১. খন্দক যুদ্ধ
পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাস। জাজিরাতুল আরবের একটি পল্লী জনপদ মদীনা। সেই মদীনার ঘরে ঘরে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। কারণ স্মরণকালের ভয়াবহতম এক অবরোধের মুখে তাদের জনজীবন আজ বিপর্যস্ত! সারা আরব থেকে কাফের-মোশরেকরা সমবেত হয়েছে মদীনার উপকণ্ঠে। বাজিয়ে চলেছে যুদ্ধের দামামা! এর বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বলতে এতটুকুই যে, মদীনাকে ঘিরে প্রশস্ত পরিখা খনন করা হয়েছে এবং সেই পরিখা পাহারা দিচ্ছে তিন হাজার যোদ্ধা।
ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা চলছে মো’মেনদের। তাদের ঈমান বলে- আল্লাহর রসুল আছেন আমাদের সঙ্গে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। বাস্তবতা বলে, দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী পরিখার ওপারে প্রস্তুত- আরবের প্রসিদ্ধ যোদ্ধারা সেখানে তলোয়ারে শান দিচ্ছে। কোনোভাবে পরিখা অতিক্রম করতে পারলেই আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এক নিমেষেই মদীনায় বয়ে যাবে রক্তগঙ্গা। আল্লাহর রসুলের সারা জীবনের সাধনা হয়ে যাবে ব্যর্থ! জীবনপণ সংগ্রাম করে যেই মদীনাকে তিনি গড়ে তুললেন, যেই মদীনায় ইসলামের ফুটন্ত গোলাপ সবে সুবাস ছড়াতে শুরু করল- সেই মদীনার সাথেই কবর হবে সত্য ও ন্যায়ের। এমনই জীবন-মরণ সঙ্কটের মুখে সবার একটাই আশা, হয়ত কোনো উপায় বের করবেন আল্লাহর রসুল। আল্লাহ কোনো বিশেষ সাহায্য পাঠাবেন তাঁর প্রিয় বন্ধুর সৌজন্যে।
ওদিকে আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে আবু সুফিয়ান, মক্কার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তার হৃদয়ে আজ প্রতিশোধের আগুন, চোখে বিজয়ের দীপ্তি! সারা আরবের সৈন্যরা একত্রিত হয়েছে মদীনার বিরুদ্ধে, এই দৃশ্য দেখে তার পুলকিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবু সুফিয়ান ভালোভাবেই জানে এত বিশাল বাহিনীকে মোকাবেলা করার সাধ্য মোহাম্মদের (সা.) নেই। অচীরেই তার অনুসারীদের উপর দশ হাজার সৈন্যের যৌথবাহিনী আছড়ে পড়বে সাক্ষাৎ গজব হয়ে। তরল শোণিতধারায় সিক্ত হবে মদীনার পথঘাট এবং একমাত্র তখনই মুসলমানরা প্রমাণ পাবে- কোরাইশ গোত্রপতিদের বিরুদ্ধাচারণ করার পরিণতি কত শোচনীয় হয়!
পরিখাবেষ্টিত মদীনাজুড়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। কতদিন অবরুদ্ধ থাকতে হবে কেউ জানে না। খাবার ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। অস্ত্রশস্ত্রও আছে নামমাত্র। অবরোধের একটি দিন যেন একটি বছর, শেষ হতেই চায় না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দু’দ- বিশ্রাম নেওয়া? তারও সুযোগ নেই। গভীর রাতে ঘুম ভাঙে তীরের শব্দে, অশ্বের হ্রেষাধ্বনিতে! এই বুঝি পরিখা পেরিয়ে এলো শত্রুরা! টেনশনে নির্ঘুম রাত কাটে মুসলিম শিবিরে।
মুনাফিকরাও কথা বলার মওকা পেয়ে গেছে। তারা বলে ‘মুহাম্মদ (সা.) আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, আমরা পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হয়ে যাব। অথচ আজ আমরা নিরাপদে পায়খানায় যেতেও পারছি না।’ তাদের এই কথার প্রত্যুত্তরে মো’মেনরা নিশ্চুপ! কারণ এর জবাব দেওয়ার সময় আসেনি। আগে সঙ্কটের মেঘ কাটুক- দিনের আলো উদ্ভাসিত হোক। আল্লাহর সাহায্য যখন আসবে তখন এই মুনাফিকদের মুখ কালিমালিপ্ত হবে। কিন্তু অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস! মুনাফিকদের প্রশ্রয় দিতেই যেন সঙ্কটের মেঘ আরও ঘনীভূত হতে লাগল। দেখা গেল মদীনার ভেতরেও শুরু হয়েছে গোলযোগ। কোনো কোনো গোত্রে নিজেরাই গণ্ডগোল শুরু করল। একপক্ষ মনে করে আমরা বোধহয় মোহাম্মদকে (সা.) আশ্রয় দিয়ে ভুলই করে ফেললাম, আরেকপক্ষ বলে- ‘কখনই নয়। তিনি আল্লাহ রসুল, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ভয় কিসের?’
২. বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত:
সব মিলিয়ে এই যখন মদীনার সঙ্কটাবস্থা, চারিদিকে হিংস্র জন্তুর কোলাহল প্রতি মুহূর্তে মদীনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- ‘মদীনা তুমি আজ চরম নিঃসঙ্গ, তোমার কেউ নেই, তুমি একপাল নেকড়ের সম্মুখে একটি হরিণছানার ন্যায় অসহায়’- ঠিক সেই মুহূর্তে একটি খবর আল্লাহর রসুলকে আরও বিচলিত করে তুলল। তিনি জানতে পারলেন বনি কুরাইজা গোত্র নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অস্ত্রধারণ করছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
সেই বিশ্বাসঘাতক বনি কোরাইজা গোত্র, যারা এর আগেও একবার নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল! আল্লাহর রসুল সেদিনই তাদেরকে বিতাড়িত করতে পারতেন, শাস্তিস্বরূপ হত্যাও করতে পারতেন। কিন্তু দয়া পরবশ হয়ে তিনি ক্ষমার ঘোষণা দেন। চুক্তি নবায়ন করেন। কে জানত বিশ্বাসঘাতকতা তাদের রক্তে মিশে আছে?
খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে আল্লাহর রসুল দুই সাহাবীকে বনি কুরাইজায় পাঠালেন। তারা বনি কুরাইজার দূর্গে গিয়ে দেখলেন - খবর সত্য। পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ। যতটা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ। ইহুদি গোত্রটিকে চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তারা খেঁকিয়ে ওঠে- ‘কে মোহাম্মদ? কীসের চুক্তি? আমরা মোহাম্মদ নামের কাউকে চিনি না।’ সাহাবীদ্বয় ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসছেন আর ভাবছেন, এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর কি সবাইকে জানানো ঠিক হবে? এই খবর প্রচারিত হলে মুসলিম বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে যাবে! তারা সম্মুখের শত্রু নিয়েই বিচলিত- পেছনেও যে বিষাক্ত নাগিন নিশ্বাস ফেলছে সেই খবর বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম বাহিনী আর যুদ্ধ করার মত মানসিক দৃঢ়তা পাবে না। সুতরাং বুদ্ধি খাটিয়ে তারা সাংকেতিক ভাষায় রসুলকে বুঝিয়ে দিলেন পরিস্থিতি বড়ই সঙ্কটজনক। খবর পুরোটাই সত্য।
বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার খবর আল্লাহর রসুলের হৃদয়ে কেমন ভাবাবেগ সৃষ্টি করেছিল? আমরা সেটা জানি না, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুমান করতে পারি তিনি কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন। বিস্মিত হবার কারণ বনি কুরাইজা নামক ইহুদি গোত্রটির চুক্তিভঙ্গের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। নিজস্ব ধর্ম পালনে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। আল্লাহর সত্যনবীকে তারা অস্বীকার করেছে তওরাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও- তবু আল্লাহর রসুল তাদেরকে কোনোদিন জোরাজুরি করেননি। কোনো বিষয়েই তাদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে এমন নজির নেই, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেওয়া হয়নি। শত্রুতার তো প্রশ্নই ওঠে না!
