Monday, February 23, 2015

মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া যখন শাস্তি!

(শুনুন হিন্দু পুরানের একটি কাহিনী)

রানী গঙ্গা সদ্য প্রসূত সন্তানকে নদীর জলে ফেলতে উদ্যত, 

আড়ালে দেখছেন রাজা শান্তনু

আমরা ছোটবেলায় সংখ্যা গণনা শেখার সময় অনেকেই পড়তাম একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ . . . আটে অষ্টবসু ইত্যাদি। হ্যাঁ, ঘটনাটা এই অষ্টবসুকে নিয়ে। তখন অষ্টবসু অর্থাৎ আটজন বসু ছিলেন স্বর্গের বাসিন্দা। দেব-দেবীদের সাথে থাকতেন, ঘুরতেন, বেড়াতেন, আনন্দ-খুশি করতেন। একদিন তাদের ইচ্ছা হলো পৃথিবীতে ঘুরতে আসার। সত্যি সত্যিই তারা পৃথিবীতে আসলেন নিজেদের বউদের সঙ্গে করে। তারা পৃথিবীর এমন একটি বনে পৌঁছলেন যেখানে বশিষ্ঠ নামের একজন অতি শক্তিধর ঋষির আশ্রম ছিল। ঋষি বশিষ্ঠ ছিলেন ঋষিদের সেরা, শক্তিমান রাজাধিরাজেরও রাজা। তার কাজে ব্যাধাত সৃষ্টি করার কথা কোনো মহাশক্তিধর রাজা-মহারাজাও চিন্তা করতে পারতেন না। ঋষি বশিষ্ঠের একটি গরু ছিল, যার নাম ছিল সুরভী। গরুটি অন্যান্য গরুদের মতো সাধারণ কোনো গরু ছিল না। সে একাই দশ হাজার মানুষের প্রয়োজনীয় দুধ প্রদান করতে পারতো। যাই হোক, অষ্টবসু যখন ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমে আসলেন তখন বশিষ্ঠ সেখানে ছিলেন না। কেবল তার গরুটি ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই গরুটি দেখে অষ্টবসুর মধ্যে অনত্যম বসু দ্যু এর স্ত্রী মুগ্ধ হয়ে গেল। তিনি গরুটিকে নিয়ে যাবার জন্য স্বামী দ্যু এর কাছে অনুরোধ জানালে অন্যান্য বসুরাও আর অমত করলেন না। হয়তো ভাবলেন- কী আর হবে, একজন ঋষির গরু নিলে তিনি কী আর করতে পারবেন? এই ভেবে তারা গরুটিকে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। আর এতেই ঘটল বিপত্তি!
ঋষি বশিষ্ঠ আশ্রমে এসে যখন গরু পেলেন না তখন যোগমারফত জানতে পারলেন সব ঘটনা। তারপর তিনি শুধু গরুটিকে ফিরিয়ে এনেই ক্ষান্ত হলেন না বরং অভিশাপ করে বসলেন যে, তোমাদের সবাইকে মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে এবং পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হবে। এ কথা শুনে তো অষ্টবসুর দফা রফা। পৃথিবী? কত কষ্টের জায়গা। কত অন্যায়, অবিচার হয় সেখানে। অশান্তিময় ওই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে? বসবাসও করতে হবে? তারা শুরু করলেন কান্নাকাটি। আকাশ-বাতাস, পশু-পক্ষী, গাছ-পালাও সে কান্নায় কষ্ট অনুভব করলো। এক পর্যায়ে ঋষি বশিষ্ঠের দয়া হলো। তিনি একটি উপায় বাতলে দিলেন যে, যদি কোনো স্বর্গের দেবী তোমাদেরকে পৃথিবীতে জন্ম দিতে রাজী হন তাহলে কেবল দ্যু ছাড়া অন্য সাতজনের পৃথিবীতে জন্ম নিলেই হবে, বসবাস করতে হবে না। তবে দ্যু-এর পাপ বেশি হওয়ায় তাকে বসবাস করতেই হবে।
অষ্টবসু এবার স্বর্গের দেবী গঙ্গার শরনাগত হয়ে ঘটনা খুলে বললে দেবী রাজী হলেন। কিন্তু কার ঔরষে অষ্টবসু পৃথিবীতে জন্ম নেবে? যার তার ঔরষে তো আর জন্ম নেয়া যায় না। এরা যে স্বর্গবাসী। অনেক খুঁজে ঠিক করা হলো কুরুবংশের প্রজাহিতৈষী রাজা শান্তনুর ঔরষে অষ্টবসু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে। অচিরেই গঙ্গার সাথে শান্তনুর সাক্ষাৎ ঘটল একটি নদীর কিনারায় যখন রাজা শান্তনু শিকারে বের হয়েছিলেন। রাজা শান্তনু দেবী গঙ্গার রূপ মাধুর্য দেখে অভিভূত হয়ে সেখানেই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। দেবী গঙ্গাও অমত করলেন না তবে কয়েকটি শর্তের কথা জানালেন।
  1. রাজা তাঁর কোনো বংশপরিচয় জানতে চাইবে না,
     
