Tuesday, March 31, 2015

বাঘ কেন বিড়াল? জাতি কেন নিধনের দর্শক?

সন্ত্রাস-সহিংসতা, মানুষ হত্যার সুচক বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পুরো সমাজ ছেয়ে গেছে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে চলাচল করছে সাধারণ মানুষ। এই যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো ঘটছে, সবই কিন্তু ঘটছে সাধারণ মানুষের সম্মুখে। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে নিমেশেই সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করছে এটা তাদের দায়িত্ব নয়, এটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। এ কাজ করার জন্যই রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে। কিন্তু এত বড় কাজ কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে সম্ভব? রাষ্ট্র কি প্রত্যেক মানুষের পেছনে একজন করে নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্ত করে রাখতে পারবে? বস্তুত এ সমস্যা যেহেতু আমাদের সকলের তাই তার সমাধানে সকলকেই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এটা সকলের ধর্মীয় ও সামাজিক কর্তব্য, এমনকি অস্তিত্বের লড়াই।


মানবসমাজ ও মনুষ্যত্বকে আলাদা করে ভাবার উপায় নেই। অভিধান বলছে, ‘মানবসমাজ হচ্ছে পরস্পর সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসকারী মনুষ্যগোষ্ঠী।’ যে সমাজের প্রতিটি সদস্য একে অপরের সুখ-শান্তি, বিপদ-আপদ সবকিছু ভাগাভাগি করে চলে অর্থাৎ যে সমাজে মনুষ্যত্ব আছে সেটাই হচ্ছে মানবসমাজ। সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক এই সহানুভূতিপূর্ণ মানসিক অবস্থাকে সমাজের একটি অলিখিত নিরাপত্তা চুক্তিও বলা যায়। শুধু মানুষের দ্বারাই এমন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়, মানুষের আশারাফুল মাখলুকাত হওয়ার এটা একটি বড় কারণ।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের এই সমাজ উল্লিখিত সংজ্ঞা থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। মানুষের মানসিক অবস্থা সমাজের অস্তিত্বের প্রশ্নে বিরাট এক অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রীতি, সহযোগিতা, সৌহার্দ্য, দয়া-ভালোবাসার লেশটুকুও হারিয়ে যেতে বসেছে। জনাকীর্ণ পরিবেশে একজন মানুষকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, কেউ তার জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসছে না। হামলা প্রতিহত করা তো দূরের কথা, হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর আহত লোকটিকে যে হাসপাতালে নেবে, সে ন্যূনতম দায়িত্ববোধও মানুষ দেখাচ্ছে না। একজন ব্রিটিশ প্রশাসক বাঙালি জাতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, Bengalis are individually cowards but collectively cruel. অর্থাৎ বাঙালিরা একা থাকলে ভীরু, সমষ্টিগতভাবে নিষ্ঠুর।’ আমরা দেখেছি পকেট মার বা ছিঁচকে চোর বাগে পেলে কী হিংস্র আক্রোশে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই বাঙালি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতেও তারা দুর্বলের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে। কিন্তু যখন জনসমাগমপূর্ণ স্থানে সকলের চোখের সামনে মাত্র দু’-একজন সন্ত্রাসী বোমাবাজী করে মানুষ হত্যা করছে, দেশের সম্পদ ধ্বংস করছে, তাদেরকে প্রতিরোধ না করে আক্রান্ত মানুষগুলোকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে শত শত মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। এমন দৃশ্য বাঘের আক্রমণে ভেড়ার পালের বেলায় মেনে নেওয়া গেলেও আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের বেলায় কীভাবে মানা যায়? তার তো কথা ছিল নিজের জীবনে ঝুঁকি নিয়ে হলেও অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার। কথা ছিল সমাজের একটি মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় পুরো সমাজের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠার। তাহলে কীসে মানুষকে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখছে?
দু’টি বিষয়। প্রথমত, সাধারণ মানুষ মনে করছে এই কাজ অর্থাৎ সন্ত্রাসী, আক্রমণকারী বা ভাঙচুরকারীদের প্রতিহত করার দায়িত্ব তাদের নয়। এটা পুলিশের কাজ। এ কাজ করার জন্যই তারা রাষ্ট্রকে কর দেয়। এ ধ্যান-ধারণা থেকে যে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে ক্ষতির শিকার হলে মনে করা হয় সে দায়ভার সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষের নয়, বরং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। সন্ত্রাসীদের শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে তাতেও সাধারণ মানুষের কোনো দায়ভার থাকে না, সর্ববিচারে সরকারি বাহিনীকেই দোষারোপ করা হয়।
দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। এছাড়াও আইনী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়। সহিংসতার ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রায়শই চেপে যান, কারণ ঘটনার সাক্ষী হলে সময় নষ্ট, বিবিধপ্রকার হয়রানি থেকে শুরু করে নিজের জীবনের উপরও বিপদ আসতে পারে ইত্যাদি।
এই দু’টি কারণেই মূলত অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। সমাজ যেন তার সংজ্ঞা থেকেই সরে যেতে চাইছে। পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র প্রভাবে অনাদিকাল থেকে সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিচালিত মানবসমাজ এখন পরিচালিত হচ্ছে স্বার্থচিন্তা ও আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে। কিন্তু সমাজের এই দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে যে সকলের ভাগ্যও পরিবর্তিত হচ্ছে, সকলের জীবনও যে অনিরাপদ হয়ে উঠছে সে হিসাব রাখছেন কয়জন?
অন্যায়, অবিচার, হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে, ভবিষ্যৎকে করছে আরও বিপদজনক। মানবসমাজে পারস্পরিক আস্থা বিকল্পহীন একটি অমূল্য সম্পদ, অথচ আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসহীনতা এমন এক হাহাকারের রূপ নিয়েছে যে, রাস্তা-ঘাটে, অলি-গলিতে হেঁটে চলা মাত্র দু’জন মানুষও একে অপরকে ছিনতাইকারী বলে সন্দেহ করতে থাকে। আর যার ব্যবসায়িক বা রাজনীতিক প্রতিপক্ষ আছে তার প্রতিটি মুহূর্তই কাটে আতঙ্কে। একটা মেয়ে কোথাও পথ হারিয়ে ফেললে কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ভরসা পায় না। মানুষগুলো যে সুস্থ শরীরে জীবিত আছে, সেটাই যেন তার অনেক বড় পাওয়া। বস্তুত সমাজ যখন স্বার্থচিন্তার মোহে অন্ধ হয়ে অনিরাপত্তায় ছেয়ে যায়, নৈতিক শিক্ষার অবমূল্যায়নের ফলে যখন প্রতিটি মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে তখন যে কোনো মানুষই অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হতে পারে। প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে বডিগার্ড সরকার কখনোই নিয়োগ দিতে পারবে না। তাই এ সমাজে যারা আক্রান্ত হয় তারা তো হয়-ই, যারা আক্রান্ত হয় না তাদেরও তখন এ কথা বলার উপায় নেই যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই সে আক্রান্ত হয় নি। আসলে সে আক্রান্ত হয় নি, কারণ সৌভাগ্যক্রমে সন্ত্রাসীরা তাকে টার্গেট করে নি। যদি টার্গেট করতো মাটির নিচে, বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় যেখানেই সে থাকুক না কেন, সে আক্রান্ত হতোই। অপরদিকে কেবল সন্ত্রাসীরাই নয়, সরকারি বাহিনীগুলোর অনেক অসাধু সদস্যও আজকাল পেশাদার খুনির ভূমিকা নিয়ে চুক্তিভিত্তিক খুন, গুম, ক্রসফায়ার করছে, অনেক সন্ত্রাসীও সরকারি বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অপকর্মগুলো করছে। অর্থাৎ এক কথায় আমাদের সমাজকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। একটি বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণা অর্থাৎ অনু-পরমাণুগুলো যদি তাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তাহলে সেটা আর ঐ বস্তুই থাকে না, অন্য বস্তু হয়ে যায়। যেমন তাপ দেওয়ার কারণে একটি চুম্বকের অনুগুলো যদি আকর্ষণ শক্তি হারিয়ে ফেলে সেটা আর চুম্বক থাকে না। বর্তমানে মানবসমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট (ব্যক্তি) তাদের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে, ফলে সমাজটিও তার ধর্ম হারিয়ে এমন এক বিশৃঙ্খল ভিড়ে পরিণত হয়েছে যার কোনো কল্যাণকর দিকই অবশিষ্ট নেই।
মানবসমাজ বস্তুর অণু-পরমাণুর ন্যায় অনেক মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এমন একটি অবস্থা যেখানে প্রতিটি মানুষ একজন অপরজনের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং পারস্পরিক ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, সহানুভূতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। সমাজ নামক এই বস্তুতে যখন স্বার্থচিন্তা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের মধ্যে থেকে দয়া-ভালোবাসা, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য নামক গুণগুলো ততই শিথিল হতে থাকে। ফলে বৃহৎ সমাজকাঠামোর প্রতিটি ইউনিট অর্থাৎ ব্যক্তিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যায় আর সমাজও ক্রমশই তার স্বতন্ত্রতা হারাতে থাকে। এরই চূড়ান্ত পরিণতি ভোগ করছি আমরা।
এমতাবস্থায় র‌্যাব-পুলিশ নয়, আইন-আদলত নয়, একমাত্র সমাধান হলো- মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে তার হারানো গুণগুলো অর্থাৎ সহযোগিতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা ইত্যাদি ফিরিয়ে আনা। নিশ্চিত ধ্বংস থেকে সমাজকে রক্ষা করার আর কোনো উপায় নেই। মানুষের চরিত্রের মেরুদণ্ড তার শিক্ষা, তাই তার চরিত্র পরিবর্তন করতে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। সেই নৈতিক ও চারিত্রিক শিক্ষায় ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মানুষের মনে যদি সর্বদা স্রষ্টার উপস্থিতির বোধ জাগ্রত থাকে, আখেরাতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয় জাগ্রত থাকে তাহলে আল্লাহর ভয়ে সে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। মানুষের মনে যদি দেশপ্রেম জাগ্রত থাকে তাহলে তার চোখের সামনে দেশ ও জাতির কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, দুর্বৃত্তকে বাধা দিতে গিয়ে বা বিপন্ন মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও সেটা শাহাদাত, এর বিনিময়ে সে আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাতে আশা করে তাহলে মানুষ অন্যের বিপদে এগিয়ে যাবে। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, রাস্তাঘাট নির্মাণ করার ক্ষেত্রে অর্থদানও সদকায়ে জারিয়া তাহলে জাতির কল্যাণে মানুষের ভূমিকা বৃদ্ধি পাবে। তখন সমাজে ঐ কথাটি প্রতিষ্ঠিত হবে যে, “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।” 
আজ মানুষের ঈমান ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা ভুলপথে পরিচালিত হওয়ার কারণে তা সমাজ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখনই সময়, তাদের ঈমানকে ধর্মব্যবসায়ীদের থাবা থেকে মুক্ত করতে হবে, তাকে বোঝাতে হবে, ইসলাম অর্থ শান্তি, তাই সমাজের মানুষ যেন শান্তিতে থাকে সে লক্ষ্যে কাজ করাই ইসলামের মূল কাজ, মুসলিমের মূল এবাদত। মানুষের ঈমানকেই যদি সঠিক পথে প্রবাহিত করা হয় তাহলে তা এই মুমূর্ষু জাতির জন্য মহৌষধের মতো কাজ করবে। মানুষ ও মানবসমাজ উভয়ই নিজ নিজ ধর্ম ফিরে পাবে। তখন তারা এককভাবে হবে সাহসী, সামষ্টিকভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যোদ্ধা জাতি অর্থাৎ রহফরারফঁধষষু ভবধৎষবংং ধহফ পড়ষষবপঃরাবষু ধ সরমযঃ. অন্যথায় যতই প্রচেষ্টা করা হোক, যতই আইন রচনা করা হোক, যতই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্য সংখ্যা ও তৎপরতা বৃদ্ধি করা হোক সমাজ কেবল ধ্বংসের পথেই এগোবে, মানুষও শান্তি পাবে না।