আল্লাহর রসুল মদীনায় হিজরতের পর একদিন সবগুলো গোত্রকে নিয়ে বসলেন। সর্বসম্মতিক্রমে একটি সনদ রচনা করলেন। সেখানে ঘোষণা করা হলো- ‘ইহুদি ও মুসলিমরা এক জাতি। আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করব না। মদীনা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে যুদ্ধ করে স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করব।’
আল্লাহর রসুল সর্বদা চেয়েছেন মদীনার প্রত্যেক গোত্র বর্ণের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতি স্থাপন করতে এবং সর্বোপরি মদীনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এতে বনি কুরাইজার মত গোত্রগুলোও কি যথেষ্ট লাভবান হয়নি? এত ন্যায়-শান্তি-সুবিচার ও নিরাপত্তা তাদের জীবদ্দশায় তারা ভোগ করেছে কখনও? তবু বহিঃশত্রুর পক্ষ নিয়ে এই বিশ্বাসঘাতকের দল স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মনস্থির করল! এতদিন যে মুসলিমরা নিজেদের জীবন দিয়ে মদীনার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এসেছে, সেই মদীনার সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আজ সেই মুসলিমদেরই নিশ্চিহ্ন করতে অস্ত্রধারণ করা- এই অপরাধের কেবল একটাই শাস্তি হতে পারে, যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
মদীনার আরও দুই ইহুদি গোত্র বনি কায়নুকা ও বনি নাজির এখানে প্রাসঙ্গিক। বেশিদিন আগের কথা নয়। তারাও মদীনায় বসবাস করত। মদীনার সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। এক পর্যায়ে তারা নিরাপত্তা চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু তাসত্ত্বেও তাদেরকে কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি, এমনকি বন্দী করা বা সমস্ত সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়ার মত কঠোরতাও দেখানো হয়নি। কেবল মদীনা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়! সেই উদারতার মর্যাদা রক্ষা করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা আবারও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, এই খন্দকের যুদ্ধেই তারা কুশীলবের ভূমিকা পালন করে। সমগ্র আরবকে একত্রিত করে তারা মদীনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, এমনকি মদীনার ভেতরে ঢুকে স্বজাতীয় ইহুদিদেরকে প্ররোচিত করে ‘রাজাকার’ বানিয়ে ছেড়েছে। এই গোত্রগুলো বরাবরই রসুলাল্লাহর ‘উদারতা’কে দুর্বলতা বিবেচনা করে এসেছে।
যা হোক পরবর্তী ঘটনা সংক্ষেপে এই যে, রসুলাল্লাহর সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কোরাইশদের সাথে বনি কোরাইজার সমঝোতা ভেস্তে যায়। তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস দানা বাঁধে। কোন্দল সৃষ্টি হয়। তারা একত্রিত হয়ে মুসলিমদের উপর চড়াও হবার যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র করেছিল- সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরই মধ্যে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দৃঢ়তা ও অবিচলতার পুরস্কার দিতে শুরু করেন। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়ে মোশরেকদের তাঁবু ও রান্নার আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আগুন নিভিয়ে দেয়। আবু সুফিয়ান তার দলবল নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা দেয়, গাতফানীরাও কুরাইশদের অনুসরণ করে অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে স্বদেশভূমির দিকে রওনা হয়। এভাবে যুদ্ধের একাংশ সমাপ্ত হয় বিনা রক্তপাতেই। কিন্তু অপর অংশ তখনও বাকি।
