধ ছিল বলেই পৃথিবী আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু সাধারণ নাগরিকও আমাদের যুদ্ধে পরোক্ষভাবে সাহায্য-সহায়তা করেছে। কিন্তু কার্যত বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এর পেছনে কারণ ছিল শুধুই সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়, এ উপমহাদেশে তার সাম্রাজ্যবাদের পথ প্রশস্ত রাখা। এই অর্থে আমাদের স্বাধীনতা লাভে কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত হতে হয়েছিল। সে পরাজয়কে দেশটি আজ পর্যন্ত ভুলতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
২. আজ যখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তখনও তার বিরোধিতার কাতারে সম্মুখভাগে অবস্থান নিয়েছে পশ্চিমা শক্তি। ’৭১ এর লাখো মানুষের বীভৎস মৃতদেহ যাদের চিত্তকে বিচলিত করতে পেরেছিল না, তারা আজ অস্থির হয়ে উঠছেন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় শুনে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও তার তাবেদার জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফোন ও চিঠি আসছে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করার জন্য। বোঝা-ই যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি আজও সেই অবস্থানেই আছে যেখানে তারা ১৯৭১ সালে ছিল।
৩. পৃথিবীর দেশে দেশে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে কথিত মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজ করতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রকে। এ কাজ করতে গিয়ে এরা কতটা আগ্রাসী রূপ ধারণ করতে পারে তার উদাহরণের অভাব নেই। সৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনকে হটিয়ে কথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইরাকের কত লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটেছে, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক বিচারে সুসভ্য একটি দেশকে কীভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে এখন ভিখারীর দেশে পরিণত করা হয়েছে তা কি কারও অজানা রয়েছে? আজকের আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চলছে তাকে কি কোনোভাবে গণতন্ত্র বলা যায়? আসলে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের নাম করে সারা বিশ্বে এমনই মেরুদণ্ডহীন শাসনপদ্ধতি কায়েম করতে চায়। আমাদের দেশও তার বাইরে নয়।
৪. মধ্যপ্রাচ্যের যে সকল বাদশাহ ও আমীরতন্ত্র কায়েম হয়ে রয়েছে, দেখা যাচ্ছে তাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের গলায় গলায় সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট ভুলেও এসব দেশে মানবাধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে, সৈরশাসন চলছে- এমন অভিযোগ উচ্চারণ করেন না। দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ এসব রাজতন্ত্রকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি বিবেচনা করেন না (বিশেষ বিশেষ দেশের জন্য যেমনটা করা হয়)। এসব দেশের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে রাজপথে নামলে তাদের পক্ষে কোনো উচ্চবাচ্চ করেন না। পশ্চিমা মিডিয়া ওই রাজতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রকামীদের চিৎকার-চেঁচামেচি প্রচার করে না। কারণ- ওসব দেশের সরকার এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহনে নিযুক্ত আছে। কাজেই সেখানে গণতন্ত্রের নামে নতুন কোনো মেরুদণ্ডহীন শাসক সৃষ্টি করার দরকার নেই।
আজকের মিশরের অবস্থা দেখুন। গত বছর দেশটির গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আর এখন সাবেক স্বৈরশাসক হোসনে মোবারককে সকল মামলা হতে অব্যাহতি দেয়ার মাধ্যমে মৃত ওই গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হচ্ছে। কিন্তু এত কিছু হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমরা জানি মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। তাহলে কোথায় গেল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রপ্রেম? কোথায় তার মানবাধিকার? এসব কি নিছক স্বার্থ হাসিলের অজুহাত নয়?