গণতন্ত্র যখন হরতালের রক্ষাকবচ ও জনতার মৃত্যুপরোয়ানা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে হরতাল এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। হরতাল কথাটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, সংঘর্ষের চিত্র; কানে ভেসে আসে সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আমলে আমাদেরকে এতবার হরতাল-অবরোধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে যে, এর উপর সাধারণ মানুষ বিষিয়ে উঠেছে। আইন করে হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও তুলেছেন অনেকে। কিন্তু সে প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। কারণ হরতাল সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যা-ই ভাবুক, সুশীলরা হরতালকে মনে করেন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন, সেই গণতন্ত্র মানুষের পছন্দ কি না তা তারা বিবেচনায় নিচ্ছেন না। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সরকারের জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুযোগ না দিলে সরকার ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে, ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে- এমনটাই আশঙ্কা তাদের। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও হরতাল-অবরোধ আহ্বানের অধিকার হারাতে চায় না। কারণ প্রতিপক্ষকে নিজেদের দাবি-দাওয়া মান্য করাতে (তা ন্যায্য বা অন্যায্য যা-ই হোক) এর চেয়ে ফলপ্রসূ অস্ত্র দ্বিতীয়টি নেই। সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় হরতাল অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষার চেয়ে বড় করে দেখা হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষাকে। যুদ্ধে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির মতো কথিত গণতন্ত্র রক্ষায় ডাকা হরতাল-অবরোধে যে প্রাণগুলো হারাচ্ছে, যে সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সবই যেন আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি (পড়ষষধঃবৎধষ ফধসধমব), যে ক্ষয়ক্ষতি না হলে ভালো, হলে কিছু করার নেই। গণতন্ত্রের যুদ্ধে এটা হয়ে থাকে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রবৃত্তি মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। হরতাল এমনই এক প্রতিবাদ মাত্র। অনেকে মনে করেন মহাত্মা গান্ধীই প্রথম হরতাল প্রচলন করেন। এ ধারণা সঠিক নয়। যতদূর জানা যায় হরতাল বা ধর্মঘটের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১১৫২ সালের ১৪ নভেম্বর। প্রাচীন মিশরের ফারাও শাসক তৃতীয় রামসেসের শাসনামলে দার-আল মদিনার রাজকীয় কারিগররা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতি পালন করতে থাকে। শ্রমিকদের এই ধর্মঘট মিশরের তৎকালীন শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ফলে শাসকরা দ্রুত কারিগরদের বেতন বৃদ্ধি করে দেয়। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ সালে ধর্মঘট আহ্বান করে রোমের প্লেবিয়ান সম্প্রদায়। তৎকালীন রোমের প্লেবিয়ানরা গণ্য হতো খুব নিচু শ্রেণি হিসেবে। তারা মূলত ছিল কর্মজীবী। রোমের আইন অনুযায়ী তাদের কোনো নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। সকল অধিকার ভোগ করত অভিজাত সম্প্রদায়। এই অভিজাতরা প্লেবিয়ানদেরকে ঋণের দায়ে আবদ্ধ করে দাসে পরিণত করতে পারত, এমনকি প্লেবিয়ানদের নিপীড়ন-নির্যাতন করতে করতে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলত। এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ সালে প্লেবিয়ানরা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দলে দলে শহর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী স্যাক্রেড মাউন্টেনে আশ্রয় নেয়। এদিকে কর্মজীবী সম্প্রদায়ের অভাবে দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কারখানায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে প্লেবিয়ানদের নির্যাতনের কল তৎকালীন ‘ঋণ আইন’ বিলুপ্ত হয়। এরপরও খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ থেকে ২৮৭ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি ধর্মঘটের মাধ্যমে প্লেবিয়ানরা সব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা অর্জন করে। একইভাবে শিল্প বিপ্লবের অন্যতম চারণভূমি ব্রিটেনে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে মালিকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং শ্রমিকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরপর কয়েকবার ধর্মঘট ডাকা হয়। ১৮৩৭, ১৮৩৮ ও ১৮৪২ সালে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে এবং অনেকাংশেই লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক পর্যায়ে মিশর, রোম, ব্রিটেন হয়ে বিংশ শতাব্দীতে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এই পদ্ধতি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ধর্মঘটকে অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন মহাত্মা গান্ধী।
হরতাল বা ধর্মঘট আহ্বান ও তার সফল বাস্তবায়নের এই ইতিহাসে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যার কোনো নজির নেই। আরও লক্ষণীয় যে, যুগে যুগে এ প্রতিবাদ কর্মসূচি কেবল নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, রাজনৈতিক অভিসন্ধী পূরণের জন্য নয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা হরতালের যে চেহারা দেখছি সেটার সাথে নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কার্যত কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। বরং সাধারণ মানুষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে, তাদের জীবন-সম্পদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে হরতালের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে, নাম দেয়া হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে যদি সাধারণ জনগণই অরক্ষিত হয়ে পড়ে তাহলে ওই গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা কী?
গণতন্ত্র যদি সত্যিকার অর্থেই মানুষের মুক্তি এনে দিতে পারত তাহলে হরতাল, অবরোধ, ঘর্মঘট ইত্যাদি আহ্বানের কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকতো না। হরতাল, অবরোধের কথা তখনই আসে যখন মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু মানুষ অধিকারবঞ্চিত হবে কেন? একটি জনমুখী কল্যাণকর সিস্টেম কখনই চাইবে না তার অধীনে পরিচালিত কেউ নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত হোক এবং সে অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হোক। কিন্তু প্রচলিত গণতন্ত্র এটা ধরেই নিয়েছে তার অধীন সমাজে জনবিরোধী কর্মকাণ্ড হবেই এবং এ জনবিরোধী কাজ থেকে সংশ্লিষ্ট সরকার বা ক্ষমতাসীনকে বিরত রাখার জন্য হরতাল-অবরোধ-ধর্মঘট পালন অনিবার্য! যেন চোরকে চুরি করতে বলে গৃহস্থকে বলা হচ্ছে সতর্ক থাকতে। কিন্তু এভাবেও কি শেষ রক্ষা হচ্ছে? আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনের ইতিহাস হলো- আমাদের দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কারণে-অকারণে, কখনও নিছক দলীয় দাবি দাওয়া পূরণের লক্ষ্যে হরতাল-অবরোধ আহ্বান করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। শুরু হয় সরকারের দমন-পীড়ন ও বিরোধীদের সহিংসতা। মাঝখানে প্রাণ হারায় উলুখাগড়া জনগণ। অর্থাৎ সাধারণ জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলন হবার কথা ছিল বাস্তবে সে আন্দোলনের যাতাকলে পিষ্ট হতে হয় সাধারণ জনগণকেই। সব মিলিয়ে, গণতন্ত্রের তত্ত্বকথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে একদিকে একটি দল মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, অন্য দল জনগণের অধিকার আদায়ের কথা বলে জনগণের মাথাতেই কাঁঠাল ভাঙছে। উভয়বিচারেই মরছে জনগণ, বেঁচে থাকছে গণতন্ত্র!

Monday, March 23, 2015

স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা


বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ সাল ছিল সর্বাধিক বেদনাদায়ক এবং একইসঙ্গে সর্বাধিক সাফল্যজনক একটি অধ্যায়। বেদনার বিষয় এই কারণে যে, এ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের লাগামহীন অত্যাচার-অবিচার ও জিঘাংসার শিকার হয়ে লাখো বাঙালিকে জীবন হারাতে হয়েছিল, সম্ভ্রম হারিয়েছিল অসংখ্য মা-বোন। বিধ্বস্ত হয়েছিল রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজসহ অসংখ্য স্থাপনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বছরটি বাঙালির জাতীয় পথচলায় স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে অমর হয়ে আছে আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎলব্ধ স্বাধীনতার কারণে। সেই একাত্তর আজও ষোল কোটি বাঙালির প্রাণের প্রেরণায় পরিণত হতে পারে। ঘুণে ধরা এই স্বার্থভিত্তিক সমাজে যখন অপরকে সুখী করতে কেউ স্বশরীরে একটি ফুলের আঁচড় নিতেও রাজী নয়, যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির দিকে শকুণের ন্যায় লোলুপ দৃষ্টি ফেলে রেখেছে, জাতির ঐক্য ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, সন্ত্রাসীরা স্বজাতির নিরীহ মানুষগুলোকে আগুন দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে, তখন একাত্তরের সেই নিঃস্বার্থ চেতনা বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নিপীড়িত, অত্যাচারিত, জনমদুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য রক্তে শিহরন জাগানো সেই স্লোগান আজ আবারও প্রাসঙ্গিক-
‘মোরা একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি’।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি:

