Wednesday, April 25, 2018

এ ধরনের হামলা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, ইসলামের পরিপন্থী!


No automatic alt text available.

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে একটি নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা যে উদ্দেশ্যেই হোক, আর যারাই করুক। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পর অভিযুক্তকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। শুধু অধ্যাপক জাফর ইকবাল কেন, যে কোনো মানুষ, যদি সে অপরাধীও হয়ে থাকে তার জন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। অতর্কিত আক্রমণ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা করার এখতিয়ার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও নেই। এই ধরনের সন্ত্রাসীপনা রাষ্ট্রীয় আইন ও ধর্মীয় আইন উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই অন্যায়, অপরাধ।
দ্বিতীয়ত, হামলাকারী ফয়জুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল- কেন সে হামলা করেছে? সে জানায় ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি।’ কিন্তু মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কোনো লেখা সে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে জানায়, সে তাঁর কোনো বই পড়েনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কে ইসলামের বন্ধু আর কে শত্রু- তা নির্ধারণের গুরুতর দায়িত্ব এই ফয়জুর রহমানরা কোথা থেকে পেল, যে কিনা একজন মানুষকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অথচ লোকটা সত্যিই ইসলামের শত্রু কিনা জানার জন্য একটা লেখা পড়ার প্রয়োজন মনে করল না? শুধু শত্রু ‘নির্ধারণ’ই নয়, কথিত ঐ ‘ইসলামের শত্রু’কে মৃত্যুদ- প্রদানের জন্য ছুরি হাতে ঝাঁপিয়েও পড়ল!
এভাবে যাকে-তাকে ইসলামের শত্রু আখ্যা দেওয়া এবং তাকে খতম করতে সশস্ত্র হামলা করা কোনোকালেই ইসলামে বৈধ ছিল না, আজও নেই। আমরা নিশ্চিত যে, হামলকারী ফয়জুল কোনো সুযোগসন্ধানী, স্বার্থান্বেষী, ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে এবং এ ধরনের ঘটনা ইতিপূর্বে বহুবার ঘটানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের গুপ্তহামলা চালিয়ে দায়স্বীকার করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী। তারপর কী হয়? সংশ্লিষ্ট দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়, একটার পর একটা রক্তারক্তি চলতেই থাকে, অবশেষে সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। বহু মুসলমানপ্রধান দেশ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে। তবে সবচাইতে বড় ক্ষতিটা হয়েছে এই যে, বিশ্বময় ইসলাম সম্পর্কে একটা ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। যারা চায় দুনিয়া থেকে ইসলামের নামটুকুও মুছে যাক সেই ইসলামবিদ্বেষীরা তাদের মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রচারের সুযোগ পেয়েছে যে, ‘ইসলাম সন্ত্রাস শেখায়, ইসলাম জঙ্গি বানায়, ইসলাম মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, ইসলাম জবরদস্তিতে বিশ্বাস করে।’ অথচ প্রকৃত ইসলাম তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
যদি কারো লেখায় বা বক্তব্যে ইসলামবিদ্বেষী কিছু থাকে সেটাকে মোকাবেলা করার যথাযথ প্রক্রিয়া ইসলামে রয়েছে। ইসলাম যুক্তির ধর্ম, কাজেই যুক্তি দিয়ে, আদর্শিক মোকাবেলা করে ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা খুবই সম্ভব। কিন্তু তার বদলে যখন ছুরি-চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া হয় তখন ইসলামবিদ্বেষীরা আরও বেশি করে প্রচারের সুযোগ পায়- ‘ঐ দ্যাখো, ইসলামের ধ্বজাধারীরা যুক্তিতে না পেরে গায়ের জোরে নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, আসলে ইসলাম এমনই, এভাবেই ইসলাম কায়েম হয়েছে, নবীজী এরকমই ছিলেন (নাউজুবিল্লাহ)।’ প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে সঠিক আকীদা (পূর্ণাঙ্গ ধারণা) না থাকায় মানুষ সহজেই ওদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সূর্যের মত মহাসত্যটি সবার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে যে, বিশ্বনবীর বিজয় যতটা সমরাঙ্গনে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি হয়েছিল মানুষের আত্মায়, মনোজগতে। রাজ্য জয় তো চেঙ্গিস খানও করেছিল, ইসলাম জয় করেছিল মানুষের হৃদয়! ঐ বিজয় নিছক সামরিক নয়, ছিল আদর্শিক!
এই যে সমরাঙ্গনের কথাটা উঠল- ইসলামের ইতিহাসে এটা কখনকার ঘটনা? আল্লাহর রসুল কখন যুদ্ধ করেছেন? যখন তিনি মদীনার সর্বজনস্বীকৃত রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি ছিলেন একাধারে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির সর্বোচ্চ নেতা, প্রধান বিচারক ও সেনাপ্রধান। কাজেই অনেক সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। যুদ্ধের প্রয়োজন দেখা দিলে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে ভেতর-বাইরের শত্রুদের দমন করতে হয়েছে, সেনা পাঠাতে হয়েছে। একজন বিচারক হিসেবে অপরাধীকে দ- দিতে হয়েছে। সবই তিনি করেছেন মহান এক উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও ঐক্য-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য, কাউকে ধর্মান্তরিত করার জন্য নয়। আবার এমনও হয়েছে যে, কেউ ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হয়ে গেছে, অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, যেটা স্পষ্টত রাষ্ট্রদ্রোহের সমান অপরাধ! তাদেরকে যে শাস্তি দেওয়া হয় সেটা ইসলাম ত্যাগের শাস্তি ছিল না, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামায় প্ররোচনা দেওয়ার শাস্তি ছিল। সেই শাস্তিটাও কি যে কেউ ইচ্ছে হলো আর দিয়ে দিলাম- এমন ছিল? কখনই নয়। শাস্তি দিয়েছেন আল্লাহর রসুল অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো ছিল না, এখনও নেই।
কোর’আনের বহু আয়াত, শরীয়তের বহু বিধান আছে যেগুলো ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, প্রত্যেক মো’মেন-মুসলিম সেগুলোর আমল করতে পারেন। কিন্তু অনেক বিধান আছে রাষ্ট্রশক্তির জন্য প্রযোজ্য, যেগুলো পালন করার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব (অঁঃযড়ৎরঃু, হুকুম দেবার ও তা তামিল করাবার ক্ষমতা বা অধিকার) প্রয়োজন হয় যেমন- যুদ্ধ ঘোষণা করা, কারো অপরাধের বিচার করা ইত্যাদি। এগুলো তো ফয়জুলদের কাজ নয়, এগুলো রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সেনাপতিদের কাজ। আজকে ইসলামের প্রকৃত আকীদা হারিয়ে যাবার কারণে কোন আমল কার জন্য, কোনটার পূর্বশর্ত কোনটা, কোনটা আগে কোনটা পরে, কোনটা ছাড়া কোনটার মূল্য নেই- এই ধারণাগুলো হারিয়ে গেছে। ফলে ইসলাম বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে, প্রতিপক্ষকে নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে ফায়দা হাসিলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলার কিছুদিন পূর্বেই আমরা দেখলাম সিলেটে ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় একটি গোষ্ঠী হামলা করে অপর গোষ্ঠীর কথিত ‘মুরতাদ’কে হত্যা করল। তারা উভয়েই ইসলামের সঠিক পথের অনুসারী বলে নিজেদেরকে দাবি করে। এই সব দাঙ্গা-সন্ত্রাসের সঙ্গে আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের দূরতম সম্পর্কও আছে কি?

No comments:

Post a Comment