৫. যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল পাকিস্তান। তার পরিণাম কী হয়েছিল তা অনেকেই জানেন। পাকিস্তানের প্রায় সব সরকার (গণতান্ত্রিক বা স্বৈরশাসক) যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড়বৃত্তি করে এসেছে। আর এই সুযোগেই পাকিস্তানকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্টকে বহু সুবিধা আদায় করে নিতে দেখা গেছে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগান আক্রমণকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এক বৈশ্বিক রাজনীতির দাবাখেলায় মেতে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা CIA ইসলামী সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে আফগানিস্তানের সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধকে জেহাদে রূপ দেবার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল, যা বাস্তবে সম্ভব হয়েছিল একমাত্র পাকিস্তানের CIA এর সহায়তা পেয়েই। পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল ওসামা বিন লাদেন, ডা. আইমান আল জাওয়াহিরিসহ সোভিয়েত বিরোধী যোদ্ধাদের (আজ যারা সর্বত্র জঙ্গি নামে পরিচিত) পৈত্রিক গৃহসদৃশ, আর তাদের মুখে অন্ন ও হাতে অস্ত্র তুলে দিতো যুক্তরাষ্ট্র। তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে নি যে, আজকের মিত্র আমেরিকা কাল পাকিস্তানকে বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলে সটকে পড়বে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। ওদিকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে পাকিস্তানের তখন লেজেগোবরে অবস্থা। পাকিস্তানের গ্রামে গঞ্জে, হাটে-বাজারে, বিমান বন্দরে সবখানে তখন আফগান যুদ্ধের অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। সোভিয়েত সেনা পিছু হটার পর থেকে আফগানিস্তানে যে ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয় তার প্রভাব প্রায় এক দশকব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রহীন পাকিস্তান অনুভব করেছিল। এই দীর্ঘ সময় পাকিস্তান শুধু পরিণতি ভোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহন করা ও তার ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করার পরিণতি। আমরা বাংলাদেশকে সেই পাকিস্তান দেখতে চাই না। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশেও ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে কোনো অঘটন ঘটানো হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটা তাদের জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়। বিশেষ করে এ দেশে যখন ক্ষেত্র আগে থেকেই প্রস্তুত আছে তখন তো কথাই নেই। এর জন্য শুধু ষড়যন্ত্রকারীদের বড় ধরনের স্বার্থ দরকার।
এ গেল যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অতীত অভিজ্ঞতা যা পৃথিবী গত কয়েক দশক ধরে প্রত্যক্ষ করেছে এবং এখনও করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন দু’মুখি ও স্বার্থবাদী কর্মকাণ্ডের উদাহরণের শেষ নেই। এখানে আমি আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকেই শুধু পয়েন্ট করেছি। এখন কথা হচ্ছে- এমন একটি আগ্রাসী শক্তি, যাকে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বললেও অত্যুক্তি হয় না, বাংলাদেশে তার সরূপ অনুভব করা বোধহয় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমি জানি না যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা তার সুচিন্তিত মতামত কি না, এটা বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতির অংশ কিনা। যদি সেটা হয়ে থাকে তাহলে আমি সেখানে অশুভ কিছু দেখি না। আজ যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থেকে অন্য কোনো দল ক্ষমতায় থাকতো, আর তারা জাতীয় স্বার্থে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতো- তাহলেও আমার একই অনুভূতি হতো। বাঙালি কোনো কালেই ষড়যন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয় নি, দেবেও না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এটা বলাই যায় যে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর যাই হোক নিজেদের স্বার্থে যে কোনো কাজ করতে পারে। আমরা যাতে কোনোভাবেই তেমন কোনো ছকে পড়ে না যাই সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। আমরা সকলের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে চাই। কিন্তু কারও ক্রীড়নকে পরিণত হতে চাই না।

আরব বসন্ত কোথায় এসে দাঁড়াল?