  2. তাঁর কোনো কাজের ব্যাখ্যা রাজা জানতে চাইবেন না,
  3.  তাঁর কোনো কাজে রাজা বাধা প্রদান করতে পারবেন না, যদি এর একটি শর্তেরও লঙ্ঘন করা হয় তাহলে গঙ্গা দেবী চলে যাবেন।
রাজা এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি তাতেই রাজী হলেন। বিয়ে হলো। বছর ঘুরতেই গঙ্গার গর্ভে রাজার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে রানী সাথে সাথে শিশুটিকে নদীতে ফেলে দিলেন। রাজা অবাক হলেন, মনকষ্টে ভুগলেন কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না, কারণ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না। এভাবে যে সন্তানই জন্ম নেয় রানী সাথে সাথে সন্তানকে পানিতে ফেলে দেন। রাজা কিছুই বলতে পারেন না। তিনি ক্রমেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সব সন্তানকে পানিতে ফেলে মেরে ফেললে বংশের ধারা রক্ষা হবে কী করে? সব থেকে বড় কথা হলো এমন কাজ কোনো মা করতে পারে? এক পর্যায়ে সাত সন্তানের মৃত্যুর পর অষ্টম সন্তানটি যখন ভূমিষ্ঠ হলো এবং রানী তাকে নদীতে ফেলার উদ্দেশ্যে নদীর ধারে গেল তখন আর রাজা শান্তনু চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি প্রতিবাদ করলেন, কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আর তখনই রানী শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে অষ্টবসুর শেষ বসু অর্থাৎ দ্যু’কে রাজার হাতে সোপর্দ করে সেখান থেকে চলে গেলেন। যাবার আগে অষ্টবসুর ঘটনা বর্ণনা করে নিজের পরিচয়ও প্রদান করলেন।

রানী গঙ্গা অষ্টম সন্তানকে জলে ফেলতে গেলে রাজা শান্তনুর বাধা প্রদান



শিক্ষনীয়: 

