বাংলা ভাষায় পত্র-পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় দুইশ’ বছর আগে। তৎকালীন দু’একটি মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে সারা দেশে চলছে হাজারো পত্রিকার জমজমাট প্রতিযোগিতা। দৈনিক, অর্ধসাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলে বাংলাদেশে প্রতিদিন শত শত পত্রিকা বা সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে, পাঠকদের হাতে পৌঁছচ্ছে তার লাখ লাখ কপি। শুধু তাই নয়, এখনও প্রতি বছরই কোনো না কোনো নতুন পত্রিকা বাজারে আসছে। প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে অনেক পত্রিকা চেষ্টা করছে পাঠকদের হাতে নতুন কিছু তুলে দেওয়ার এবং সেই নতুনত্বকে পুঁজি করে বাজারে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করার। আবার কেউ সাধারণ পাঠকদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে বাজারে সর্বাপেক্ষা কম মূল্যে পত্রিকা ছেড়ে শুরুতেই পাঠক জগতে হৈ চৈ ফেলে দেবার চেষ্টা করছেন, অনেকে সফলও হচ্ছেন। কিন্তু পত্র-পত্রিকার এত প্রাচুর্যতা, এত বৈচিত্রতা ও পাঠকচাহিদা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো আমাদের সংবাদপত্রগুলো মানবতার কল্যাণে, দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেন পারছে না সেটাই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শত অবিশ্বাসের মাঝেও অতীতে পত্র-পত্রিকার উপর মানুষের শক্ত বিশ্বাস ছিল। ছিল বিশ্বাসপ্রসূত ভক্তি। মানুষ পত্রিকা পড়ত সত্য জানার জন্য। পত্রিকা প্রকাশিতও হতো মানুষকে সত্য জানানোর জন্য। অনেক পত্রিকা তো প্রকাশিতই হতো নির্দিষ্ট আদর্শকে ধারণ ও বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে, তাই নীতি ও সত্যের পরীক্ষায় ওসব পত্রিকা বরাবরই ছিল উত্তীর্ণ। কিন্তু আজ পত্র-পত্রিকার এত আধিক্য থাকলেও তার প্রায় সবই হলো আদর্শহীন, নির্জীব, নি®প্রাণ। সত্য প্রকাশের জন্য প্রয়োজনে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সংবাদপত্রের সেই মহান চেতনা এখন অবশিষ্ট নেই। সেখানে জেঁকে বসেছে লোভনীয় ব্যবসা, স্বার্থবাদ, অভিসন্ধী ও মিথ্যার সাথে আপস করে চলার এক ধূর্ত প্রক্রিয়া। ফলে সংবাদপত্রের উপর মানুষ ক্রমেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, যা নৈতিকতার প্রশ্নে পত্র-পত্রিকার জন্য বিরাট এক অশনিসংকেত বলা যায়। আজ সংবাদপত্রকে বাইরে থেকে দেখতে যতই চাকচিক্যময় মনে হোক, ভেতরে ভেতরে কখন যে তার প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে কেউ জানতেও পারে নি। সংবাদপত্র সম্পর্কে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না আজকালকার পত্র-পত্রিকাগুলো কারা চালায়, কী লক্ষ্যে চালায়। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর আর দশটা ব্যবসার পাশাপাশি সংবাদপত্রকেও একটি ব্যবসা হিসেবে নেয়া হয়েছে এবং সে ব্যবসা অবশ্যই অতি লাভজনক ও সম্মানজনক ব্যবসা, যাকে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু আমরা জানি ইতিহাসে সংবাদপত্রকে কখনই এখনকার মতো নিছক ব্যবসা-বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত করা হয় নি। ব্যবসা করার মতো বহু উপাদান আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, সংবাদপত্র ওসবের ভেতরে পড়ে না। যে কারণে একজন লেখকের সাহিত্যকর্মকে আপনি নিছক ব্যবসায়িক কর্ম হিসেবে দেখতে পারেন না, সেই কারণেই সংবাদপত্রও কেবল ব্যবসায়িক পণ্য নয়। একজন লেখক তার উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ বা অন্য যে কোনো সাহিত্যকর্ম থেকে উপার্জন অবশ্যই করেন, কিন্তু তবুও তার ওই সাহিত্যকর্মকে ব্যবসায়িক পণ্য বলা যায় না, কেউ সেটা মনেও করেন না, বরং সে সাহিত্যকর্মকে সকলে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন, অবশ্যই শ্রদ্ধা ও ভক্তির দৃষ্টিতে। সংবাদপত্র যুগ যুগান্তর ধরে সমাজের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও ক্ষুর্ধার্ত মানুষের পক্ষে কথা বলে এসেছে; সমাজের দুর্গতি, অসঙ্গতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। জ্ঞানী-গুণী সাহিত্যিকরা পত্র-পত্রিকার শক্ত লেখনী দিয়ে হতাশায় ভারাক্রান্ত মানুষের চোখে স্বপ্নের ঝলক সৃষ্টি করেছেন, মরণোদ্যত মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছেন, নির্যাতিত মানুষকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন। কাজেই সাধারণ মানুষের সাথে সংবাদপত্রের সম্পর্ক নিছক বাণিজ্যিক নয়, আত্মার- এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