বৈশ্বিক রাজনীতিতে আরবভূমি এক বিরাট লীলাক্ষেত্রে রূপ লাভ করেছে। যখন-তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে সেখানে। সভ্যতার অন্যতম এই লীলাভূমির ধূসর বালুরাশি হচ্ছে রক্তে রঞ্জিত। শত্র“তা ও প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীময়। এরই অংশ হিসেবে আরবের ভূমিতে আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক এই মাসটিতেই শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছিল আরব বসন্ত। নামটি পশ্চিমাদের দেওয়া। তৎকালীন বিশ্বে আরবদের ওই জাগরণ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। একের পর এক স্বৈরশাসকদের পতন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশের কোটি কোটি জনগণকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। কিন্তু আজ কয়েক বছর পেরিয়ে এসে বিশ্ববাসীর সামনে যে পরিষ্কার সমীকরণ দাঁড়িয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কোটি কোটি মুক্তিপ্রেমী মানুষের ওই জাগরণ কার্যত বিফল হয়েছে। বসন্তকাল তো আসেই নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তারা মুখোমুখি হয়েছে ঘোর শৈত্যপ্রবাহের।
আজ থেকে চার বছর আগে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস। উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ার একজন বেকার যুবক মোহাম্মদ বুয়াজিজির নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। অভিযোগ- ‘তিউনিশিয়ার একজন পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহার’। তার দেখা দেখি আত্মহুতি দেয় মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশের যুবক। শুরু হয় আলজেরিয়া, জর্ডান, মিশর, ইয়েমেনে ব্যাপক সরকার বিরোধী আন্দোলন। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, মিছিল-মানববন্ধন চলতে থাকে সমান তালে। এদিকে পশ্চিমা মিডিয়ার ক্যামেরার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় আরবের ওই রাষ্ট্রগুলো। আন্দোলনকারীদের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত তৈরি করতে এসব মিডিয়া প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য মোড়ল রাষ্ট্রগুলোও শর্তহীন সমর্থন দিতে থাকে আন্দোলনকারীদের। চলে সাহায্য-সহযোগিতাও।
প্রথম ধাক্কাতেই তিউনিশিয়ায় ফোটে বসন্তের ফুল। তারিখ ১৪ জানুয়ারি। শাসক বেন আলী জনবসন্তের ধকল সইতে না পেরে পালিয়ে যান সৌদি আরবে। ২৫ জানুয়ারি থেকে মিশরে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ১৮ দিনব্যাপী বিদ্রোহের পরে ৩০ বছর ধরে শাসন করা প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ১১ ফেব্র“য়ারি পদত্যাগ করেন। কিছুদিন পর পতন হয় জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর। এদিকে ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আব্দুল্লাহ সালেহ ঘোষণা দেন যে, তিনি ২০১৩ সালের পর আর রাষ্ট্রপতি থাকবেন না। একমাত্র সমস্যা বাঁধল লিবিয়ায়। গাদ্দাফী সরকার কোনোভাবেই ছাড় দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু তারপর যা হলো তা সকলেরই জানা। পশ্চিমা সামরিক হামলার সামনে টিকতে পারল না স্বৈরশাসক মুয়াম্মর গাদ্দাফি। তার পতনের পেছনে মার্কিন স্বার্থই প্রধান নিয়মক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকের বিশ্বাস।
এরপর দ্বিতীয় ও সর্বাধিক বাধাটি আসে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পক্ষ থেকে, যে বাধা আজ অবধি ডিঙ্গাতে পারে নি পশ্চিমা জোট। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিদ্রোহীদের সমস্ত প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়। এমতাবস্থায় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদও মুখোশ খুলে সরূপে আবির্ভূত হয়। এর যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আরও পোক্ত হবে। কারণ সিরিয়া-ই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ যা কিনা সরাসরি ইরান ও রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করে চলছে। যাই হোক, মার্কিন সমর্থন, অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা পাবার পরও ফ্রি সিরিয়ান আর্মি এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে পারে নি। বরং আইএস নামক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে।
এদিকে সিরিয়ায় সরকারি বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যখন ইতিহাসের বর্বরতম লড়াই চলছিল তখন হঠাৎ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরে গেল মিশরের দিকে। মিশরে আরব বসন্তের সুবাদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিপুল জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় বসা মুরসী সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে নেয় সে দেশের সেনাবাহিনী। মুক্তিপ্রেমী মানুষের কাছে এই ঘটনা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। কিন্তু এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি রহস্যের আবরণে ঢাকা পড়ে যখন সেনা অভ্যুথানের কোনোরূপ বিরোধিতা না করে আমেরিকা, সৌদি আরব এবং ইসরাইল মিশরের সেনাপ্রধানকে হাজার হাজার ডলার আর্থিক সাহায্য পাঠায়। এমনকি পশ্চিমারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণকে প্রাথমিকভাবে সেনা অভ্যুত্থান হিসেবে মানতেও ছিল নারাজ। কারণ সেনা অভ্যুত্থান হিসেবে মেনে নিলে আর্থিক সাহায্য পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী হতো। সব মিলিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, মিশরে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমা সমর্থন ছিল এবং আজ পর্যন্ত সে সমর্থন অব্যাহত আছে।
আসা যাক বর্তমান পরিস্থিতিতে। প্রথমেই লিবিয়া। কথিত আরব বসন্তের মরিচিকায় মুগ্ধ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে লিবিয়া অন্যতম। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে গাদ্দাফী যুগের পরিসমাপ্তি ঘটার পর আজ দুই বছর পেরিয়ে গেলেও লিবিয়ায় বসন্তের কোনো ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। শৃঙ্খলতা ভেঙ্গে স্বাধীনতার মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল লিবিয়ার মানুষ, সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয় নি। বরং ঘটছে ঠিক উল্টোটা। সারাক্ষণ হত্যা, গুম, বোমা হামলা, অপহরণের আশংকায় তটস্থ থাকতে হচ্ছে তাদের। গাদ্দাফী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেকেই এখনও তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করেনি। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তার জের আজও চলছে। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আজও দাঁড় করানো যায়নি। দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ দূর করে জাতীয় ইস্যুতে তাদের একাত্ম করতেও ব্যর্থ হয়েছে লিবিয়ার বর্তমান সরকার। দেশের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার করা যায়নি। অর্থনীতি বলা যায় ‘ব্যাক ফুটে’ চলে গেছে। আজ তারা না গণতন্ত্র পেয়েছে, না শান্তি পেয়েছে, বরং তাদেরকে ইতিহাসের জঘন্যতম সময় অতিক্রম করতে হচ্ছে। পশ্চিমারাও তাদেরকে পরিত্যাগ করেছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ-সম্পদশালী দেশ লিবিয়া এখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার ক্ষমতাও হারিয়েছে।
এদিকে মিশরের অবস্থা আরও করুণ। জেনারেল সিসি আবির্ভূত হয়েছে নব্য হোসনে মোবারকের ভূমিকায়। দুর্নীতি ও হত্যার অভিযোগ তুলে যে স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে নামাতে গিয়ে শত শত মিশরীয় প্রাণ হারালো সেই হোসনে মোবারককে এখন নির্দোষ প্রমাণ করতে দেখা যাচ্ছে। গত শনিবার মিশরের একটি আদালত ২০১১ সালের গণজাগরণে সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রায় আট শতাধিক মানুষের প্রাণহানির অভিযোগ থেকে হোসনে মোবারককে অব্যাহতি প্রদান করে। রায়ে বলা হয়, জনতার উপর গুলি চালাবার নির্দেশ উচ্চ পর্যায় থেকে আসে নি। গণমাধ্যমসূত্রে জানা যাচ্ছে, এই রায় মিশরের মুক্তিকামী মানুষ মেনে নিতে পারে নি। এতদিনে হয়তো মিশরবাসী বুঝে উঠতে পারছে যে, মুক্তি তাদের ভাগ্যে জোটে নি, পশ্চিমা বিশ্ব তাদের সাথে এক প্রকার ছলনা করেছে মাত্র।
অন্যদিকে সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি কাউকে নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কথিত আরব বসন্তের শুরু থেকে এ বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সিরিয়ায় এক লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি আদম সন্তান। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। কথিত বিদ্রোহীদের গাছে তুলে ইতোমধ্যেই মই নিয়ে গেছে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। এখন সিরিয়ায় কোনোপক্ষই জয়ের কাছাকাছি নেই। ধারণা করা হচ্ছে- দেশটির মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। আরব বসন্তের পটভূমি থেকে জন্মগ্রহণ করা ‘আইএস’ নামের মাত্র একটি গ্র“প সারা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়া থেকে উদ্গত এই আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মিভূত করছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইরাককে।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে- আরব বসন্ত কী দিল আরবদের? কিছুই দেয় নি, অথচ নিয়ে গেছে সর্বস্ব। পশ্চিমা প্রচারিত কথিত আরব বসন্ত আজ মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি কেড়ে নিয়েছে, নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে, বহু নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। পৃথিবীকে দিয়েছে অনিরাপত্তার নতুন মাত্রা। এর ধকল কাটাতে ভাবি পৃথিবীকে হয়তো আরও বহু সময় অতিক্রম করতে হবে। এই যে এতকিছু হলো এবং হচ্ছে- এর জন্য প্রধানত কে দায়ী? আমি বলব সাম্রাজ্যবাদ। এ সব কিছুর মূলে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ উদ্ধার। এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনকে রুখে দিতে না পারলে এমন পরিস্থিতি ঘুরে ফিরেই অবতীর্ণ হবে। তাই শান্তিপূর্ণ ও মুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

তথ্যপ্রযুক্তি-যুগের হাওয়া লাগল গায়ে!

