Saturday, May 12, 2018

হক্কানী আলেম ও ভণ্ড আলেম!

- কথা কি সত্য?
- আলবৎ সত্য হুজুর। আল্লাহ সাক্ষী।
- তাইলে আজকের পর ওর কাছে যাইবা না। ব্যাটা এক নম্বরের জাহেল।
- হুজুর, সে তো আলেম মানুষ।
- কেমনে বুঝলা আলেম মানুষ?
- আলেম পাস।
- আলেম পাস করলেই আলেম হওন যায় নাকি? স্কুল-কলেজের মতন না বিষয়টা যে, ডাক্তারি পাস কইরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস কইরা ইঞ্জিনিয়ার।
- হুজুর, বিষয়টা তাহলে কেমন? এতদিন তো জানতাম মাদ্রাসা পাস করলেই তিনি আলেম।
- আরে নাহ! বহুৎ মাদ্রাসা পাস ‘ভণ্ড আলেম’ আছে। এই যেমন তুমি যার কথা বলতেছো, সে হইল পাক্কা ভণ্ড। ওর কাছে আর যাওয়ার দরকার নাই।
- হুজুর, সে কিন্তু আরবিতে কথাও বলতে পারে। মুখে কোর’আন হাদিসের খই ফোটে।
- আরে বেকুব! যেইটা বোঝো না সেইটা নিয়া কথা বলো কেন? আরবিতে কথা তো আবু জাহেলও বলতে পারত। পাণ্ডিত্যের কথা কও? আবু জাহেল ছিল ওই সময়ের সবচাইতে বড় পণ্ডিত, সবচাইতে বড় আলেম!
- কী বলেন হুজুর?
- ঠিক কথাই বলতেছি। ঈমান নাই, আমল নাই, আলেম সাইজা বসছে। এইগুলা হইল আবু জাহেলের বংশধর। একশ’ হাত তফাৎ থাকবা।
- জ্বি হুজুর।
- এরা নিজেরাও জাহান্নামে যাইব, তোমারেও সঙ্গে লইব। আল্লাহ তাআলা সুরা ইয়াসীনের ২১ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন, ‘অনুসরণ কর তাদের যারা বিনিময় নেয় না এবং সঠিক পথপ্রাপ্ত।’ কাজেই এই ভণ্ডদের অনুসরণ করা হারাম।
- হুজুর, ‘বিনিময় নেয় না’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
- এতকিছু জাইনা তোমার তো কাম নাই বাপু। আমি যেইটুকু বলছি সেইটুকুই মাথায় রাখো। ভণ্ডদের অনুসরণ করবা না। ব্যস।
- কিন্তু হুজুর, ভণ্ড চিনব কী করে?
- ভণ্ড চেনাও তোমার কাম না। এর জন্য উত্তম আলেম হইতে হয়। সমস্যা নাই কোনো। আমি চিনায়া দিব। আমি যারে বলব ভণ্ড তুমি তারে ভণ্ড জানবা, তার কথা শুনবা না, তার অনুসরণ করবা না। তার কথা মুখেও আনবা না।
- জ্বি হুজুর।
- অবশ্য তুমি আজ ওই ভণ্ডটার খবর দিয়া ভালোই করছো। আগেই সাবধান হওয়া যাইব।
- জ্বি।
- ব্যাটা নিশ্চিত জাহান্নামী! মানুষরে গোমরাহ করতেছে।
- তার মানে তো হুজুর, ওই আলেমের হাজার হাজার অনুসারীও জাহান্নামী। ওরা লোকটারে কতই না শ্রদ্ধা করে। বিশ্বাস করে। তার মুখের কথা কোর’আন-হাদিসের মতন মান্য করে।
- মান্য করে বইলাই জাহান্নামী হইব। এইটাই শাস্তি।
- হুজুর, গুস্তাখি মাফ হয়। যদি দেখা যায়, ওই হুজুরই ঠিক আছে, আপনিই সঠিক পথে নাই, তাহলে?
- তোমার তো সাহস কম না হে? কী বলতেছো এসব?
- হুজুর, মনে কিছু নিয়েন না। আমরা বে-বুঝ বে-এলেম মানুষ! আপনাদের মতন এতকিছু তো বুঝি না। বোঝার উপায়ও নাই। মস্ত মস্ত আরবি ফারসির কিতাব, কোর’আন, হাদিস, উসুল, ফিকাহ, মাসলা-মাসায়েল, ইসলামি সাহিত্য- এতকিছু পড়া আমাদের সাধ্যের বাইরে। তাই আপনাদের দ্বারস্থ হই। একেকজন একেক আলেমের কাছে ধর্ণা দিই। আপনারা যা করতে বলেন তাই করি।
- হুম।
- কিন্তু হুজুর, আপনি আজকে সাংঘাতিক সব কথা বললেন। মাদ্রাসায় পড়লেই নাকি আলেম হওয়া যায় না। আলেমদের মধ্যে বহু ‘ভণ্ড আলেম’ও আছে। আবু জাহেলও আলেম ছিল। আবু জাহেলমার্কা আলেমের কথা শুনলে জাহান্নামী হতে হবে।
- ঠিকই তো বলছি।
- তাহলে আপনি যে ‘ভণ্ড আলেম’ নন- তার প্রমাণ কী? আপনি যাকে ভণ্ড বললেন, আর তার অনুসারীদের জাহান্নামী বললেন, সেও আপনার ব্যাপারে একই কথা বলবে। ওই আলেমকে বিশ্বাস করে হাজার হাজার মানুষ। আপনাকেও বিশ্বাস করে হাজার হাজার মানুষ। আমরা এই ‘বে এলেম’ মানুষরা কী দোষ করেছি হুজুর?
- আহা, ওইটা তো অন্য বিষয়। কথাটা হইল. . .
- এইটা তো জুয়া খেলার মতন হয়ে যাচ্ছে হুজুর। একজন আলেমের অনুসরণ করব, তবে সেই আলেম ভণ্ডও হতে পারে হক্কানিও হতে পারে- এটা নির্ভর করবে ভাগ্যের উপর। আলেম যদি আলেম হয় তো ভাগ্য ভালো- গেলাম জান্নাতে। ভাগ্য মন্দ হলে জাহান্নামে। এ কেমন বিচার?
- না মানে হইছে কি, বিষয়টা একটু ইয়ে আর কি। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি না হয় সব আলেমের কথাই শুনিও।

জাহান্নামের আগুন খাওয়া!

- পেটে বোমা ফাটলেও শুদ্ধ কইরা একটা সুরা পড়তে পারবা?
- জ্বি না হুজুর। আমার উচ্চারণে সমস্যা আছে।
- অথচ তুমি আমারে জ্ঞান দিবার চাও!
- হুজুর, বেআদবী হলে মাফ করবেন। কথাগুলো কিন্তু মিথ্যা নয়।
- মিথ্যা নয় কীভাবে বুঝলা?
- কোর’আন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তো বলা হয়েছে, হুজুর।
- কোর’আন হাদিসের তুমি কী বোঝো হে? এইটা বোঝার জন্য এলেম লাগে, এলেম।
- জ্বি হুজুর।
- তাজ্জব ব্যাপার স্যাপার! একটা চটি বই পইড়াই তুমি কোর’আন হাদিস বুঝে যাইতেছো। আর আমরা হুদাই বিশ বছর ধইরা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলাম। তোমার কাছে গেলেই হইত, তুমি দুই মিনিটে ইসলাম শিখায়া দিতা।
- হুজুর, বিষয়টা তা না। আপনারা আমার চাইতে অনেক ভালো জানেন। আর জানেন বলেই এখানে আসা। আমি সঠিক ব্যাখ্যাটা জানতে চাচ্ছি।
- ও আচ্ছা।
- তাছাড়া এটা আপনার দায়িত্বও বটে। যেহেতু অভিযোগের তীর আপনাদের দিকেই। ধর্মীয় কাজ করে অর্থোপার্জন যদি হারাম হয়, জাহান্নামের আগুন খাওয়ার সমান অপরাধ হয়, তাহলে পুরো আলেম সমাজই দোষী হয়ে যাচ্ছে।
- শোনো বাপু! হজরত আবু বকর (রা.) ইমামতি কইরা বেতন নিতেন। এইটাই কি যথেষ্ট না?
- হুজুর, ওই যুক্তিও খণ্ডণ করা হয়েছে।
- কীভাবে?
- তাদের কথা হচ্ছে, আবু বকর (রা.) তো বর্তমানের মতন মসজিদ কমিটির বেতনভুক্ত নামাজের ইমাম ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের ইমাম। সারা মুসলিম জাহানের ইমাম। তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এজন্য রাষ্ট্র থেকে তাকে ভাতা দেওয়া হত। নামাজের জন্য নয়।
- আরে যেই জন্যই দিয়া হোক। দিয়া তো হইত।
- হুজুর, সেই ভাতার টাকাও তিনি মৃত্যুকালে পরিশোধ করে যান।
- তো? কী বলতে চাও তুমি?
- হুজুর, আমি কিছুই বলতে চাই না। আমি কেবল তাদের কথাগুলো বলতে এসেছি, আর আপনার ব্যাখ্যাটা জানতে এসেছি।
- (দীর্ঘশ্বাস)
- ওরা বলে, ইসলাম এসেছে মানবতার কল্যাণের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য। এর সাথে যখনই শ্রেণিবিশেষের ‘স্বার্থ’ জড়িত হয়ে গেল, তখন থেকেই ইসলামের বিকৃতি শুরু। কথায় কিন্তু যুক্তি আছে হুজুর।
- যুক্তির মাথা খাই আমি। ধর্মকর্ম কি যুক্তির বিষয়? বিশ্বাসের বিষয়।
- বিষয়টা বুঝলাম না হুজুর।
- এলেম থাকলে তো বুঝবা। কও দেহি ইবলিস কী কারণে বিতাড়িত হইছে?
- ইয়াদ নাই হুজুর। কী কারণে?
- যুক্তি দেখাইতে গিয়া। আল্লাহ হুকুম করলেন- ‘ওহে ফেরেশতারা, সবাই আদমকে সেজদা করো।’ ভালো কথা। সুন্দরমত সেজদা করলেই হয়ে যায়। কিন্তু ইবলিস ব্যাটা যুক্তি দেখায়া বলল, আমি আগুনের তৈরি, আর আদম মাটির তৈরি। ওরে সেজদা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। ব্যস! যুক্তি দেখানোর অপরাধে জাহান্নামী হইল।
- তার মানে তো হুজুর, ইবলিসের দুইটা অপরাধ। একে তো আল্লাহর হুকুম অমান্য, তার উপর আবার যুক্তি দেখানো।
- হুম। এই তো বুচ্ছ।
- জ্বি হুজুর। কিন্তু আমার খুব টেনশন হচ্ছে আপনাদের নিয়ে। যদি সত্যিই কোর’আনে আল্লাহ দ্বীনের বিনিময় হারাম করেন তাহলে আপনাদের কী দশা হবে? আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হচ্ছে এবং তার পক্ষে যুক্তিও দেখানো হচ্ছে। বিষয়টা কিন্তু গুরুতর।
- উফফ! কী বে-এলেম জাহেল ছেলে! আমারে নিয়া টেনশন কর, তাই না? তুমি গিয়া নিজের টেনশন কর। তোমারে আগেই বলা হইছে- ওদের লেখা পড়িও না। ঈমান চলে যাইব। এখন সেই লক্ষণই দেখা যাইতেছে। দেশটা ইহুদি নাসারার দালালে ভরে গেছে। নাউজুবিল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ!

