Wednesday, April 25, 2018

আবারও কি সহিংস হয়ে উঠবে রাজপথ?


No automatic alt text available.

২০১৮ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বছরটি সহিংসতার বছর হয়ে ওঠে কিনা সেটাই বিরাট প্রশ্ন। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোই আবারও সামনে আসতে শুরু করেছে। এ নিয়ে সুধী মহল ও রাজনৈতিক শিবির ক্রমশই সরগরম হয়ে উঠছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, কিভাবে এবং কাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে, নির্বাচনের সময় সংসদ থাকবে না-কি ভেঙ্গে দেয়া হবে, এবং নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কি-না, হলে কিভাবে হবে- এ বিতর্ক যতই দিন যাচ্ছে ঘনীভূত হচ্ছে, আর সেই সাথে আশঙ্কার পারদও চড়ছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি। বিএনপিসহ বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ওই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে চার বছর পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র অবস্থান আগের জায়গাতেই আছে। আওয়ামী লীগের চাওয়া হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক, আর বিএনপির চাওয়া দলনিরপেক্ষ একটি সরকার। বোঝাই যাচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সরগরম থাকবে ২০১৮ সাল। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি বিএনপির দাবি উপেক্ষা করেই সরকার আবারও নির্বাচন করে ফেলতে চায় তাহলে বিএনপি’ আবারও সহিংসতার পথে হাঁটবে কিনা?
বিএনপি বলছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি মানা না হলে আবারো আন্দোলনের পথেই হাঁটবেন তারা। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন নতুন কোন নিরপেক্ষ সরকারের ধারণা আবারও উড়িয়ে দিয়েছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কয়েকদিন আগেই বলেছেন, ‘আমাদের দাবি পরিষ্কার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না, পার্লামেন্ট বহাল রেখে নির্বাচন হতে পারে না। একটি সংসদ থাকবে, সংসদ সদস্যরা সরকারি প্রটোকল নিয়ে নির্বাচন করবে। আর একজন সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, মন্ত্রীরা মন্ত্রী থাকবে, এটা কখনো সমতল ভ‚মি হতে পারে না।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। তার আগের ৯০ দিনের মধ্যেই যে নির্বাচন হবে, বর্তমান সরকার সেই নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতায় থাকবে। তারা দৈনন্দিন কাজ করবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে, যেরকম অন্যান্য দেশেও হয়। এখানে যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে আমাদের তো কিছু করার নেই। নির্বাচন হবেই এবং সেই নির্বাচন হবে সংবিধানের ভিত্তিতে। এর বাইরে ক্ষমতাসীন দল বা আমাদের জোট যাবে না।’
বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকারের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রথম ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে সময়কার ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অধীনে, যার তিনটিই ছিল সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার। তবে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি করে সব দলের ঐকমত্যে গঠিত একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৯৯৬ সাল থেকে পরপর ৩টি নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ২০১১ সালে সংবিধানে সংশোধনী এনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানে ফিরে যায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে অস্বীকৃতি জানায় বিএনপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার হরতাল-অবরোধসহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। দাবি পূরণ না হলে এবারো দলটির নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আন্দোলনের কথাই বলছেন। তবে এবার তত্ত্বাবধায়কের বদলে ‘সহায়ক সরকার’ এর কথা বলছেন দলটির নেতারা। কিন্তু এ নিয়ে সু¯পষ্ট কোনো রূপরেখা এখনো ঘোষণা করেনি বিএনপি।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা একটি নাম বলেছি যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি সহায়ক সরকার। যে নামেই হোক না কেন, মূল কথাটা হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার। এই সরকারের রূপরেখা আমরা দেব, আমাদের নেত্রী উপযুক্ত সময়ে এই রূপরেখা দেবেন। সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা এই রূপরেখা নিয়ে জনগণের কাছে যাবো এবং এই জনগণকে নিয়েই আমরা আগামী নির্বাচনের সময় পর্যন্ত থাকতে চাই। যদি সরকার ২০১৪ সালের পথে হাঁটে তাহলে জনগণ রাস্তায় নেমে তাদের ভোটের অধিকার আদায় করে নিবে।’
বিএনপি জনগণের অধিকার আদায়ের কথা বললেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলনে দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষরাই। এবারো পরিস্থিতি সেদিকে গড়াবে কি-না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। সুধী মহল থেকে যে আলোচনার কথা উঠছে সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন কোনো আলোচনায় বসতে আওয়ামী লীগ আগ্রহী নয়, সংবিধানে যা আছে তার ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে দুই দল আবারও মুখোমুখী দাঁড়িয়ে পড়ছে বলেই মনে হচ্ছে, যেন হাতছানি দিচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন আরেক অধ্যায়!
নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সহিংসতা যেন দেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৫১৯, আর একই সময়ে কম-বেশি আহত হয়েছেন দেড় লাখ মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, নির্বাচনী সহিংসতা এবং দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের জরিপ অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারের শাসনামলে সহিংসতা ঘটেছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ১৭৪ জন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৭৬৭ জনের। পরবর্তী ২০০১ থেকে ২০০৬ সালÑ এ ৫ বছরে বিএনপির সরকারের শাসনামলে নির্বাচনী হত্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭২ জনে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে মারা গেছে ৫৬৪ জন মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে জনসাধারণ।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের’ হিসাবে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। অধিকার বলছে, শুধু ২০০১ সাল থেকে ২০১৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৯২৬ এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ২১১ জন। এর মধ্যে ২০০১ সালেই মারা গেছেন ৬৫৬ জন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৯৮ আর ২০১৬ সালে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। মানবাধিকার সংগঠন ‘আসক’ এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৬৪টি রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, যাতে নিহত হয়েছেন ১৪৭, আর আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৩৭৩ জন। এদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক বিবৃতিতে জানায়, ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতায় ১৪৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৮৮৬ জন আহত হন।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ১৯ জন। নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এ নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও ইউপি নির্বাচনেও সহিংসতা পিছিয়ে নেই। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনী সহিংসতা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর তথ্য মতে, ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপেই নিহত হয় ১০০ এর বেশি মানুষ। 
সুজনের দাবি, এর আগে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সবচেয়ে বেশি সহিংসতাপূর্ণ ও প্রাণঘাতী ছিল। ওই নির্বাচনে ৮০ জনের প্রাণহানি হয়।

তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার সবচেয়ে নির্মম অধ্যায়টি রচিত হয় ২০১৫ সালে, পেট্রল বোমাবাজীর মাধ্যমে। নিরাপরাধ জনগণকে বাসের মধ্যে পেট্রল বোমা মেরে ঝলসে দেওয়ার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে কিনা সেটাই সুস্থচিন্তার মানুষের সামনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে!

No comments:

Post a Comment