৩. বনি কুরাইজা অভিযান
বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার দণ্ড তখনও দেয়া হয়নি। আল্লাহর রসুল লোক পাঠালেন তাদের গতিবিধি দেখার জন্য। মুসলিমরা বনি কুরাইজায় পৌঁছলে ইহুদিদের মধ্যে নমনীয়তার বদলে যেন আরও ঔদ্ধত্য ফুটে উঠল। তারা আল্লাহর রসুল ও তাঁর স্ত্রী-পরিজন নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। তাদের মনোভাব যুদ্ধংদেহী। সম্ভবত তারা আশা করেছিল খায়বার থেকে অন্যান্য ইহুদিরা তাদের সাহায্যের জন্য আসবে। তাই কোরাইশরা চলে গেছে দেখে তারা মোটেও ভয়-ভীত নয়, বরং আনন্দিত এই ভেবে যে, এখন তারা সমস্ত ইহুদি মিলে মদীনাকে জব্দ করতে পারবে। তারাই হবে মদীনার সর্বেসর্বা।
আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা দৃঢ়তার সাথে বনি কুরাইজা গোত্রকে অবরুদ্ধ করে রাখল। অবরুদ্ধ ইহুদিরা সাহায্যের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকল। কিন্তু প্রায় পঁচিশ দিন পেরিয়ে যাবার পরও কোনোদিক থেকে সাহায্যের ছিটেফোঁটাও এলো না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করল। ঘটনাটি এরকম- অবরোধ চলাকালে একদিন আলী (রা.) চিৎকার করে বললেন, ‘হে মো’মেন যোদ্ধারা! আমরা আজ হামজার মত শাহাদাতের পেয়ালা পান করব, অথবা ওদের দূর্গ জয় করব।’ এই বলে তিনি ও যুবায়য়ের (রা.) সামনে অগ্রসর হলেন। ইহুদিরা তখন ভয় পেয়ে দূর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। তারা বলল, হে মুহাম্মদ! আমরা আত্মসমর্পণ করতে মনস্থির করেছি। তবে একটি শর্ত আছে। আমাদের ব্যাপারে ফয়সালা আপনি করবেন না। আমরা সা’দ ইবনে মু’আযের ফয়সালা অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করছি। সাদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা সেটাই মেনে নিব।
পাঠকরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, বনি কুরাইজা গোত্র বিচারক হিসেবে সাদ (রা.) কে চাইল কেন? এর কারণ সাদ (রা.) ছিলেন আওস গোত্রের, আর আওসরা বনি কুরাইজার অনেক পুরোনো মিত্র। কাজেই বিশ্বাসঘাতক ইহুদিরা হয়ত আশা করেছিল সাদ বিন মোয়াজ (রা.) আর যাই হোক মিত্র গোত্রের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ফয়সালা দিবেন না।
আল্লাহর রসুল তাদের শর্ত মেনে নিলেন। সাদকে (রা.) বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সাদ (রা.) সেখানে উপস্থিত হয়েই জানতে চাইলেন- তিনি যেই ফয়সালা দিবেন সেটাই সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিবে কিনা। নাকি আবার রায় প্রত্যাখ্যান করবে। ইহুদিদের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে সাদ (রা.) বললেন, এখানে আরও একজন আছেন, তাঁর মন্তব্যও প্রয়োজন (অর্থাৎ তিনি আল্লাহর রসুলের কাছেও জানতে চাচ্ছেন)। আল্লাহর রসুল বললেন, হ্যাঁ, তুমি যে ফয়সালা দিবে সেটাই কার্যকর হবে। অতঃপর যে দণ্ড তাদের প্রাপ্য ছিল সেটাই সাদ (রা.) ঘোষণা করলেন এবং তাও আবার তাদের ধর্মগ্রন্থ তওরাতের আইন দিয়েই। দ-াজ্ঞা হলো- ‘বনি কুরাইজার প্রাপ্তবয়স্ক যোদ্ধাদের প্রাণদণ্ড ও অন্যদের বন্দী করার’। অচিরেই সেই দণ্ড কার্যকর করা হলো।
৪. ইসলামবিদ্বেষীদের অপপ্রচার কতটা যৌক্তিক?
পাঠক, এ পর্যন্ত খন্দক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বনি কুরাইজা অভিযানের যে বর্ণনা তুলে ধরলাম- তা কিন্তু আমার নিজের মনগড়া বক্তব্য নয়। সবই ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রের আলোকে বলা, আস্তিক-নাস্তিক কেউই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। আশা করি এই ঐতিহাসিক আলোচনার পর পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে এই বিশ্বাসঘাতক গোত্রটিকে কেন এতবড় দণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং তা কোন প্রেক্ষাপটে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ইতিহাসের অবতারণা করলাম। করলাম এই কারণে যে, আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে বাংলার ইন্টারনেট জগতে ধুম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী একটি মহল, আর তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছে ইতিহাস অসচেতন ব্যক্তিরা। বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না যখন বিশ্বাসঘাতক বনি কুরাইজা গোত্রের বেইমানীর দণ্ডকে তারা ‘হত্যাকাণ্ড’ ‘গণহত্যা’ ইত্যাদি বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন! এই ইসলামবিদ্বেষীদের একটা মারাত্মক দক্ষতা হলো- ‘ইতিহাসকে কেটে ছেটে সুবিধাজনকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন’- বর্ণনা সত্য কিন্তু উপস্থাপনার দোষে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তারা সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনার বাইরে রেখে তাদের পছন্দের অংশবিশেষের উপর বিদ্বেষের প্রলেপ লাগিয়ে এমনভাবে পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন যা ইতিহাস অসচেতন ব্যক্তিমাত্রকেই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
ব্লগে, ফেসবুকে এই ইসলামবিদ্বেষীদের কুৎসামূলক লেখালেখির সাথে যারা পরিচিত আছেন, তারা ভালোভাবেই জানেন বনি কুরাইজার শাস্তির ঘটনাটি নিয়ে কী পরিমাণ বিদ্বেষ ইসলামের বিরুদ্ধে ছড়ানো হয়ে থাকে। এই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে তারা অসংখ্য লেখালেখি করেছেন, এখনও করে যাচ্ছেন। সাধারণত তারা ওই গোত্রের অপরাধগুলো এড়িয়ে যান, কোন পরিস্থিতিতে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হলো, তাদের অপরাধের ভয়াবহতা ইত্যাদি বিচিত্র কারণে বেমালুম ভুলে যান। যদি ক্ষীণকণ্ঠে দুই এক বাক্য বলেনও তাহলে এমনভাবে বলেন যেন ওটা কোনো অপরাধের মধ্যেই পড়ে না, সামান্য ভুল বোঝাবুঝি মাত্র। আসল অপরাধ হচ্ছে তাদেরকে দণ্ড দেওয়া। এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হলো, একজন নবী কীভাবে এত নির্দয় হতে পারেন- এই প্রশ্ন তুলেই তারা বনি কুরাইজার যোদ্ধাদের হত্যার পুংখানুপুংখ বর্ণনা নিয়ে হাজির হন। তাদেরকে কীভাবে টানতে টানতে নিয়ে আসা হলো, শিরোচ্ছেদ করা হলো, কোথায় লাশ ফেলা হলো, কে চিৎকার করছিল, কার রক্ত কোথায় গড়িয়ে পড়েছিল- এইসবের বীভৎস ফিরিস্তি দিতে থাকেন। সেই ফিরিস্তি পড়ে আপনি ভাববেন, আসলেই তো! এতগুলো মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা!
আপনি যখন এই কথাটি ভাবছেন তখন ২০১৮ সাল। আপনি একটি রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক, একজন রাষ্টপ্রধান বা সেনাপতি নন, এমনকি সাধারণ সৈনিকও নন। আপনি না কোনো যুদ্ধের মধ্যে আছেন, আর না সম্প্রতি আপনার জাতি ভয়াবহতম অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে এবং কেউ সেই সঙ্কট থেকে ফায়দা লোটার জন্য আপনারই ছত্রছায়ায় থেকে আপনার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। যুদ্ধ সম্পর্কে আপনার প্রত্যক্ষ ধারণা নেই, যুদ্ধের নিমর্ম বাস্তবতা সম্পর্কে আপনি অনভিজ্ঞ। আপনি বাস করছেন একটি স্বাভাবিক পরিবেশে, শত্রুমুক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। এই অবস্থায় তিনশ’ জন মানুষ কেন, একজন মানুষকে হত্যা করা হলেও আঁৎকে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু মাত্র ৪৭ বছর আগের বাংলাদেশে ফিরে যান, দেখবেন পথেঘাটে মানুষের মরদেহ পড়ে আছে, আর তারই পাশে জীবিতরা নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেউ আঁৎকে উঠছে না। কারণটা যুদ্ধকালীন বাস্তবতা। আপনি যখন যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করবেন তখন ওই যুদ্ধের বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না।
আমার কথা হচ্ছে, পাকিস্তানি মিলিটারিরাও মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারাও মানুষ। পাকিস্তানিরা বাঙালি মেরেছে, মুক্তিযোদ্ধারাও কি পাকিস্তানি মারেনি? পাকিস্তানিদের রক্ত গড়িয়ে পড়েনি? বোমার আঘাতে পাকিস্তানিদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েনি? ওদের স্ত্রী-সন্তান, মাতা-পিতা স্বজন হারানো বিয়োগব্যথা ভোগ করেনি? যদি ন্যায়ের পক্ষ অন্যায়ের পক্ষ বলে কিছু না থাকে, সব মৃত্যুই সমান অমানবিক হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধকে কী বলা হবে?