এলেমের মূল্য!

- হুজুর, বিষয়টা কিন্তু গুরুতর। শুধু আমার না, প্রশ্নটা সবার মনেই উঁকি দিচ্ছে।
- উঁকি তো দিবেই। ইবলিস তো বইসা নাই। ইবলিসের প্রধান কাজ হইল আলেমদের বিরুদ্ধে পাবলিকের মনে সন্দেহ ঢুকায় দেওয়া।
- সেজন্যই হুজুর, আপনার মুখ খোলা দরকার।
- শোনো বাবা! আমার মুখ খোলাই আছে। কিন্তু একজন ইমাম সাহেব নামাজ পড়াইলে তারে বেতন দিতে হয়- এইটাও কি সবাইরে শিখাইতে হইব? বড়ই দুঃখজনক কথাবার্তা!
- হুজুর, আমরা গুনাহগার মানুষ। বোঝেনই তো!
- বুঝি বইলাই তো বিপদ হইছে। সবকিছু আমারেই বুঝতে হয়, আবার তোমাগোরেও বুঝাইতে হয়। যাই হোক- মন দিয়া শোনো আল্লাহর বান্দারা। এই যে আমি তোমাদের নামাজ পড়াই, এর ন্যায্য মূল্য তোমরা কোনোদিনই দিতে পারবা না। ধরো, দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ একদিকে আর নামাজ আরেকদিকে- কোনটা বেশি ভারী হইব কও দেহি?
- হুজুর, অবশ্যই নামাজ বেশি ভারী হবে।
- তাই যদি হয়, তাইলে ইমাম সাহেবের হাতে কয়েক হাজার টাকা দিয়াই কেন ভাবো নামাজের বেতন দিয়া দিলাম? এইটা ফাসেকী চিন্তা-ভাবনা। নামাজের বেতন তোমরা কোনোদিনই দিতে পারবা না। আকাশের চাঁদ আইনা দিলেও পারবা না। হীরার পাহাড় কাইটা দিলেও পারবা না।
- তা অবশ্য ঠিক।
- পাঁচ/দশ হাজার যা পাই, সেইটারে বেতন বলা হইলেও বেতন কিন্তু না। ওইটা হইল হাদিয়া। সমাজের দশজন মানুষের নামাজে ইমামতি করি। আমারও তো ঘর-সংসার আছে, বউ বাচ্চা আছে, নাকি নাই?

- তা তো আছে হুজুর।
- তারা কি না খাইয়া থাকব? তাগো ক্ষুধা লাগে না? পরনের কাপড় চোপড় লাগে না? বাড়িঘরে থাকা লাগে না? এইটা যদি সমাজের দশজনে না দেখে তাইলে কেমনে চলব?
- কিন্তু হুজুর! নামাজ তো সারাদিনের কাজ না। মাত্র কয়েক মিনিটের কাজ। বাকি সারাটা দিন তো পড়েই থাকে রোজগার করার জন্য।
- আমি রোজগার করব?
- হুজুর, মনে কিছু নিয়েন না। আপনাকে রোজগার করতেই হবে তা বলিনি। তবে করলে ভালো হয়। আপনি হুজুর মানুষ, সবার সম্মানের পাত্র। আপনার মত একজন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে থাকলে ভালো দেখায় না!
- হায়রে মুসলমান! এজন্যই তো কই! তোমরা এখনও এলেমের মূল্যই বুঝলা না। এইখানে দয়া-দাক্ষিণ্যের কী আছে। এই যে আমি জীবনের অর্ধেকটা সময় দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে এলেম অর্জন কইরা আলেম হইলাম, আমি কি পারতাম না অন্য কিছু হইতে?
- তা অবশ্য পারতেন।
- আমি ডাক্তারও তো হইতে পারতাম। ইঞ্জিনিয়ার হইতে পারতাম। ইংরেজি মাধ্যমে পইড়া সরকারি অফিসার-টফিসার হইতে পারতাম। রোজগার পাতি নিয়া আমারে কোনো চিন্তাই করতে হইত না। কিন্তু আমি কী হইলাম? আলেম হইলাম। সারাজীবন কোর’আন হাদিস শিখলাম, ফিকাহ শিখলাম, আরবি ফারসি শিখলাম। জানি এইগুলা দিয়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওন যায় না, লাখ লাখ টানা ইনকাম করন যায় না। তারপরও শিখলাম ইসলামের জন্য। এইটা কি আমার অপরাধ?
- হুজুর, গুস্তাখি মাফ করবেন। আমি অপরাধের কথা বলি নাই। আমি চাই আপনি অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকুন। তাছাড়া রোজগারের জন্য আপনাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন তো কথা নেই। মানুষ তো কায়িক শ্রম দিয়েও পরিবারের ভরণ-পোষণ করছে। তারা যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও নিজের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে পারে, আপনি কেন পারবেন না?
- কী সাংঘাতিক কথাবার্তা! সবার সাথে তুমি আমারে মিলাইতেছো? একজন আলেম রাস্তায় রাস্তায় হকারী কইরা বেড়াইব, জুতা সেলাই করব, চটপটি বেইচা বেড়াইব! তোমার মাথা ঠিক আছে?
- হুজুর, কোনো কাজকেই কিন্তু ছোট করে দেখা উচিত নয়। আমাদের নবীজী বকরি চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, তার কিন্তু আত্মসম্মানে আঘাত লাগেনি। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে, আপনাকে নামাজের ইমামতি করাতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ এই কাজ তো আপনার জন্য ফরদ নয়। ফরদ হচ্ছে পরিবারের মুখে হালাল রোজগার করে খাবার তুলে দেওয়া। ফরদ ছেড়ে দিয়ে নফল নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না তো? আপনি আলেম মানুষ, আপনিই ভালো জানেন বিষয়টা।
- সেইটাই মাথায় রাইখো। আলেম হিসেবে আমি অনেক কিছুই জানি, যেইটা তোমরা জানো না। আর এই কারণেই আলেম হইয়া পড়ছি এক বিপদে। কথায় কথায় প্রশ্ন, কথায় কথায় সন্দেহ। একজন আলেমের জন্য দশটা হাজার টাকা খরচ করতে তোমাগো কলিজা ফাইটা যাইতেছে- আখেরী জামানায় আরও কত কী দেখতে হইব কে জানে! 😒

Monday, May 7, 2018

বনি কুরাইজা: হত্যাকাণ্ড নাকি রাষ্ট্রদ্রোহীর দণ্ড?

১. খন্দক যুদ্ধ

পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাস। জাজিরাতুল আরবের একটি পল্লী জনপদ মদীনা। সেই মদীনার ঘরে ঘরে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। কারণ স্মরণকালের ভয়াবহতম এক অবরোধের মুখে তাদের জনজীবন আজ বিপর্যস্ত! সারা আরব থেকে কাফের-মোশরেকরা সমবেত হয়েছে মদীনার উপকণ্ঠে। বাজিয়ে চলেছে যুদ্ধের দামামা! এর বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বলতে এতটুকুই যে, মদীনাকে ঘিরে প্রশস্ত পরিখা খনন করা হয়েছে এবং সেই পরিখা পাহারা দিচ্ছে তিন হাজার যোদ্ধা।
ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা চলছে মো’মেনদের। তাদের ঈমান বলে- আল্লাহর রসুল আছেন আমাদের সঙ্গে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। বাস্তবতা বলে, দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী পরিখার ওপারে প্রস্তুত- আরবের প্রসিদ্ধ যোদ্ধারা সেখানে তলোয়ারে শান দিচ্ছে। কোনোভাবে পরিখা অতিক্রম করতে পারলেই আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। এক নিমেষেই মদীনায় বয়ে যাবে রক্তগঙ্গা। আল্লাহর রসুলের সারা জীবনের সাধনা হয়ে যাবে ব্যর্থ! জীবনপণ সংগ্রাম করে যেই মদীনাকে তিনি গড়ে তুললেন, যেই মদীনায় ইসলামের ফুটন্ত গোলাপ সবে সুবাস ছড়াতে শুরু করল- সেই মদীনার সাথেই কবর হবে সত্য ও ন্যায়ের। এমনই জীবন-মরণ সঙ্কটের মুখে সবার একটাই আশা, হয়ত কোনো উপায় বের করবেন আল্লাহর রসুল। আল্লাহ কোনো বিশেষ সাহায্য পাঠাবেন তাঁর প্রিয় বন্ধুর সৌজন্যে। 
ওদিকে আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে আবু সুফিয়ান, মক্কার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তার হৃদয়ে আজ প্রতিশোধের আগুন, চোখে বিজয়ের দীপ্তি! সারা আরবের সৈন্যরা একত্রিত হয়েছে মদীনার বিরুদ্ধে, এই দৃশ্য দেখে তার পুলকিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আবু সুফিয়ান ভালোভাবেই জানে এত বিশাল বাহিনীকে মোকাবেলা করার সাধ্য মোহাম্মদের (সা.) নেই। অচীরেই তার অনুসারীদের উপর দশ হাজার সৈন্যের যৌথবাহিনী আছড়ে পড়বে সাক্ষাৎ গজব হয়ে। তরল শোণিতধারায় সিক্ত হবে মদীনার পথঘাট এবং একমাত্র তখনই মুসলমানরা প্রমাণ পাবে- কোরাইশ গোত্রপতিদের বিরুদ্ধাচারণ করার পরিণতি কত শোচনীয় হয়!

পরিখাবেষ্টিত মদীনাজুড়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। কতদিন অবরুদ্ধ থাকতে হবে কেউ জানে না। খাবার ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। অস্ত্রশস্ত্রও আছে নামমাত্র। অবরোধের একটি দিন যেন একটি বছর, শেষ হতেই চায় না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দু’দ- বিশ্রাম নেওয়া? তারও সুযোগ নেই। গভীর রাতে ঘুম ভাঙে তীরের শব্দে, অশ্বের হ্রেষাধ্বনিতে! এই বুঝি পরিখা পেরিয়ে এলো শত্রুরা! টেনশনে নির্ঘুম রাত কাটে মুসলিম শিবিরে।
মুনাফিকরাও কথা বলার মওকা পেয়ে গেছে। তারা বলে ‘মুহাম্মদ (সা.) আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, আমরা পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের যাবতীয় ধন-দৌলতের মালিক হয়ে যাব। অথচ আজ আমরা নিরাপদে পায়খানায় যেতেও পারছি না।’ তাদের এই কথার প্রত্যুত্তরে মো’মেনরা নিশ্চুপ! কারণ এর জবাব দেওয়ার সময় আসেনি। আগে সঙ্কটের মেঘ কাটুক- দিনের আলো উদ্ভাসিত হোক। আল্লাহর সাহায্য যখন আসবে তখন এই মুনাফিকদের মুখ কালিমালিপ্ত হবে। কিন্তু অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাস! মুনাফিকদের প্রশ্রয় দিতেই যেন সঙ্কটের মেঘ আরও ঘনীভূত হতে লাগল। দেখা গেল মদীনার ভেতরেও শুরু হয়েছে গোলযোগ। কোনো কোনো গোত্রে নিজেরাই গণ্ডগোল শুরু করল। একপক্ষ মনে করে আমরা বোধহয় মোহাম্মদকে (সা.) আশ্রয় দিয়ে ভুলই করে ফেললাম, আরেকপক্ষ বলে- ‘কখনই নয়। তিনি আল্লাহ রসুল, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ভয় কিসের?’

২. বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত:

সব মিলিয়ে এই যখন মদীনার সঙ্কটাবস্থা, চারিদিকে হিংস্র জন্তুর কোলাহল প্রতি মুহূর্তে মদীনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- ‘মদীনা তুমি আজ চরম নিঃসঙ্গ, তোমার কেউ নেই, তুমি একপাল নেকড়ের সম্মুখে একটি হরিণছানার ন্যায় অসহায়’- ঠিক সেই মুহূর্তে একটি খবর আল্লাহর রসুলকে আরও বিচলিত করে তুলল। তিনি জানতে পারলেন বনি কুরাইজা গোত্র নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অস্ত্রধারণ করছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
সেই বিশ্বাসঘাতক বনি কোরাইজা গোত্র, যারা এর আগেও একবার নিরাপত্তা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল! আল্লাহর রসুল সেদিনই তাদেরকে বিতাড়িত করতে পারতেন, শাস্তিস্বরূপ হত্যাও করতে পারতেন। কিন্তু দয়া পরবশ হয়ে তিনি ক্ষমার ঘোষণা দেন। চুক্তি নবায়ন করেন। কে জানত বিশ্বাসঘাতকতা তাদের রক্তে মিশে আছে?
খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে আল্লাহর রসুল দুই সাহাবীকে বনি কুরাইজায় পাঠালেন। তারা বনি কুরাইজার দূর্গে গিয়ে দেখলেন - খবর সত্য। পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ। যতটা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়েও খারাপ। ইহুদি গোত্রটিকে চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তারা খেঁকিয়ে ওঠে- ‘কে মোহাম্মদ? কীসের চুক্তি? আমরা মোহাম্মদ নামের কাউকে চিনি না।’ সাহাবীদ্বয় ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসছেন আর ভাবছেন, এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর কি সবাইকে জানানো ঠিক হবে? এই খবর প্রচারিত হলে মুসলিম বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে যাবে! তারা সম্মুখের শত্রু নিয়েই বিচলিত- পেছনেও যে বিষাক্ত নাগিন নিশ্বাস ফেলছে সেই খবর বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম বাহিনী আর যুদ্ধ করার মত মানসিক দৃঢ়তা পাবে না। সুতরাং বুদ্ধি খাটিয়ে তারা সাংকেতিক ভাষায় রসুলকে বুঝিয়ে দিলেন পরিস্থিতি বড়ই সঙ্কটজনক। খবর পুরোটাই সত্য। 
বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার খবর আল্লাহর রসুলের হৃদয়ে কেমন ভাবাবেগ সৃষ্টি করেছিল? আমরা সেটা জানি না, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুমান করতে পারি তিনি কতটা বিস্মিত হয়েছিলেন। বিস্মিত হবার কারণ বনি কুরাইজা নামক ইহুদি গোত্রটির চুক্তিভঙ্গের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। নিজস্ব ধর্ম পালনে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। আল্লাহর সত্যনবীকে তারা অস্বীকার করেছে তওরাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও- তবু আল্লাহর রসুল তাদেরকে কোনোদিন জোরাজুরি করেননি। কোনো বিষয়েই তাদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে এমন নজির নেই, কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেওয়া হয়নি। শত্রুতার তো প্রশ্নই ওঠে না!
আল্লাহর রসুল মদীনায় হিজরতের পর একদিন সবগুলো গোত্রকে নিয়ে বসলেন। সর্বসম্মতিক্রমে একটি সনদ রচনা করলেন। সেখানে ঘোষণা করা হলো- ‘ইহুদি ও মুসলিমরা এক জাতি। আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করব না। মদীনা আক্রান্ত হলে সবাই মিলে যুদ্ধ করে স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করব।’
আল্লাহর রসুল সর্বদা চেয়েছেন মদীনার প্রত্যেক গোত্র বর্ণের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতি স্থাপন করতে এবং সর্বোপরি মদীনার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এতে বনি কুরাইজার মত গোত্রগুলোও কি যথেষ্ট লাভবান হয়নি? এত ন্যায়-শান্তি-সুবিচার ও নিরাপত্তা তাদের জীবদ্দশায় তারা ভোগ করেছে কখনও? তবু বহিঃশত্রুর পক্ষ নিয়ে এই বিশ্বাসঘাতকের দল স্বদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মনস্থির করল! এতদিন যে মুসলিমরা নিজেদের জীবন দিয়ে মদীনার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এসেছে, সেই মদীনার সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আজ সেই মুসলিমদেরই নিশ্চিহ্ন করতে অস্ত্রধারণ করা- এই অপরাধের কেবল একটাই শাস্তি হতে পারে, যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতকদের যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
মদীনার আরও দুই ইহুদি গোত্র বনি কায়নুকা ও বনি নাজির এখানে প্রাসঙ্গিক। বেশিদিন আগের কথা নয়। তারাও মদীনায় বসবাস করত। মদীনার সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। এক পর্যায়ে তারা নিরাপত্তা চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু তাসত্ত্বেও তাদেরকে কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি, এমনকি বন্দী করা বা সমস্ত সহায়-সম্পদ কেড়ে নেওয়ার মত কঠোরতাও দেখানো হয়নি। কেবল মদীনা থেকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়! সেই উদারতার মর্যাদা রক্ষা করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা আবারও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, এই খন্দকের যুদ্ধেই তারা কুশীলবের ভূমিকা পালন করে। সমগ্র আরবকে একত্রিত করে তারা মদীনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, এমনকি মদীনার ভেতরে ঢুকে স্বজাতীয় ইহুদিদেরকে প্ররোচিত করে ‘রাজাকার’ বানিয়ে ছেড়েছে। এই গোত্রগুলো বরাবরই রসুলাল্লাহর ‘উদারতা’কে দুর্বলতা বিবেচনা করে এসেছে।
যা হোক পরবর্তী ঘটনা সংক্ষেপে এই যে, রসুলাল্লাহর সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কোরাইশদের সাথে বনি কোরাইজার সমঝোতা ভেস্তে যায়। তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস দানা বাঁধে। কোন্দল সৃষ্টি হয়। তারা একত্রিত হয়ে মুসলিমদের উপর চড়াও হবার যে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র করেছিল- সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরই মধ্যে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দৃঢ়তা ও অবিচলতার পুরস্কার দিতে শুরু করেন। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়ে মোশরেকদের তাঁবু ও রান্নার আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আগুন নিভিয়ে দেয়। আবু সুফিয়ান তার দলবল নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা দেয়, গাতফানীরাও কুরাইশদের অনুসরণ করে অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে স্বদেশভূমির দিকে রওনা হয়। এভাবে যুদ্ধের একাংশ সমাপ্ত হয় বিনা রক্তপাতেই। কিন্তু অপর অংশ তখনও বাকি।

৩. বনি কুরাইজা অভিযান

বনি কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার দণ্ড তখনও দেয়া হয়নি। আল্লাহর রসুল লোক পাঠালেন তাদের গতিবিধি দেখার জন্য। মুসলিমরা বনি কুরাইজায় পৌঁছলে ইহুদিদের মধ্যে নমনীয়তার বদলে যেন আরও ঔদ্ধত্য ফুটে উঠল। তারা আল্লাহর রসুল ও তাঁর স্ত্রী-পরিজন নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। তাদের মনোভাব যুদ্ধংদেহী। সম্ভবত তারা আশা করেছিল খায়বার থেকে অন্যান্য ইহুদিরা তাদের সাহায্যের জন্য আসবে। তাই কোরাইশরা চলে গেছে দেখে তারা মোটেও ভয়-ভীত নয়, বরং আনন্দিত এই ভেবে যে, এখন তারা সমস্ত ইহুদি মিলে মদীনাকে জব্দ করতে পারবে। তারাই হবে মদীনার সর্বেসর্বা।
আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা দৃঢ়তার সাথে বনি কুরাইজা গোত্রকে অবরুদ্ধ করে রাখল। অবরুদ্ধ ইহুদিরা সাহায্যের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকল। কিন্তু প্রায় পঁচিশ দিন পেরিয়ে যাবার পরও কোনোদিক থেকে সাহায্যের ছিটেফোঁটাও এলো না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করল। ঘটনাটি এরকম- অবরোধ চলাকালে একদিন আলী (রা.) চিৎকার করে বললেন, ‘হে মো’মেন যোদ্ধারা! আমরা আজ হামজার মত শাহাদাতের পেয়ালা পান করব, অথবা ওদের দূর্গ জয় করব।’ এই বলে তিনি ও যুবায়য়ের (রা.) সামনে অগ্রসর হলেন। ইহুদিরা তখন ভয় পেয়ে দূর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। তারা বলল, হে মুহাম্মদ! আমরা আত্মসমর্পণ করতে মনস্থির করেছি। তবে একটি শর্ত আছে। আমাদের ব্যাপারে ফয়সালা আপনি করবেন না। আমরা সা’দ ইবনে মু’আযের ফয়সালা অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করছি। সাদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা সেটাই মেনে নিব।
পাঠকরা নিশ্চয়ই ভাবছেন, বনি কুরাইজা গোত্র বিচারক হিসেবে সাদ (রা.) কে চাইল কেন? এর কারণ সাদ (রা.) ছিলেন আওস গোত্রের, আর আওসরা বনি কুরাইজার অনেক পুরোনো মিত্র। কাজেই বিশ্বাসঘাতক ইহুদিরা হয়ত আশা করেছিল সাদ বিন মোয়াজ (রা.) আর যাই হোক মিত্র গোত্রের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ফয়সালা দিবেন না।
আল্লাহর রসুল তাদের শর্ত মেনে নিলেন। সাদকে (রা.) বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সাদ (রা.) সেখানে উপস্থিত হয়েই জানতে চাইলেন- তিনি যেই ফয়সালা দিবেন সেটাই সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিবে কিনা। নাকি আবার রায় প্রত্যাখ্যান করবে। ইহুদিদের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে সাদ (রা.) বললেন, এখানে আরও একজন আছেন, তাঁর মন্তব্যও প্রয়োজন (অর্থাৎ তিনি আল্লাহর রসুলের কাছেও জানতে চাচ্ছেন)। আল্লাহর রসুল বললেন, হ্যাঁ, তুমি যে ফয়সালা দিবে সেটাই কার্যকর হবে। অতঃপর যে দণ্ড তাদের প্রাপ্য ছিল সেটাই সাদ (রা.) ঘোষণা করলেন এবং তাও আবার তাদের ধর্মগ্রন্থ তওরাতের আইন দিয়েই। দ-াজ্ঞা হলো- ‘বনি কুরাইজার প্রাপ্তবয়স্ক যোদ্ধাদের প্রাণদণ্ড ও অন্যদের বন্দী করার’। অচিরেই সেই দণ্ড কার্যকর করা হলো।

৪. ইসলামবিদ্বেষীদের অপপ্রচার কতটা যৌক্তিক?

