Wednesday, April 25, 2018

যাদের অধিকার নেই পৃথিবীতে বসবাসের


Image may contain: 1 person

কথা হচ্ছিল ফয়সাল মাহমুদের (ছদ্মনাম) সাথে। তিনি ভারতের আসাম রাজ্যের একজন বাসিন্দা; শিক্ষিত, বয়সে তরুণ। তিনি বারবার আকুতি জানাচ্ছিলেন যেন আসামের ব্যাপারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নীরব না থাকে, জোরালো ভূমিকা পালন করে। পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন ভারতের আসামে কী ঘটছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গত বছর আসামে সরকার গঠন করেই অভিযোগ তোলে যে, অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় হিন্দুদের কর্মসংস্থান নষ্ট করে দিচ্ছে। কাজেই ‘অবৈধ’ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় একটি আদমশুমারি চালানো হয় এবং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। নাগরিক নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা রয়টার্সকে বলেন, “আসামে বসবাসরত ‘অবৈধ’ বাংলাদেশি’দের চিহ্নিত করতেই এনআরসি করা হয়েছে। এতে যাদের নাম থাকবে না, তাদের ফেরত পাঠানো হবে।” তবে বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু আসামে গিয়েছেন তাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। বিষয়টি কেবল আসামে নয়, সারা বিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে।
ফয়সাল মাহমুদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম আসামের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘আমাদের বেদনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু এটুকু বলি, আমরা না হতে পারলাম বাঙালি, না আসামি, শুধু বাংলাদেশী অপবাদ! নরকে বসবাস করা আর এখানে বসবাস করা একই কথা!’ ফয়সালের এই অভিব্যক্তি শুনে বিবেকবান মানুষমাত্রই চিন্তিত হবেন। ফয়সাল ‘নরক’ বলছে অন্য কোনো দেশকে নয়, তার নিজের মাতৃভূমিকে। যে মাটিতে পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, যেখানে জন্ম নিয়েছেন, যেখানকার আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন, যে মাটিতে ফসল ফলিয়ে ক্ষুধা নিবরণ করেছেন, কতখানি অপমান বঞ্চনা নিগ্রহ আর আঘাত পেলে কারো কাছে সেই মাটিকে ‘নরক’ মনে হতে পারে?
সেই নরকযন্ত্রণার কথাই জানতে চাইলাম তার কাছে। ফয়সাল এক কথায় যা বললেন তা হচ্ছে-‘আমাদেরকে দমন করে রাখা হয়েছে।’ আমাদেরকে মানে বাংলাভাষীদেরকে, আরও সুস্পষ্ট করে বললে বাঙালি মুসলমানদেরকে। ইচ্ছে ছিল খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নিই ঠিক কী ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্যে রাখা হয়েছে তাদেরকে। পরে মনে হলো তার দরকার নেই। কারণ এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয় কোপানল ও জাতিগত বিদ্বেষ কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনে কতবড় অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে তার উদাহরণ খুঁজতে তো বহুদূর যেতে হয় না, পার্শ্ববর্তী রোহিঙ্গাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে, ভিটেমাটি হারিয়ে, স্বজন হারিয়ে, কেবল নিজের প্রাণটুকু হাতে নিয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়েছে। কতখানি অসহায় হলে কেউ মাতৃভূমি ছাড়ার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না! কেউ পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কেউ নদীতে ডুবে মারা পড়েছে। কেউ বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়েই অনাহারে মারা পড়েছে। আর যারা শেষপর্যন্ত প্রাণটা বাঁচাতেই পেরেছে, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় হয়েছে বা হয় নি, তাদের জীবনযাপনকে কোনোভাবেই মানুষের জীবনযাপন বলা যায় না! পেছনে রেখে আসা মৃত্যুর সাথে এই জীবনের পার্থক্য খুব বেশি নয়, একটা মরে যাওয়া অন্যটা মরে বেঁচে থাকা- এইটুকুই।