‘মানুষ বড্ড বুদ্ধিমান প্রাণী’- তার প্রমাণ পৃথিবী ইতোমধ্যেই পেয়েছে। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরে মানুষ আজ আনন্দে আটখানা। আছে অহংকারও। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর প্রবহমান সময়কে মানুষের অহংকারের শতাব্দী বলাটা অবান্তর হবে বলে মনে হয় না। এ অহংকার হচ্ছে কৃতিত্বের অহংকার, সাফল্যের অহংকার। কী করেনি মানুষ? বহুকিছু করেছে। বহু রহস্যের দ্বার উন্মোচন করেছে। দুর্বোধ্য বিষয়ের সহজ-সাবলীল ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। কল্পনা ও স্বপ্নকে সকল প্রকার সীমারেখার আচ্ছাদন হতে মুক্ত করেছে। মানুষ সব পারে। আজ পারেনি কাল পারবে, কাল না পারলে পরশু পারবে। এটা পারবে না, ওটা সম্ভব নয়- এমন কথা বলার যুগ শেষ হয়ে গেছে।
মানুষের এই অগ্রযাত্রায় ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ এক বিস্ময়ের নাম। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন-স্যাটেলাইটের এই যুগে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খবরাখবর আমরা পাচ্ছি হাতের নাগালে। অতীতে, অন্ততপক্ষে কয়েক শতাব্দী আগে এমনটা কল্পনা করাও ছিল বোকামির নামান্তর। পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, কয়েক শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবী একটি ছোট্ট মার্বেলে রূপ লাভ করবে, আর আমরা কোটি কোটি মানুষ একজনের সাথে আরেকজন জড়িয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়ে থাকবো। আসল কথা হলো, তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশের ফলে মানুষ দূরে বসে থেকেও সহজেই একে অপরের কাছে আসতে পারছে। কাছে আসছে মোবাইল, টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট ইত্যাদির মাধ্যমে। যেখানে আগে এক গ্রামে ঘটে যাওয়া তুলকালাম কাণ্ড অপর গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে কয়েক দিনের সময়ের ব্যাপার ছিল সেখানে আজ এক মহাদেশের ছোট্ট একটি দেশে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা পর্যন্ত অন্যান্য মহাদেশের মানুষ ঘরে বসে জানতে পারছে, দেখতে পারছে। এটাকেই বলা হচ্ছে পৃথিবীর ছোট হয়ে যাওয়া, বিশ্বের নামকরণ করা হয়েছে- বিশ্বগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিলেজ।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে পরিচিত বাংলাদেশেও লেগেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়া। আমাদের দেশও তথ্য-প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তবে গতিটা বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নিন্দুকেরা এটাকে বলেন কচ্ছপের গতি। আর আশাবাদীরা খরগোশ কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে বলেন- লক্ষ্য ঠিক থাকলে কচ্ছপের গতিতেই আসবে সফলতা। হয়তো আসবে। কিন্তু গতিহীনতার পেছনে কারও ব্যর্থতা থাকলে সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার বলে অনেকে অভিমত দিয়ে থাকেন।
তবে এটা মানতে হবে যে, যেটুকু তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে তাতেই দেশের আমূল পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। আজ থেকে বছর দশেক আগেও আমাদের দেশে মিডিয়ার এত আধিক্য ছিল না। গ্রাম-গঞ্জের এবং শহরেরও অধিকাংশ মানুষকেই দেশের খবরাখবরের জন্য বিটিভির রাত আটটার খবরের উপর নির্ভর করতে হতো। এছাড়া টেলিভিশনে প্রচারিত নাটক, চলচ্চিত্র, গান-বাজনা, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ইত্যাদিও ছিল সীমিত পরিসরে। কিন্তু আজ এক দশক পেরিয়ে আমরা টিভি চ্যানেলের ভিড়ে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হবার অবস্থায় পৌঁছেছি। দেশে এখন প্রায় গোটা তিরিশেক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, আছে শত শত জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা। বিবিধ টিভি চ্যানেলের বিবিধ অনুষ্ঠান। কোনো চ্যানেল সিনেমা, নাটককেন্দ্রিক; কোনোটা সারাদিন শুধু গানই প্রচার করছে; কোনোটা খেলা প্রচার করছে; কোনোটা আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে শুধু সংবাদ, সংবাদ বিশ্লেষণ ও টক শো প্রচার করছে। অনলাইন পত্রিকার সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অনলাইন পত্রিকা যাত্রা শুরু করছে। ইদানীং অনলাইনভিত্তিক টিভি চ্যানেলেরও আনাগোনা শোনা যাচ্ছে। তবে এ দেশে দেশীয় চ্যানেলগুলোর চেয়ে বিদেশি চ্যানেলগুলোরই কদর দেখা যায় বেশি। টিভি চ্যানেল ও পত্র-পত্রিকার পর বাংলাদেশের তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তির আকাশে হঠাৎ জ্বলে ওঠা নক্ষত্রের নাম ফেসবুক। অল্প দিনের ব্যবধানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘ফেসবুক’ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যবহার করছেন। কী হয় না ফেসবুকে! যে একটি স্থানে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ একত্রিত হচ্ছে এবং সারা দেশের ঘটনাবলী ও তার বহুমুখী বিশ্লেষণ একসাথে পাচ্ছে, তা হচ্ছে ফেসবুক। বন্ধু নির্বাচন, আড্ডা দেওয়া, রাজনৈতিক জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস দিয়ে হোমপেজ সরগরম রাখা থেকে শুরু করে রাজপথ সরগরম রাখার প্রচেষ্টা বা অপচেষ্টা কোনোটাও বাদ নেই। আবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বলা হলেও ফেসবুক থেকে এখন ব্যবসায়ীরাও বিশাল সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।
এই আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির একটি দিক অর্থাৎ আপতদৃষ্টে উপকারের দিক। এবার আলোচনা করব অপর দিকটি নিয়ে, যাকে অকল্যাণের দিক বলা যেতে পারে। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের জীবনে একটি নীরব বিপ্লব সম্পন্ন করে ফেলেছে। আমাদের জীবন-ধারার অধিকাংশই পরিবর্তন করে ফেলেছে। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উদ্গাতা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্বকে অনুকরণ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর তথ্য-প্রযুক্তি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছে। এতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা বাঁধল তখন- যখন দেখা গেল আমাদের দেশে পশ্চিমা প্রযুক্তির সাথে সাথে পশ্চিমা সংস্কৃতি তথা ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গিও আমদানি করার চেষ্টা শুরু হলো। একবারও ভাবা হলো না যে, পশ্চিমা বিশ্বের সমাজব্যবস্থা আজ যে রূপ ধারণ করেছে তা একদিনে হয় নি। হয়েছে দীর্ঘ সময়ের ক্রমাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। ঐ সমাজ-সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি শুধু ভিন্নই নয়, একেবারে বিপরীতমুখী। এখানে ওটাকে জোর করে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই আজ দেখা যাচ্ছে, আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সংস্পর্শ পাওয়া দেশের যুবসমাজের একটি বিশাল অংশ না পশ্চিমা আদর্শের ধারক হচ্ছে, না তাদের চরিত্রে এ দেশীয় স্বকীয়তা বজায় থাকছে- এরা পরিণত হচ্ছে এক প্রকার পরগাছায়। এরা পশ্চিমা আদর্শ অর্থাৎ চুরি করব না কারণ এটা দেশের সম্পদ- এই শিক্ষা যেমন পাচ্ছে না, তেমনি চুরি করলে পাপ হবে- প্রাচ্যের এই সাধারণ শিক্ষাটাও হারাচ্ছে। পরিণতিতে তারা জাতির ক্ষতি হয় এমন কাজ নির্বিকারভাবে করতে পারছে।
বাংলাদেশে ক্রমাগতহারে সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ বাড়ছে। পারিবারিক কলহের জের ধরে বা আর্থিক ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে গ্রামাঞ্চলে হত্যা-সংঘর্ষের পরিমাণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। মানুষের মধ্যে ভয়ানক লোভ-লালসার বিস্তার লক্ষ করা যাচ্ছে। বাবা-মাকে জবাই দেওয়া, স্ত্রী-পুত্রকে হত্যা করা, কিংবা পরকীয়ার জেরে স্বামী-সন্তানকে হত্যা করার ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত ঘটছে। বাংলাদেশে এ ধরনের নৃশংস ও অমানবিক ঘটনার সংখ্যা অতীতে খুব বেশি ছিল না। ইদানীং এসব বেড়ে গেছে এবং বেড়ে গেছে অতি আশঙ্কাজনক হারে। জেল-মামলা, আইন-আদালত কোনো কিছুই কাজে আসছে না। এ ধরনের পারিবারিক