স্বাধীনতা যুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয় নি, ৯ মাসের এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে বহু বছর লেগেছে। শত শত অন্যায়-অবিচারের স্টিম রোলার চলেছে এ জাতির উপরে। পাকিস্তানিরা ক্ষমতালাভের পর থেকেই এ দেশের মানুষের উপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, অপশাসন চালিয়েছে তারই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি রচিত হয়েছে এই যুদ্ধের মাধ্যমে। অন্যায়, অবিচার, যুলুমের বিরুদ্ধে বাঙালির সোচ্চার কণ্ঠের এটি একটি পর্যায়মাত্র। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ কেবল ৯ মাস নয়, বহু বছর ধরে চলেছে। সে যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদেরকে আরও আগে থেকে শুরু করতে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দীর্ঘ প্রায় আড়াইশ বছর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি আমাদেরকে শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ পাচার করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে, আর আমাদেরকে উপহার দিয়েছে ক্ষুধা-দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ। কোটি কোটি মানুষকে মরতে হয়েছে শুধু ক্ষুধার জ্বালায়। আমাদের মান-সম্মানকে বুটের তলায় পিষ্ট করেছে, আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ করেছে। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা বারবার পদদলিত হয়েছে। এরপর যখন ব্রিটিশরা চলে গেল, বলা হলো- তোমরা স্বাধীন। আর কেউ তোমাদের জীবন-সম্পদ দিয়ে খেলা করবে না, তোমাদের বাড়া ভাতে থাবা বসাবে না, না খাইয়ে মারবে না, অন্যায়, অবিচার করবে না, বৈষম্য করবে না। তোমরা একই ধর্মের মানুষ একই সাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। আমরা স্বভাবসুলভ সরল হৃদয়ে বিশ্বাস করলাম। ইসলামের সুমহান আদর্শ- সাম্য, ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে অর্থাৎ এই অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইসলামী জীবনাদর্শ উপহার দেওয়ার কথা বলে ভারত থেকে স্বাধীন জাতিসত্ত্বা নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি দেশ গঠন করা হলো। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান উভয় ভূখণ্ডের মানুষই মুসলমান। তারা এক আল্লাহকে সেজদাহ করে, একই দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ পড়ে। তারা এমন নবীর উম্মত যাঁর স্পষ্ট নির্দেশ- মুসলমান ভাই ভাই, মুসলমানের রক্ত ও মান-মর্যাদা একে অপরের জন্য হারাম (পবিত্র)। কাজেই ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূ-খণ্ডের ফারাক ধর্মের মেলবন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক উল্টোটা। একই ধর্মের মানুষ হিসেবে ভাই ভাই হয়ে বসবাস করার যে আশা করা হয়েছিল তা উবে গেল অল্প দিনেই। প্রতারক, স্বার্থবাজ, পাকিস্তানের নেতারা অচীরেই ভুলে গেল আল্লাহ ও আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে প্রদত্ত ওয়াদার কথা। পাকিস্তানি শাসকরা মুখে মুখে ধর্মকে আলিঙ্গন করে রাখলেও, অল্প দিনেই কার্যত ধর্মের লেবাস ছেড়ে ঘোর অধর্মের ডাল-পালা বিস্তার করল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক- সকল দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পদে পদে বঞ্চিত করা শুরু হলো। ব্রিটিশ শোষকদের প্রেতাত্মা ভর করল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উপর। ঔদ্ধত্য তাদেরকে এতটাই অন্ধ করে দিল যে, এ দেশের শত বছরের নির্যাতিত, নিপীড়িত সহজ-সরল মানুষের বুকে গুলি চালাতেও তারা দ্বিধা করল না। ভাষার জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, সর্বপোরি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার বাঙালির রক্ত ঝরতে লাগল। এরই ধারাবাহিকতায় রচিত হলো ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ এর নির্বাচন এবং ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। যখনই পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ দেশের নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ছক এঁকেছে, এ দেশের কোটি কোটি মানুষ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ফলে পাকিস্তানি শোষকরা ব্যর্থতার গ্লানিতে জ্বলে অস্ত্রের ভাষায় নিজেদের ক্ষোভের প্রশমন ঘটাতে চেয়েছে। সারা বিশ্ব দেখেছে- বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়তার সাথে শোষকদের প্রতিটি বুলেটকে হজম করেছে, কিন্তু পিছপা হয় নি। ঐক্যের শক্তির বারবার পরাজিত করেছে অস্ত্রের শক্তিকে, এমনকি পরাজিত করেছে ১৯৭১ সালেও।

স্বাধীনতার চেতনা মানে কি ধর্মহীনতা?

একাত্তরে এই জাতির সংগ্রাম ছিল অন্যায়, অবিচার, অনাচার, যুলুম, নির্যাতন তথা অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কোটি কোটি নিরীহ ও শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রাম। সেই সাথে সেটা ছিল ধর্মের নামে চলা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রকৃত ধর্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। নিরীহ মানুষকে আল্লাহু আকবার বলে গুলি করলেই কি সেটা বৈধ হয়ে যায়? না, হয় না, বরং সে কাজ আরও গর্হিত হিসেবে প্রতিভাত হবার যোগ্য। একাত্তরে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী এমন গর্হিত কাজই করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের সকল অপকর্মকে জায়েজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশের মানুষ ধর্মান্ধের মতো তাদের অন্যায় মেনে নেয় নি। কোনটা ধর্ম, কোনটা ধর্মব্যবসা- বাংলার লাখো কোটি জনতা তা ভালোভাবেই বুঝেছিল। তাই এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ধর্মের নামে চলা অধর্মের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ধর্মব্যবসায়ীরা লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়।
অর্থাৎ একাত্তরের চেতনা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো- আজ অনেকেই একাত্তরের চেতনা বলতে ধর্মহীনতাকে বোঝেন, যে ধর্মহীনতা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার চিন্তা-চেতনা, ভাবধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামবিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী কিছু লেখক-সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ার প্রচারণা এবং ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবে বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের সামনে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা কার্যত উধাও হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে কৌশলে দেশপ্রেমিক তরুণদের মধ্যে ধর্মহীনতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে।
আমরা সকলেই জানি- মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মুক্তির লক্ষ্যে। কী থেকে মুক্তি? যে কোনো অন্যায়, অসত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, তা সামাজিক হোক, রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয় হোক। একটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী দুর্নীতি করলে তার দায়ভার যেমন ওই সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান নেবে না, ওই দুর্নীতিবাজ কর্মচারীকে নিতে হবে, তেমনই ধর্মের দোহাই দিয়ে যদি কেউ অপকর্ম করে তার দায়ভারও ধর্ম নেবে না, এর জন্য দায়ী করতে হবে ওই ধর্মব্যবসায়ীদেরকে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যুগে যুগে ধর্মই মানুষকে অসত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে সত্যের আলোয় আলোকিত করেছে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ধর্মহীন দল হিসেবে প্রচার করতো তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো পরের কথা, শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতে হতো এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একইভাবে লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা ধর্মহীনতার চেতনা নিয়ে যুদ্ধ করেছে- এমন ধারণাও নিতান্তই অর্বাচীনসুলভ। কাজেই একাত্তরের চেতনার সাথে ধর্মহীনতাকে জুড়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস থেকে সকলের বের হয়ে আসা উচিত।

ক্রিকেট উন্মাদনায় ভাসছে দেশ/ হারিয়ে যেতে বসেছে জাতীয় খেলা কাবাডি


বিশ্বায়নের এই যুগে আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটও এগিয়ে চলেছে- বিষয়টি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের হলেও একইসাথে সতর্ক থাকতে হবে যেন এই ক্রিকেটই আবার আমাদের লজ্জায় না ফেলে। এমন আশঙ্কা হবার কারণ আছে। ক্রিকেট কোনো যুদ্ধ নয়, প্রতিশোধের অস্ত্র নয়। এটি একটি খেলা, নিছক বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু ইদানীং আমরা যেন সেটা ভুলে যেতে বসেছি। যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দেয়, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে খালি হাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সে জাতি কীভাবে চরম হানাহানি-রক্তপাতময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও খেলাকে কেন্দ্র করে উন্মাদনায় ভাসতে পারে তা আমার বোঝে আসে না। উন্মাদনা শব্দটি যদিও নেতিবাচক, তথাপি ক্রিকেটের উন্মাদনা যদি ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু এ উন্মাদনা এখন খেলার পরিসর ছেড়ে বাস্তব জীবনেও প্রবেশ করছে।
মাত্র দুইমাসের ব্যবধানে এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া শতাধিক মানুষ চোখের সামনে পুড়ে মরে গেল, নারী-শিশুও উন্মত্ত হায়েনার লোলুপ থাবা থেকে বাঁচতে পারল না। এমতাবস্থায় দেশের কোটি কোটি মানুষের আত্মা কেঁপে উঠার কথা, এ ঘৃণিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা, হিংস্র-নরপশুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা। আমরা কি তা করেছি? করি নি, বরং জাতির এই দুর্দিনে কিনা আমরা একটি ক্রিকেট ম্যাচের জয়কে কেন্দ্র করে আনন্দে-উন্মাদনায় আত্মাহারা হয়েছি! রাস্তায় রাস্তায় নেচে-গেয়ে ফূর্তি করেছি। বিগত দিনগুলোর সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর কথা ভেবে বলুন তো, এ দুঃসময়ে কি এমন উন্মাদনা মানায়? পরিহাসের এখানেই শেষ নয়। অবরোধ-হরতালের মধ্যে জীবন্ত মানুষ পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হলো, কত পরিবার সর্বশান্ত হলো, কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়িয়ে ও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু কোনো কথাতেই, কোনো আর্তিতেই যারা হরতাল বন্ধ করেন নি, তারা কিনা হরতাল বন্ধ রাখলেন ক্রিকেট জয়ের আনন্দ মিছিল করার জন্য! আনন্দ মিছিল করল সরকারী দলও। এটা কি সভ্য মানুষের কাজ হলো? আজ তারা আনন্দ মিছিল করলেন, কই- হাজার হাজার স্বজন হারানো মানুষের কথা চিন্তা করে, কিংবা এখনও যারা বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে একদিনও তো তারা শোক মিছিল করলেন না, হরতাল বন্ধ রাখলেন না? ক্রিকেট যে একটি খেলা এবং খেলাকে খেলা হিসেবেই উপভোগ করা উচিত সে জ্ঞান কি আমাদের হারিয়ে গেছে? খেলার মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আমরা ভাবি- এই তো আমরা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হারিয়ে দিলাম, তারা ১৭৫৭ সালে আমাদের হারিয়েছিল, আমরা ২০১৫ সালে তার প্রতিশোধ নিলাম। কতটা জড়বুদ্ধির পরিচয়! ব্রিটিশ আমাদের হারালো অস্ত্র দিয়ে আমরা তাদের হারালাম ব্যাট-বল দিয়ে, তারা আমাদের মারল ভাতের অভাবে, আমরা তাদের মারলাম (!) রানের অভাবে। এই ব্যাট-বলের সাথে অস্ত্রের এবং ভাতের সাথে রানের পার্থক্য যদি না বুঝি তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের বোধ-বুদ্ধির গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দোষের কিছু থাকে কি?
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। বিশ বছর পূর্বেও এ দেশে কাবাডি অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কাবাডিই ছিল বড়দের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় একটি খেলা। গ্রামের বিনোদনপ্রেমী মানুষ ব্যাপক উৎসবমুখর পরিবেশে কাবাডি খেলতো। বলা যায়, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাবাডির সমপর্যায়ের খেলা আর নেই। মানসিকভাবেও ক্ষিপ্রতা, অবিচলতা, মস্তিস্কের গতিশীলতার জন্য খেলাটি অদ্বিতীয়। এসব গুণাবলীর কারণেই বাংলাদেশের জাতীয় খেলার মর্যাদা পেয়েছে কাবাডি। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্মের কয়জন এ খেলাটি খেলে বা খেলতে পারে? কাবাডি নামের একটি খেলার যে বাংলাদেশে একসময় ব্যাপক প্রচলন ছিল, পড়াশোনার প্রয়োজনে হয়তো সেটা অনেকেই জানে, হয়তো নিয়ম-কাননও কিছু মুখস্ত আছে, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, অধিকাংশ স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়–য়া ছেলে স্বচক্ষে কাউকে কাবাডি খেলতে দেখেনি এবং নিজেরাও খেলে নি। এই হলো বাংলাদেশের জাতীয় খেলার হাল। অথচ এই বাঙালিই কিনা দেশের চরম দুঃসময়েও ক্রিকেটের উন্মাদনায় বিভোর!
বাংলাদেশে এত ক্রিকেট উন্মাদনা এবং স্বদেশী খেলার ব্যাপারে অনীহার অন্যতম একটি কারণ হলো নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনম্মন্যতা। একটি খেলাকে মেরে ফেলার জন্য অন্য আরেকটি খেলাকে প্রণোদনা দেওয়াই যথেষ্ট। ক্রিকেটকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা চলছে, অন্যান্য খেলা বিশেষ করে কাবাডির ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। কাবাডিকে ভাবা হয় সেকেলে খেলা। অন্যদিকে ক্রিকেট ও ফুটবলকে মনে করা হয় আধুনিক। ক্রিকেটের জন্য যতকিছু করা হয় তার অর্ধেকও যদি কাবাডির পেছনে করা হতো তাহলে আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, কাবাডি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি খেলায় পরিণত হতে পারত। সেটাই হতো প্রকৃত দেশপ্রেমের পরিচয়। জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, হীনম্মন্যতা এবং বৈদেশিক সংস্কৃতি-সভ্যতার ব্যাপারে অতিরিক্ত অনুরাগী হবার কারণেই বর্তমানে আমাদেরকে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।
কোনো কিছুতেই ক্ষুদ্রতা বা সংকীর্ণতার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়। ক্রিকেট আমরা অবশ্যই খেলব। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল আরও দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা সকলের। কিন্তু অবশ্যই নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে নয়। বাঙালি হিসেবে আমাদের যে স্বকীয়তা আছে, আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছু নিয়েই সামনে এগোতে হবে। একটি-দু’টি খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সব ধরনের খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জাতীয় খেলা হিসেবে কাবাডির যে মর্যাদা প্রাপ্য তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই খেলাধুলার জগতে আমাদের ভারসাম্য ফিরে আসবে। তবে সব কথার শেষ কথা হিসেবে এটাই বলব যে, খেলাকে খেলা হিসেবেই উপভোগ করা উচিত, কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি ভালো নয়।