এখন শুনুন ঘটনাটি বলার তাৎপর্য। পুরানের এই দ্যু’কেই আমরা মহাভারতের কাহিনীতে ভীস্ম হিসেবে জানি। তিনি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শাস্তি হিসেবে, যে শাস্তি তাকে পেতে হয়েছিল দীর্ঘ জীবনে একটু একটু করে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে করতে। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে যিনি কখনও সত্যের পক্ষ নিয়ে কৃতার্থ হয়েছেন আবার কখনও অজ্ঞতাবশত মিথ্যার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। তবে সবশেষে তিনি সত্যকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন যার দরুন এত কষ্ট সত্ত্বেও তার জনম স্বার্থক হয়েছিল। কিন্তু আমাদের জনম কি স্বার্থক হবে? আমরা কি সত্যের ধারক? হলেও কতটুকু? বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে। দ্যু’ বসু পৃথিবীতে স্বেচ্ছায় আসেন নি, এসেছিলেন বাধ্য হয়ে। হয়তো আমরাও স্বেচ্ছায় আসি নি। অশান্তিময় এই পৃথিবীতে কেই বা স্বেচ্ছায় আসতে চায়? কিন্তু আজ আমাদের অবস্থা এই যে, আমরা অনেকেই ভাবি পৃথিবীই সব, আর অধিকাংশ মানুষ সরাসরি তা না ভাবলেও কার্যত তারা পৃথিবীর জীবন নিয়েই ব্যস্ত। কী ভয়ানক ব্যাপার!
পৃথিবী বড়ই কঠিন। এখানে শুধুই পরীক্ষা আর পরীক্ষা। এটা আরাম-আয়েশে বেঁচে থাকার জায়গা নয়। এটা সংগ্রামের জায়গা, দুঃখ-কষ্টের জায়গা। যারা পৃথিবীকেই সককিছুর আধার ধরে নিয়ে পার্থিব ভোগ-বিলাসে মত্ত রয়েছে তারা বিপথগামী ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তো- যুগে যুগে আমরা কত ঋষি-মুণি, দরবেস, পীর-ফকির, সন্ন্যাসী, ভিক্ষুর কথা জানতে পাই যারা এই জগৎ সংসারের মায়া ত্যাগ করে, পার্থিব কাজ-কর্ম ত্যাগ করে কেবল স্রষ্টাকেই খুঁজে ফিরেছেন, আত্মিক উন্নতি করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সমাজ-সংসার থেকে বের হয়ে বনে-জঙ্গলে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওটাও কোনো স্বাভাবিক জীবন নয়, মুক্তির পথ নয়। প্রকৃত মুক্তির পথ আমরা পাই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে। যেমন গীতায় আছে কর্মযোগ। কর্মযোগের মাধ্যমে কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব, পার্থিব জগতে বাস করেও, অন্য আর দশজন মানুষের সাথে জীবনযাপন করেও, সংসারধর্ম পালন করেও সন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব। তার জন্য বনে-জঙ্গলে যাবার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নিঃস্বার্থভাবে মানবতার কল্যাণে কাজ করা। নিজের জন্য নিজের সুবিধার জন্য কিছু না করে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সমাজসংসারে বসবাস করেও সন্ন্যাসধর্ম পালন করা যায়। এতে যেমন স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাওয়া যায় তেমন পৃথিবীকেও সুন্দর করা যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে যখন অর্জুনের দৃঢ়তার খুঁটি নড়বড় করছিল তখন মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা শ্রীকৃষ্ণ তাকে এই মুক্তির পথই দেখিয়েছিলেন।
ইসলাম ধর্মও একই কথা বলে। আল্লাহর রসুল নিঃস্বার্থভাবে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঘর-বাড়ি ত্যাগ করাকে অর্থাৎ জেহাদকে ইসলামের বৈরাগী বলে অভিহিত করেছেন। মহামতি বুদ্ধকেও আমরা দেখি এককালে সংসারের মায়া ত্যাগ করে তিনি সমাজ-সংসার ছেড়েছিলেন ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে সত্য পাওয়ার পর সমাজ-সংসারেই ফিরে এসেছেন ভিন্নভাবে, ভিন্ন উদ্দেশ্যে।
আবারো বলছি পৃথিবী মোটেও ভালো জায়গা নয়। কিন্তু তাই বলে আমরা পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যেতেও পারি না। আমাদের জন্য তাই সবচেয়ে ভালো হবে যদি নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে একে অপরের কল্যাণে সংগ্রাম করি, যেটা সকল নবী-রসুল-অবতার করেছেন। তাতে পৃথিবীও সুন্দর হবে, পরকালও সুন্দর হবে।

No comments:

Post a Comment