কলহের পেছনে ভিনদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সিরিয়ালের একটি বড় প্রভাব আছে বলে অনেকে মতামত প্রকাশ করছেন। এ নিয়ে বহু লেখালেখিও হয়েছে। কিছু জায়গায় মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। বিশিষ্ট জনরা মনে করছেন, এসব বিদেশি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে চলতে দেয়া না গেলে হয়তো কিছুটা হলেও পারিবারিক কোন্দল প্রশমিত হবে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও ইদানীং অসামাজিক কাজের প্রমাণ মিলছে। শোনা যাচ্ছে দেশের একটি বিরাট সংখ্যক তরুণ ক্রমেই এই মিডিয়াতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। একবার ফেসবুক রোগ পেয়ে বসলেই আর রক্ষা নেই। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ইচ্ছামত ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ে সারাদিন বসে থাকতে হয় কম্পিউটার-ল্যাপটপ বা মোবাইলের স্ক্রিনের সামনে। এ নিয়ে প্রায়শই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। এ ছাড়া ফেসবুক ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা, পরীক্ষার গোপন প্রশ্নপত্র প্রকাশ, জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও ধর্মানুভূতিতে আঘাতসহ বিবিধ অপকর্ম করে চলেছে অনেকে। ফলে ফেসবুকের কল্যাণকর দিকের পাশাপাশি অকল্যাণকর দিক চিন্তা করে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সমাজচিন্তকরা। অবশ্য ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাক- এটাও কারও কাম্য নয়।
এর উপর আবার ভয়াবহ বিপদ দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেটে পর্ণ সাইটগুলো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে খুব সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে এসব অরুচিকর পর্ণ ভিডিও। অনেকেই রীতিমত তাতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে জীবনের শুরুতেই তাদের সর্বাধিক মূল্যবান যে জিনিস অর্থাৎ চরিত্র- তারা তা হারিয়ে ফেলছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা প্রবেশ করছে অস্বাভাবিক এক অন্ধকার জগতে। এর পরিণাম প্রাথমিকভাবে বোঝা না গেলেও, একটি পর্যায়ে তা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির জন্য ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে; যার ছটা ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে।
এই সকল বিষয়কে একত্র করলে যা দাঁড়ায় তাতে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সামনে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। আমরা এর ব্যবহার নিয়ে যতই উচ্ছ্বসিত হই, অপব্যবহার নিয়ে তার খুব কমই মাথা ঘামাই। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সমস্যা কেবল দু-একজনের নয়। জাতীয় সমস্যা। তাই এর সমাধানে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এখানে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন আসে। বিদেশি সংস্কৃতি-সভ্যতার প্রতি আমাদের অনুরাগ জন্ম নিয়েছে এবং নিজেদের সম্পর্কে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যাবতীয় বিপর্যয়ের এটা এক বড় কারণ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাবো কিন্তু নিজ সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, বিদেশ সংস্কৃতির আগ্রাসনকে নীরবে সমর্থন দিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে- বাঙালির সংস্কৃতি-সভ্যতা অন্য কোনো জাতির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বাঙালির ব্যক্তি মূল্যবোধ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক অন্যান্য জাতির জন্য অনুসরণীয় হবার যোগ্য। কাজেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার করে বৈদেশিক সংস্কৃতির আগ্রাসন ঘটানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। জাতির সামগ্রিক কল্যাণের জন্য এখনই এই অপচেষ্টা রুখে দেওয়া অনিবার্য।
(দৈনিক বজ্রশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত ০৭.১২.১৪)