আপনার সন্তানকে নিয়ে একটু ভাবুন

শ্রদ্ধেয় মুরুব্বীগণ,
আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন। আমি আপনাদের পুত্র ও পৌত্রসম একজন তরুণ হিতাকাঙ্ক্ষী। বহুদিনের অব্যক্ত কিছু বাস্তব অনুভূতি ও সঞ্চিত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে বসেছি নিছক দায়বদ্ধতাবশত। অবশ্য এই দায়বদ্ধতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নয়, আমার বিবেক-বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব ও আমার ধর্মের প্রতি।
বহুবার শুনেছি, জেনেছি- শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, শিক্ষা ছাড়াও তেমন বিশ্বদরবারে কোনো জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, বারবার তাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিসম। একটি মানবশিশু মায়ের গর্ভ থেকেই চর্মচক্ষু লাভ করে, কিন্তু জগতে ওই চর্মচক্ষুই যথেষ্ট নয়। দৃষ্টির সাথে সাথে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে, ন্যায়-অন্যায়, করণীয়-বরণীয়, বৈধ-অবৈধ জ্ঞান প্রদান করে। চিন্তাশক্তি, বোধশক্তির দুয়ার উন্মোচন করে। সুবিস্তীর্ণ নীলাকাশ দেখে কেউ ভূত-প্রেতের নিবাস কল্পনা করে, আবার কেউ গ্রহ-নক্ষত্র-তারকারাজী দেখে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ভ্রমণের নকশা আঁকে, মহাবিশ্বের বিশালতা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে স্রষ্টার মাহাত্ম কীর্তন করে। দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যবধান শুধুই শিক্ষাপ্রসূত। এখন দেখার বিষয় হলো আমরা যে শিক্ষা লাভ করছি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা রেখে যাচ্ছি তা কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছে।
আজ আমাদের বাস্তবতা হলো, কোনো তরুণ-তরুণী অসম্ভব প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে নামকরা একটি দেশীয় বা ভিনদেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেলে তার পরিবার-পরিজনের আনন্দের অন্ত থাকে না। এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশিদের কাছে, যাচিত বা অযাচিত উভয়প্রকারেই। কার ছেলে কোন ভার্সিটিতে পড়ে, কার মেয়ে কোন নামকরা বিদ্যাপীঠে স্থান পেল অভিভাবকরা সেটাকেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে ভালোবাসেন। কিন্তু এ আত্মতৃপ্তির সঞ্জিবনী রস যে কবে শুকিয়ে গেছে সে খবর কি তারা রাখেন? বিনীত অনুরোধ- আগেই আনন্দে আটখানা হবেন না। আপনার আনন্দের সময় এখনও আসে নি। প্রতিষ্ঠানের নাম-যশ আপনার কোনো কাজে আসবে না যদি না প্রিয় সন্তানের সুশিক্ষা লাভ হয়। যখন দেখবেন আপনার ছেলে বা মেয়ে সুশিক্ষা লাভ করে মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছে, এই জগৎ-সংসারকে কিছু দিতে পারছে, কেবল তখনই আপনার আনন্দের সময় আসবে। তখন আপনি গর্ব করে বলতে পারবেন- আমার সন্তান শিক্ষিত এবং অবশ্যই সুশিক্ষিত; আমার সন্তান দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে মানবতার কল্যাণে কাজ করছে। আমি গর্বিত, আমি আমার সন্তানকে নিয়ে গর্বিত। কিন্তু যদি দেখেন আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তান দেশের জন্য নয়, মানুষের জন্য নয়, এমনকি পরিবার-পরিজনের জন্যও নয়- নিছক নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজের এতটুকু সুবিধা অর্জনের জন্য দেশ-জাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে, কিংবা কোনো দেশবিরোধী অসাধু স্বার্থান্বেষী মহলের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে তখন আর গর্ব নয়, আপনার পুত্রের সেই শিক্ষা আপনাকে লজ্জায় ডোবাবে। তাই বলছি, আগেই খুশিতে আটখানা হবেন না, সন্তানের দিকে দেখুন, শুধু বাবা হিসেবে নয় একজন দেশপ্রেমিকের দৃষ্টিতে বিচার করুন।
আমিও একজন বাবার সন্তান, আমার বাবাও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, সন্তানের সাফল্যে বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ আনন্দ পুরোটা অনুভব না করলেও, কিছুটা বুঝি। আপনিও আপনার সন্তানকে নিয়ে সীমাহীন আশাবাদী, সন্দেহ নেই। সেই আশার আলো যাতে অশুভ শক্তির দমকা হাওয়ায় মুহূর্তেই নিভে না যায় সে কারণেই বলছি- ভার্সিটি-কলেজে পড়–য়া সন্তানটিকে আরও একবার দেখুন। চর্মচক্ষুর পাশাপাশি অন্তরের চোখ দিয়ে দেখুন। ছেলে লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শেষে একদিন চাকরি-বাকরি করবে বা ব্যবসা করবে, কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করবে, অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্য তৈরি করবে- যদি এই হয় আপনার বাসনা তাহলে আমার কিছুই বলার নাই। আপনি অপেক্ষা করুন। নিশ্চয়ই আপনার আশা পূরণ হবে, কারণ যুগের হাওয়া ওদিকেই বইছে। তবে আপনার মনস্কামনা যদি হয় এমন, একদিন আপনার সন্তান এই দেশ, সভ্যতা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে উন্নত করবে, মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াবে তাহলে সেই আশা মিছে।
আপনি লক্ষ্য করেছেন কি, যে সন্তান কিছুদিন পূর্বেও আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করত আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসার পর সে আপনার সাথে কেমন আচরণ করছে? লক্ষ করেছেন কখনও- যে ধর্মের জন্য জীবন বাজি রাখতেও আপনি কুণ্ঠিত নন, যে সংস্কার কাল থেকে কালান্তরে আপনার পরিবার ও সমাজকে সমৃদ্ধি ও সোহাগের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে সেই ধর্ম, সেই সংস্কার-সংস্কৃতির ব্যাপারে আপনার সন্তানের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন? যে দেশের মাটির জন্য দলবেঁধে মা-মাটি-মানুষের গান গেয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেন, সহযোদ্ধাদের হাসিমুখে দাফন করে এলেন, সেই দেশের মাটি ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আপনার সন্তানের হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে পারছে কি? স্মরণ করুণ আপনার স্কুল-কলেজ-পাঠশালার শিক্ষকদের কথা যারা এখনও আপনার হৃদয়ের মণিকোঠায় সম্মানের সাথে পূজিত হন। আর বিবেচনা করুন আজ শিক্ষকদের প্রতি আপনার সন্তানের শ্রদ্ধা-সম্মানের পূর্ণতা বা ঘাটতির কথা। আপনার সন্তান কি তার শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সাফল্যের সাথে জীবন নদী পার হবার প্রেরণা কামনা করছে নাকি উচ্ছৃঙ্খলতা আর ঔদ্ধত্বপূর্ণতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষককে গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ করে রাখছে? জুতাপেটা করছে? এসিড নিক্ষেপ করছে?
নিজেকে প্রশ্ন করুন, বিবেকের কাঠগড়ায় বিচার করে দেখুন আপনার প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানটির গতিপথ কোন দিকে? আর চোখ-কান বন্ধ করে থাকবেন না। চারপাশটা একবার ভালোভাবে দেখে নিন। ভবিষ্যত কল্পনা করুন। দেখবেন গা শিউরে উঠবে। ভয়ঙ্কর এক অতল গহ্বরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনার সন্তানকে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আমি শিক্ষার বিরুদ্ধে নই। শুরুতেই বলেছি, শিক্ষা ছাড়া যে কোনো জাতি অন্ধ। জ্ঞানের আলো যতক্ষণ না ছড়াবে ততক্ষণ সে অন্ধকার ঘুঁচবে না, সমাজ ও দেশ আলোকিত হবে না। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, শিক্ষার নাম করে অশিক্ষা-কুশিক্ষা চালু থাকলে সেটা সমাজের অন্ধকারকে আরও ঘনীভূত করবে।
এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চলছি আমরা? শিক্ষাব্যবস্থায় যে রাহু প্রবেশ করেছে তার গ্রাস আমাদের ভবিষ্যতকে দিনদিন পঙ্গু করে ফেলছে, অথচ আমরা নিশ্চুপ! শুধু কি নিশ্চুপ, বরং এই ভয়ানক শিক্ষাব্যবস্থার করাল থাবায় ছেলে-মেয়েকে বন্দী করে রেখে আনন্দে আটখানা হচ্ছি, তাদের সুনিশ্চিত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিন্তা করে পুলকিত হচ্ছি। ভাবছি- এই বুঝি জ্ঞানের সূর্য উদিত হয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা অন্ধকারগুলো দূর করে দিবে, পৃথিবী সেই আলোর ঝলকে বিমোহিত হয়ে রবে। কত উদাসীন আমরা, কত অদুরদর্শী আমরা, সেই সাথে কত নির্বোধ আমরা!
আরো লক্ষ্য করুন, একদা সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আজ ক্লাসে আপনার ছেলেকে কী শেখাচ্ছে, কী পড়াচ্ছে। আপনার সরল ছেলেটির কানে কত জঘন্য বিষ ঢেলে দিচ্ছে, কীভাবে এক শ্রেণির শিক্ষক বিদেশি এজেন্ডা বাস্তাবায়ন করছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি একদিনের জন্যও আপনি আপনার সন্তানকে একথা বলেন নি যে, বাবা তোমার ক্লাসে কী পড়ানো হয়, কী কথা শোনানো হয় একটু বল তো। জিজ্ঞাসা করেন নি, কারণ হয়তো ভেবেছেন- আমি ওসবের কী বুঝব? খুব বুঝবেন। যদি সন্তান বোঝাতে চায় অবশ্যই বুঝবেন। আর যদি নেহায়েত অবজ্ঞাবশত আপনাকে এড়িয়ে যায় তাহলে অন্তত এটুকু বুঝবেন যে, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের কোনো শিক্ষা তাদেরকে দেওয়া হয় না।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম আপনার বংশে কোনো নাস্তিক নেই, ধর্মবিদ্বেষী নেই। আপনি নিজেও স্রষ্টার প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ ও তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করে থাকেন। আল্লাহ, আল্লাহর রসুল, ধর্মগ্রন্থকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় কষ্টের রোজগার থেকে গরীব-দুঃখীকে দান করেন, জায়গা-জমি বিক্রি করে হজ্ব করে আসেন, সমাজের কল্যাণে অবদান রাখেন। কিন্তু আপনার সন্তান আজ এমন কী শিক্ষা লাভ করল যে, খোদ স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রশ্নেই সে সংশয় বয়ে বেড়াচ্ছে? এক শ্রেণির শিক্ষক শিক্ষা প্রদানের নাম করে আপনার ছেলে বা মেয়ের মনে-মগজে একটু একটু করে ধর্মবিদ্বেষ প্রবেশ করাচ্ছে, ফলে একটি পর্যায়ে পৌঁছে আপনার সন্তান শুধু নাস্তিকই হচ্ছে না, ঘোর ধর্মবিদ্বষী কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে, যার সূত্র ধরে রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরে ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। যারা ধর্মবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তাদের দলে হয়তো আপনার বিশ্ববিদল্যায় পড়–য়া বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা সন্তানটিও আছে, কিন্তু আপনি তার কিছুই জানেন না। একবার চিন্তা করুন তো, ধর্মপ্রাণ একটি ছেলেকে মগজ ধোলাই করে ঘোর ধর্মবিদ্বেষী বানাতে একটি শ্রেণি কতটা বদ্ধ পরিকর ভূমিকা পালন করেছে? অথচ আপনি ঘুনাক্ষরেও তা টের পান নি। আজ এই ধর্মবিদ্বেষী ছেলেগুলো আপনার-আমার বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহ, আল্লাহর রসুল ও ধর্মগ্রন্থকে কতটা অরুচিকর ভাষায় গালাগালি করছে, প্রকাশ্যে লিখে বেড়াচ্ছে তার একটু নমুনাও যদি আপনি দেখতেন লজ্জা ও গ্লানিতে মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকতো না। সন্তান কিন্তু আপনার, তাকে শিক্ষা-প্রদান করে মানুষের মতো মানুষ করার দায়িত্বও ছিল আপনারই, এটা আপনার এবাদতের অংশ ছিল, সেটা করতে আজ আপনি ব্যর্থ হয়েছেন। একদিন এর জবাবদিহি আপনাকেও করতে হবে।
আপনি রাত-দিন পবিত্র কোর’আনকে ভালোবেসে চুমু খাচ্ছেন, আর আপনারই সন্তান আল কোর’আনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে, কী দাম রইল আপনার ভালোবাসার? যে নবীর নাম শুনলে আপনার চোখের কোন ভিজে যায় সেই নবীর শত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে আপনারই সন্তান যখন অকথ্য-অশ্লীল ভাষায় লেখালেখি করে, তখন আপনার ওই নবীপ্রেমের কোনোই মূল্য থাকে না। আপনার সন্তান তো এমন ছিল না? কে তাকে এমন বানালো? ভাবুন। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন। আর এড়িয়ে চলার উপায় নেই, বিষয়টি এড়িয়ে যাবার মতো নয়। জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আপনার সিদ্ধান্তের উপর। এখনই যদি না ভাবেন তাহলে অপেক্ষা করুন এর চেয়েও ভয়ংকর কোনো পরিণতির জন্য। কবরে গিয়েও শান্তি পাবেন না। হাশরের ময়দানে সর্বশক্তিমান ও চূড়ান্ত বিচারক আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে শুধু এই নিস্পৃহ-নির্জীব থাকার জন্য। আল্লাহ আপনাদের বোধোদয় ঘটিয়ে জাতিকে রক্ষা করুন।