দশকের পর দশক সংবাদপত্রের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সাহিত্যকর্ম। পত্রিকার নামই ছিল সাহিত্যপত্র, আর যেগুলো সংবাদপত্র নামে পরিচিতি পেয়েছে সেগুলোরও প্রাণশক্তি জুগিয়েছে সাহিত্য। সাহিত্য বিনে পত্রিকা চালানো তো দূরের কথা ভাবাই যেত না। বাংলা সংবাদপত্র বা সাময়িকীর ইতিহাস ঘাটলে এ কথার সত্যতা মিলে। বাংলায় ভাষায় সংবাদপত্রের (সাহিত্যপত্র) সূচনা হয়েছিল ১৮১৮ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গাল গেজেট’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে। এরপর ১৮২৮ সালে রামমোহন রায় প্রকাশ করেন সাময়িকপত্র ‘সম্বাদ কৌমুদী’। প্রাথমিকভাবে মুসলমানরা একটু পিছিয়ে থাকলেও এক সময় তারাও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা ও সমাজ সংস্কারের কাজে মনোযোগী হয়। মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সাময়িকপত্র হিসেবে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সমাচার সভা রাজেন্দ্র। এর সম্পাদক ছিলেন শেখ আলিমুল্লাহ। এটি ছিল বাংলা-ফারসি দ্বিভাষিক পত্র। সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাটির নাম ছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’। এর আগে অন্যান্য সকল পত্রিকাই ছিল সাপ্তাহিক, পাক্ষিক নতুবা মাসিক। তাই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকেই বাংলা ভাষায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অগ্রসৈনিক হিসেবে মনে করা হয়। অর্থ-বিত্তহীন এবং ইংরেজি শিক্ষাবর্জিত এই কবি পত্রিকাটি প্রকাশ করে জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন আশাতীতভাবে। তিনি বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের দৈনন্দিন জীবন ও সমাজনীতি-রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাতেন এবং অনেক নামী-দামী লেখকের কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিতেন, দীনবন্ধ মিত্র ছিলেন তাদেরই একজন। এরপর ১৮৪৩ সালে ব্রাহ্মসমাজের নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সেকালের গুণীজনদের লেখা প্রকাশিত হতো যাতে করে একেবারে সাধারণ পাঠকরাও সাহিত্যের প্রতি ভীষণভাবে অনুরাগী হয়েছিলেন। সমসাময়িক সময়ে প্যারীচাঁদ মিত্র একটি পত্রিকা প্রকাশ করে শিক্ষার আলো বঞ্চিতা নারীদেরকে আধুনিক সাহিত্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি তার লেখায় খুব সহজ-সাবলিল বাক্য ব্যবহার করতেন যাতে সকলের বুঝতে সুবিধা হয়। এদিকে মুসলিম বাংলার দ্বিতীয় সাময়িকপত্র ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ প্রকাশিত হয় ১৮৪৬ সালে মৌলভী রজভ আলীর সম্পাদনায়। তারপর ১৮৭২ সালে এসে বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গদর্শন’ বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর দুই বছর পর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় মীর মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘আজীনন নাহার’। ১৮৮৯ সালে সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকায় যে সাহিত্যিকগণ লেখালেখি করতেন তারা ‘সুধাকর দল’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। সাহিত্য ও সমাজভাবনাকে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার এ মিছিলে শরীক হয়েছিলেন রীবন্দ্রনাথ ঠাকুরও। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সালে প্রকাশ করেন ‘ভারতী’ এবং একই বছর মুসলিম বঙ্গের মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ করেন মাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘ইসলাম প্রচারক’। এছাড়া ১৮৯৭ সালে ‘হাফেজ’, ১৮৯৮ সালে ‘কোহিনূর’, ১৮৯৯ সালে ‘প্রচারক’ এবং ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় লহরী’। এই সবই ছিল সমকালীন শিক্ষা-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের অন্যতম মাধ্যম। ১৯১৫ সালে উপমহাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক ‘আল-এসলাম’। এ পত্রিকায় মূলত ধর্মীয় সাহিত্যাদি প্রকাশিত হতো। তারপর ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’। এরই মধ্যে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন সম্পাদিত নামকরা পত্রিকা মাসিক ‘সওগাত’ প্রকাশিত হয়। ফলে মুসলিম সাহিত্য যেন নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় মোসলেম ভারত, ১৯২১ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ এবং ১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্র ‘ধুমকেতু’, যা তৎকালীন ব্রিটিশ অপশাসনের মাথা ব্যথায় পরিণত হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যপত্র ধুমকেতু ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এই ধুমকেতু পত্রিকাতেই রাজদ্রোহী লেখা প্রকাশ করার অভিযোগে কাজী নজরুল ইসলামকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এই সমসাময়িককালে ১৯৩০-এ ‘কল্লোল’ তার পরবর্তীতে ‘পরিচয়’, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ এবং ‘কালি-কলম’, রমানন্দ মজুমদার সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ বাংলা সাহিত্যের বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া মুসলিম বঙ্গের সাড়া জাগানো পত্রিকা দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। বাংলা ভাষায় পত্র-পত্রিকার প্রাথমিক যুগ থেকে এই শতাধিক বছর এবং তারপরও আরও কয়েক দশক পত্রিকা বলতেই বোঝা হতো সাহিত্যপত্র। সেগুলোতে কি খবরাখবর থাকত না? অবশ্যই থাকত। সে সব পত্রিকায় সমকালীন দেশ-বিদেশের সমাজ, সংস্কার, উত্থান-পতন, রাজনীতি, অর্থনীতির বিভিন্ন খবরাখবর অবশ্যই থাকতো, কিন্তু সেগুলো পত্রিকার প্রাণ ছিল না। মানুষ সাহিত্য, দর্শন, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, সমাজ চেতনা জাগ্রত করে এমন দিক-নির্দেশনা ইত্যাদির আশায় পত্রিকা পড়ত। আরেকটি বিষয় হলো সংবাদপত্রের সেই সোনালী দিনগুলোতে সাহিত্যিকরা সংবাদপত্রের জন্য অপরিহার্য ছিলেন ঠিকই, তবে সংবাদপত্রও কিন্তু সাহিত্যিকদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অনেক নামকরা সাহিত্যিক তাদের প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন সংবাদপত্রের মাধ্যমে। ব্যক্তিগতভাবে বই লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা যাদের ছিল না, পত্রিকাই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। এভাবেই সাহিত্যনির্ভর সংবাদপত্র দেশ মাতিয়ে রেখেছিল যুগের পর যুগ। সেই স্বর্ণালী যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল কীভাবে? আসুন ব্যাখা করা যাক।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শত অবিশ্বাসের মাঝেও অতীতে পত্র-পত্রিকার উপর মানুষের শক্ত বিশ্বাস ছিল। ছিল বিশ্বাসপ্রসূত ভক্তি। মানুষ পত্রিকা পড়ত সত্য জানার জন্য। পত্রিকা প্রকাশিতও হতো মানুষকে সত্য জানানোর জন্য। অনেক পত্রিকা তো প্রকাশিতই হতো নির্দিষ্ট আদর্শকে ধারণ ও বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে, তাই নীতি ও সত্যের পরীক্ষায় ওসব পত্রিকা বরাবরই ছিল উত্তীর্ণ। কিন্তু আজ পত্র-পত্রিকার এত আধিক্য থাকলেও তার প্রায় সবই হলো আদর্শহীন, নির্জীব, নি®প্রাণ। সত্য প্রকাশের জন্য প্রয়োজনে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সংবাদপত্রের সেই মহান চেতনা এখন অবশিষ্ট নেই। সেখানে জেঁকে বসেছে লোভনীয় ব্যবসা, স্বার্থবাদ, অভিসন্ধী ও মিথ্যার সাথে আপস করে চলার এক ধূর্ত প্রক্রিয়া। ফলে সংবাদপত্রের উপর মানুষ ক্রমেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, যা নৈতিকতার প্রশ্নে পত্র-পত্রিকার জন্য বিরাট এক অশনিসংকেত বলা যায়। আজ সংবাদপত্রকে বাইরে থেকে দেখতে যতই চাকচিক্যময় মনে হোক, ভেতরে ভেতরে কখন যে তার প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে কেউ জানতেও পারে নি। সংবাদপত্র সম্পর্কে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না আজকালকার পত্র-পত্রিকাগুলো কারা চালায়, কী লক্ষ্যে চালায়। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর আর দশটা ব্যবসার পাশাপাশি সংবাদপত্রকেও একটি ব্যবসা হিসেবে নেয়া হয়েছে এবং সে ব্যবসা অবশ্যই অতি লাভজনক ও সম্মানজনক ব্যবসা, যাকে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু আমরা জানি ইতিহাসে সংবাদপত্রকে কখনই এখনকার মতো নিছক ব্যবসা-বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত করা হয় নি। ব্যবসা করার মতো বহু উপাদান আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে, সংবাদপত্র ওসবের ভেতরে পড়ে না। যে কারণে একজন লেখকের সাহিত্যকর্মকে আপনি নিছক ব্যবসায়িক কর্ম হিসেবে দেখতে পারেন না, সেই কারণেই সংবাদপত্রও কেবল ব্যবসায়িক পণ্য নয়। একজন লেখক তার উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ বা অন্য যে কোনো সাহিত্যকর্ম থেকে উপার্জন অবশ্যই করেন, কিন্তু তবুও তার ওই সাহিত্যকর্মকে ব্যবসায়িক পণ্য বলা যায় না, কেউ সেটা মনেও করেন না, বরং সে সাহিত্যকর্মকে সকলে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন, অবশ্যই শ্রদ্ধা ও ভক্তির দৃষ্টিতে। সংবাদপত্র যুগ যুগান্তর ধরে সমাজের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও ক্ষুর্ধার্ত মানুষের পক্ষে কথা বলে এসেছে; সমাজের দুর্গতি, অসঙ্গতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। জ্ঞানী-গুণী সাহিত্যিকরা পত্র-পত্রিকার শক্ত লেখনী দিয়ে হতাশায় ভারাক্রান্ত মানুষের চোখে স্বপ্নের ঝলক সৃষ্টি করেছেন, মরণোদ্যত মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছেন, নির্যাতিত মানুষকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছেন। কাজেই সাধারণ মানুষের সাথে সংবাদপত্রের সম্পর্ক নিছক বাণিজ্যিক নয়, আত্মার- এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সংবাদপত্র কোনো কালেই খবরসর্বস্ব ছিল না
দশকের পর দশক সংবাদপত্রের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সাহিত্যকর্ম। পত্রিকার নামই ছিল সাহিত্যপত্র, আর যেগুলো সংবাদপত্র নামে পরিচিতি পেয়েছে সেগুলোরও প্রাণশক্তি জুগিয়েছে সাহিত্য। সাহিত্য বিনে পত্রিকা চালানো তো দূরের কথা ভাবাই যেত না। বাংলা সংবাদপত্র বা সাময়িকীর ইতিহাস ঘাটলে এ কথার সত্যতা মিলে। বাংলায় ভাষায় সংবাদপত্রের (সাহিত্যপত্র) সূচনা হয়েছিল ১৮১৮ সালে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গাল গেজেট’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে। এরপর ১৮২৮ সালে রামমোহন রায় প্রকাশ করেন সাময়িকপত্র ‘সম্বাদ কৌমুদী’। প্রাথমিকভাবে মুসলমানরা একটু পিছিয়ে থাকলেও এক সময় তারাও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা ও সমাজ সংস্কারের কাজে মনোযোগী হয়। মুসলমান সম্পাদিত প্রথম সাময়িকপত্র হিসেবে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সমাচার সভা রাজেন্দ্র। এর সম্পাদক ছিলেন শেখ আলিমুল্লাহ। এটি ছিল বাংলা-ফারসি দ্বিভাষিক পত্র। সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাটির নাম ছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’। এর আগে অন্যান্য সকল পত্রিকাই ছিল সাপ্তাহিক, পাক্ষিক নতুবা মাসিক। তাই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকেই বাংলা ভাষায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অগ্রসৈনিক হিসেবে মনে করা হয়। অর্থ-বিত্তহীন এবং ইংরেজি শিক্ষাবর্জিত এই কবি পত্রিকাটি প্রকাশ করে জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন আশাতীতভাবে। তিনি বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের দৈনন্দিন জীবন ও সমাজনীতি-রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাতেন এবং অনেক নামী-দামী লেখকের কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিতেন, দীনবন্ধ মিত্র ছিলেন তাদেরই একজন। এরপর ১৮৪৩ সালে ব্রাহ্মসমাজের নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সেকালের গুণীজনদের লেখা প্রকাশিত হতো যাতে করে একেবারে সাধারণ পাঠকরাও সাহিত্যের প্রতি ভীষণভাবে অনুরাগী হয়েছিলেন। সমসাময়িক সময়ে প্যারীচাঁদ মিত্র একটি পত্রিকা প্রকাশ করে শিক্ষার আলো বঞ্চিতা নারীদেরকে আধুনিক সাহিত্য-শিক্ষা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি তার লেখায় খুব সহজ-সাবলিল বাক্য ব্যবহার করতেন যাতে সকলের বুঝতে সুবিধা হয়। এদিকে মুসলিম বাংলার দ্বিতীয় সাময়িকপত্র ‘জগদুদ্দীপক ভাস্কর’ প্রকাশিত হয় ১৮৪৬ সালে মৌলভী রজভ আলীর সম্পাদনায়। তারপর ১৮৭২ সালে এসে বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গদর্শন’ বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর দুই বছর পর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় মীর মোশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘আজীনন নাহার’। ১৮৮৯ সালে সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকায় যে সাহিত্যিকগণ লেখালেখি করতেন তারা ‘সুধাকর দল’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। সাহিত্য ও সমাজভাবনাকে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার এ মিছিলে শরীক হয়েছিলেন রীবন্দ্রনাথ ঠাকুরও। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সালে প্রকাশ করেন ‘ভারতী’ এবং একই বছর মুসলিম বঙ্গের মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমেদ প্রকাশ করেন মাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘ইসলাম প্রচারক’। এছাড়া ১৮৯৭ সালে ‘হাফেজ’, ১৮৯৮ সালে ‘কোহিনূর’, ১৮৯৯ সালে ‘প্রচারক’ এবং ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় লহরী’। এই সবই ছিল সমকালীন শিক্ষা-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের অন্যতম মাধ্যম। ১৯১৫ সালে উপমহাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক ‘আল-এসলাম’। এ পত্রিকায় মূলত ধর্মীয় সাহিত্যাদি প্রকাশিত হতো। তারপর ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’। এরই মধ্যে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন সম্পাদিত নামকরা পত্রিকা মাসিক ‘সওগাত’ প্রকাশিত হয়। ফলে মুসলিম সাহিত্য যেন নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় মোসলেম ভারত, ১৯২১ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ এবং ১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যপত্র ‘ধুমকেতু’, যা তৎকালীন ব্রিটিশ অপশাসনের মাথা ব্যথায় পরিণত হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যপত্র ধুমকেতু ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এই ধুমকেতু পত্রিকাতেই রাজদ্রোহী লেখা প্রকাশ করার অভিযোগে কাজী নজরুল ইসলামকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এই সমসাময়িককালে ১৯৩০-এ ‘কল্লোল’ তার পরবর্তীতে ‘পরিচয়’, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ এবং ‘কালি-কলম’, রমানন্দ মজুমদার সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ বাংলা সাহিত্যের বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া মুসলিম বঙ্গের সাড়া জাগানো পত্রিকা দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। বাংলা ভাষায় পত্র-পত্রিকার প্রাথমিক যুগ থেকে এই শতাধিক বছর এবং তারপরও আরও কয়েক দশক পত্রিকা বলতেই বোঝা হতো সাহিত্যপত্র। সেগুলোতে কি খবরাখবর থাকত না? অবশ্যই থাকত। সে সব পত্রিকায় সমকালীন দেশ-বিদেশের সমাজ, সংস্কার, উত্থান-পতন, রাজনীতি, অর্থনীতির বিভিন্ন খবরাখবর অবশ্যই থাকতো, কিন্তু সেগুলো পত্রিকার প্রাণ ছিল না। মানুষ সাহিত্য, দর্শন, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, সমাজ চেতনা জাগ্রত করে এমন দিক-নির্দেশনা ইত্যাদির আশায় পত্রিকা পড়ত। আরেকটি বিষয় হলো সংবাদপত্রের সেই সোনালী দিনগুলোতে সাহিত্যিকরা সংবাদপত্রের জন্য অপরিহার্য ছিলেন ঠিকই, তবে সংবাদপত্রও কিন্তু সাহিত্যিকদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। অনেক নামকরা সাহিত্যিক তাদের প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন সংবাদপত্রের মাধ্যমে। ব্যক্তিগতভাবে বই লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা যাদের ছিল না, পত্রিকাই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা। এভাবেই সাহিত্যনির্ভর সংবাদপত্র দেশ মাতিয়ে রেখেছিল যুগের পর যুগ। সেই স্বর্ণালী যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল কীভাবে? আসুন ব্যাখা করা যাক।