পাঠক, এ পর্যন্ত খন্দক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বনি কুরাইজা অভিযানের যে বর্ণনা তুলে ধরলাম- তা কিন্তু আমার নিজের মনগড়া বক্তব্য নয়। সবই ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রের আলোকে বলা, আস্তিক-নাস্তিক কেউই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। আশা করি এই ঐতিহাসিক আলোচনার পর পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে এই বিশ্বাসঘাতক গোত্রটিকে কেন এতবড় দণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং তা কোন প্রেক্ষাপটে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ইতিহাসের অবতারণা করলাম। করলাম এই কারণে যে, আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে বাংলার ইন্টারনেট জগতে ধুম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী একটি মহল, আর তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছে ইতিহাস অসচেতন ব্যক্তিরা। বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না যখন বিশ্বাসঘাতক বনি কুরাইজা গোত্রের বেইমানীর দণ্ডকে তারা ‘হত্যাকাণ্ড’ ‘গণহত্যা’ ইত্যাদি বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন! এই ইসলামবিদ্বেষীদের একটা মারাত্মক দক্ষতা হলো- ‘ইতিহাসকে কেটে ছেটে সুবিধাজনকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন’- বর্ণনা সত্য কিন্তু উপস্থাপনার দোষে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তারা সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনার বাইরে রেখে তাদের পছন্দের অংশবিশেষের উপর বিদ্বেষের প্রলেপ লাগিয়ে এমনভাবে পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন যা ইতিহাস অসচেতন ব্যক্তিমাত্রকেই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
ব্লগে, ফেসবুকে এই ইসলামবিদ্বেষীদের কুৎসামূলক লেখালেখির সাথে যারা পরিচিত আছেন, তারা ভালোভাবেই জানেন বনি কুরাইজার শাস্তির ঘটনাটি নিয়ে কী পরিমাণ বিদ্বেষ ইসলামের বিরুদ্ধে ছড়ানো হয়ে থাকে। এই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে তারা অসংখ্য লেখালেখি করেছেন, এখনও করে যাচ্ছেন। সাধারণত তারা ওই গোত্রের অপরাধগুলো এড়িয়ে যান, কোন পরিস্থিতিতে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হলো, তাদের অপরাধের ভয়াবহতা ইত্যাদি বিচিত্র কারণে বেমালুম ভুলে যান। যদি ক্ষীণকণ্ঠে দুই এক বাক্য বলেনও তাহলে এমনভাবে বলেন যেন ওটা কোনো অপরাধের মধ্যেই পড়ে না, সামান্য ভুল বোঝাবুঝি মাত্র। আসল অপরাধ হচ্ছে তাদেরকে দণ্ড দেওয়া। এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হলো, একজন নবী কীভাবে এত নির্দয় হতে পারেন- এই প্রশ্ন তুলেই তারা বনি কুরাইজার যোদ্ধাদের হত্যার পুংখানুপুংখ বর্ণনা নিয়ে হাজির হন। তাদেরকে কীভাবে টানতে টানতে নিয়ে আসা হলো, শিরোচ্ছেদ করা হলো, কোথায় লাশ ফেলা হলো, কে চিৎকার করছিল, কার রক্ত কোথায় গড়িয়ে পড়েছিল- এইসবের বীভৎস ফিরিস্তি দিতে থাকেন। সেই ফিরিস্তি পড়ে আপনি ভাববেন, আসলেই তো! এতগুলো মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা!
আপনি যখন এই কথাটি ভাবছেন তখন ২০১৮ সাল। আপনি একটি রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক, একজন রাষ্টপ্রধান বা সেনাপতি নন, এমনকি সাধারণ সৈনিকও নন। আপনি না কোনো যুদ্ধের মধ্যে আছেন, আর না সম্প্রতি আপনার জাতি ভয়াবহতম অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে এবং কেউ সেই সঙ্কট থেকে ফায়দা লোটার জন্য আপনারই ছত্রছায়ায় থেকে আপনার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। যুদ্ধ সম্পর্কে আপনার প্রত্যক্ষ ধারণা নেই, যুদ্ধের নিমর্ম বাস্তবতা সম্পর্কে আপনি অনভিজ্ঞ। আপনি বাস করছেন একটি স্বাভাবিক পরিবেশে, শত্রুমুক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। এই অবস্থায় তিনশ’ জন মানুষ কেন, একজন মানুষকে হত্যা করা হলেও আঁৎকে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু মাত্র ৪৭ বছর আগের বাংলাদেশে ফিরে যান, দেখবেন পথেঘাটে মানুষের মরদেহ পড়ে আছে, আর তারই পাশে জীবিতরা নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেউ আঁৎকে উঠছে না। কারণটা যুদ্ধকালীন বাস্তবতা। আপনি যখন যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করবেন তখন ওই যুদ্ধের বাস্তবতা ভুলে গেলে চলবে না।
আমার কথা হচ্ছে, পাকিস্তানি মিলিটারিরাও মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারাও মানুষ। পাকিস্তানিরা বাঙালি মেরেছে, মুক্তিযোদ্ধারাও কি পাকিস্তানি মারেনি? পাকিস্তানিদের রক্ত গড়িয়ে পড়েনি? বোমার আঘাতে পাকিস্তানিদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েনি? ওদের স্ত্রী-সন্তান, মাতা-পিতা স্বজন হারানো বিয়োগব্যথা ভোগ করেনি? যদি ন্যায়ের পক্ষ অন্যায়ের পক্ষ বলে কিছু না থাকে, সব মৃত্যুই সমান অমানবিক হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধকে কী বলা হবে?
ইসলামবিদ্বেষীদের জন্য আমার আফসোস হয় এই কারণে যে, ইসলামকে খুনোখুনির ধর্ম প্রমাণ করতে তেমন কিছু খুঁজে না পেয়ে অবশেষে বেচারারা বিশ্বাসঘাতক বনি কুরাইজাকে দেওয়া ‘দণ্ড’কেই প্রধান উপজীব্য হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কতই না সিরাতের পাতা উল্টেছেন, কতই না হাদিস গ্রন্থ তোলপাড় করেছেন, এমন কিছুই পাননি যেখানে আল্লাহর রসুল নিরাপরাধ কাউকে হত্যা করেছেন। অগত্যা লজ্জার মাথা খেয়ে তাদেরকে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে ‘অপরাধীর দণ্ড’ নিয়ে, সাফাই গাইতে হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার পক্ষে। ‘যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মানবতা মুছে ফেল টিস্যুতে’ স্লোগান দিয়ে যারা রাজপথ মুখরিত করে রাখেন, তারাই কোন যুক্তিতে যুদ্ধাপরাধী বিশ্বাসঘাতক ইহুদি গোত্র বনি কুরাইজার জন্য কান্নাকাটি করে দুনিয়া ভাসিয়ে ফেলেন আমার বুঝে আসে না। হত্যা আর দণ্ডের মধ্যেকার পার্থক্য কি তারা বোঝেন না?
বনি কুরাইজা গোত্রের এই যে রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্ত, এর ভয়াবহতা কতখানি তা বুঝতে হবে। যেই মুহূর্তে প্রত্যেক গোত্র প্রশ্নহীন শর্তহীনভাবে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে রাষ্ট্রপ্রধানের হাতকে শক্তিশালী করার কথা, সেই মুহূর্তে তারা চুক্তিপত্র ছিঁড়ে ফেলে শত্রুসেনার সাথে হাত মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সূচনা করেছিল- তার পরিণতি কী হতে পারত? সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধ না করতে পেরে নিঃসন্দেহে হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষ মৃত্যুবরণ করত, যার মধ্যে নারী-শিশুও থাকত। আর তেমনটা হলে আজকে যারা তিনশ’ জন ইহুদি হত্যা নিয়ে অশ্রুবর্ষণ করেন, হাজার হাজার মুসলিম হত্যার ঘটনায় এক লাইন লেখারও প্রয়োজন বোধ করতেন না। পাঠকদের নিশ্চয়ই অজানা নয় ইহুদিরা অন্তত দুই হাজার বছর ধরে ইউরোপের নানা দেশে নির্যাতিত হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে। খ্রিষ্টানরা সংঘবদ্ধভাবে ইহুদিদের বাড়িঘরে আক্রমণ করে তাদের গণহত্যা করেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, অবাধ লুটপাট চালিয়েছে, যেই হত্যালীলা বোঝাতে ইংরেজিতে একটি শব্দেরই জন্ম হয় ‘পোগরোম’। পোগরোমের সর্বশেষ সংস্করণ হিসেবে একজন খ্রিষ্টান রাষ্ট্রপ্রধান হিটলার ষাট লক্ষ ইহুদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এই যে খ্রিষ্টানদের হাতে নিহত লক্ষ লক্ষ ইহুদি, কোনো এক রহস্যময় কারণে এদের জন্য ইসলামবিদ্বেষী লেখকদের কোনো মমতাবোধ জাগ্রত হয় না। এদের যারা হত্যা করল তাদের বিরুদ্ধে কলমের ডগায় প্রতিবাদের ফোয়ারা সৃষ্টি হয় না। তাদের দুঃখ কেবল ওই তিনশ’ জন ইহুদির জন্য যারা রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মৃতুদণ্ড ভোগ করে। এতেই বোঝা যায় মানবতার আড়ালে তাদের আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন। সেটা হলো আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। নিহত ইহুদির সংখ্যা যদি লক্ষাধিকও হয়, কিন্তু হত্যাকারী অন্য কেউ হয় তাহলে তাদের আপত্তি নেই।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের দুনিয়াতেও ওই ধরনের অপরাধের কী শাস্তি দেওয়া হয়? কোনো রাষ্ট্রপ্রধানই বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করেন না। আমাদের দেশে ছিচল্লিশ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। সেই সাথে এ বিচার যুদ্ধের পরপরই হওয়া উচিত ছিল বলে আফসোস করা হচ্ছে। আল্লাহর রসুল যাদেরকে অতীতে একবার ক্ষমা করেছেন, আবার ক্ষমা করবেন কি নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের সুযোগ করে দেবার জন্য? অতীতে ক্ষমা করা হয়েছে বলেই রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্তকে মামুলি বিষয় মনে করা হয়েছে, ধরেই নেওয়া হয়েছে যদি চক্রান্ত ভেস্তেও যায় প্রাণদণ্ড হবে না, বড়জোর নির্বাসিত করা হবে। এভাবে বারবার ক্ষমা পেতে থাকলে কোনো গোত্রই রসুলাল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দুশ্চিন্তাবোধ করত না। অথচ খন্দকের যুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ থেকে অলৌকিক সাহায্য না পেলে ঘটনা ঘটত উল্টো। সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধে মুসলিম সৈন্যবাহিনী ব্যর্থ হত, আর ওইদিনই দুনিয়া থেকে ইসলামের নাম-গন্ধ মুছে যেত। আল্লাহর রসুল অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট, দারিদ্র্য, অপমান, নির্যাতন আর লাঞ্ছনার বিনিময়ে একটি জাতি গঠনের পর সেই জাতিকে চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখতেন।
একটি জাতি তিনি গঠন করতে চেয়েছেন। তার জন্য নিজের গোত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছেন, তাঁর অনুসারীরা নিজেদের বাপ-ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, বদরে ওহুদে কত সাহাবী হাসতে হাসতে প্রাণত্যাগ করেছে! এত কোরবানির বিনিময়ে জাতি গঠিত হবার পর কোনো নেতাই ওই জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে যাকে হুমকি মনে করবেন তার সাথে আপস করবেন না। তিনি আল্লাহর সত্যনবী, তিনি কেবল মানুষকে শান্তি ও সুবিচারের গালভরা বাণী মুখস্থ করাতে আসেননি, তিনি শান্তি ও সুবিচার কায়েম করতে এসেছিলেন। সাধুদের পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করতেই তার আগমন।
আল্লাহর রসুল বনি কুরাইজা গোত্রের সবার প্রাণদণ্ড কার্যকর করেননি, তবে যোদ্ধাদের মধ্যে অনেককে প্রাণ হারাতে হয়েছিল। সেই সংখ্যা নিয়েও মতভেদ আছে। সিরাতে যদিও ৭০০’র কথা বলা হয়েছে, হাদিসে তিনশ’র কথাও আছে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, যদি রসুলাল্লাহ আবারও উদারতা দেখিয়ে ক্ষমা করে দিতেন বা পুরো গোত্রকে অন্য কোথাও চলে যাবার সুযোগ করে দিতেন তারা ঠিকই অন্যান্য ইহুদিদের জোটবদ্ধ করে আবারও মদীনাকে ধ্বংস করতে ফিরে আসত। এই কারণেই বিশ্বাসঘাতকদের সহজে ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল না, কিন্তু যদি কেউ ভেবে থাকেন ওরা নিছক অন্য ধর্মের হবার কারণেই বিদ্বেষপ্রসূত শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাহলে সেটা ইতিহাসের প্রতি অন্যায় করা হবে। খন্দকের যুদ্ধের আগেও মুসলমানরা যুদ্ধবিজয় করেছে, পরেও বহু যুদ্ধ বিজয় করেছে, কয়টা গোত্রের পুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে? মক্কা বিজয়ের পর রসুলাল্লাহ যে ক্ষমার ঘোষণা দিবেন তা মক্কাবাসীও কি কল্পনা করতে পেরেছিল? পারেনি। ক্ষমার এমন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যে মহামানব তিনি তিনশ’ জন ইহুদির প্রতি রাগ সংবরণ করতে পারলেন না- তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি এত বড় শাস্তি হতে দিলেন কারণ এই শাস্তি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় তাঁর সামনে ছিল না। (সমাপ্ত)


এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে. . .

প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় আর পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘পাস করতে না পারায় তিন/চার/পাঁচ কিশোরীর আত্মহত্যা’। আমি ‘কিশোর’ না লিখে সচেতনভাবেই ‘কিশোরী’ শব্দটা লিখলাম কারণ এই প্রবণতা কিশোরীদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করে আদু ভাইয়ের মত দুই/চার বছর একই ক্লাসে পড়ে থাকতে পারার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে পুরুষরা জন্মগ্রহণ করে। নারীর ক্ষেত্রে তা হয় না। তাদের কুসুমকোমল হৃদয় শক্ত আঘাত নিতে পারে না, সহজেই কাহিল হয়ে পড়ে। তখন নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মত নিজের জীবন ধ্বংস করে হলেও অন্যদের অপরাধের প্রতিশোধ নেয় তার অভিমানী মন।


অবশ্য এটাও ঠিক যে, কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট না হলে কিশোরদের যে পরিমাণ হেনস্থার শিকার হতে হয়, কিশোরীদের হতে হয় তার কয়েক গুণ বেশি। এমনিতেই ছেলেরা সাত খুন মাফ পেয়ে যায়। মেয়েদের বেলায় পদে পদে কাঁটা। খারাপ রেজাল্ট করা ছেলেকে প্রথমে থাপ্পড় দিয়ে বাড়ি ছাড়া করলেও একটুপরেই খুঁজে আনা হয়। কোথাও চিরদিনের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হয় না। কিন্তু হতভাগা মেয়েদের বেলায় যেন ভেঙে যায় সমস্ত ধৈর্যের বাধ। একটা ছেলে খুঁজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চিরদিনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়ি। অনেকে বলবেন, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া কি খারাপ কিছু? না, অবশ্যই খারাপ কিছু নয়, তবে ফেল করার শাস্তিস্বরূপ বিয়ে দিয়ে শশুরবাড়িতে নির্বাসন দেওয়াটা অগ্রহণযোগ্য। 

এমনিতেই এই বয়সী মেয়েদের চাল-চলন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে আমাদের সমাজে একটা ট্যাবু কাজ করে। এরা হাসলেও সমস্যা, কাঁদলেও সমস্যা। জোরে কথা বললেও সমস্যা, আস্তে কথা বললেও সমস্যা। এই অবস্থায় যখন তাদের কেউ পরীক্ষায় ফেল করে তখন এক শ্রেণির পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মুখে পরনিন্দার তুবড়ি ছুটতে থাকে। সামান্য একটি পরীক্ষার ফলাফলকে কেন্দ্র করে একটি মেয়েকে যেভাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তাতে মনে হতেই পারে, পরীক্ষার ব্যর্থতার সাথেই তার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, আশা, আকাক্সক্ষা ও মমতার জায়গাগুলো আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে, হতাশা আর গ্লানিই তার জীবনের একমাত্র সম্বল!


সেই আপত্তিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে যারা বিপত্তি বাঁধিয়ে বসে তাদের জন্য কিছু কথা। তোমাদের কাছে যদি মনে হয় স্রষ্টা মানুষ নামক আশরাফুল মাখলুকাতকে নিছক ‘এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার জন্য’ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, এর চাইতে মহৎ কোনো লক্ষ্য বা এর চাইতে বড় কোনো অর্জন মানুষের হতে পারে না, তাহলে একজন অকৃতকার্য শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে শেষ করে দিতে পারো- আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ যে কাজের জন্য কোনোকিছু তৈরি করা হয় সেটাই মুখ্য বিষয়। ওই বস্তুকে দিয়ে ওই কাজ না হলে তা অর্থহীন হয়ে যায়। ব্লু হোয়েল গেমের উদ্ভাবক নাকি বলেছিল- ‘যারা এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে তারা সমাজের জঞ্জাল। এদের আগেভাগে মরে যাওয়াই ভালো।’ কথাটা আমার যথেষ্ট ভালো লেগেছে। তোমাদের কাছে জীবনকে এতই ঠুনকো বিষয় মনে হলে জঞ্জালের মতই সাফ হয়ে যাও, জগৎ পরিশুদ্ধ হোক।


আর যদি মনে কর যে- না আমি সমাজের জঞ্জাল নই। আমি মানুষ। সৃষ্টির সেরা আমি। আমার জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য আছে, লক্ষ্য আছে। বৃক্ষের সফলতা যেমন ফলদানে, সূর্যের সফলতা আলো প্রদানে, তেমনি মানুষের সফলতা মানবতার কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারায়। এইসব স্কুল-কলেজ ইত্যাদি আমার জীবনের আনুষঙ্গিকতা মাত্র, জীবনের সারবস্তু মোটেও নয়। আমাদের দেশকে যারা যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছিলেন তাদের সবাই মেধাবী এ প্লাসপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন না, তবু তারা আমাদের জাতীয় বীর। আমাদের আখেরী নবী মোহাম্মদ (সা.) লেখাপড়াই জানতেন না, তবু তিনি সমস্ত বিশ্বজাহানের নয়নের মনি, কোটি মানুষের আলোকবর্তিকা। মানুষ শিক্ষিত হয় তাঁর জীবনী পড়ে। যদি এই বোধ তোমাদের থাকে তাহলে বলব- খবরদার! কারো কথায় কান দিবে না। কেবল শপথ নাও- এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে/ এই দিনেরে নিয়ে যাব সেই দিনেরও কাছে।

