
মাদকে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, আর সেই সাথে ক্ষয়ে যাচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রাণশক্তি। মাদকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন হচ্ছে, টিভি অনুষ্ঠান হচ্ছে, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, পুস্তিকা-হ্যান্ডবিল ইত্যাদি প্রচার করা হচ্ছে, ওয়াজ-নসিহতে ধর্মীয় উপদেশবাণী প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাদক কী কী ক্ষতি বয়ে আনে সেগুলো তরুণ প্রজন্মকে শেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন মাদকের সর্বনাশা বিস্তার রুদ্ধ হবার নয়। সমস্ত শুভ প্রচেষ্টাই ব্যর্থতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ হয়ে উঠছে মাদকের অভয়ারণ্য।
তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যেই মাদকের খপ্পরে পড়ে গেছে। বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা। একবার মাদকাসক্ত হলেই আর রক্ষা নেই। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে না শাস্তি দিয়ে ফেরানো যায়, না বুঝিয়ে ফেরানো যায়। মাদকের টাকা যোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই, রক্তপাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও অহরহ ঘটছে, যার কোনো সুরাহা খুঁজে পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক পরিষ্কার ভাষাতেই জানিয়ে দিয়েছেন মাদক নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তিনি দুইটি বিষয়কে সামনে এনেছেন। প্রথমটি হচ্ছে, মাদক একটি আসক্তি। জেল-জরিমানা করে আসক্তি দূর করা যায় না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মাদক আসছে প্রতিবেশী দেশ থেকে। প্রায় একশ’ কিলোমিটার সীমান্ত প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে। এছাড়াও মাছের নৌকায়, সবজির নৌকায় মাদক চলে আসে। এটা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তবে আইজিপি’র এই বক্তব্যের বাইরেও কথা আছে। আছে বহু প্রশ্ন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে মাদকের এমন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে গ্রাম পর্যন্ত শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কেউ উৎপাদনের সাথে, কেউ কাঁচামাল কেনাবেচার সাথে, কেউ মাদক তৈরিতে, কেউ বিপণনে, কেউ চোরা-চালানে, আর কেউ চোরাচালানে সহযোগিতায় জড়িত। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক হর্তাকর্তারাই এর মূল বেনিফিশিয়ারি হয়ে থাকে।
সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশের মাদক গডফাদারদের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। দেশজুড়ে যার সংখ্যা ১৪১ জন। এতে ক্ষমতাধর অনেক রাজনীতিকের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে এসেছে। ৩১ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়। ঐ তালিকায় থাকা কয়েকজন মাদক গডফাদারের নাম প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে, যার মধ্যে একজন সংসদ সদস্যের নামও রয়েছে। তার ব্যাপারে বলা হয়, ঐ সংসদ সদস্যই হচ্ছেন দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। দেশের ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’ তবে শুধু রাজনৈতিক নেতাই নয়, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীদেরও নাম রয়েছে ঐ মাদক গডফাদারদের নামের তালিকায়। এ ধরনের প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে মাদকের বিস্তার রোধ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এ অঞ্চলে মাদকের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে- রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই মূলত মাদকের প্রসার ঘটেছে। আফিম চাষ ও আফিম ব্যবসা চালু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে আফিম উৎপাদন করে চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করত। সে সময় স্থানীয়ভাবে বিক্রির জন্যও আফিমের দোকান চালু করা হয়। কোম্পানির মাদক ব্যবসা থেকে শুরু হয় ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব আদায়। আফিম, মদ ও গাঁজা ছাড়াও আফিম ও কোকেন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রসার ঘটানো হয় নানান কৌশলে। এ ব্যাপারে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার বিস্তারিত একটি আইন প্রণয়ন করে। এসবই করা হয় মাদকের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে। বর্তমানে ইংরেজ নেই, কাজেই সরকারিভাবে মাদকের প্রসার ঘটানোর চক্রান্তও নেই, কিন্তু মাদকের সর্বনাশা স্রোত এখনও বন্ধ হয় নি। দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যে সবাই মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও লোকচক্ষুর আড়ালে মাদকের রমরমা প্রসার ঘটিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছে অনেকেই।
তারাই আবার রাজনীতিতে জড়িত হয়ে ব্যাপক ক্ষমতার অধিপতি হয়ে উঠছে, কিংবা পয়সা ঢেলে ক্ষমতাবানদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই মাদকব্যবসা ও চোরচালান চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মোকাবেলায় সাধারণ জনগণ দূরে থাক, প্রশাসনও অসহায়। পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যখন প্রশাসনের সদস্যরাও মাদকব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে যান!
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক কামনাশীষ সরকারকে গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করা হয় সদ্যবিদায়ী বছরের ২৫ নভেম্বর। এ সময় তার অফিস থেকে ৬৮ কেজি গাঁজা ও ২৪ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মো. নাজমুল কবিরকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক। তার অফিসের ড্রয়ার থেকে ঘুষের দুই লাখ টাকা ছাড়াও আরও কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- বাংলা মদের এক কারবারির লাইসেন্স নবায়ন বাবদ ডিডি মো. নাজমুল কবির তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। পরে দুই লাখে রফা হয়। এছাড়া গত ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ দুইজন সেনা সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করা হলে দুইজনকে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময় মাদকের প্রসারে ভূমিকা রাখার অভিযোগ ওঠে! প্রশ্ন হচ্ছে, সর্ষের ভেতরের ভুত তাড়াবে কে?
সাধারণত বিশেষজ্ঞরা বলেন সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে, এটাই ফলপ্রসূ সমাধান। কিন্তু শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদকের যে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা দেখা যাচ্ছে, তার বিপরীতে কেবল উপদেশ প্রচার করে খুব একটা আশাবাদী হবার সুযোগ আছে কি? এই প্রশ্নটি রেখেছিলাম হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের ইমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম- এর কাছে। তাঁর মতে মাদকের মত সঙ্কটগুলো আসলে প্রচলিত জীবনব্যবস্থার আনুষঙ্গিক রেজাল্ট।
তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেন- ‘‘একটি জীবনব্যবস্থা তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে যখন তাতে মানুষের দেহ-আত্মা ও দুনিয়া-পরকালের ভারসাম্য বজায় থাকে। আমাদের যে জীবনব্যবস্থা আমরা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি করে নিজেদের উপর চাপিয়ে রেখেছি এতে কেবল একটি দিক আছে- দেহের দিক, বস্তুর দিক। আত্মা ও পরকালের দিক এতে নেই। ফলে মানুষ অন্যায় করবে, মাদক খাবে, মাদকের ব্যবসা করবে, নয়ত মাদকের ব্যবসায় সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু ¯্রষ্টাহীন জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি, আল্লাহর ভয়ের প্রশ্ন আসে না, পরকালের জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে না, আইন দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়, কাজেই আইনের চোখে ফাঁকি দিতে পারলেই বা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারলেই সে দুরাচারী হয়ে উঠবে। কাজেই আমি প্রথমেই বলব এই সমাজব্যবস্থা পাল্টাতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা কার্যকরী করতে হবে যেটাতে একদিকে মানুষের নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকবে, অন্যদিকে কঠোর আইনও থাকবে, দুর্নীতির বা অপরাধের সুযোগ থাকবে না। এই গোড়ায় হাত না দিয়ে আপনি যতই কোর’আন-হাদীসের উপদেশবাণী শোনান, কাজ হবে না। আল্লাহর রসুল যখন আরবে আবির্ভুত হলেন তখন সেখানকার অবস্থা আরও খারাপ ছিল। মানুষ মদ খেয়ে অচেতন হয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকত, মাদকের বেনিফিশিয়ারি ছিল তৎকালীন সমাজের হর্তাকর্তা ওতবা-শায়বারা। রসুল (সা.) কিন্তু তৎকালীন জনসাধারণকে ওয়াজ করে করে মাদকের কুফল শিক্ষা দেন নি। কারণ তিনি জানতেন এটা সমাধান নয়, যেহেতু এখানে বিরাট সিন্ডিকেট আছে। কাজেই রসুল একেবারে গোড়ায় হাত দিলেন। রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকেই পাল্টে ফেললেন।
আমাদেরকেও বর্তমানের এই দুর্নীতিবাজ ও ধান্দাবাজ তৈরির রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে সত্যনিষ্ঠ মানুষ তৈরির রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। তখন মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা রাষ্ট্র থেকেই অর্জন করবে। জীবনের উদ্দেশ্য জানবে কাজেই জীবনকে অহেতুক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। আর যদি কেউ জাতিবিনাশী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে, একজনের শাস্তি দেখলে একশ’ জন সোজা হয়ে যাবে। আমার এই কথাগুলো আপনি ফেলে দিতে পারতেন, অলীক কল্পনা বলতে পারতেন যদি ইতিহাসে এর কোনো নজির না থাকত। তা তো নয়। যে ব্যবস্থা অতীতে মানুষকে ভয়াবহ সঙ্কট থেকে মুক্তি দিয়েছে, তা আজকেও মুক্তি দিতে পারে, যে ওষুধ অতীতে রোগ সারিয়েছে তা আজও সারাতে সক্ষম।’’
No comments:
Post a Comment