হেযবুত তওহীদের নারীরা

রসুলাল্লাহর সময় নারীরা কেমন ছিলেন?

রসুলাল্লাহর সময় নারীরা মহানবীর সামনা সামনি বসে আলোচনা শুনতেন, শিক্ষাগ্রহণ করতেন, মহানবীকে প্রশ্ন করে জরুরি বিষয় জেনে নিতেন, অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শও দিতেন। এ সময় রসুলাল্লাহ ও মেয়েদের মাঝে কোনো কাপড় টাঙ্গানো ছিল এই ব্যাপারে কেউ কোনো দলিল দেখাতে পারবে না। নারীরা মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে, জুমা’র সালাতে, দুই ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতেন। তারা পুরুষের সঙ্গেই হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন, যেটা এখনও চালু আছে; তারা কৃষিকাজে, শিল্পকার্যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেছেন। এ সমস্ত কাজ তারা ইসলামের নির্দেশিত হেজাবের সাথেই করতেন। এমনকি রসুলাল্লাহর নারী সাহাবীরা পুরুষ সাহাবীদের সঙ্গে থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে সমানতালে অংশগ্রহণ করেছেন। মসজিদে নববীর এক পাশে তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা। এই বিশেষ চিকিৎসা ইউনিটে অধ্যক্ষ ছিলেন একজন নারী। অথচ আজ বিকৃত অতি পরহেজগার নারীদের এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই। বর্তমান ইসলামে যে নারী যত আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে গৃহ-অভ্যন্তরে অবস্থান করবেন তিনি তত বড় পরহেজগার হিসেবে গণ্য হন।


ধর্মব্যবসায়ীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পুরুষদের পাশাপাশি হেযবুত তওহীদের নারীরাও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন


হেযবুত তওহীদের নারীদের কর্মকাণ্ড:

হেযবুত তওহীদের মেয়েরা আন্দোলনের সমস্ত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এমামুয্যামান সব সময় চেষ্টা করেছেন পুরুষদের পাশাপাশি যেন মেয়েরাও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। নারীরা মহানবীর সঙ্গে থেকে বিস্ময়কর বিপ্লব সম্পাদনে যে ভূমিকা রেখেছেন তা এমামুয্যামান হেযবুত তওহীদের মোজাহেদাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। হেযবুত তওহীদের মেয়েরা শহরে এবং প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষকে তওহীদের বালাগ দিয়েছেন। মেলায়, মার্কেটে গিয়ে বই বিক্রী করেছেন, হ্যান্ডবিল বিতরণ করেছেন। তওহীদের বালাগ দিতে গিয়ে পুরুষদের সাথে অনেক মেয়েও হাসিমুখে জেল, জুলুম, ধর্মব্যবসায়ী আলেম ওলামাদের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন, ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন, নিজের ঘরবাড়ি ও পরিবার থেকে বহি®কৃত হয়েছেন। অনেকে স্বামী, সন্তান, সংসার পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন যেটা মহানবীর অনেক নারী সাহাবীর ক্ষেত্রেও হয়েছিল। মানবজাতির কল্যাণের জন্য, মানবজীবনে সত্য প্রতিষ্ঠা করে সুবিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার জীবন ত্যাগ করে অনেক মেয়ে কঠিন সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ বরণ করে নিয়েছেন।

উপার্জনে মেয়েরা:

পুরুষরা ব্যস্ত ১৬ কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। দিন নেই, রাত নেই কেবলই সংগ্রাম, সত্য প্রতিষ্ঠা ও মিথ্যার বেসাতি ধ্বংসের সংগ্রাম। কিন্তু পরিবার চলবে কী করে? উপার্জন করবে কে? বেঁচে থাকতে হবে তো। কিছু উপায়-উপার্জন তো করতেই হবে। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এই উপার্জনের দায়িত্ব তখন কাঁধে তুলে নিয়েছেন হেযবুত তওহীদের নারীরা। পিঠা বিক্রি করে, দোকানে দোকানে, রাস্তা-ঘাটে, বাড়িতে বাড়িতে বই-পুস্তক বিক্রি করে, খেলনা বিক্রি করে, পত্রিকা-ম্যাগাজিন বিক্রি করে হলেও আল্লাহর রাস্তায় নিবেদিত স্বামী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন তারা। আল্লাহর রহমে অনেক সদস্যা পরিবারের খরচ যোগানোর পর তার নিজের উপার্জন থেকে আন্দোলনের ফান্ডেও অর্থপ্রদান করে সত্য প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। ধর্মীয় কুসংস্কারসহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের সমাজে এখনও নারীদের আয়-উপার্জনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। বিশেষ করে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি বাড়ির বাইরে গিয়ে নারীদের উপার্জনের বিরোধিতায় লিপ্ত। ধর্মের লেবাসধারী এই অধার্মিকরা জাতির অর্ধেক নারীকে কার্যত অক্ষম করে রাখতে চায়। তাই হেযবুত তওহীদের নারীদের জন্য কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। অনেক স্থানেই ধর্মব্যবসায়ী ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কার্যত ধর্মান্ধরা হেযবুত তওহীদের নারীদেরকে নিয়ে কটূক্তি করেছে, এমনকি গালাগাল পর্যন্ত করেছে। কিন্তু হেযবুত তওহীদের মোজাহেদারা সত্যের ধারক, সত্যের বাহক, তাই সত্য কাজ নিয়ে কোনো হীনম্মন্যতা তাদের নেই। কে কী বলল, কে কী মনে করল তা না দেখে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই পরম পাওয়া ভেবে নিশ্চিন্তে পুরুষদের পাশাপাশি উপার্জনে শরীক হয়েছেন।

জাতীয় অস্থিতিশীলতা নিরসনে দেশজুড়ে হেযবুত তওহীদের নারীরা:

বাংলাদেশের জনগণকে প্রায়শই রাজনৈতিক অচলাবস্থার মাঝে পড়তে হয়। ধ্বংস হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ, রুদ্ধ হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি। জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, হরতাল, অবরোধের সর্বনাশা আগুনে জ্বলে ছাই হয় শত শত নিরাপরাধ প্রাণ। এই সবকিছুর প্রধান কারণ হলো জাতীয় অনৈক্য। তাই এ অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে চাইলে সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে জাতিকে ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এই সময়পোযোগী কাজেই নেমেছে হেযবুত তওহীদ, আর তাতে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে আন্দোলনের নারী সদস্যরা। মূমুর্ষু এই জাতির জীবন ফিরে পাবার একমাত্র মহৌষধ নিয়ে পুরুষদের পাশাপশি দেশজুড়ে ছুটে চলেছে হেযবুত তওহীদের নারীরা। তারা ছুটছে পথে-প্রান্তরে, নগরে-বন্দরে, মন্ত্রী-এমপি-পুলিশ প্রধানের কার্যালয় থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলার সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, অফিস-আদালত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, শিক্ষক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, ছাত্র, সাংবাদিক, আইনজীবী, কৃষক, শ্রমিক পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের কাছে। এমনকি গ্রাম পর্যায়ের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষগুলোর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা সঙ্কট নিরসনে সকলকে সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান পৌঁছে দিচ্ছেন।
এর আগে ২০১৩ সালে দেশব্যাপী রাজনৈতিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করলে, ক্রমাগত হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, সংঘাত-সংঘর্ষ অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে গেলে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা যখন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেতে ভয় পাচ্ছিলেন, সরকারী দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা সহিংসতা দমনে ভূমিকা না রেখে উল্টো সাধারণ মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে গ্রাম ছাড়ছিলেন তখন দেশবাসীর বিপর্যয় ঘোঁচাতে হাত বাড়িয়েছিল হেযবুত তওহীদ। তখন হেযবুত তওহীদের মেয়েরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে সাহসিকতার নজির স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। তারা রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহর, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ ইত্যাদিতে গিয়ে হাজার হাজার বার জনসচেতনতামূলক ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও সংস্থা, প্রশাসনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সাথে আলোচনা অনুষ্ঠান করে সকলের শর্তহীন সমর্থন পেয়েছেন। হেযবুত তওহীদের মেয়েদের দ্বারা এমন হাজার হাজার ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে যেগুলোতে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের দু’হাত তুলে ঐক্যবদ্ধ হবার ঘোষণা দিয়েছেন। পরবর্তীতে সহিংসতা-সন্ত্রাস কমে আসার অন্যতম কারণ ছিল হেযবুত তওহীদের এই দেশব্যাপী প্রচার-প্রচারণা, যে কথা পরবর্তীতে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই বলেছেন। সারা দেশ যখন আতঙ্কিত, অতি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে বের হয় না, সরকারি দলের নেতাকর্মীরা এলাকায় যেতে ভয় পাচ্ছিল, প্রশাসনের গলদঘর্ম অবস্থা ঠিক সেই সময়ে হেযবুত তওহীদের মেয়েরা ষোল কোটি বাঙালির সামনে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জীবনের পরোয়া না করে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে এমন উদ্যোগ কেবল হেযবুত তওহীদের মেয়েদের পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। কারণ তারা যামানার এমামের অনুসারী, তারা ইসলামের সেই আকীদা পেয়েছেন যে আকীদা পেয়ে রসুলের নারী আসহাবরা তাঁবুর খুঁটি দিয়ে পিটিয়ে ফেতনাবাজ শত্র“সেনাকে পরাস্ত করেছিল।
এ ছাড়া দেশজুড়ে হেযবুত তওহীদ ও হেযবুত তওহীদের মিডিয়া পার্টনারের আয়োজনে যত সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার অধিকাংশেরই উপস্থাপনা, অতিথি আপ্যায়ন ইত্যাদির দায়িত্ব পালন করেছেন মেয়েরা। অনেক সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবেও বক্তব্য রেখেছেন আন্দোলনের নারী সদস্য। জাতির ক্রান্তিলগ্নে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে মানবতার কল্যাণে হেযবুত তওহীদের নারীদের এই আত্মনিবেদন মহান আল্লাহ অবশ্যই সফল করবেন।

আল্লাহর নির্দেশিত হিজাবের যথাযথ বাস্তবায়ন:

বর্তমানে বিকৃত পর্দাপ্রথার অজুহাতে আলেম-মোল্লারা মেয়েদেরকে গৃহকোণে বন্দী করে রাখতে চায়। তারা যে পদ্ধতিতে বোরকা দিয়ে মেয়েদেরকে মুড়ে রাখতে চায় তা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী বৈধ নয়। সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, মো’মেন নারীগণ যেন তাদের শরীরের সাধারণ প্রকাশমান অংশ ব্যতীত তাদের আভরণ বাইরে প্রকাশ না করে এবং তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ কাপড় দ্বারা আবৃত করে। সাধারণতঃ প্রকাশমান বোলতে এখানে হাত, মুখমণ্ডল, পায়ের গোড়ালী ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। তাই এমামুয্যামান হেযবুত তওহীদের নারীদেরকে এভাবেই হেজাব করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে মোতাবেক হেযবুত তওহীদের সকল মেয়েরাই আন্দোলনের কাজে বা ব্যক্তিগত কাজে বাইরে গেলে আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতিতে হেজাব করার চেষ্টা করে। মুখমণ্ডল ঢেকে রাখলে মানুষকে চেনার উপায় থাকে না, তাই আল্লাহর নির্দেশমত না করে বাড়িয়ে বা কমিয়ে হেজাব করা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা।

আন্দোলনের আলোচনা-অনুষ্ঠানে নারীরা:

হেযবুত তওহীদের মেয়েরাও পুরুষদের সঙ্গে একত্রে এমামুয্যামানের আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, সালাহ কায়েম করেছেন। কখনও কখনও শুধু মেয়েদেরকে নিয়েও এমামুয্যামান আলোচনা করেছেন, সেখানে মেয়েরা তাদের পারিবারিক নানা সমস্যার বিষয়ের সমাধান এমামের কাছ থেকে শুনেছেন, নিজেদের দীন সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর জেনে নিয়েছেন। এ কথা ভুললে চলবে না যে, জাতির প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। একজন মানুষের একটি পা কেটে ফেলে দিলে সে যেমন চলতে পারে না, তেমনি এ জাতিটিও মেয়েদেরকে স্বেচ্ছায় গৃহনির্বাসন দিয়ে নিজেদের একটি পা-ই কেটে ফেলেছে। কবি নজরুল এজন্যই বলেছেন,

“সে গৌরবের গোর হয়ে গেছে আঁধারের বোরকায়
আঁধার হেরেমে বন্দিনী হলো সহসা আলোর মেয়ে,
সেইদিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে
লক্ষ খালেদা আসিবে যদি এ নারীরা মুক্তি পায়।”
এছাড়া হেযবুত তওহীদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে সমস্ত রান্না মেয়েরাই করে থাকে। কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা, সেবাপ্রদান ইত্যাদি কাজেও মেয়েরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

দায়মোচন নয়, দায়িত্ব নিয়ে সন্ত্রাস প্রতিহত করুন

সহিংসতা-সন্ত্রাসের কবলে পড়েছে দেশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই আক্রান্ত হচ্ছেন সন্ত্রাসীদের দ্বারা। গত দুই মাসের সহিংসতায় অনেক মায়ের কোল খালি হয়েছে, অনেক সন্তান এতিম হয়েছে, অনেক পরিবার হয়েছে সর্বস্বান্ত। পুড়ে মরার মিছিল থেকে বাদ পড়ে নি অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রীলোকও। একেকটি বাসে আগুন মানেই যেন বার্ন ইউনিটের বীভৎসতা, আর্তনাদ, চামড়া পোড়ার গন্ধ, স্বজনের আর্তি, দেশ ও দশের আতঙ্ক-উত্তেজনা। পুলিশ-প্রশাসনের নিরাপত্তা বেষ্টনী কোনো কাজে আসে নি। এখনও ঘটছে অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত এই জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড। এ সহিংসতার কুশীলব কারা? দায়ভার কেউ নিচ্ছে না। কিন্তু দায়ভার কেউ না নিলেও সহিংসতা তো হচ্ছে, কেউ না কেউ তো করছে। তারা কারা?
সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য-বিবৃতিতে বারবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে দায়ী করা হচ্ছে। এর পেছনে শক্ত যুক্তিও তারা দেখাচ্ছেন। সেটা হলো- এই সহিংসতাগুলো ঘটছে বিএনপির অবরোধ-হরতালের মধ্যেই। তাছাড়া ককটেল-পেট্রলবোমাসহ অনেক বিএনপি-জামাতকর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কাজেই সরকার বিএনপিকে দায়ী করছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে তারা সহিংসতা-সন্ত্রাস, মানুষ পোড়ানোর সাথে জড়িত নয়। তারা কখনও বলছে সরকারই বিএনপির উপর দায় চাপানোর জন্য এসব করছে, আবার কখনও বলছে এসব তৃতীয় কোনো শক্তির কাজ। গত মাসের ১৪ তারিখে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী শাজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন- চলমান সহিংসতার জন্য বিএনপি দায়ী নয়। সুযোগ সন্ধানী তৃতীয় কোনো শক্তি এসব করতে পারে। এমন কথা আরও অনেকে বলছেন।
অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিকদের ভাষ্যমতে এ সহিংসতার জন্য সরকার ও বিরোধীপক্ষ কেউই দায়ী নয়। এটা করছে অন্য কেউ, অন্য কোনো শক্তি। যদি প্রশ্ন করা হয় কোন স্বার্থে অন্য কোনো শক্তি এসব করছে- উত্তর মিলবে না। তবুও না হয় ধরেই নিলাম তৃতীয় কোনো শক্তি করছে। এই তৃতীয় শক্তি কিন্তু সন্ত্রাসী শক্তি, সন্ত্রাস করেই তারা নিজেদের অস্তিত্বের আবহ তৈরি করেছে। সারা দেশ একদিকে আর কথিত এই তৃতীয় শক্তি একদিকে, পরস্পরবিরোধী সংঘর্ষে লিপ্ত।
এখন রাজনীতিকদের কাছে প্রশ্ন হলো- আপনারা সরকার ও বিরোধীপক্ষ কেউই যখন সে সন্ত্রাসের সাথে জড়িত নন, সকলেই যখন ধোয়া তুলশী পাতা তাহলে সে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে সোচ্চার হতে বাধা কোথায়? র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি, লক্ষ লক্ষ দলীয় কর্মী-সমর্থক সকলেই কি সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায় হয়ে গেলেন? গত দুই মাস যাবৎ দেশে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে, রাজনীতিক দলগুলোর বাইরে ভিন্ন কোনো অপশক্তি যদি এ কাজে লিপ্ত থাকে তাহলে এতদিনেও কেন আপনারা তার কোনো মাথা-মুণ্ডু আবিষ্কার করতে পারলেন না? সাধারণ নিরীহ-নিরপরাধ, রাজনীতি-জ্ঞানশূন্য মানুষ আগুনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে, ওই মানুষগুলোকে রক্ষা করার দায়িত্ব কার? অবশ্যই আপানাদের। কারণ আপনারাই পাঁচ বছর পর পর জনতার কাছে করজোড়ে ভোট ভিক্ষা করেন, আশ্বাসের ফাঁকা বাণী শুনিয়ে শান্তিময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান। এটাই কি সেই শান্তির নমুনা?
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে রাজনীতিকরা আরও বড় মনের পরিচয় দিতে পারতেন। জনগণ সংগঠিত নয়, তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক ধাপ এগোলে দুই ধাপ পেছনে ফেরে। প্রাণের মায়া, সংসারের মায়া তাদেরকে সন্ত্রাস-সহিংসতার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা থেকে বিরত রাখছে। কিন্তু আপনারা তো সংগঠিত। প্রতিটি জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম-মহল্লায় আপনাদের কমিটি আছে, লোকবলের অভাব নেই। সেই সংগঠিত শক্তি নিয়ে আপনারা পারতেন না সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে তো দেশের জন্য নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করে দেওয়া। তেমন কিছু তো আমরা দেখলাম না। আবার যারা জাতীয়তাবাদের ছাতা ধরে আছেন তারাই বা কোন আশায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হাত গুটিয়ে রয়েছেন? জনগণের জন্যই যদি আপনাদের আন্দোলন হয় তাহলে এ বোধ আপনাদের নিশ্চয়ই আছে যে, এখন সরকার পতনের চেয়ে সন্ত্রাস নির্মূল বেশি প্রয়োজনীয়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই দেশের মানুষ, এই দেশের সম্পদ রাজনীতিকদের জন্য আমানত। এই আমানতের হানি ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এ অবস্থায় যদি রাজনীতিকরা ঘর ছেড়ে মানুষের কাতারে এসে না দাঁড়ান তাহলে তারা মানুষের বিশ্বাস হারাবেন। তাই সরকার ও বিরোধীপক্ষ উভয়ের কাছেই আহ্বান- আর দায়মোচন নয়, এবার দায়িত্ব নিয়ে সন্ত্রাসকে প্রতিরোধ করুন।

