Monday, March 23, 2015

ক্রিকেট উন্মাদনায় ভাসছে দেশ/ হারিয়ে যেতে বসেছে জাতীয় খেলা কাবাডি


বিশ্বায়নের এই যুগে আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটও এগিয়ে চলেছে- বিষয়টি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের হলেও একইসাথে সতর্ক থাকতে হবে যেন এই ক্রিকেটই আবার আমাদের লজ্জায় না ফেলে। এমন আশঙ্কা হবার কারণ আছে। ক্রিকেট কোনো যুদ্ধ নয়, প্রতিশোধের অস্ত্র নয়। এটি একটি খেলা, নিছক বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু ইদানীং আমরা যেন সেটা ভুলে যেতে বসেছি। যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দেয়, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে খালি হাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, সে জাতি কীভাবে চরম হানাহানি-রক্তপাতময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও খেলাকে কেন্দ্র করে উন্মাদনায় ভাসতে পারে তা আমার বোঝে আসে না। উন্মাদনা শব্দটি যদিও নেতিবাচক, তথাপি ক্রিকেটের উন্মাদনা যদি ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে আমার আপত্তি ছিল না, কিন্তু এ উন্মাদনা এখন খেলার পরিসর ছেড়ে বাস্তব জীবনেও প্রবেশ করছে।
মাত্র দুইমাসের ব্যবধানে এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া শতাধিক মানুষ চোখের সামনে পুড়ে মরে গেল, নারী-শিশুও উন্মত্ত হায়েনার লোলুপ থাবা থেকে বাঁচতে পারল না। এমতাবস্থায় দেশের কোটি কোটি মানুষের আত্মা কেঁপে উঠার কথা, এ ঘৃণিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কথা, হিংস্র-নরপশুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা। আমরা কি তা করেছি? করি নি, বরং জাতির এই দুর্দিনে কিনা আমরা একটি ক্রিকেট ম্যাচের জয়কে কেন্দ্র করে আনন্দে-উন্মাদনায় আত্মাহারা হয়েছি! রাস্তায় রাস্তায় নেচে-গেয়ে ফূর্তি করেছি। বিগত দিনগুলোর সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর কথা ভেবে বলুন তো, এ দুঃসময়ে কি এমন উন্মাদনা মানায়? পরিহাসের এখানেই শেষ নয়। অবরোধ-হরতালের মধ্যে জীবন্ত মানুষ পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হলো, কত পরিবার সর্বশান্ত হলো, কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়িয়ে ও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু কোনো কথাতেই, কোনো আর্তিতেই যারা হরতাল বন্ধ করেন নি, তারা কিনা হরতাল বন্ধ রাখলেন ক্রিকেট জয়ের আনন্দ মিছিল করার জন্য! আনন্দ মিছিল করল সরকারী দলও। এটা কি সভ্য মানুষের কাজ হলো? আজ তারা আনন্দ মিছিল করলেন, কই- হাজার হাজার স্বজন হারানো মানুষের কথা চিন্তা করে, কিংবা এখনও যারা বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে একদিনও তো তারা শোক মিছিল করলেন না, হরতাল বন্ধ রাখলেন না? ক্রিকেট যে একটি খেলা এবং খেলাকে খেলা হিসেবেই উপভোগ করা উচিত সে জ্ঞান কি আমাদের হারিয়ে গেছে? খেলার মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আমরা ভাবি- এই তো আমরা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হারিয়ে দিলাম, তারা ১৭৫৭ সালে আমাদের হারিয়েছিল, আমরা ২০১৫ সালে তার প্রতিশোধ নিলাম। কতটা জড়বুদ্ধির পরিচয়! ব্রিটিশ আমাদের হারালো অস্ত্র দিয়ে আমরা তাদের হারালাম ব্যাট-বল দিয়ে, তারা আমাদের মারল ভাতের অভাবে, আমরা তাদের মারলাম (!) রানের অভাবে। এই ব্যাট-বলের সাথে অস্ত্রের এবং ভাতের সাথে রানের পার্থক্য যদি না বুঝি তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের বোধ-বুদ্ধির গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দোষের কিছু থাকে কি?
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। বিশ বছর পূর্বেও এ দেশে কাবাডি অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কাবাডিই ছিল বড়দের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানীয় একটি খেলা। গ্রামের বিনোদনপ্রেমী মানুষ ব্যাপক উৎসবমুখর পরিবেশে কাবাডি খেলতো। বলা যায়, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাবাডির সমপর্যায়ের খেলা আর নেই। মানসিকভাবেও ক্ষিপ্রতা, অবিচলতা, মস্তিস্কের গতিশীলতার জন্য খেলাটি অদ্বিতীয়। এসব গুণাবলীর কারণেই বাংলাদেশের জাতীয় খেলার মর্যাদা পেয়েছে কাবাডি। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্মের কয়জন এ খেলাটি খেলে বা খেলতে পারে? কাবাডি নামের একটি খেলার যে বাংলাদেশে একসময় ব্যাপক প্রচলন ছিল, পড়াশোনার প্রয়োজনে হয়তো সেটা অনেকেই জানে, হয়তো নিয়ম-কাননও কিছু মুখস্ত আছে, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, অধিকাংশ স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়–য়া ছেলে স্বচক্ষে কাউকে কাবাডি খেলতে দেখেনি এবং নিজেরাও খেলে নি। এই হলো বাংলাদেশের জাতীয় খেলার হাল। অথচ এই বাঙালিই কিনা দেশের চরম দুঃসময়েও ক্রিকেটের উন্মাদনায় বিভোর!
বাংলাদেশে এত ক্রিকেট উন্মাদনা এবং স্বদেশী খেলার ব্যাপারে অনীহার অন্যতম একটি কারণ হলো নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে হীনম্মন্যতা। একটি খেলাকে মেরে ফেলার জন্য অন্য আরেকটি খেলাকে প্রণোদনা দেওয়াই যথেষ্ট। ক্রিকেটকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা চলছে, অন্যান্য খেলা বিশেষ করে কাবাডির ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। কাবাডিকে ভাবা হয় সেকেলে খেলা। অন্যদিকে ক্রিকেট ও ফুটবলকে মনে করা হয় আধুনিক। ক্রিকেটের জন্য যতকিছু করা হয় তার অর্ধেকও যদি কাবাডির পেছনে করা হতো তাহলে আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, কাবাডি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি খেলায় পরিণত হতে পারত। সেটাই হতো প্রকৃত দেশপ্রেমের পরিচয়। জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা, হীনম্মন্যতা এবং বৈদেশিক সংস্কৃতি-সভ্যতার ব্যাপারে অতিরিক্ত অনুরাগী হবার কারণেই বর্তমানে আমাদেরকে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়।
কোনো কিছুতেই ক্ষুদ্রতা বা সংকীর্ণতার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়। ক্রিকেট আমরা অবশ্যই খেলব। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল আরও দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা সকলের। কিন্তু অবশ্যই নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে নয়। বাঙালি হিসেবে আমাদের যে স্বকীয়তা আছে, আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছু নিয়েই সামনে এগোতে হবে। একটি-দু’টি খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সব ধরনের খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জাতীয় খেলা হিসেবে কাবাডির যে মর্যাদা প্রাপ্য তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই খেলাধুলার জগতে আমাদের ভারসাম্য ফিরে আসবে। তবে সব কথার শেষ কথা হিসেবে এটাই বলব যে, খেলাকে খেলা হিসেবেই উপভোগ করা উচিত, কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি ভালো নয়।

No comments:

Post a Comment