ইসলামবিদ্বেষীদের জন্য আমার আফসোস হয় এই কারণে যে, ইসলামকে খুনোখুনির ধর্ম প্রমাণ করতে তেমন কিছু খুঁজে না পেয়ে অবশেষে বেচারারা বিশ্বাসঘাতক বনি কুরাইজাকে দেওয়া ‘দণ্ড’কেই প্রধান উপজীব্য হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কতই না সিরাতের পাতা উল্টেছেন, কতই না হাদিস গ্রন্থ তোলপাড় করেছেন, এমন কিছুই পাননি যেখানে আল্লাহর রসুল নিরাপরাধ কাউকে হত্যা করেছেন। অগত্যা লজ্জার মাথা খেয়ে তাদেরকে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে ‘অপরাধীর দণ্ড’ নিয়ে, সাফাই গাইতে হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার পক্ষে। ‘যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মানবতা মুছে ফেল টিস্যুতে’ স্লোগান দিয়ে যারা রাজপথ মুখরিত করে রাখেন, তারাই কোন যুক্তিতে যুদ্ধাপরাধী বিশ্বাসঘাতক ইহুদি গোত্র বনি কুরাইজার জন্য কান্নাকাটি করে দুনিয়া ভাসিয়ে ফেলেন আমার বুঝে আসে না। হত্যা আর দণ্ডের মধ্যেকার পার্থক্য কি তারা বোঝেন না?
বনি কুরাইজা গোত্রের এই যে রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত, এর ভয়াবহতা কতখানি তা বুঝতে হবে। যেই মুহূর্তে প্রত্যেক গোত্র প্রশ্নহীন শর্তহীনভাবে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে রাষ্ট্রপ্রধানের হাতকে শক্তিশালী করার কথা, সেই মুহূর্তে তারা চুক্তিপত্র ছিঁড়ে ফেলে শত্রুসেনার সাথে হাত মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সূচনা করেছিল- তার পরিণতি কী হতে পারত? সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধ না করতে পেরে নিঃসন্দেহে হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষ মৃত্যুবরণ করত, যার মধ্যে নারী-শিশুও থাকত। আর তেমনটা হলে আজকে যারা তিনশ’ জন ইহুদি হত্যা নিয়ে অশ্রুবর্ষণ করেন, হাজার হাজার মুসলিম হত্যার ঘটনায় এক লাইন লেখারও প্রয়োজন বোধ করতেন না। পাঠকদের নিশ্চয়ই অজানা নয় ইহুদিরা অন্তত দুই হাজার বছর ধরে ইউরোপের নানা দেশে নির্যাতিত হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে। খ্রিষ্টানরা সংঘবদ্ধভাবে ইহুদিদের বাড়িঘরে আক্রমণ করে তাদের গণহত্যা করেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, অবাধ লুটপাট চালিয়েছে, যেই হত্যালীলা বোঝাতে ইংরেজিতে একটি শব্দেরই জন্ম হয় ‘পোগরোম’। পোগরোমের সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে একজন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রপ্রধান হিটলার ষাট লক্ষ ইহুদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এই যে খ্রিষ্টানদের হাতে নিহত লক্ষ লক্ষ ইহুদি, কোনো এক রহস্যময় কারণে এদের জন্য ইসলামবিদ্বেষী লেখকদের কোনো মমতাবোধ জাগ্রত হয় না। এদের যারা হত্যা করল তাদের বিরুদ্ধে কলমের ডগায় প্রতিবাদের ফোয়ারা সৃষ্টি হয় না। তাদের দুঃখ কেবল ওই তিনশ’ জন ইহুদির জন্য যারা রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মৃতুদণ্ড ভোগ করে। এতেই বোঝা যায় মানবতার আড়ালে তাদের আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন। সেটা হলো আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। নিহত ইহুদির সংখ্যা যদি লক্ষাধিকও হয়, কিন্তু হত্যাকারী অন্য কেউ হয় তাহলে তাদের আপত্তি নেই।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের দুনিয়াতেও ওই ধরনের অপরাধের কী শাস্তি দেওয়া হয়? কোনো রাষ্ট্রপ্রধানই বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেন না। আমাদের দেশে ছিচল্লিশ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। সেই সাথে এ বিচার যুদ্ধের পরপরই হওয়া উচিত ছিল বলে আফসোস করা হচ্ছে। আল্লাহর রসুল যাদেরকে অতীতে একবার ক্ষমা করেছেন, আবার ক্ষমা করবেন কি নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ করে দেবার জন্য? অতীতে ক্ষমা করা হয়েছে বলেই রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্তকে মামুলি বিষয় মনে করা হয়েছে, ধরেই নেওয়া হয়েছে যদি চক্রান্ত ভেস্তেও যায় প্রাণদণ্ড হবে না, বড়জোর নির্বাসিত করা হবে। এভাবে বারবার ক্ষমা পেতে থাকলে কোনো গোত্রই রসুলাল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দুশ্চিন্তাবোধ করত না। অথচ খন্দকের যুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিক সাহায্য না পেলে ঘটনা ঘটত উল্টো। সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধে মুসলিম সৈন্যবাহিনী ব্যর্থ হত, আর ওইদিনই দুনিয়া থেকে ইসলামের নাম-গন্ধ মুছে যেত। আল্লাহর রসুল অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট, দারিদ্র্য, অপমান, নির্যাতন আর লাঞ্ছনার বিনিময়ে একটি জাতি গঠনের পর সেই জাতিকে চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখতেন।
একটি জাতি তিনি গঠন করতে চেয়েছেন। তার জন্য নিজের গোত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন, তাঁর অনুসারীরা নিজেদের বাপ-ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, বদরে ওহুদে কত সাহাবী হাসতে হাসতে প্রাণত্যাগ করেছে! এত কোরবানির বিনিময়ে জাতি গঠিত হবার পর কোনো নেতাই ওই জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে যাকে হুমকি মনে করবেন তার সাথে আপস করবেন না। তিনি আল্লাহর সত্যনবী, তিনি কেবল মানুষকে শান্তি ও সুবিচারের গালভরা বাণী মুখস্থ করাতে আসেননি, তিনি শান্তি ও সুবিচার কায়েম করতে এসেছিলেন। সাধুদের পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করতেই তার আগমন।
আল্লাহর রসুল বনি কুরাইজা গোত্রের সবার প্রাণদণ্ড কার্যকর করেননি, তবে যোদ্ধাদের মধ্যে অনেককে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। সেই সংখ্যা নিয়েও মতভেদ আছে। সিরাতে যদিও ৭০০’র কথা বলা হয়েছে, হাদিসে তিনশ’র কথাও আছে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, যদি রসুলাল্লাহ আবারও উদারতা দেখিয়ে ক্ষমা করে দিতেন বা পুরো গোত্রকে অন্য কোথাও চলে যাবার সুযোগ করে দিতেন তারা ঠিকই অন্যান্য ইহুদিদের জোটবদ্ধ করে আবারও মদীনাকে ধ্বংস করতে ফিরে আসত। এই কারণেই বিশ্বাসঘাতকদের সহজে ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল না, কিন্তু যদি কেউ ভেবে থাকেন ওরা নিছক অন্য ধর্মের হবার কারণেই বিদ্বেষপ্রসূত শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাহলে সেটা ইতিহাসের প্রতি অন্যায় করা হবে। খন্দকের যুদ্ধের আগেও মুসলমানরা যুদ্ধবিজয় করেছে, পরেও বহু যুদ্ধ বিজয় করেছে, কয়টা গোত্রের পুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে? মক্কা বিজয়ের পর রসুলাল্লাহ যে ক্ষমার ঘোষণা দিবেন তা মক্কাবাসীও কি কল্পনা করতে পেরেছিল? পারেনি। ক্ষমার এমন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যে মহামানব তিনি তিনশ’ জন ইহুদির প্রতি রাগ সংবরণ করতে পারলেন না- তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি এত বড় শাস্তি হতে দিলেন কারণ এই শাস্তি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় তাঁর সামনে ছিল না। (সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment