Wednesday, April 25, 2018

জাফর ইকবালের ওপর হামলা! এই ধর্মান্ধতার শেষ কোথায়?

Image may contain: 1 person, smiling
আরও একটি কালো অধ্যায় রচিত হলো। আবারও চাপাতি, আবারও ধর্মান্ধতা! এবার ছুরিকাহত হলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল যাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। দেশের হাজার হাজার তরুণ মেধাবী ছেলে-মেয়ে যে মানুষটার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে পারলে ধন্যবোধ করে, সেই জাফর ইকবালের মাথায় ছুরি ও রডের আঘাত করে বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে, বাংলাদেশের মানুষ গুণের কদর করতে জানে না! বাংলাদেশের মানুষ গুণীর সুরক্ষা দিতে জানে না! তার চেয়েও মর্মান্তিক বিষয় এই যে, হামলাকারী তরুণ ফয়জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি’। শনিবার রাতে র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ এই কথা বলেন। কী অন্ধ চিন্তাধারা- শুনলেও গা শিউরে ওঠে!

বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে যে, এ দেশে ভিন্নমতের মানুষরা ক্ষণিকের জন্যও নিরাপদ নয়! এখানে ধর্মের নামে মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়, মানুষ কী বলবে আর কী বলবে না, কী লিখবে আর কী লিখবে না- তা ঠিক করে দেয় ধর্মের ধ্বজাধারী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। ধর্মকে কুক্ষিগত করে রেখে তারা নিজেদের মনগড়া ফতোয়াকে ধর্মের বিধান বলে চালিয়ে দেয়, কিন্তু কারো কিছু বলার নেই। মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে নিয়ে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হয়, কোর’আন-হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়, ভিন্নমতের মানুষকে উৎখাত করা হয়, কিন্তু কারো সাধ্য নেই প্রতিবাদ করার। করলেই তাকে ফতোয়া দেওয়া হয় নাস্তিক, মুরতাদ, ইহুদি-খৃষ্টানের দালাল, ইসলামের শত্রু এবং আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কথিত ঐ ইসলামের শত্রুদের বিচার করার দায়িত্বও তারা নিজেদের হাতে তুলে নেন। চাপাতি, কিরিচ, রড, ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইসলামকে শত্রুমুক্ত করতে! ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ইসলামের সাথে কবে কোথায় কী শত্রুতা করেছেন তা একমাত্র ঐ হামলাকারীই হয়ত বলতে পারবে, তবে ‘ইসলামের শত্রু’ আখ্যা দিয়ে হামলার ঘটনাটি যে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, দেশে সহিংস ধর্মীয় উন্মাদনার তালিকায় নতুন সংযোজনমাত্র তা বুঝতে পণ্ডিত হবার প্রয়োজন পড়ে না।
এই ব্রেইন ওয়াশড তরুণরা কবে বুঝবে- ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালরা ইসলামের শত্রু নয়, ইসলামের শত্রু তারাই যারা তাদেরকে কোর’আন-হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে জাতিবিনাশী হত্যাকা-ে লিপ্ত করে রেখেছে? তারাই বড় শত্রু, যারা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম বানিয়েছে এবং যাদের কূপম-ূকতা, অন্ধত্ব, পশ্চাদপদতা, বিজ্ঞানবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণতার কারণে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ‘হাসি-তামাশার’ বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। যারা জোর করে ড. জাফর ইকবালের মত ব্যক্তিত্বকে ইসলামের শত্রু বলে আখ্যা দিতে চায়, কিন্তু ইসলামের আসল শত্রুকে দৃষ্টির আড়ালেই রেখে দেয়। সমস্ত পৃথিবীতে সা¤্রাজ্যবাদী অপশক্তিগুলো নিরীহ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে, ওরা এই প্রায়ান্ধদের দৃষ্টিতে ইসলামের শত্রু হলো না, ওদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা হুংকার তুলতে পারল না, তারা নামল জাফর ইকবালকে হত্যা করতে! অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, কাপুরুষতা আর মানসিক বিকৃতি বোধহয় একেই বলে।
ইসলাম যেন এক ‘পিতৃমাতৃহীন পথশিশু’, দেখার কেউ নেই, পরিচর্যার কেউ নেই। ১৬০ কোটির মুসলমান জাতি, এক আল্লাহ এক রসুল এক কিতাবে তাদের বিশ্বাস, কিন্তু সিদ্ধান্তের বেলায় তাদের অবস্থা ‘হ-য-ব-র-ল’, কোনো একক নেতা নেই, কর্তৃপক্ষ নেই। হালবিহীন মাঝিবিহীন নৌকার মত বাতাসের তোড়ে ভাসছে, যে যার মত করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। প্রকৃত ইসলাম কি এমন ছিল? ইতিহাস তো সেটা বলে না। যারা কোর’আন-হাদীসের ইচ্ছেমত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, অমুক কাফের, অমুক মুরতাদ, অমুক ইসলামের শত্রু- ওকে কতল কর ইত্যাদি রায় দিচ্ছেন, আদতে ইসলামের কোনো বিষয়ে রায় দেওয়ার অধিকার তাদের আছে কিনা? তারা আল্লাহর রসুলের সুন্নাহর অনুসরণ করতে চান কিন্তু আল্লাহর রসুল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন, প্রধান বিচারক ছিলেন, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, সেনাপ্রধান ছিলেন, পক্ষান্তরে তাদের পরিচয় কী? কুয়োর ব্যাঙ! কাকের ময়ুরপুচ্ছ ধারণের মত করে পাড়া-মহল্লার কোনো এক মসজিদের ইমাম, কোনো এক মাদ্রাসার মুফতি হয়েই তারা ‘মহামান্য’ বিচারকের মত দ- ঘোষণা করেন, অথচ সে অধিকার তাদের আছে কিনা ভেবে দেখেন না।
কোর’আনের বহু আয়াত, শরীয়তের বহু বিধান আছে যেগুলো ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, প্রত্যেক মো’মেন-মুসলিম সেগুলোর আমল করতে পারেন। কিন্তু অনেক বিধান আছে রাষ্ট্রশক্তির জন্য প্রযোজ্য, যেগুলো পালন করার জন্য রাষ্ট্রীয় অথরিটি প্রয়োজন হয় যেমন- যুদ্ধ ঘোষণা করা, কারো অপরাধের বিচার করা ইত্যাদি। এগুলো তো মসজিদপতি ও মাদ্রাসাপতিদের কাজ নয়, এগুলো রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সেনাপতিদের কাজ। তারা কেন নিজেদের অবস্থান বোঝেন না? কেন কোমলমতি তরুণদেরকে কথিত জিহাদী বয়ান দিয়ে বিপথগামী করেন? কবে আমরা এই ধর্মান্ধতার কফিনে পেরেক ঠুকতে পারব? আর কতকাল মানুষ ইসলাম নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ পেতে থাকবে? আর কতদিন পবিত্র ইসলাম কলঙ্কিত হতে থাকবে?
তবে এতদিনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে এই ধর্মান্ধতার মোকাবেলা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে অনেক আগেই হয়ে যেত। পত্যেক নাগরিকের পেছনে তো আর পুলিশ মোতায়েন করে রাখা যায় না, তারপরও রাষ্ট্রশক্তি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে। এখন এর সাথে আদর্শিক মোকাবেলা যোগ হলে অর্থাৎ প্রকৃত ইসলামের আকীদা (সামগ্রিক ধারণা) সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা গেলে ধর্মান্ধতার মূলোৎপাটন সহজ হয়ে যাবে।

No comments:

Post a Comment