ফয়সালদের সৌভাগ্য যে, তাদের নরকযন্ত্রণা ঐ পর্যন্ত পৌঁছে নি! তারা এখনও নিজেদের জন্মভূমিতে পথ চলতে পারছেন- অন্তত যতদিন তার সুযোগ থাকে। ‘যতদিন সুযোগ থাকে’ কথাটা এইকারণে বলতে হচ্ছে যে, ইতোমধ্যেই আসামের নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে এবং তা থেকে অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না অচীরেই আসামের একটি বিরাট মুসলিম জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে যে, তাদের কোনো দেশ নেই, মাটি নেই, থাকার জায়গা নেই, যেন তারা মিয়ানমারেরও না, বাংলাদেশেরও না, কার্যত পৃথিবীতে বসবাসের অধিকারই নেই তাদের, তেমনটাই ঘটতে যাচ্ছে সম্ভবত আসামের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর জীবনে। কিছুদিন বাদে হয়ত জানা যাবে- এদেরও পৃথিবীতে বসবাসের অধিকার নেই, এরাও বাংলাদেশরও না, ভারতেরও না!
গত ৩১ ডিসেম্বর ভারতের আসামের নাগরিক তালিকার প্রথম খসড়া প্রকাশ করেছে রাজ্য সরকার। নাগরিকদের এ তালিকায় ১ কোটি ৩৯ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়েছে। যদিও বলা হচ্ছে আরও অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তী খসড়া প্রকাশ করা হবে তারপরও খুব বেশি আশ্বস্ত হবার কারণ নেই। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ববর্তী সময় থেকে ২০ লাখেরও বেশি মুসলিম ভারতের আসাম রাজ্যে গেছেন। নাগরিক স্বীকৃতি পেতে তাদের ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে সেখানে বসবাসের পারিবারিক প্রমাণপত্র দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলিমদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের পূর্বসূরীরা এসব প্রমাণ বা নথি সংরক্ষণ করার কথা বুঝতে পারেননি। নাগরিক প্রমাণের মতো যথেষ্ট কাগজপত্র নেই অনেকেরই। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই আসামি মুসলিমদের প্রচুর মিল আছে রোহিঙ্গাদের সাথে। আজ বাদে কাল যদি ভারত সরকার দাবি করে- এরা (কাগজহীন আসামি বাঙালিরা) আমাদের নয়, যথারীতি তখন বাংলাদেশও বলবে এরা আমাদের নয়। এক দেশ জোর করে নির্বাসনে পাঠাবে, অন্য দেশ জোর করে অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখবে। ভাবটা এমন যে, তোমরা পারলে অন্য কোনো গ্রহে চলে যাও, পৃথিবীতে তোমাদের বাস করার অধিকার নেই।
এই যে মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ফেলা- এটা কেবল ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নয়, সারা পৃথিবীতেই এক চিত্র। দেশ নাই, ভূখণ্ড নাই, থাকার জায়গা নাই এবং যাওয়ারও জায়গা নাই- এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় এবং সেই সংখ্যাটি দিনদিন বেড়েই চলেছে। কেউ আসামি মুসলিমদের মত নাগরিক অধিকার হারাবার পথে আছে, কেউ রোহিঙ্গাদের মত নাগরিক অধিকার হারিয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে, কেউ নাগরিক অধিকার থাকার পরও যুদ্ধ-সংঘাত ও দুর্ভিক্ষের কারণে স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু কোথায় যাবে নিজেরাই জানে না। আবার কেউ নিজের দেশেই ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। যেমন লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের মানুষ। কেউ নেই তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। ইউরোপে ঢোকার আশায় প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ কেবল ভূমধ্যসাগরেই ডুবে মারা যাচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। যারা ঢুকতে পারছে তারাও যে মানুষের মত বাঁচতে পারছে তা নয়। পুরুষকে পর্যন্ত দেহব্যবসায় জড়াতে হচ্ছে! পৃথিবীতে এই অসহায় দিশেহারা মানুষের সংখ্যা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি!
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার ২০১৭ সালে দেওয়া তথ্যমতে, ‘বিশ্বজুড়ে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা রেকর্ড ৬ কোটি ৫৬ লাখ। তাদের বাৎসরিক প্রতিবেদনে ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ উদ্বাস্তু মানুষের এ পরিসংখ্যান দিয়েছে, যা ২০১৫ সালের চেয়ে ৩ লাখ বেশি। ২০১৬ সালে দক্ষিণ সুদান থেকে প্রতিবেশী উগান্ডায় পালিয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। সিরিয়া থেকে পালানো মানুষের সংখ্যা এবছর ছিল ২ লাখ।’ তবে এই পরিসংখ্যানে ২০১৭ সালের তথ্য না থাকায় সবচাইতে বড় শরণার্থী সমস্যাটাই এটাতে স্থান পায় নি। গত বছরের শেষ দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছাড়তে বাধ্য হয়, যাদেরকে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এই তাণ্ডবে হাজার হাজার মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে, শত শত শিশুর প্রাণহীন দেহ নাফ নদীতে ভেসে গেছে, শ্লীলতাহানি হয় নি এমন রোহিঙ্গা নারী খুব বেশি নেই। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদী ইজরাইল আস্ত একটা দেশকেই গায়েব করে দিচ্ছে শক্তির জোরে। তাদের অত্যাচারে ফিলিস্তিনিরা নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে আছে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। তাদেরও পেছনে মৃত্যু আর সামনে সীমানাপ্রাচীর! পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দুর্যোগ এসেছে, বহু যুদ্ধ-রক্তপাত হয়েছে, শোষণ-বঞ্চনাও কম হয় নি, কিন্তু এ যেন সমস্ত অন্যায়-অবিচারকে হার মানায়। এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি বলেছেন, “শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব অপারগ হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।”
এই সেদিনও পৃথিবীতে শরণার্থী সঙ্কট এরকম ভয়াবহ ছিল না। মানুষ যেখানে ইচ্ছা যেতে পারত, যেখানে ইচ্ছা বসবাস করতে পারত। কোনো দুর্যোগে বা যুদ্ধ-রক্তপাতে ঘর-বাড়ী হারালে অন্যত্র গিয়ে পুনর্বাসিত হতে পারত। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়, টাকা-পয়সা, গায়ের রঙ, ভাষা ইত্যাদির প্রভাব থাকলেও তা বর্তমানের মত ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে নি। কিন্তু পশ্চিমা ধর্মহীন বস্তুবাদী সভ্যতা ঐ ধর্ম, ভাষা, গায়ের রঙ ইত্যাদি ভেদাভেদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে।
মানুষমাত্রই বিশ্ব নাগরিক, সারা বিশ্বের উপর তার অধিকার আছে- এই অধিকারটা কেড়ে নেওয়া হলো এবং বিভিন্ন সংকীর্ণ পরিচয়ের ভিত্তিতে পৃথিবীর বুকে দাগ দিয়ে সীমান্তরেখা অঙ্কিত করা হলো। এই বিষবৃক্ষেরই বিষফল ভোগ করছে বিশ্বের কোটি কোটি নিপীড়িত উদ্বাস্তু মানুষ। যাদের জন্মগত অধিকার ছিল পৃথিবীতে গৌরবের সাথে বসবাস করার, তারা আজ এতটাই অসহায় যে, ৫১ কোটি বর্গকিলোমিটার পৃথিবীতে তাদের থাকার জায়গা নেই, যাবার জায়গা নেই। পক্ষান্তরে অল্প জনসংখ্যার বহু রাষ্ট্র পৃথিবীর বিরাট এলাকা দখল করে সেটার প্রাকৃতিক সম্পদ রাজার হালে ভোগ করছে।
বর্তমানে তুলনামূলকভাবে অল্প জনসংখ্যার কিন্তু বিরাট ভূ-ভাগের অধিকারী এমন রাষ্ট্র আছে যেখানে যে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন হয় তার একটা বিরাট অংশ জাহাজে করে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিতে হয়। মাইলের পর মাইল কোনো মানুষ নজরে পড়ে না। প্রতি জনের ভাগে লক্ষ লক্ষ একর জমি পড়ে এবং তারপরও লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল অনাবাদি পড়ে থাকে চাষ করার মানুষের অভাবে। কিন্তু ঐ যে ছয় কোটি ঘরবাড়িহীন অসহায় মানুষের কথা বলা হলো, এদের কেউ একজন এইসব রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে চাইলে ঢুকতে দেওয়া দূরে থাক গুলি করে মেরেও ফেলা হতে পারে। এর চেয়ে বড় যুলুম, এর চেয়ে বড় অবিচার আর কী হতে পারে?

No comments:

Post a Comment