তওহীদী জনতা

১.
একটি জ্বালাময়ী সমাবেশের আয়োজন করেছে ‘নিখিল বঙ্গ মর্দে মুজাহিদ কমিটি’। তাতে প্রধান বক্তা হিসেবে ভাষণ দানের কথা রয়েছে বিশিষ্ট ইসলামের খাদেম, মুফতিয়ে আজম, বাতেলের আতংক,পীরে আজম, মর্দে মুজাহিদ, তাগুদের কিরমনি, কুতুবে রাব্বানি, আলেম কুলের শিরোমণির।
তিনি একপা দুইপা করে মঞ্চের দিকে এগোচ্ছেন। চারিদিকে লাখো জনতার চাপা নিঃশ্বাস। তারা একবার মঞ্চের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার পেছনের বটগাছটার দিকে তাকাচ্ছে। কারণ বটগাছের গোড়ায় আস্তানা গেড়েছে দাঙ্গা পুলিশ। তাদের মতিগতি সন্দেহজনক!
ভাষণ শুরু হয়েছে। ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে মাওলানা সাহেবের চেহারা মোবারক। তিনি হঠাতই হুংকার দিয়ে উঠবেন তা সবাই জানে, কিন্তু কখন দিবেন তা কারো জানার কথা নয়। জনতা সেই সময়ের প্রতীক্ষায়।
২.
প্রতীক্ষার প্রহর বেশি দীর্ঘ হলো না। অচীরেই বাংলার সিংহপুরুষ সিংহনাদ দিতে লাগলেন। বাংঁলার মর্দে মুজাহিদ তওহীদী জঁনতার কাছে আমি জানতে চাই, ওঁহে মুসলমান ভাঁইয়েরা, তোমাদের গাঁয়ে কিঁসের রঁক্ত?
- মুসলমানের রক্ত হুজুর। (জনতা টগবগিয়ে উঠল)
- সেই মুসলমানের রঁক্তের নামে শঁপথ করে বলতে চাই, মাননীয় প্রঁধানমন্ত্রী, আঁপনি যদি রক্ত চান, আমরা রঁক্ত দিতে পারি। যদি লাশ চান, লাশ ফেঁলতে পারি। যদি হঁরতাল চান, হঁরতাল দিতে পারি। অঁবরোধ চান অঁবরোধ দিতে পারি। যদি এই মুসলমানের জমিন থেকে নাস্তিক মুঁরতাদদের বিঁতাড়িত না কঁরেন, তাঁহলে আমরা চুঁড়ি পরে ঘরে বসে থাকব নাঁ। বাংলার লক্ষ লক্ষ তঁওহীদী জনতা যদি রাঁস্তায় নেমে পেচ্ছাব করে দেয়- তাতেই সমস্ত নাস্তিক মুরতাদরা ভেঁসে চলে যাবে। ঠিঁক কিনা বলেন?
- ঠিইইইইইইইক (সমস্বরে মুজাহিদ জনতার চিৎকার/চেচামেচি)
- ভাঁইয়েরা আজকেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে, বাংলার জমিনে কে থাকবে কে থাঁকবে না। আমি জানতে চাই, বাংলার জমিন থেকে নাস্তিক হঁডবে নাকি মুসলমান হঁডবে?
- নাস্তিইইইইইইক (দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার)
জনতার চিৎকারধ্বনি শুনে দাঙ্গা-পুলিশের জনৈক অফিসার হাই তুলে একটা পান মুখে দিলেন। অদূরে কারেন্টের তারে বসে ছিল দু’টো দাঁড়কাক। তারাও সমস্বরে বলে উঠল- কা কা কা।
হুজুর জ্বালাময়ী বক্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন। জনতার তরঙ্গ থেকে মুহুর্মূহ তর্জন-গর্জন ভেসে আসছে। এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারী দলের নীতি-নির্ধাকরা প্রথমে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করার তালে ছিলেন। তওহীদী জনতা অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসাছাত্রের তর্জন-গর্জন দেখে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেছেন। পুলিশ লাগানো ঠিক হবে কিনা ভাবছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যদি পরিস্থিতি অন্যদিকে যায়?
পরিস্থিতি বোধহয় অন্যদিকেই যাচ্ছে। হুজুর এক মুহূর্তও থেমে নেই। তবে শ্রোতাদের চিৎকার চেচামেতিতে তিনি কী বলছেন তা বোঝা যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে দুই একটা শব্দ বোঝা যাচ্ছে শুধু। যেমন- ওমরের বংশধর, কতল, মুজাহিদ, জমিন, নাস্তিক, সরকার ইত্যাদি। পুলিশের অফিসার পান খাওয়া বন্ধ রেখেছেন। তবে হাই তোলা অব্যাহত আছে। তিনি রিল্যাক্স ভঙ্গিতে আছেন কারণ তাকে ঝামেলায় জড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে হুজুরের সাথে যোগাযোগ করা হবে অচীরেই। প্রয়োজনে কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে হলেও ঘরের ছেলেকে ঘরে পাঠানো হবে।
৩.
হঠাৎ বিকট আওয়াজ। শব্দ পেয়েই পুলিশ সদস্যরা এদিক-সেদিক ছিটকে যেতে লাগলো। পুলিশের অফিসার পান মুখে দিতে যাচ্ছিলেন। তড়িঘড়ি করে পান ফেলে রিভলবার হাতে নিতেই খেয়াল করলেন- তার সামনে বিরস বদনে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ির চাকার দিকে তাকিয়ে আছে। টায়ার বার্স্ট হওয়াতে তাকে যথেষ্ট মর্মাহত দেখাচ্ছে। অফিসারের উদ্বেগ কেটে গেল, তবে পরোক্ষণেই রাজ্যের বিস্ময় তাকে ভর করল।
অফিসার তাকিয়ে দেখলেন মঞ্চে কেউ নেই। তওহীদী জনতা যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। একটি ছেলে পড়ে আছে, তার কপালে চাপ চাপ রক্ত। সাদা টুপি লাল হয়ে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে পালাতে গিয়ে প্যান্ডেলের খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়েছে মনে হয়। সমাবেশ মাঠে এখন কোনো তওহীদী জনতা নেই। তবে শত শত স্যান্ডেল পড়ে আছে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কী ঘটল। একবার ভাবল পুলিশটাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে কিনা। পরোক্ষণেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হলো- কারণ পুলিশ অফিসার তার দিকে রাগে কটমট হয়ে তাকিয়ে আছে। সেই রাগ অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি।

ঈমান চলে যাবে

- হুজুর একটা কথা বলতে চাই। যদি আপনি অভয় দেন।
- ভয়ের কী আছে বাপু? তুমি তো আর কাফের মুশরিক না যে, মু’মিন মুসলমান দেইখা ভয় পাইবা।
- তা বটে! তারপরও ভয় পাচ্ছি, কারণ আমার কথাটাকে আপনি কীভাবে নিবেন বুঝতে পারছি না।
- আরে কও না, হুনি আগে।
- বিষয়টা হচ্ছে হুজুর, আমি একটা বই পড়তেছি। বইয়ের নাম ‘ধর্মব্যবসার ফাঁদে’। হেযবুত তওহীদের বই। হেযবুত তওহীদের নাম শুনেছেন তো হুজুর?
- হুম। 😒
- এই বইতে তারা কোর’আন হাদিস ইতিহাস দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে দ্বীনের কাজ করে অর্থোপার্জন করা হারাম। এছাড়াও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে অন্য কোনো প্রকার পার্থিব স্বার্থোদ্ধার- এগুলো ধর্মব্যবসা। এই ধর্মব্যবসা যারা করে তাদের জন্য আল্লাহ জাহান্নামের ঘোষণা দিয়েছেন। তাদেরকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।
- এইসব কথা তুমি বিশ্বাস করলা? 😠
- মোটেও না হুজুর। বিশ্বাস করি নাই। আমি ভাবলাম মিথ্যা কথাও তো হতে পারে। তাই কোর’আন হাদিস খুললাম। ওদের রেফারেন্স দেওয়া আয়াতগুলো, হাদিসগুলো খুঁজে বার করলাম। তখন দেখলাম কথা সত্য। তারা মিথ্যা লেখে নাই। তারপর বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। হুজুর, বিষয়টা নিয়ে আমি আসলে চিন্তিত।
- আচ্ছা, তুমি কেমনে বুঝলা ওদের কথা সত্য? আরবি জানো তুমি? কোর’আনের তাফসির পড়ছো কোনোদিন? কয়টা তাফসির পড়ছো? কোর’আনের একটা আয়াতের কত প্রকার অর্থ হইতে পারে জানা আছে তোমার? হাদিসের শানে নজুল বোঝো? কয় লাখ হাদিস মুখস্ত আছে তোমার?
- হুজুর আমি তো এতকিছু জানি না। আমি পড়েছি কোর’আনের বাংলা তরজমা। তাহলে কোনো ভুল করলাম নাকি?
- বাপুরে, তোমাদের এই এক দোষ! সবকিছু নিজে নিজেই বুঝতে চাও। রোগের চিকিৎসা যদি রোগীরাই করতে পারে তাইলে ডাক্তার দিয়া কী কাম? সেই তো ডাক্তারের কাছে আসতেই হলো, শুধু শুধু নিজে মাতুব্বরী করলা!
- হুজুর আমার ভুল হয়ে গেছে। নগন্য গুনাহগার মানুষ আমি। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বললে আমার উপকার হয়।
- শোনো বাবা! ঘটনা আর কিছু না, ষড়যন্ত্র। সব আলেমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তোমারে খালেস নিয়তে একটা কথা কই- ‘যদি ঈমান বাঁচাইতে চাও এরপর থেইকা তুমি ওদের লেখা পড়িও না।’ সাবধান!
- জ্বি আচ্ছা।
- ওদের ধান্দা তোমরা সাধারণ মানুষরা বুঝবা না। আমরা আলেমরা ভালোমতই বুঝি। আলেমদের উপর থেকে মানুষের মুহব্বত উঠায়া দিবার চায় তারা। তখন মানুষ আর আলেমদের কাছে ইসলাম শিখতে যাইব না। ইসলাম বইলা কিছু থাকবেও না। কী সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র! 🤔
- কিন্তু হুজুর, তাদের কথা তো আলেমদের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ইত্যাদি স্বার্থ হাসিল করে তাদের বিরুদ্ধে।
- তুমি কি আমারে গাধা মনে কর নাকি হে? আমি কি জানি না- কারা ধর্ম দিয়া রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ফায়দা ভোগ করে? ✌️

মুসলিম সঙ্কট

- আমি চেরাগের দৈত্য বলছি: হুকুম করুন মালিক। মুহাহাহা।
- আমি যা হুকুম করব তুমি তাই করে দিবে?
- জ্বি মালিক। তবে একটা সমস্যা আছে। মুহাহাহা।
- শোনো দৈত্য, তোমার মুখে সমস্যার কথা মানায় না। তোমার মুখে থাকবে শুধু সমাধানের কথা।
- মালিক, সমস্যা হলো জীবনের অক্সিজেন। সমস্যা আছে বলেই মানুষ বেঁচে আছে, দৈত্যরা বেঁচে আছে। যেদিন দেখবেন কোনো সমস্যা নাই, সেদিন দেখবেন জগতও নাই। আপনিও নাই, আমিও নাই।
- দার্শনিক উক্তি ছেড়ে আসল কথা বলো। কী সমস্যা আছে?
- মালিক! আগে আমি তিনটা ইচ্ছা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু কলি যুগে আমার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। আমি আপনার মাত্র একটি হুকুম তামিল করতে পারব। মুহাহাহা।
- এতে হাসির কী হলো? কথায় কথায় এত মুহাহাহাহা করবা না।
- আচ্ছা মালিক। আপনার যা মর্জি তা-ই হবে।
- শোনো দৈত্য! আমি মুসলমানের ঘরের সন্তান। স্বার্থপর, বেঈমানের মত নিজের জন্য কিছু চাইব না। আমি চাই ইসলামের কল্যাণ হোক, হক্বপন্থী মুসলমানের উপর নির্যাতন বন্ধ হোক এবং ইসলামের শত্রুরা ধ্বংস হয়ে যাক। চারদিকে ইসলামের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা নস্যাত হোক।
- মারহাবা মারহাবা! তা আমায় কী করতে হবে মালিক?
- বেশি কিছু না। আমাদের দেশে একটা বাতিলপন্থী মাওলানা আছে, লক্ষ লক্ষ তার অনুসারী। এই লোক কোর’আন হাদিসের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে, এই ফাসেকের কল্লা ফেলে দাও।
- এইটা তো আমার বাম হাতের কাজ। আপনি কোনোই চিন্তা করবেন না মালিক। আমি চললাম. . .
- অ্যায় দৈত্য দাঁড়াও দাঁড়াও। ওরে মারতে হবে না। আমি চিন্তা করে দেখলাম ওর চেয়ে বেশি ক্ষতি করে সেক্যুলার দলগুলা। আমি একজন সেক্যুলার নেতার নাম বলছি। তুমি তাকে উপরে পাঠিয়ে দাও। একটা কাফের কমল, ইসলামপন্থী দলেরও সুযোগ বাড়ল- কী বলো তুমি?
- মালিক! বিশ্বের বহু দেশে ইসলামপন্থী দল ক্ষমতায় গেছে। কোথাও নির্বাচনের মাধ্যমে, কোথাও জোরপূর্বক শক্তি প্রয়োগ করে। তাতে কিন্তু আপনাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নাই।
- (ঈষৎ চিন্তিত হয়ে) তা অবশ্যি ঠিক। তাহলে কী করা যায়?
- মালিক, আপনাকে ইসলামের আসল শত্রুকে চিনতে হবে।
- তাহলে তুমি শিয়াদের প্রধান ইমামকে হত্যা করে ফেলো। এই বজ্জাতগুলা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলছে।
- মালিক, শিয়ারা যদি সমূলে ধ্বংসও হয়ে যায় তাতেই কী? সুন্নিদের মধ্যেও তো হাজার হাজার দল-উপদল, ভাগ-উপভাগ, তরিকা-উপতরিকা, ফেরকা-মাজহাব আছে। একেক ভাগের কাছে একেক রকম ইসলাম। এক ভাগ আরেক ভাগরে কাফের বলে।
- বুঝেছি, তাহলে তুমি নাস্তিকদের মধ্যে সবচাইতে বড় ব্লগারটাকে খতম করে দাও। এরা ইসলামকে বড্ড গালাগালি করে।
- মালিক, এরা থেমে গেলেই কি ইসলাম শত্রুমুক্ত হয়ে যাবে? মুসলমানদের দেশগুলোকে তো নাস্তিক ব্লগাররা হামলা করে ধ্বংস করছে না। ওই হামলা তো চলতেই থাকবে।
- তা অবশ্যি ঠিক। একটা কাজ করলে কেমন হয়, ফিলিস্তিনের ভাই-বোনেরা সত্তর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছে। ওদের ইহুদি প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু একটা পাক্কা কাফের। ওইটারে ফালাই দাও।
- ‍মালিক, এক নেতানিয়াহু ইন্তেকাল করলে হাজার নেতানিয়াহু আছে ওদের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মত পরাশক্তিরা ওদের ইয়ার-বন্ধু লাগে। কী লাভ হবে? রাখাইনে তো নেতানিয়াহু নাই। এখানেও মুসলমানরা গণহত্যার শিকার হচ্ছে। বড় বড় পরাশক্তিরা তাতে মদদ দিচ্ছে।

- তাইলে ট্রাম্পের কল্লা ফেলো। সিরিয়াতে এই কাফেরের বাচ্চা অতিরিক্ত মাতব্বরী করছে।

- মালিক! কথায় আছে, থোড় বড়ি খাড়া/খাড়া বড়ি থোড়। ট্রাম্পের আগেও তো কত প্রেসিডেন্ট এসেছে-গেছে। তাদের কেউই মুসলমানদের প্রতি মমতা দেখায়নি। ট্রাম্পের পরে যে আসবে সেও তেমনি হবে না তার নিশ্চয়তা কী?

- তাহলে মুসলমানের প্রকৃত শত্রুটা কে শুনি? কাকে খতম করলে মুসলমানরা মুক্তি পাবে? আমি তো কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না। একবার মনে হচ্ছে সবাই শত্রু, আরেকবার মনে হচ্ছে, এদের মধ্যে কেউ না, অন্য কেউ আছে। সেই ‘অন্য কেউ’টা কে তাও ভেবে পাচ্ছি না। তোমার কি জানা আছে? 

- মালিক! আমি সেই মহাশত্রুকে ভালোমত চিনি। কিন্তু তা ফাঁস করার স্পর্ধা আমার নেই। একমাত্র কোনো মনুষ্যসন্তানই পারবে তা প্রকাশ করতে। তার জন্য মনুষ্য-সন্তানকে মনের দুয়ার উন্মোচন করতে হবে। দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে হবে। চিন্তাকে রাখতে হবে যাবতীয় ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতামুক্ত। এতদিন আপনারা যাকে-তাকে ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়েছেন। রক্তপাত পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু আসল যেই শত্রু- সে আড়ালেই রয়ে গেছে। তাকে আপনারা চিনতেই পারেন নি, প্রতিরোধ করবেন কীভাবে? অদূর ভবিষ্যতে কোনোদিন সেই মহাশত্রুকে যদি চিনতে পারেন তাহলে সেটা হবে আপনাদের সবচাইতে বড় সফলতা। তখন আপনারাই তাকে প্রতিরোধ করতে পারবেন। আমার প্রয়োজন পড়বে না। আর চিনতে না পারলে মহাসর্বনাশ! দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। কিছুতেই মুক্তি পাবেন না আপনারা। মানুষ তো বটেই, কোনো দেও-দানবও মুক্তি এনে দিতে পারবে না। কোনো মন্ত্রবলেই না।

বেদাত

- শোনো হে মুসল্লিগণ! ইসলামে শবে বরাত নাই। এইটা নিঃসন্দেহে বেদাত।
- হুজুর বেদাত আবার কী বস্তু?
- বেদাত হইল ইসলামের মধ্যে নতুন কালচার চালু করা।
- নতুন কালচার মানে?
- আল্লাহর রসুল যেই ইসলাম নিয়া আসছেন সেইটা হইল পরিপূর্ণ ইসলাম। নতুন করে ওইটাতে কিছু যোগ করনের সুযোগ নাই। আল্লাহর রসুল সারাজীবন যেই কাজ কইরা গেছেন, তাঁর আসহাবরা কইরা গেছেন, সেইটা ছাড়াও নতুন কিছু চালু করলে সেইটাই বেদাত।
- ও আচ্ছা আচ্ছা।
- এই যে চারদিকে ধুমধাম কইরা উৎসবের মতন শবে বরাত পালন করা হইতেছে- ইহা কি নবীজীর জামানায় ছিল? কেউ ইতিহাস থেইকা দেখাইতে পারবা? আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম। আবার দ্যাখো এই যে হাজার হাজার পীর, মাজার-দরগা, হুজরা-খানকা, এইসব কি নবীজীর আমলে ছিল?
- হুজুর এগুলোও কি তাহলে বেদাত?
- আলবৎ বেদাত। শেরকের সমান কবীরা গুনাহ।
- তাহলে তো বড়ই চিন্তার বিষয় হুজুর। কত মানুষ না জেনে পাপের ভাগী হচ্ছে।
- এজন্যই বাতিলের বিরুদ্ধে হুংকার দিতে হইব। শোনো বাবারা, তোমরা হইলা তরুণ প্রজন্ম, তোমাগোরেই আগায়া আসতে হবে। তাইলে দেখবা কোনো বাতিল মাজারপুজারী, পীরপূজারী, বেদাতী বাংলার জমিনে ঠাঁই পাইব না।
- ইনশা’আল্লাহ হুজুর, আমাদের জন্য দোয়া কইরেন।
- অবশ্যই দোয়া করি। ফি আমানিল্লাহ।
- আচ্ছা হুজুর, একটা কথা মনে পড়ল। আপনি বেদাতের যেই সংজ্ঞা দিলেন সেই মোতাবেক আরও অনেক কিছুই বেদাত হবার কথা। নবীজীর যুগে যেমন পীর-মুরীদ ছিল না, তেমনি তো ‘মাওলানা’ ‘মুফাসসির’ ‘মুহাদ্দিস’ ‘মুফতি’ এসবও ছিল না। কোনো সাহাবীর নামের আগে মাওলানা, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ‍মুফতি ছিল না। তাহলে নামের সাথে এই টাইটেল জুড়ে দেওয়ার কালচার কি বেদাত হয় না?
- আরে না না! তা হবে কেন? এইসব তো হইল গিয়া ডিগ্রি।
- ও আচ্ছা। আরেকটা বিষয় বলি। নামাজে ইমামতি করা, মুর্দা দাফন করা, বিয়ে পড়ানো, কুরবানির পশু জবাই দেওয়া, ওয়াজ করা, মিলাদ পড়ানো ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মীয় কাজের জন্য আমরা আপনাদের দারস্থ হই। বিভিন্ন ধর্মীয় মাসলা-মাসায়েল জানার জন্যও আপনাদের কাছে যাই। এই যে মুসলমান জাতির মধ্যে দুইটি ভাগ হয়ে গেল- এক ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ, আরেক ভাগ আলেম-মাওলানা শ্রেণি, এই ভাগাভাগি তো আল্লাহর রসুলের জামানায় ছিল না। কিছু মানুষ সারাজীবন ধর্মীয় বই-পুস্তক নিয়ে পড়ে থাকবে, পাণ্ডিত্য অর্জন করবে, মাসলা-মাসায়েল তৈরি করবে, আর বৃহৎ জনসাধারণ ওই শ্রেণির অনুসরণ করতে থাকবে এমন সিস্টেম রসুলের আসহাবদের মধ্যে ছিল কি?
- আরে বাপু, তুমি তো দেখি কিছুই বুঝ নাই।

- বুঝি নাই বলেই তো প্রশ্ন করছি হুজুর। প্রশ্ন আরও আছে।

- (হুজরের দীর্ঘশ্বাস)

- হুজুর, খ্রিষ্টানদের মধ্যে একটা নিয়ম ছিল যে, রাষ্ট্রের নেতা একজন, ধর্মের নেতা আরেকজন। এই খ্রিষ্টধর্মীয় কালচার কিন্তু রসুলের জামানায় ছিল না। ইতিহাসে আমরা পাই, রসুলাল্লাহ ও তাঁর আসহাবরা যখন জীবিত ছিলেন তখন যিনি ছিলেন সমাজের ইমাম, তিনিই ছিলেন মসজিদের ইমাম। রাষ্ট্রীয় নেতার বিপরীতে ‘ধর্মীয় নেতা’ নামে কোনো শ্রেণির অস্তিত্ব ওই ইসলামে ছিল না। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে এই পুরোহিত শ্রেণিটি নিজেরাই ইসলামে গজিয়ে ওঠা নতুন কালচার অর্থাৎ বেদাত। তাই নয় কি?

- এই থামো থামো। তুমি তো . . .

- আরেকটা কথা হুজুর। টাকা দিয়ে মাওলানা ‘ভাড়া’ করে ওয়াজ মাহফিল আয়োজন করার কালচারও রসুল ও তাঁর সাহাবীদের জীবদ্দশায় ছিল না। এটাও কি বেদাত নয়? বলা হয়ে থাকে প্রত্যেক মুসলমানকে মাজহাব মানতেই হবে, অথচ রসুলের যুগে কোনো মাজহাবই ছিল না। শিয়া-সুন্নি-ওহাবী-আহলে হাদিস ইত্যাদি ফেরকাও ছিল না। এই সমস্তই রসুলের ইন্তেকালের বহু পরে চালু হওয়া কালচার। এগুলো তাহলে কেন ‘বেদাত’ হবে না? যেই যুক্তিতে আপনি শবে বরাতকে বেদাত বললেন, একই যুক্তি এখানেও তো খাটে।

- না না না। তুমি আসলে কিছুই বুঝ নাই। তোমারে অন্য এক সময় ভালোভাবে বুঝাইতে হবে। আপাতত তুমি চুপ থাকো। কোনো কথাই বলবা না আর। আমি অন্যদের বুঝাই।

Wednesday, May 2, 2018

সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি

- হুজুর, একটা সিরিয়াস প্রশ্ন আছে। জবাবটা দিলে আমার বহুত ফায়দা হইত।
- মাশা’আল্লাহ! বলো বলো। আমি জবাব দিচ্ছি।
- হুজুর, আমরা মুসলমানরা তো আল্লাহর সবচাইতে প্রিয় বান্দা- কথা ঠিক কিনা?
- ঠিক মানে? মহাঠিক।
- কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হয় না। মনে হয় কথাটা মিথ্যা।
- নাউজুবিল্লাহ। শোনো বাবা, এর চাইতে বড় সত্য আসমান-জমিনে নাই। অন্য সমস্ত জাতি নরকে যাবে, আমরাই আল্লাহর খাস বান্দা, মরণের সাথে সাথে জান্নাতে দাখিল। জান্নাতের অগণিত রহমত-নেয়ামত সব আল্লাহ কাদের জন্য সাজায়ে রাখছেন? আমাদেরই জন্য। সবাই বলো সুবহানাল্লাহ।
- সুবহানাল্লাহ। কিন্তু তাহলে সারা পৃথিবীতে আমরা মার খাচ্ছি কেন? যেনতেন মার না, যাকে বলে পাইকারি মার। ফুটবলের মত সবাই আমাদের লাথি মারে। এইটা তো হুজুর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির পরিচয় না, গোলাম জাতির পরিচয়।
- ও আচ্ছা, এই কথা?
- জ্বি, এটাই কথা। আমার মনে হয় কোনো ঘাপলা আছে।
- বাবারে, কোনো ঘাপলা নাই। ঘটনা আর কিছু না- আল্লাহর পরীক্ষা। তিনি তাঁর খাস বান্দাদের পরীক্ষা নিতেছেন। তিনি দেখেন তাঁর বান্দারা বিপদের সময় তাকে ভুলে যায় নাকি মনে রাখে।
- তাই বলে শতাব্দীর পর শতাব্দী অন্য জাতির গোলামী করিয়ে পরীক্ষা নিবেন? কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানুষকে ন্যায়ের আদেশ আর অন্যায় থেকে বিরত রাখার জন্য।’ এটাই যদি আমাদের জাতিগত দায়িত্ব হয় তাহলে আমাদের ভাগ্যে গোলামী কেন? গোলাম কখনও মনিবকে ন্যায়ের আদেশ দিতে পারে? অন্যায় থেকে বিরত রাখতে পারে?
- বাপুরে, এজন্যই কথায় আছে অল্প বিদ্যা ভয়ংকর। কোর’আনের আয়াত শোনাও আমারে, আমি কি কোর’আন না পইড়াই মাওলানা হইছি? মানুষ হুদাহুদিই আমারে ওয়াজের দাওয়াত দেয়? দুই পাতা বাংলা কোর’আন পইড়াই তোমরা মনে কর, সব বোঝা হয়ে গেছে। বড়ই দুঃখের কথা।
- হুজুর, মনে কষ্ট নিয়েন না। আর বাংলা কোর’আন আউড়ে আপনার এলেমের মর্যাদা নষ্ট করব না। আপনি জবাবটা দিয়ে দেন।
- শোনো বাবা, আল্লাহর রসুল বলেছেন, দুনিয়া মো’মেনের জেলখানা, কাফেরদের জান্নাত। কাজেই দুনিয়া কাফেরের, পরকাল আমাদের। মরণের পরে দেখবা আসল খেলা।
- কিন্তু হুজুর, ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। আল্লাহর রসুল নিজেই ‘দুনিয়া’ করে গেলেন। যুদ্ধ করলেন, আরব উপদ্বীপ শাসন করলেন। বিচারকার্য করলেন। সেনাপতিত্ব করলেন। সারা আরবের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন। তাঁর সাহাবীরা যুদ্ধ করে রোমান পারস্যের সৈন্যদের পরাজিত করলেন, অর্ধদুনিয়া শাসন করলেন। প্রবল প্রতাপ আর গতিশীল পদচারণায় সমস্ত পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে দিলেন। তাদের সমস্ত জীবনটাই তো কাটল দুনিয়া নিয়ে। তার মানে কি তাদের পরকাল নেই? (নাউজুবিল্লাহ)
- না মানে ব্যাপারটা হইল গিয়া . . .
- ও আরেকটা কথা, ওই জাতির মধ্যে এত ভালো ভালো ঈমানদার ছিলেন, তারা তো কারো গোলাম হলেন না। বরং যারা আগে গোলাম ছিলেন তারা মুক্ত হয়ে গেলেন। তাদের নারীরা ধর্ষিতা হলেন না। তাদের শিশুদের লাশ সমুদ্রে ভাসল না। দুনিয়ায় তারা পরিণত হলেন সবচাইতে সম্মানিত জাতিতে। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা নেবার প্রয়োজনবোধ করলেন না, পরীক্ষা নিচ্ছেন কিনা আমাদের মত দুর্বলচিত্তের মুসলমানের, তাও আবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে! কথাটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?
- দ্যাখো বাবা, সবকিছু বুঝতে যাওয়া উচিত না। সমস্তকিছু আল্লাহর এখতিয়ার, তার অনুমতি ছাড়া গাছের পাতাটাও নড়ে না। আল্লাহই ভালো জানেন কেন এমন হচ্ছে। যা হোক - তুমি এখন যাও। আমি জিকির করব।

পল্টিবাজী

- ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদীনা।
- আহা! সাধু সাধু! তা ভাইজান, মদীনায় গিয়া কী করবেন?
- সিনেমা হলে সিনেমা দেখব।
- আস্তাগফিরুল্লাহ! একে তো সিনেমা দেখবেন, তাও আবার নবীর দেশে গিয়া। জাহান্নামেও তো জায়গা হইব না আপনের।
- সেই টেনশন আপনাকে করা লাগবে না। আপনি চুপ থাকেন। সিনেমা দেখা মোটেও হারাম না। এমনকি মক্কা-মদীনাতেও হারাম না।
- বললেই হলো? আলবৎ হারাম। নাফরমানির কাম। ঈমান থাকব না।
- ও তাই নাকি? তাহলে আপনারা যে বলেন সৌদি আরব ইসলামিক কান্ট্রি। তাও আবার যেনতেন ইসলাম না, একেবারে খাঁটি ইসলাম। কেউ ইসলাম নিয়ে কথা বলতে গেলেই আপনারা প্রশ্নবান ছুঁড়ে মারেন যে, মক্কা-মদীনার আলেমের চাইতে বেশি জানো? সেই মক্কা-মদীনার আলেমদের, মুফতিদের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া নিশ্চয়ই ইসলামিক কান্ট্রিতে সিনেমা হল তৈরি হয় নাই! তাহলে তারা যেটাকে হালাল বলে সেটাকে হারাম বলার আপনি কে?
- না মানে ইয়ে মানে, কোথাকার কোন আলেম বললেই তো হইব না, কোর’আন-হাদিসে যেইটা আছে সেইটা হইল ইসলাম।
- এই তো আসল চেহারা বেরিয়ে যাচ্ছে। যখন কোর’আন হাদিস দেখাই তখন বলেন মক্কা-মদীনার আলেমদের চাইতে বেশি বোঝেন? আর যখন মক্কা-মদীনার আলেমদের দৃষ্টান্ত দেখাই তখন বলেন কোর’আন হাদিসে যেটা আছে সেটা ইসলাম। ইসলামের নামে আপনাদের এই পল্টিবাজী আরও কতদিন দেখতে হবে আল্লাহ মালুম।

ইসলামের ছায়াতল

- আসেন ইসলামের ছায়াতলে।
- কেন ভাই, কুপাকুপি করতে?
- এইটা কী বলেন ভাইজান? কুফরি কথাবার্তা!
- দেখুন ধর্মের নামে কুপাকুপি হচ্ছে তো, নাকি মিথ্যা বলছি?
- তা হচ্ছে।
- হচ্ছে মানে ভালোমতই হচ্ছে। আপনারা শিয়া হয়ে সুন্নি মারেন, নয়ত সুন্নি হয়ে শিয়া মারেন। এক দল আরেকদলকে বোম মারেন। এক ফেরকা আরেক ফেরকার উপর হামলা করেন। এক পীরের মুরিদ আরেক পীরের মুরিদকে রাস্তায় ফেলে পিটান- তাতে কিছু হচ্ছে না, আমি সত্যটা বললেই কুফরি কথা হয়ে গেল?
- ভাইজান ইসলামে কুপাকুপি নাই। ইসলামের ছায়াতলে আসেন। দেখবেন ইসলাম কত শান্তির ধর্ম।
- তাহলে শান্তি নেই কেন?
- শান্তি নেই মানে? কী বলেন আপনি? অবশ্যই শান্তি আছে। মসজিদে আসেন। নামাজ পড়েন। হালকায়ে জিকির করেন।
- তার মানে মসজিদের বাইরে শান্তির দরকার নাই?
- ভাইজান, সবখানেই শান্তি পাইবেন। আগে আল্লাহর মহব্বতে দিল মশগুল করেন। দেখবেন দিল হালকা হবে।
- আরে ভাই, দিল হালকা তো গাঁজা খেলেও হয়। দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকা যায়। আমি ওই শান্তির কথা বলিনি। আমি বলছি সমাজের শান্তির কথা। ওই যে ভুখা-নাঙ্গা মানুষ দেখছেন, আমি বলছি তাদের কথা। ওদের পকেটে পয়সা নাই, পরনে বস্ত্র নাই, পেটে খাদ্য নাই, মাথার ওপর ছাদ নাই। খোদার প্রেমে মশগুল হলেই ওরা শান্তি পাবে? মসজিদে আসলে ওদের খাবার দিবেন আপনারা? বস্ত্র দিবেন? বাসস্থান দিবেন? সামান্য টয়লেটের দরজাতেই যেখানে তালা ঝুলিয়ে রাখেন।
- ভাই, ওইসব তো সরকারের কাজ। মসজিদ তো সরকার চালায় না।
- শান্তি দেওয়াও তো সরকারের কাজ। তাহলে শান্তির ধর্ম বলেন কেন? বলবেন মসজিদের ধর্ম। মেডিটেশনের ধর্ম!
- ভাই ইসলামের ছায়াতলে আসলে আপনি. . .
- রাখেন আপনার ছায়াতল। সেই ছায়াতলে মানুষ কেন যাবে যেখানে অনাহারীকে ক্ষুধা চেপে রেখে কোটিপতির পাশে নামাজে দাঁড়াতে হয়?
- ভাইজান, কিছু মনে কইরেন না। আপনি কি নাস্তিক?
- এই তো আসল কথায় আসলেন। আমাকে নাস্তিক সন্দেহ হচ্ছে। কারণ আমি যুক্তি দেখাচ্ছি। নিপীড়িত মানুষের কথা বলছি। অথচ এই নিপীড়িত মানুষ নিয়ে ভাবার কথা ছিল আপনাদের। আল্লাহর রসুল নিপীড়িত বেলালকে কাবার ছাদে উঠিয়েছিলেন! কুরাইশদের অহংকার চুর্ণ করে তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন- ‘সত্যনিষ্ঠ মানুষের সম্মান কাবারও ঊর্ধ্বে।’ সেই আদর্শ আপনারা খুইয়েছেন। ফিরে গেছেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের পর্বে। ইসলামের আগে কুরাইশরা আপনাদের মতই খুব ধর্মকর্ম করত। আচার-প্রথা মেনে চলত। তারাও ঈশ্বরের উপাসনা করত। ওসব করে খুব আত্মার প্রশান্তি পেত। কিন্তু সমাজ ছিল অশান্তিময়। আল্লাহর রসুল সংগ্রাম করে দেখিয়ে দিলেন ধর্মের কাজ দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়কে তুষ্ট রাখা নয়, দুঃখ-কষ্টকে দূর করা। পারলে সেই ইসলামের দিকে মানুষকে ডাকুন, সেই ইসলামের ছায়াতলে শোষিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, নিপীড়িত মানুষকে সমবেত করুন। তাহলে আস্তিক হিসেবে আমাকে তো পাবেনই, আমার ধারণা নাস্তিকদেরও পাবেন।