সমাজ নিয়ে কেউ ভাবে না

কালের প্রবাহে আজ আমরা এমন একটি শোচনীয় পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছি যেখানে ব্যক্তি নয়, ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড়িয়েছে আমাদের সমাজ। মনুষ্যত্ব হারিয়ে সামাজিক জীব মানুষ রূপ নিয়েছে অমানবিক প্রাণিবিশেষে। এমন কোনো অন্যায়, অপরাধ নেই যা আমাদের সমাজে হচ্ছে না। নিজের পিতা-মাতাকে জবাই দিতেও মানুষের আত্মা কাঁপছে না, কোলের শিশুর জীবন নিতে দ্বিধা আসছে না, কয়েকশ’ টাকার লোভে নৃশংসভাবে একজন আরেকজনকে হত্যা করছে। স্বার্থের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত ন্যায়, সত্য, সুবিচার। এই ব্যক্তিগত স্বার্থান্ধতা হুমকির মুখে ফেলেছে সমাজকে। কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে সমাজের ঐক্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য। সমাজ হয়ে পড়ছে ভঙ্গুর, মেরুদণ্ডহীন প্রথাবিশেষে।
মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে প্রতিক্ষণে সমাজের সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। সমাজকে দিয়ে এবং সমাজ থেকে নিয়ে মানুষের পথচলা। চিরকালই মানুষের পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে তার সমাজ, তার আশেপাশের পরিচিত-অপরচিত মানুষগুলো। সমাজে মানুষে মানুষে সহযোগিতা-সহমর্মিতার মাত্রা যত বেশি থাকে সমাজ তত বেশি শক্তিশালী ও দৃঢ় হয়। আর সহযোগিতার পরিধি ক্ষুদ্র হলে সে সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্রতায় ডুবে থেকে ধ্বংসের প্রহর গুণে। বর্তমানে আমাদের সমাজের হাল-হকিকত সকলেরই জানা। যাদের দৃষ্টি আছে, অন্ধকার নামলে তাদেরকে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না যে অন্ধকার নেমেছে, তা রাতের অন্ধকারই হোক আর মিথ্যার অন্ধকারই হোক, আর যাদের দৃষ্টি নেই, অন্ধকার কেন, মৃত্যুখাদের কিনারে দাঁড়িয়েও তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে।
আফসোস এই জাতির জন্য, এই কোটি কোটি মানুষের জন্য, যারা ইতোমধ্যেই বোধ-বুদ্ধি খুইয়ে নিজেদের ও অনাগত বংশধরের জন্য মৃত্যুউপত্যকা রচনা করেছে নিশ্চিন্তমনে, কোনো প্রকার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ব্যতিরেখে। পতনোন্মুখ এই সমাজের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে, নির্যাতিত, নিপীড়িত, দুঃখ-কষ্টে কাতর মানুষের আর্তনাদ দেখেও যাদের কপালে ভাঁজ পড়ে না। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় স্বচক্ষে দেখার পরও যারা খাচ্ছে-দাচ্ছে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করছে কোনো প্রকার উদ্বেগ ছাড়াই, নির্বিকার চিত্তে। সমাজের এই অধঃপতন কি মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে না? পারছে, আসলে সমস্যাটা ওখানে নয়, সমস্যা হচ্ছে- মানুষের স্বার্থবাদিতা তাকে সমাজের এই অধঃপতন রোধে করণীয় থেকে বিরত রেখেছে। স্বার্থ নামক সামাজিক মহামারিটি সমাজকে এতটাই গ্রাস করে ফেলেছে যে, দয়া, মায়া, মমতা তার কাছে গৌণ। অপরের কী হচ্ছে না হচ্ছে, সুখে-আছে নাকি দুঃখে আছে, খেতে পেল কি পেল না- তা দেখার বিষয় নয়। নিজ দেশকে ভুলে, নিজ সমাজকে ভুলে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিজ পরিবার-পরিজনকে ভুলে মানুষ ব্যস্ত থাকছে নিজেকে নিয়ে। সমাজের প্রতিটি মানুষ আজ মোহাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অর্থের মোহ, ক্ষমতার মোহ, মান-সম্মানের মোহ বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরীমাকে করেছে অচল-অসার-নির্জীব।
এখন বলুন- এভাবে সমাজ চলতে পারে? সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সহযোগিতা, কেননা সমাজের প্রতিটি মানুষ সর্বদা একে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকে। এই সহযোগিতার শর্ত ভঙ্গ করে যদি স্বার্থবাদিতার ভিত্তিতে কোনো সমাজ দাঁড়াতে চায় সেটাকে আর যাই হোক মানুষের সমাজ বলা যায় না। তাই অতি জরুরি ভিত্তিতে এখনই সমাজকে ঢেলে সাজাতে হবে। সমাজ নিয়ে ভাবতে হবে। কেন ভাবতে হবে তার পক্ষে আরও ব্যাখ্যা আছে।
সমাজ হলো একটি ছাঁচ। এই সাঁচে পড়ে ওই সমাজে বসবাসকারী মানুষের চরিত্র রচিত হয়। একটি মানবশিশু জন্মের সাথেই কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। যেমন শিশুটি ছেলে হলে এক ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়, মেয়ে হলে আরেক ধরনের। অর্থাৎ লিঙ্গভিত্তিক কিছু প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য সে জন্মগতভাবেই লাভ করছে। কিন্তু এটা লক্ষণীয়, এ বেশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে শারীরিক বৈশিষ্ট্য, মানসিক বা চরিত্রগত নয়। চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হলো বৈধ-অবৈধ বা ন্যায়-অন্যায়বোধ, শিষ্টাচার, আদব-কায়দা, সহানুভূতি, দয়া-মায়া, ভালোবাসা, পরোপকারিতা ইত্যাদি। এই গুণগুলো একটি শিশু জন্মগতভাবে পায় না, এগুলো সে লাভ করে পরিবার, খেলার সাথী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সমাজ থেকে। একে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সামাজিকীকরণ।
পরিবার ও সমাজকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। কারণ পরিবার সমাজেরই একটি ক্ষুদ্রতম একক। একটি শিশু জন্মলাভ করার পর প্রথম সমাজের এই ক্ষুদ্রতম একক অর্থাৎ পরিবারের সাথে পরিচিত হয়। পরিবার থেকে সে আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, প্রাথমিক ন্যায়-অন্যায়বোধ শিক্ষা লাভ করে। শিশুর জীবনে সর্বাধিক প্রভাব পড়ে পরিবারের। তার পরিবার যে ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মবিশ্বাস লালন করে ওই শিশুটিও সেদিকেই প্রবাহিত হয়। পরিবার যদি সুশৃঙ্খল হয়, রুচিশীল হয়, মার্জিত ও ভদ্র-সভ্য হয় সে পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুটিও সাধারণত সুশৃঙ্খল, মার্জিত রুচিশীল ও ভদ্র-সভ্য হয়। আর পরিবার যদি কলহপূর্ণ হয়, ঐক্যহীন হয় তাহলে শিশুও সেভাবে বেড়ে ওঠে।
এই পরিবারেরই বৃহত্তর সংস্করণ হলো সমাজ। কাজেই পরিবার যেভাবে একটি শিশুর চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, সমাজও সেভাবেই ওই সমাজবদ্ধ প্রতিটি মানুষের চরিত্রকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি মাছ যখন পুকুরে বসবাস করে তখন তার বসবাসপ্রণালী একরকম থাকে, যখন বানের জলে ভেসে নদীতে যায় তখন ভিন্ন রকম হয়, আবার যখন নদী বেয়ে সমুদ্রে পৌঁছে তখন অতল সমুদ্রের বিভিন্ন প্রভাবকের সংস্পর্শে এসে তার জীবনপ্রণালী অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত একজন মানুষ পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়, সে বয়স পেরিয়ে গেলে তার জীবনের গতিপথ নির্ধারিত হয় সামাজিক ব্যবস্থার আলোকে। দাঙ্গাপ্রিয়, হিংসাত্মক, ষড়যন্ত্র ও অকৃতজ্ঞতায় পূর্ণ সমাজে আবদ্ধ হয়ে ভালো মানুষও হিংসা-বিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজে বসবাসরত অসৎ ও দাঙ্গাপ্রিয় লোকও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৎ জীবনের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। স্রোতের বিপরীতে খুব কম জনই তরী বইতে পারে।
যাই হোক, কোনো প্রকার চিন্তা-ভাবনা ব্যতিরেখেই এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আমরা বর্তমানে যে সমাজে বসবাস করছি সে সমাজ ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজ নয়, এ সমাজের সঞ্জিবনী শক্তি হলো স্বার্থ। স্বার্থকেন্দ্রিক এ সমাজে আপনি যতই ভালো হয়ে থাকার চেষ্টা করুন, ব্যর্থ হবেন, জীবনের প্রতি পদে হোঁচট খাবেন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অতি স্বল্পসংখ্যক মানুষ হয়তো এই বিপরীত স্রোতকে ডিঙ্গিয়ে যেতে সক্ষম হবেন কিন্তু মোটের তুলনায় তারা এতই নগণ্য যে, সমষ্টির চাপে তাদেরকে থাকতে হবে কোনঠাসা হয়ে। তারা সৎ হবেন বটে, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা এতই প্রখর যে, অন্যের অপকর্ম মুখ বুঁজে দেখা ছাড়া উপায় থাকবে না। এটাকে যদি আপনি সততা বলেন তাহলে গোটা জাতিতে হয়তো এমন হাতে গোনা কিছু সৎ লোকের দেখা মিলবে। কিন্তু বাকিদের অবস্থা? তারাই তো সমাজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গে অজগরের ন্যায় পেঁচিয়ে আছে। তাদের কথা ভাববে কে?
সমাজ নিয়ে যারা এক-আধটু চিন্তা-ভাবনা করেন, ভাবলে ভুল হবে যে, তাদের এ প্রয়াসের কারণ সমাজের উন্নতি ঘটানো, বরং তাদের এত ভাবনা-চিন্তার পেছনেও স্বার্থ কাজ করে। শিক্ষাকে তারা পণ্যে রূপ দিয়ে দরকষাকশি করছেন প্রতিনিয়ত। সমাজের গতিপথ কতটা মঙ্গলজনক, কতটা অমঙ্গলজনক- সেটা তাদের গবেষণার তালিকায় স্থান পায় নি, কারণ ওটাতে লাভের পাল্লায় কেবলই শুন্য। অন্যদিকে যে ধর্ম এসেছে সমাজের কল্যাণের জন্য, সেই ধর্মই এখন সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তির বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ধর্ম আর ধর্ম নেই, ধর্মগুরু প্রতারকরা ধর্মকে বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। আর্থিক বাণিজ্য, রাজনৈতিক বাণিজ্য- সবখানেই ধর্মের বাম্পার চাহিদা। ফলে সমাজ ও ধর্ম এখন বিপরীত অভিমুখে গতিশীল দুই মেরুর বস্তু। ধর্মব্যবসায়ীদের বাইরে যে কথিত ধার্মিক শ্রেণিটি বিদ্যমান তারা সমাজকে দুনিয়া জ্ঞান করে ও সমাজে চলা অন্যায়, অবিচারকে ফেতনা জ্ঞান করে সর্বদা এড়িয়ে চলেন। তাদের দৃষ্টি কখনও সাত আসমানের নিচে নামে না। সমাজকে পবিত্র করে যে পৃথিবীকেও স্বর্গে পরিণত করা যায় সে বোধ তাদের নেই। এভাবে সবাই যখন সমাজবিমুখ হয়ে নিজ নিজ স্বার্থের সিন্দুক আগলে রাখছেন, তখন একদল সন্ত্রাসী, অপরাধী, গডফাদাররা সমাজের দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে। ফলে কাকের ডিম ফুটে যেমন কোকিলশাবক বেরোয় না, তেমন এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজও ভালো মানুষ তৈরি করতে পারছে না।
এই যখন অবস্থা, তখন একটি বারও ভেবেছেন কি, আপনার অনাগত সন্তানের জন্য কেমন সমাজ রেখে যাচ্ছেন? মনে রাখবেন, এই সমাজের অনুকূলেই কিন্তু আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরের চরিত্র নির্মিত হবে। আমাদের সমাজ তো এমন ছিল না। কোথায় গেল বাঙালির চিরাচরিত সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য? কেন প্রকাশ্য দিনেদুপুরে একজন মানুষকে খুন করে খুনিরা শত শত মানুষের সামনে দিয়ে বীরদর্পে চলে যায় আর মানুষ দর্শকের ভূমিকা পালন করে, এমনকি কেউ ওই আহত ব্যক্তিকে টেনে তোলার সাহসটুকুও দেখায় না? কীভাবে আমাদের সমাজে স্বার্থবাদ এত প্রকট আকার ধারণ করল? এ প্রশ্নের উত্তর আজ হোক কাল হোক সন্ধান করতেই হবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের সমাজব্যবস্থার শত শত বছরের ইতিহাস হচ্ছে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ইতিহাস। সে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে কীভাবে স্বার্থবাদভিত্তিক নতুন এক কলঙ্কজনক ইতিহাসের পথ রচিত হলো তা অবশ্যই ভাবার বিষয়।

প্রতিবাদের ভাষা যখন মানবদেহে অগ্নিসংযোগ

প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে মানবদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সাড়া জাগানো আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল মূলত তিউনিসিয়ার এক বেকার যুবকের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে। মোহাম্মদ বুয়াজিজির নামের ওই যুবকটি এক পুলিশের দুর্ব্যবহারের কারণে জনসম্মুখে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার এই প্রতিবাদের ভাষা এতই কার্যকরী ছিল যে, তার আত্মাহুতির জের ধরে তিউনিসিয়ায় ব্যাপক সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং মাত্র ২৬ দিনের মধ্যে বেন আলী সরকারের পতন ঘটে। শুধু তিউনিসিয়ায় নয়, যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়েছে মুক্তিকামী মানুষ। কখনও সে ক্ষোভ অন্যরা অনুভব করতে পেরেছে, কখনও পারে নি। যাই হোক আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের প্রতিবাদের সমর্থক না হলেও এখানে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছি ইতিহাসের আলোকে পাঠকের সামনে বর্তমান সময়ের সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে। বর্তমান মানে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট।
পাঠক, বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নাম করে যা চলছে, আন্দোলনের নাম করে যে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, সহিংস কর্মকাণ্ড চলছে, ট্রাক-বাসের নিরীহ-নিরাপরাধ সাধারণ মানুষকে আগুন দিয়ে ঝলসে দেওয়া হচ্ছে এটাকে নিশ্চয়ই আপনি আর যা-ই হোক আন্দোলন বলবেন না। আন্দোলন হয় জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আন্দোলন হতে পারে না। চোরাগোপ্তা হামলা করে, সহজ-সরল মানুষের রক্তপাত ঘটিয়ে প্রকৃতপক্ষে কার লাভ হচ্ছে? লাভ তো কারও হচ্ছেই না, মাঝখান থেকে পৃথিবীর বুকে এই দেশটি একটি জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। পশ্চিমা মোড়লরা আমাদের ব্যাপারে অযাচিত নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলাফল আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
আমরা যদি ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাবো যে, মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছুক্ষেত্রে নিজেই নিজের গায়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, ছটফট করতে করতে প্রাণত্যাগ করে কার্যত যালেম শ্রেণির গালে চপেটাঘাত করেছে কিন্তু অন্যায়ভাবে নিরাপরাধ কাউকে জিম্মি করে বা অন্যের গায়ে আগুন দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করে নি। সারা পৃথিবীর মধ্যে একটি দেশও পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক দাবি আদায় করতে গিয়ে নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে নিরাপরাধ মানুষের শরীরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে অঙ্গার করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এ বর্বরতম দৃষ্টান্ত তথা কলঙ্ক রচিত হয়েছে একমাত্র আমাদের দেশেই। হতভাগা এই জাতিটিকে আরও কত দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে কে জানে।
যারা এ ঘৃণিত অপকর্ম করছে স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা তাদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য স্বার্থ প্রতিষ্ঠা, আখের গোছানো, মানুষের জীবন-সম্পদকে ব্যবহার করে নিজেদের অভিসন্ধি পূরণ করা। মানুষের জন্য যারা রাজনীতি করবে, মানুষের জন্য যাদের জীবন নিবেদিত তারা কীভাবে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে কয়লা বানাতে পারে? সাধারণ মানুষ বলে কি এদের প্রাণের দাম নেই? এই নিপীড়িত, অত্যাচারিত, অবহেলিত মানুষগুলোকে আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে? আর কত প্রাণ হারালে, আর কত মায়ের কোল খালি হলে, আর কত সন্তান এতিম হলে রাজনীতিকদের রক্তপিপাসা মিটবে?

লজ্জা হয় নিজেকে মানুষ পরিচয় দিতে!

ছি! লজ্জা এই মানবজাতির জন্য! ধিক্কার এই মানবজাতির জন্য! নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিতেও আজ কুণ্ঠা হয়। সৃষ্টির সেরা জীবের পদবীধারী (?) এই মানবজাতি দিনদিন যে বীভৎসতার পরিচয় দিচ্ছে তা জন্তু জানোয়ারের হিংস্রতাকেও হার মানিয়েছে। নিকৃষ্টতা, বর্বরতা ও হিংস্রতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করছে মানুষ দাবিদার কিছু নরপশু।
অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার আব্দুল মান্নানের ছেলে শিপন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও লাগামহীন সহিংসতার মধ্যেই পেটের দায়ে জীবন বাজি রেখে কাভার্ডভ্যান নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন চাপাইনবাবগঞ্জে মাল আনার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে হেলপার হিসেবে ছিল ১৪ বছরের শিশু শাকিল। কিন্তু রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ধারালো পথ অতিক্রম করে কেউই ফিরতে পারলেন না। গত মঙ্গলবার ভোরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে গণতান্ত্রিক সন্ত্রাসের বলি হতে হয় দু’জনকেই। গাড়ি থেকে নামার এতটুকু সুযোগ না দিয়ে একদল নরপিশাচ পেট্রল বোমা ছুঁড়ে গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে কাভার্ডভ্যানের ভেতরেই পুড়তে থাকে চালক শিপন ও হেলপার শাকিল। বহু কষ্টে দগ্ধ শাকিল ভ্যান ছেড়ে বের হতে পারলেও, বের হতে পারেনি চালক শিপন। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ঝলসে যায় সে। আমৃত্যু আগুনের যন্ত্রণা ভোগ করে মৃতুর কোলে ঢলে পড়ার পরও জ্বলতে থাকে শিপনের প্রাণহীন দেহটি। হতভাগা এই মানুষটির গোস্ত-চামড়া লেপ্টে যায় পোড়া সিটের লোহার সাথে, মেঝের সাথে। কোনো অপরাধ নেই, কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতাও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্ধ রাজনীতি তাকে ক্ষমা করল না। এ কেমন বর্বরতা? এ কেমন হিংস্রতা? মানুষ কেন বন্য পশুর চেয়েও অধম জানোয়ারে পরিণত হলো? আরে তুমি যাকে পোড়ালে, তুমি যার পরিবারের মুখের অন্ন কেড়ে নিলে সে তো তোমাদেরই মুখের অন্ন সরবরাহ করছিল! এটাই কি তার অপরাধ? যে শরীরের ঘাম ঝরিয়ে, রক্ত পানি করা পরিশ্রম করে শিপনের দরিদ্র সংসার চলতো সেই দেহখানি পেট্রল বোমার আগুনে জ্বলে কয়লায় পরিণত হলো। যে বয়সে একটি শিশুর বাবা-মার পূর্ণ আদর-সোহাগ ভোগ করার কথা সেই বয়সে শাকিল কিনা মানুষরূপী বন্য হায়েনার লোলুপ শিকারে পরিণত হলো। দেহের ৪০ শতাংশ পোড়ার দগদগে ক্ষত শিশুটি কতক্ষণ বয়ে বেড়াবে? শিশুটির প্রতিটি আর্তনাদ কি আমাদের জীবনে অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হবে না? রাজনীতিক অধঃপতনেরও তো শেষ বলে কথা আছে, মানসিক বিকারগ্রস্ততারও তো সীমা আছে। আমরা ভালোভাবেই জানি এরপরও রাজনীতিকদের লজ্জা হবে না, ক্ষমতার মোহ দূর হবে না, স্বার্থের জয়গীত বন্ধ হবে না। কারণ আমরা সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ নই। আমরা সহিংসতা-সন্ত্রাসকারীদের স্বার্থের বলি হয়েও নিশ্চুপ, উদ্বেগহীন, প্রতিবাদহীন। এ বীভৎসতাও আমাদের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা একযোগে সকল অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস, সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই না। নিয়তির উপর দায় চাপিয়েই দায়িত্বের ইতি টানি, যেন নিয়তিই এ দুর্ভোগের কারণ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পরিস্থিতি কি আমাদের কর্মফল নয়? মানুষের কর্মের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় মানুষের নিয়তি। তাই আর নিয়তির উপর অপবাদ নয়, আসুন এ অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হই, সন্ত্রাসকে প্রতিহত করি; পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং দেশ-মাটি ও মানুষের শান্তির কথা ভেবে, এমনকি শুধু নিজের অস্তিত্বের জন্য হলেও যাবতীয় অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলি।