কেবল নামাজ পড়ে স্রষ্টাকে পাওয়ার চেষ্টা আমিও করেছি, হন্যে হয়ে খুঁজেছি স্রষ্টাকে এক নজর দেখব বলে। হৃদয়ের সবটুকু চাওয়াকে একত্রিত করে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রার্থনা করেছি- হে আল্লাহ, তোমার সাক্ষাৎ চাই, তোমার সন্তুষ্টি চাই, তোমার সান্নিধ্য চাই। তোমার করুণার অমৃতসুধা পান করে জীবনকে সার্থক করতে চাই। দেখা দাও খোদা, এ অন্তরকে সিক্ত কর। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি- স্রষ্টাকে একবারের জন্যও পাই নি।
স্রষ্টাকে অন্তরদৃষ্টিতে দেখব বলে একমনে তসবিহ জপেছি। একবার নয় বারবার। প্রশংসাবাক্য পাঠ করে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, তাও একরাত নয়, বহুরাত। হাটে-বাজারে, দোকানপাটে, রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজে, ওয়াজে-মাহফিলে, বিছানায়, পড়ার টেবিলে, জোছনা রাতে, প্রখর রোদ্রৌজ্বল দুপুরে, প্রভাতে- সর্বদা কেবল স্রষ্টাকেই জপেছি, স্রষ্টাকেই চেয়েছি, স্রষ্টাকেই খুঁজেছি। যত্ন করে ফুল-চন্দনে সাজিয়েছি অন্তঃপুরের সিংহাসন- স্রষ্টাকে বসতে দেব বলে। কিন্তু, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি- তসবীহর দানায় স্রষ্টাকে পাই নি।
রমজানে ক্ষুধা-তেষ্টায় কাতরাতে কাতরাতে ঝাঁপশা নয়নে অপলক চেয়ে থেকেছি কেবল স্রষ্টাকে দেখব বলে। লাইলাতুল কদরে গভীর রজনীতে সেজদায় পড়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি স্রষ্টাকে পাব বলে। ওয়াজ-মাহফিলে মাওলানার মুখঃনিসৃত তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠের ধ্বনি অন্তরে তুফান সৃষ্টি করেছে, শহীদী যোশে আল্লাহু আকবার বলে রক্তলোলুপ হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে কাফের-মুশরিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়েছি শুধু স্রষ্টাকে পাব বলে। মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য পকেটের শেষ আধুলিটাও দান করেছি কেবল স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাব বলে। কিন্তু বিশ্বাস করুন- কোথাও আল্লাহকে পাই নি, এক দিনের জন্যও পাই নি, এক সেকেন্ডের জন্যও পাই নি।
তবে আজ আমি স্রষ্টাকে পেয়েছি। এখন আমায় স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়াতে হয় না। যেদিকে তাকাই স্রষ্টাকেই দেখি। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি এই প্রকৃততিতে, গাছপালায়, বনে-জঙ্গলে, মাটিতে, পানিতে, বাতাসে, আকাশে, মেঘমালায়, গ্রহ-নক্ষত্রে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি পীচঢালা রাজপথে, অলিতে-গলিতে, পচা ডোবায়, নালায়, খাল-বিল-ঝিলে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি জীবন্ত কঙ্কাল হয়ে বেঁচে থাকা পথশিশুর প্রতি ফোটা অশ্রুর অনু-পরমাণুতে, আমি স্রষ্টাকে দেখেছি অত্যাচারী শাসকের নির্মমতার শিকার হওয়া অসহায় শাসিতের ভারী দীর্ঘশ্বাসে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি মৃত্যুপথযাত্রী অনাহারী সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে অপারগ পিতার নিষ্ঠুর নীরবতায়।
আমি স্রষ্টাকে দেখেছি সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা শিশু আইলানের জড়সড় প্রাণহীন দেহে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি রাকিব-রাজনদের মৃত্যুপূর্বের প্রতিটি আর্তচিৎকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি তালাবদ্ধ ঘরে চাচার লাগানো আগুনে পুড়ে মরা ভাতিজাদের পোড়া মাংসের গন্ধে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি দুই কেজি চালের বিনিময়ে গর্ভজাত সন্তানকে বিক্রি করতে উদ্যত সিরিয়ান মায়েদের স্পর্ধায়, আমি স্রষ্টাকে দেখেছি কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর প্রতি ফোটা রক্তের কণায়। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি ধর্ষিতার নীরব আহাজারীতে।
বিশ্বাস করুন- আমি এখন রোজ স্রষ্টাকে দেখি। একদিনও স্রষ্টাকে না দেখে থাকতে হয় না।
No comments:
Post a Comment