Saturday, August 2, 2014

বিএনপির আন্দোলন, আওয়ামী লীগের আস্ফালন- সহিংসতার আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত জনতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির ঈদ পরবর্তী আন্দোলন এখন সর্বাধিক আলোচ্য বিষয়। গত মাসের ১৬ তারিখে বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে ঈদের পর কঠিন আন্দোলনের ঘোষণা আসার পর থেকেই এটা রাজনীতির মুখ্য আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ঈদ ইতোমধ্যেই শেষ। ঈদের আমেজও ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। জনজীবন হয়ে উঠছে স্বাভাবিক। নাড়ির টানে ঘরে ফিরে যাওয়া মানুষগুলোও অনেকেই ফিরে এসেছে রাজধানীতে। তবে সবার মনেই দানা বাঁধছে এক গুপ্ত আশঙ্কা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন নিয়ে কম-বেশি সবাই চিন্তিত। বিশেষ করে যারা গত বছরের শেষ অবধি বিএনপি জোটের লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের কবলে পড়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা বিএনপির ঘোষিত এই আন্দোলনকে ছোট করে দেখতে নারাজ।
বিএনপি নেত্রীর আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিচিত্র সব মন্তব্য করে চলেছেন রাজনীতিকরা। সরকারি দলের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা বিএনপির গত বছরের আন্দোলনে ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বিএনপিকে। বিষয়টি নিয়ে বিএনপিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করা হচ্ছে অনেক। তবে যদি সত্য সত্যই বিএনপি গত বছরের আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কৌশলে মাঠে নামে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ১৬ জুলাই একটি অনুষ্ঠানে আন্দোলনের ঘোষণা দেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরদিনই তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি ইফতার মাহফিলে বলেন- তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করছেন না। তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চান। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণার পর হতেই যেন নড়েচড়ে বসেছেন আওয়ামী লীগসহ সরকারের জোট নেতারা। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তারা বক্তব্য দিচ্ছেন নানা ঘোষণা সহকারে। তবে সেসব বক্তব্য কতটুকু দলীয় মত প্রকাশ করছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। ঠিক একইভাবে বিএনপি নেতারাও আন্দোলনের কথা বলে মাঠ গরম করতে চাইছেন।
বিশ্লেষকদের ধারণা- বিএনপি আন্দোলন শুরু করার বহু পূর্ব থেকেই এত উচ্চ-বাচ্চ করে মূলত সরকারের উপর একটি পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এতে সংলাপের দরজা খুললেও খুলতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা যে খুব একটা নেই, সম্প্রতি তা নিশ্চিত করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লন্ডনে ভ্রমণরত অবস্থায় বিবিসি বাংলাকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেন- বিএনপির সাথে আলোচনার কথা ঘুরে ফিরে কেন বলা হচ্ছে তা তার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন- বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুল করেছে তার মাশুল তাদেরকে দিতেই হবে।’ বিএনপি যতই হুমকি দিক না কেন, সরকার যে সেটাকে খুব একটা দাম দিতে ইচ্ছুক নয়, তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে। লন্ডন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মাঠের খেলা মাঠেই হবে। ফুটবল মাঠে কে কয়টা গোল দেয়, সেটা সেখানেই দেখা যাবে। মাঠে নামুক না। মাঠে আওয়ামী লীগ আছে-যুবলীগ আছে। মানুষও আছে।’ এদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই কথার জবাবে বিএনপির অপর একটি ইফতার অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আন্দোলন মানে মারধর, জ্বালাও পোড়াও নয়। ঈদের পরে আমাদের আন্দোলন হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক। আমরা শুনতে পারছি, ঈদের পর আওয়ামী লীগও পাল্টা রাজপথে নামবে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, আপনারা রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভালো। তবে পুলিশ ও গুন্ডা বাহিনী নিয়ে অস্ত্র হাতে রাজপথে নামবেন না। এটা করা হলে পাল্টা জবাব দেয়া হবে। এর পরিণতি ভালো হবে না।’ বস্তুত বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে যে, সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনকে বান্চাল করতে অবৈধভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। তাদের ধারণা- বিগত বছরে সরকার যদি প্রশাসনকে তাদের দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মতো ব্যবহার না করতো তাহলে বিএনপির আন্দোলন কখনোই ব্যর্থ হতো না। তবে এবার সব ধরনের আটঘাট বেঁধেই রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সাথে রয়েছে স্বভাবজাত যুদ্ধংদেহী মনোভাব। সরকারকে হুঁশিয়ার করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নির্বাচন আয়োজনে বিএনপির আহ্বানকে দুর্বলতা ভেবে অগ্রাহ্য করলে তাতে তুমুল যুদ্ধেরই পদধ্বনি শোনা যাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হামলা-মামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, হরতাল-অবরোধ ইত্যাদি নতুন কোনো বিষয় নয়। এরশাদ পরবর্তী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবার পর থেকে এদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রধান দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের ধারা বহুদিনের। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের শেষ অবধি আন্দোলনের নামে হরতাল-অবরোধ, সহিংস কর্মসূচি পরিচালনা করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ১৮ দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গত বছরের শেষ তিন মাস কাটে তুমুল অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। একদিকে চলে হরতাল-অবরোধের নামে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, মানুষ খুন, চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা, আরেকদিকে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, জেল-জরিমানা। এই তিন মাসের অধিকাংশ সময় রাজধানী ঢাকা শহর সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল। বহু-হতাহত, বহু প্রাণক্ষয় আর জাতীয় সম্পদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির উপর দিয়ে শেষ হয় বিএনপির ঐ সরকার বিরোধী আন্দোলন। বিএনপি এ আন্দোলনের সুফল ঘরে তুলতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষ যে অশেষ ভোগান্তির শিকার হয়েছিল তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে নতুন নির্বাচন দেওয়ার দাবিতে যে আন্দোলনের ঘোষণা আসছে তাতে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কায় কার্যত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে দেশের আপামর জনতা।
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের শেষ অবধি ৫৫ দিনই কেটেছে তৎকালীন বিরোধী জোটের হরতাল বা অবরোধের মধ্যে। এর মধ্যে বছরের শেষ তিন মাসের আন্দোলন-সহিংসতার পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে যে, বছরের শেষে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- এই তিন মাসেই রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৪৭ জন, আর আহত হয়েছেন প্রায় ১২,৬৪৬ জনের অধিক। এই সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র আগুনে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৯৪ জন ব্যক্তি। ককটেলের বিস্ফোরণে নিহত হয় ৬ শিশু, আহত হয়ে অঙ্গ হারায় কমপক্ষে ২২ শিশু। শেষ তিন মাসের সহিংসতায় ১১ জন পুলিশ সদস্যও তাদের জীবন হারান। ৬৭৪ টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। তখন নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস ঘটনায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩১৫টি মামলায় অন্তত ৬৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছিল। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে পড়েছিল মারাত্মক প্রভাব। শুধুমাত্র এই তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতি হয় ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এই ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ আয়ের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অতি দুর্যোগময় সময় অতিক্রম করেছে সাধারণ জনগণ। এত ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানী আর আতঙ্কের জন্ম দিয়েও বিএনপির আন্দোলন সফল হয় নি। তাই এবার সাফল্য পাওয়ার আশায় আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে- এমনটাই বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। আর তা সাধারণ জনগণের ভাগ্যে যে অতি করুণ বার্তা বয়ে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুনভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে জনজীবন সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত হবে। তেমন স্থিতি কারও কাম্য নয়। এমন সম্ভাবনা যেন কখনোই বাস্তবতার মুখ না দেখে- তেমনটাই আশা করছে আন্দোলনের ভারে ভীত-সন্ত্রস্ত আপামর জনতা।

আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ

প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও খুন-খারাবি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অতীতেও ঘটতো, তবে বর্তমানের মতো এত বেশি নয়। তাছাড়া সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা এতটাই নৃশংস ও হৃদয়বিদারী যে, তা পুরো দেশবাসীর মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে যখন ঘটনাগুলোর সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার খবর মিলছে। তাছাড়া কিছু ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত না থাকলেও সেই অপরাধের সাথে তাদের যোগসূত্রতা ও পরোক্ষভাবে মদদ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাগুলোর সম্পূর্ণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারের উপর, যার মোকাবেলায় সরকার কার্যত সফলতার পরিচয় দিতে পারছে না। অথচ প্রথম থেকেই সরকারের কিছু সদিচ্ছা এরকম পরিস্থিতির মোকাবেলায় যথেষ্ট ছিল। কিছুদিন ধরে যে গুম-খুন-অপহরণের ঘটনায় দেশ উত্তাল রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে তা নতুন নয়, কম বেশি সব সময়ই ছিল। তবে যেটা নতুন তাহলো- তা প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত ও বর্তমানের এমনই কিছু অকল্যাণকর সিদ্ধান্ত আলোকপাত করেই মূলত এই লেখাটি।
ক. রাজনৈতিক স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার: আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা এদেশে নতুন নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রায়ই আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম প্রথমে আসতে দেখা গেছে। এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট সরকারকেই দায়ী করা যায় না। বিএনপি আমলে ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠনের অন্যতম একটি কারণ ছিল মূলত পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাওয়া এবং তা থেকে বের করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়া। তাছাড়া জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের মাত্রা অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাবার কারণে তৎকালীন সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই র‌্যাব গঠন করেছিল। এটা ঠিক যে, প্রাথমিক পর্যায়ে র‌্যাব কিছু কার্যকারী ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা খুব বেশিদিন টিকে নি। পরবর্তীতে তাদের সামগ্রিক কার্যকলাপ প্রকাশ্য ও গোপন, ভালো ও খারাপ এই দুই ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ যখন ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসে তখন পুলিশ বাহিনীর মতো র‌্যাবও সবেমাত্র কিছু কিছু ব্যাপারে বিতর্কিত হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় সরকার এই বাহিনীগুলোর উপর কোনো রকম রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার না করে ও বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারতো। আইনের শাসন বলতে যা বোঝানো হয় তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে পারতো। কিন্তু তা না করে, আওয়ামী লীগ সরকারও স্রোতের জলে গা ভাসায়। সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনে। বিএনপি সরকারের মতো আওয়ামী লীগও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হবার পথে এগিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থাকা অবস্থায় এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে টিআইবি একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রকাশিত উক্ত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পুলিশকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়। সহস্রাধিক মানুষের মধ্যে জরিপ করে ঐ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন টিআইবির এই প্রতিবেদনটিকে গুরুত্ব তো দেনই নি, উল্টো তিনি টিআইবির বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বিভিন্ন বক্তৃতা প্রদান করেন। সেই সাথে চলে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের প্রতি বাহবা প্রদান। বলা হয় অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত। এতে করে যেখানে যে প্রভাবই পড়–ক না কেন, পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারগুলো যে যথেষ্ট উৎসাহ পেয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন যুক্তিতে সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে কঠিন হস্তে দমন করে নি শুধুই রাজনৈতিক স্বার্থে। এই ধারা অব্যাহত রেখে প্রশাসনের কাছ থেকে অপরাধ দমনে এবং আইনের শাসন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজে যথাযোগ্য ভূমিকা পাওয়া যতটা অসম্ভব, ততটাই অবাস্তব।
খ. প্রশাসনই যখন শেষ ভরসা: গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত সরকারকে বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক আন্দোলন-সহিংসতা, হরতাল, অবরোধ ও জ্বালাও-পোড়াও এর মোকাবেলা করতে হয়েছে। বাস্তবতা হলো এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকার একচেটিয়াভাবে আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। র‌্যাব-পুলিশ, বিজিবি কখনও স্বতন্ত্রভাবে আবার কখনও যৌথভাবে অপারেশন চালিয়ে বিরোধী পক্ষের সহিংসতা-সন্ত্রাস বা আন্দোলন, যাই বলা হোক না কেন তার মোকাবেলা করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বিরোধী পক্ষের বহু নেতা-কর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে। বিরাট সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। অনেকে এখনও জেলে আছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, সহিংস আন্দোলনকারীদের আক্রমণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও হতাহত হয়েছেন। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থেকেও প্রশাসন আন্তরিকভাবে সরকারের আনুগত্য করে গেছে। সে সময় র‌্যাব-পুলিশের সামান্য দায়িত্বহীনতা বা উদাসীনতাও সরকারের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতে পারতো, কিন্তু তেমনটি হয় নি। প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রশাসন হচ্ছে এই সরকারের অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহু। আর এটাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‌্যাব-পুলিশ ভালোভাবেই জানে যে, তাদের যে কোনো বিপর্যয়কে সরকার নিজের বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করবে। তারাই সরকারের একমাত্র ভরসা। এই বাস্তবতা প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। তারা হয়ে পড়ছেন অনিয়ন্ত্রিত। জবাবদিহিতা হচ্ছে অনিশ্চিত।
গ. অভিযুক্ত র‌্যাবের বিচারে উদাসীনতা: নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার খ্যাত নৃশংস ঘটনাটির পেছনে সর্বপ্রথম র‌্যাবের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশিত হলে অনেকেই বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুরের অভিযোগ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে ধারাবাহিকভাবে র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলোর কারণে অল্প দিনেই অভিযোগটি যৌক্তিকতা ফিরে পায়। মিডিয়ার কল্যাণে অনেক সাড়া জাগানো তথ্য বের হতে শুরু করে। জানা যায়, ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা এই জঘন্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করেছে। হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন। উঠে আসে এমন কয়েকজন র‌্যাব কর্মকর্তার নাম যাদের মধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতাও রয়েছেন। অভিযোগ উঠার পর র‌্যাবের এই তিন কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের আইনের অধীনে আনা নিয়ে শুরু হয় সরকারের কার্যত গড়িমসি। বোঝা যাচ্ছিল যে, সরকার কয়েকটি তদন্তকমিটি গঠন করেই দায়িত্বের ইতি ঘটাতে চাচ্ছে। অর্থাৎ র‌্যাবের ঐ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের অনাগ্রহ প্রকট। এমতাবস্থায় এই ঘাটতি পূরণ করে আদালত। র‌্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয় আদালত। নির্দেশ প্রদানের পর কয়েকদিন র‌্যাবের এই কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে গড়িমসি করা হলেও শেষ বিচারে সরকারের সবুজ সংকেত আসে। ফলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আদালতের এই নির্দেশকে সরকার যে মোটেও সোজাভাবে নেয় নি, তার প্রমাণ মিলেছে পরবর্তীতে আদালতের এই সিদ্ধান্তকে ইঙ্গিত করে আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। র‌্যাবের এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আসা সত্ত্বেও সরকারের গড়িমসি ও তাদেরকে গ্রেফতারে অনিচ্ছা প্রকাশ কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। এতে সরকারের ভাবর্মূতি ক্ষুণœ হয়েছে ব্যাপকভাবে। আবার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও আসামি নূর হোসেনও এত নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পেছনেও অনেকে সরকারের শিথিলতাকে দায়ী করছেন। খুন হওয়া নজরুল ইসলাম, প্রধান আসামি নূর হোসেন উভয়ই সরকার দলীয় স্থানীয় নেতা। আবার যে র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেই র‌্যাবকেও পরিচালনা করছে সরকারই। সব মিলিয়ে সরকার পড়েছে বিরাট সঙ্কটে। অথচ সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এবং দলের মধ্যে সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকলে এই সব বিপর্যয়-ই সরকার দাপটের সাথে মোকাবেলা করতে পারতো। হয়তবা এমন কোনো ঘটনার সূত্রপাতই হতো না।
ঘ. জনমত উপেক্ষা ও দলীয় ক্যাডার সৃষ্টি: যে কোনো সরকারের প্রাণ বা আত্মা হচ্ছে জনসমর্থন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থনকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে সরকারের জন্য ইতিবাচক কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে যে কেউ বুঝতে পারেন যে, ঐ নির্বাচনটি একটি স্বাভাবিক, সুষ্ঠু নির্বাচন ছিল না। অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচনই হয়নি; বেশির ভাগ ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাননি। অনেকে নিরাপত্তার অভাবে সুযোগ পেলেও ভোটকেন্দ্রে যায় নি। এমনই একটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। তাদের জনসমর্থন কতটা আছে, এবং সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের পরিণতি কী হবে তা তাদের অজানা নয়। গত বছরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটা নিুমুখী। বস্তুত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঐ অশনিসংকেত অনুধাবন করেই আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত ছিল তাদের বিশাল কর্মী বাহিনীকে ব্যবহার করে ব্যাপক জনকল্যাণকর কাজ সম্পাদন করা এবং তার মাধ্যমে জনসমর্থন পুনরুদ্ধার করা। তাছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে হত্যা, দখল, টেন্ডারবাজী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদির অভিযোগ উঠে থাকে তার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্ত বাস্তবতা হলো সরকার সে পথে হাঁটে নি। জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে না গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তার বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দল দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিরোধী দল দমনে কার অবদান কতটুকু, কাকে এলাকার সকল দলের লোক ভয় পায়, কে ভালো সহিংসতা চালাতে পারে এগুলোই দলীয় কর্মীদের পদমর্যাদা বণ্টনে বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। বিরোধী দল দমনে সরকার সফল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন যেন নিজের দলই নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। নিজ দলকে নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের জন্য অসম্ভব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের নেশায় আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী লীগকে ছেড়ে কথা বলছে না। সুযোগ পেলেই শেষ করে দেয়া হচ্ছে প্রতিপক্ষকে। আগে যে প্রতিযোগিতা চলতো জনপ্রিয়তাকেন্দ্রিক, এখন দলের জাতীয় চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবার কারণে তা রূপ নিয়েছে শক্তি প্রদর্শনকেন্দ্রিক। কাজেই এটা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, বর্তমান আওয়ামী লীগের এই দুরাবস্থার পেছনে আওয়ামী লীগের অতীত রাজনীতির ধারা অনেকাংশেই দায়ী।
মাত্র চারটি প্রেক্ষাপট আলোচনা করলাম যেখানে আওয়ামী লীগ সরকার যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয় নি। আওয়ামী লীগ এদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। বিজয় এনে দিয়েছে। এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্নের দল ছিল আওয়ামী লীগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার পিতার মতোই আওয়ামী লীগকে জনগণের দলে পরিণত করার কথা বলেন। তিনিই এখন ঐতিহ্যবাহী এই দলটির কাণ্ডারী। কিন্তু বাস্তবে তিনি বা তার দল আওয়ামী লীগ যা করছে তা এদেশের জনগণের আশার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে যে, জনপ্রিয়তা ছাড়া কোনো দলই চলতে পারে না। সরকারের সামনে যতই বাধা আসুক যদি জনগণ সরকারের পাশে থাকে তাহলে সরকারের কোনো ভয়ের কারণ নেই। বিরোধী দল যদি জনকল্যাণ পরিপন্থী কোনো কাজ করে, তাহলে তাদের দমনে র‌্যাব-পুলিশের দরকার নেই, দলীয় ক্যাডার সৃষ্টির দরকার নেই, এর জন্য আপামর জনতাই যথেষ্ট। কিন্তু তার জন্য আওয়ামী লীগকে তাদের হারানো জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে হবে। যে আওয়ামী লীগের জন্য গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ রোজা রেখে মানত করতো, সেই আওয়ামী লীগ আর আজকের আওয়ামী লীগ যে এক নয় তা প্রধানমন্ত্রী ভালোভাবেই জানেন। কাজেই যদি আওয়ামী লীগ সরকার তাদের হারানো জনপ্রিয়তা যে কোনোভাবে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় তাহলেই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ রক্ষা হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা যায় অনায়াসেই।

যে মসজিদে আত্মা নেই, সে মসজিদে স্রষ্টাও নেই


আমাদের দেশের মসজিদগুলোর গেটে প্রায়শই কিছু আদেশ বা উপদেশমূলক লাইন লিখিত থাকে। যেমন- মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা হারাম, রাজনৈতিক কথা বলা নিষিদ্ধ, মসজিদের কল থেকে পানি তোলা নিষেধ ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় সব মসজিদই নামাজের ৫/১০ মিনিট বাদ দিয়ে বাকি সময় তালাবদ্ধ থাকে, ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না মসজিদের শৌচাগার, অজুখানা ও পানির কলও। কোনো বিদপগ্রস্ত মানুষও বিপদের মুহূর্তে মসজিদে আশ্রয় পায় না। সর্বদাই মসজিদগুলো সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব প্রাণহীন জড়গৃহ হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। বিকৃত এসলামের যাজক-পুরোহিত শ্রেণির কব্জায় পড়ে মসজিদগুলো নিতান্তই নামাজকেন্দ্রিক উপাসনালয়ে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মসজিদে বসে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোনো আলোচনা-পরামর্শ করাও ইমাম সাহেবরা হারাম ফতোয়া দিয়ে রেখেছে। আর সাধারণ মানুষ চোখ-কান বুুঁজে তাদের মনগড়া ফতোয়াকেই ধর্মের বিধান জ্ঞান করছে। তারা বিসমিল্লাহ বলে চুপচাপ মসজিদে ঢুকছে, নামাজ পড়ছে, আর আলহামদুলিল্লাহ বলে চুপচাপ বের হয়ে আসছে। বুদ্ধি-বিবেকহীনতার কি ন্যাক্কারজনক পরিণতি!
আজকাল সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখা যায়, পানির জন্য হাহাকার। শত শত মানুষ পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, এমনকি পানির গাড়ি পর্যন্ত ছিনতাই করতে বাধ্য হচ্ছে। খরার মৌসুমে রাজধানীতে পানির সমস্যা প্রতি বছরই প্রকট হারে দেখা দেয়। ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে এর পুরো প্রতিকার করাও সম্ভব হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এটাও দেখতে পাই যে, প্রতিনিয়ত যে মসজিদগুলো তৈরি করা হচ্ছে তাতে পানির সুবিধা প্রচুর। ঢাকা শহরের অলি-গলিতে বড় বড় মসজিদ আমাদের সবারই দৃষ্টিতে পড়ে। কোথাও পানি না থাকলেও মসজিদে সব সময় ঠিকই পানি থাকে। এর কারণ হল মসজিদে পানির ব্যবস্থা করা হয় অনেক লোকের জন্য। কিন্তু সারাদিন মসজিদ বন্ধ থাকায় সে পানি অব্যবহৃতই থেকে যায়। যারা নামাজে আসে তাদের অধিকাংশই বাড়ি থেকেই ওজু করে আসে। আর এ কারণে মসজিদের পানির রিজার্ভ ট্যাংকি সব সময় ভরা থাকে। অথচ মসজিদের পাশের যে বাড়িটি রয়েছে, যে বস্তিটি রয়েছে, তাদের রান্না বন্ধ হয়ে থাকে শুধুমাত্র পানির অভাবে। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ছটফট করে কোলের শিশু। ট্যাংক ভর্তি পানি অব্যবহৃত রেখে যখন মোয়াজ্জিন-ইমাম সাহেব মসজিদে তালা ঝুলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরছেন, তখন তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত হাড্ডিসার মানুষগুলো সীমাহীন কষ্টের মাঝে সময়ক্ষেপণ করছে। এটাই কি ধর্মের শিক্ষা? ধিক এই নিচু মানসিকতাকে! বিদ্রোহী কবি বলেছিলেন-
কোথা চেংগিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা র’বে, চালা হাতুরি-শাবল চালা!
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই বিদ্রোহী উক্তির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে এক রূঢ় বাস্তবতা। স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। মানুষের জন্যই ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ঐ মসজিদ, ঐ খানকা, ঐ এবাদতখানা এসব তো মানুষেরই জন্য। কাজেই ওসবের উপর সবার সমান অধিকার আছে। এই অধিকার আল্লাহ দিয়েছেন, কোনো মানুষ সে অধিকারকে কেড়ে নিতে পারে না তা সে যত বড় আলেম, পুরোহিত, ইমাম সাহেবই হোন না কেন। আমরা দাবি করি যে, আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত। তাঁর আদর্শের অনুসারী। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? রসুলাল্লাহর যামানায় কবে কোন মসজিদের গেটে তালা দেয়া হয়েছে আমাদের ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবরা বলবেন কি? বরং মসজিদেই সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যাদি সম্পন্ন হতো। এখান থেকেই রাষ্ট্রীয় অনুদান বিতরণ করা হতো, বৈদেশিক দূতদের সাথে আলাপ হতো, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। মসজিদে বসেই চার খলিফা অর্ধ পৃথিবী পরিচালনা করেছেন। আর্ত মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য আল্লাহর ঘর মসজিদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ আর কোনো ঘর আছে কি? তাহলে সেই ঘরে আজ তালা কেন? বস্তুত আজকের এই মসজিদ, এই খানকা, এই এবাদতখানা প্রকৃত এসলামের মসজিদ নয়। এটা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত বাণিজ্যকেন্দ্র। রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘যে কেউ সৃষ্টিজীবের প্রতি সদয় হয় আল্লাহও তার প্রতি সদয় হন। অতএব পৃথিবীর সব মানুষের প্রতি দয়ালু হও, সে ভালো হোক বা মন্দ।’ আমাদের মধ্যে এই শিক্ষা কোথায়? বরং বাস্তবে আমাদের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রের প্রতিফলন ঘটেনি কি? রসুলাল্লাহর খেজুর পাতার ছাউনী দেয়া মাটির ঘরের মসজিদে আল্লাহ ছিলেন, ঐ মুসল্লিরা মোমেন ছিলেন, মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সৈনিক ছিলেন; আর আজ জাকজমকপূর্ণ এসি, সোনার ডোমওয়ালা প্রাসাদসম মসজিদে আল্লাহ নেই, আর নামাজীরাও পথভ্রষ্ট বিশৃঙ্খল জনসংখ্যা। কারণ যে ঘরে আর্তপীড়িত মানুষের ঠাঁই হয় না, সে ঘর আত্মাহীন জড়গৃহ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে ঘরের আত্মা নেই সে ঘরে স্রষ্টাও নেই। কাজেই সে ঘরে যতই এবাদত-উপাসনা করা হোক না কেন তা স্রষ্টার কাছে পৌঁছে না। তা কেবলই পণ্ডশ্রম। কবির ভাষায়-
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি