Wednesday, April 25, 2018

কড়াই থেকে চুলোয় লাফিয়ে পড়া আর কতকাল?

আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, আগে নিজে ভালো হোন, তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। এই কথাটি সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে পথ চলতে পারে না। জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনের চাপে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না। বিশাল এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যমুনা নদীর তুলনায় এক টুকরো শোলার মতো। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, সেটা দ্বারা ব্যক্তিও প্রভাবিত হতে বাধ্য, ইচ্ছে করলেও সৎ থাকা যায় না। কাজেই জাতীয়ভাবে আজ আমাদের এমন একটি সিস্টেম দরকার যেখানে শত চেষ্টা করেও কেউ ঘুষ খেতে পারবে না, অন্যায় করতে পারবে না, ওয়াদা খেলাফ করতে পারবে না, কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে এমন অবিচার সৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনাও যেখানে থাকবে না।
আমরা দেখছি প্রচলিত সিস্টেমে একদলের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে অন্যদলের ভোটের বাক্স ভরে দিচ্ছে জনতা, যাদেরকে নির্বাচিত করল তারাও পরীক্ষিত দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস লালনকারী, বিদেশে অর্থপাচারকারী, ওয়াদা ভঙ্গকারী এবং যাদেরকে পরাজিত করল তারাও এদেরই মতো। এই ক্ষমতার দৌড়ঝাঁপে আজ পর্যন্ত কত প্রাণ গেল, কত রক্ত ঝরল, কত গাড়ি-বাড়ি পুড়লো, কত মানুষ পঙ্গু হল, কতজন অন্যায়ভাবে জেলে পঁচলো। এসব করে মানুষের লাভটা কী হল?
এ যেন কড়াই থেকে বাঁচার জন্য লাফ দিয়ে চুলোয় পড়া, আর চুলো থেকে উঠে আবার কড়াইতে পড়া। পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার অনুকরণে এমন এক বিষাক্ত সিস্টেমকে আমরা নিজেদের উপর চাপিয়ে রেখেছি যে সিস্টেমে একজন সৎ, যোগ্য, প্রকৃত ওয়াদা রক্ষাকারী, আমানতদার, নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমী, উঠে আসতে পারবে না; এ সিস্টেমে যে যত বেশি অপপ্রচার চালাতে পারে, মিথ্যা প্রচার করতে পারে, কালো টাকা ছড়াতে পারে, পেশীশক্তি ব্যবহার করতে পারে সে নির্বাচিত হয়। সে যত বড় দুর্নীতিবাজ, মিথ্যাবাদী, ওয়াদা খেলাফকারী, দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী, সন্ত্রাস লালনকারী হোক না কেন তাদের কোন অসুবিধা নাই। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কোন জালের ফাঁকাগুলি যদি বড় বড় থাকে তাহোলে সেটা দিয়ে কোন ছোট মাছ ধরা সম্ভব হয় না, সেগুলি সব ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। থেকে যায় কেবল বড় বড় মাছগুলি। বর্তমানের নেতা নির্বাচন পদ্ধতিটি একটি জালসদৃশ যার ফাঁকাগুলি অনেক বড় বড়। তাই সমাজে যারা প্রভাবশালী, বিত্তবান, পেশীশক্তিতে বলীয়ান অর্থাৎ সমাজের রুই কাতলারা এই জালের মাধ্যমে জাতির নেতৃত্বপদ লাভ করেন। পক্ষান্তরে যারা চরিত্রবান, ভালো মানুষ, ওয়াদা রক্ষাকারী, ভদ্র, সভ্য, কারও ক্ষতি করে না তারা বর্তমানের সমাজে গুরুত্বহীন, সর্বত্র অবদমিত। তারা ছোট মাছের মত জালের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যান এবং কখনওই নেতৃত্বে উঠে আসেন না।
Related image
প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে প্রথমে একজন টাকা দিয়ে মনোনয়ন পত্র কিনে প্রার্থী হয়, নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপায়, নিজের গুণগান নিজেই প্রচার করে, মিছিল করে, ব্যানার টানায়, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, মানুষকে তার পক্ষে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়, প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে খুন করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। নিয়মিত শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনী তো আছেই, নির্বাচনের কেন্দ্র এবং ভোটের বাক্স পাহারা দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীও মোতায়েন করতে হয়। পাহারা উঠিয়ে নিলেই বোঝা যায় কে কতটা সভ্য! তখন বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটবাক্স লুট ইত্যাদি অনেক কিছুই ঘটে। গ্রাম্য মেম্বার থেকে শুরু করে যে কোন পর্যায়ের নির্বাচনেই এসব ঘটনা ঘটে থাকে। এটাই নেতা নির্বাচনের বর্তমান সিস্টেম, সারা দুনিয়াতে এই সিস্টেম প্রায় একই রকম, শুধু কোথাও সহিংসতা কম, কোথাও বেশি। এখন ধরুন একজন সৎ মানুষ আছেন যিনি বিত্তবান নন, নিজস্ব কোন লাঠিয়াল বাহিনী নেই, পেছনে প্রভাবশালী গোষ্ঠির মদদ নেই তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। তার প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী বড়ই দুঃশ্চরিত্র, নীতিহীন এবং অনেক টাকার মালিক। এখন এই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কার? অবশ্যই দ্বিতীয় লোকটির। এভাবে প্রতিটি পর্যায় থেকে সাধারণত খারাপ লোকগুলি বিজয়ী হতে হতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আসে। যারা নেতা নির্বাচিত হন তাদের ১০০% ই খারাপ তা অবশ্য নয়, কিছু কিছু ভাল মানুষও যদি কালে ভদ্রে নেতা হন, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আর তারাও বেশীদিন তাদের সচ্চরিত্র ধরে রাখতে পারেন না; সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি যে, কেউ ভালো থাকতে চাইলেই ভালো থাকতে পারেন না।
Image result for ভোটকেন্দ্রে দখল
এই স্বার্থভিত্তিক সিস্টেম বজায় রেখে জাতির মুক্তি সম্ভব নয়। সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অনাচার, অশান্তি ও রক্তপাত নির্মূল করার জন্য প্রচলিত সিস্টেম পাল্টিয়ে এমন সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে মানুষ স্বার্থ ও ভোগের চিন্তা না করে অপরের কল্যাণের চিন্তা করবে। নিজে কী পেলাম সেই চিন্তা না করে সমাজকে কী দিতে পারলাম এই চিন্তা করবে। তেমনটা হওয়া কেবল স্রষ্টা প্রদত্ত সত্য জীবনব্যবস্থাতেই সম্ভব, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত কোনো ব্যবস্থা একদিনের জন্যও তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে নি, কোনোদিন পারবেও না। পারবে না কারণ মানুষ নামক এই প্রাণী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, কাজেই কোন রাস্তায় বা সিস্টেম-এ সে সুখে থাকবে সেটা ভালো জানেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই হচ্ছে সেই সরল পথ, এর নামই তাই আল্লাহ রেখেছেন সেরাতুল মোস্তাকীম বা সহজ-সরল পথ। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে আমরা বর্তমানে তওহীদবিহীন যে ইসলাম দুনিয়াতে চলছে সেই বিকৃত বিপরীতমুখী ইসলামের কথা বলছি না, প্রকৃত ইসলাম গত ১৩০০ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেম শ্রেণি এই বিকৃত ইসলামটিকে তাদের রুটি রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে, কেউ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের মাধ্যম বানিয়েছে। একদা লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ, অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদী আজ ফেরকা, মাজহাব, মাসলা মাসায়েল ইত্যাদির কূটতর্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে; আরেকটি অংশ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষকে ইসলামের বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। জাতির বৃহত্তম অংশটি শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ বিকৃত ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা করে যাচ্ছে। এর কোনটাই আল্লাহ, রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। কেননা ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থই শান্তি। অর্থাৎ যারা ইসলামের অনুসারী হবে তারা শান্তিতে থাকবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। আমরা হেযবুত তওহীদ আল্লাহর রহমে সেই সেই প্রকৃত ইসলাম মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।

বিশ্বনেতাদের রণহুংকার! মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী?


No automatic alt text available.

নতুন বছরের শুরুতে একজন অপরজনকে ‘শুভেচ্ছা’ বা ‘শুভকামনা’ জানাবেন এটাই প্রথা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সব মানুষই নতুন বছরকে ইতিবাচকভাবে শুরু করতে চান। অতীতের ভুল ত্রুটি শুধরে নিয়ে নতুনকে সুশোভিত করতে চান শান্তি ও সুন্দরের সাজে। কিন্তু তার বদলে যদি বছরের শুরুটাই হয় খুন আর ধ্বংসের বার্তা দিয়ে তাহলে বাকি দিনগুলো কেমন যেতে পারে?
না, নিছক কল্পনা নয়, এটাই সত্য হয়েছে এ বছর। যুদ্ধ, রক্তপাতে পরিপূর্ণ ২০১৭ সালের পর ২০১৮ সালটিও শুরু হলো যুদ্ধের হুংকার দিয়ে। প্রথমে হুংকার দিলেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন, তারপর দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর কেমন সেই রণহুংকার? এ যেন বিশ্বের শক্তিশালী দুইটি দেশের রাষ্ট্রনায়কের বাণী নয়, যেন কলহোদ্যত দুইটি অবুঝ শিশুর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়!
২০১৭ সালে একের পর এক ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা এবং যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আলোচনায় থাকা উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন নতুন বছরও শুরু করেছেন যুদ্ধের হুমকি দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে কিম বলেছেন, ‘পারমানবিক বোমার বোতাম সবসময় আমার টেবিলেই থাকে।’ নতুন বছর উদযাপন উপলক্ষে টেলিভিশনে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘সমস্ত যুক্তরাষ্ট্র নর্থ কোরিয়ার পারমানবিক অস্ত্রের আওতায়। এটি বাস্তবতা, কোন হুমকি নয় বলেও যোগ করেন তিনি।’ এর জবাব দিয়েছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিও দম্ভ করে বলেছেন তার পরমাণু বোমার সুইচ উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের বোমার সুইচের চেয়ে ‘অনেক বড়’ এবং ‘বেশি শক্তিশালী’’। বলার অপেক্ষা রাখে না- যে কোন অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্টের হাতের কাছেই পরমাণু বোমার সুইচের কোড থাকে এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারও আমেরিকারই।
প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন বছরের শুরুতে যখন বিশ্বের সুস্থচিন্তার মানবতাপ্রেমী মানুষরা শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছেন ঠিক সেই সময় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং কথায় কথায় পরমাণু অস্ত্রের হুমকি বিশ্বকে কী বার্তা দিচ্ছে? সব হুমকিই কি শেষ পর্যন্ত হুমকিতে সীমাবদ্ধ থাকবে, সব হুংকারই কি শেষ পর্যন্ত হুংকারেই সীমাবদ্ধ থাকবে? একটি হুংকারও যদি বাস্তবে রূপ নেয়, কোনো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট যদি হঠকারিতাবশত পরমাণু অস্ত্রের ‘বোতামে’ চাপ দিয়েই ফেলেন- তাতে কী পরিণতি হতে পারে?
কী হতে পারে তার বিশ্লেষণ বহু বছর ধরেই চলে আসছে। বিশেষজ্ঞরা অনেক ধরনের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে চলেছেন। তবে একটি ব্যাপারে কারো মধ্যে দ্বিমত নেই যে, তা এক মহাধ্বংসের সূচনা করবে, যে ধ্বংসের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। পৃথিবীর ছোটবড়, শক্তিশালী-দুর্বল সব ধরনের রাষ্ট্রই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই বিপর্যয়ে জড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরামাণু অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই বোমার তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই, আর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি আজ পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা যায় নি। এখনও পৃথিবীর বুকে সেই বোমা দুইটির ক্ষত লেগে আছে। এরপর আর কোনো পরামাণু যুদ্ধ শুরু হয় নি। না হবার কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় ব্লকে পৃথিবীর ভাগ হয়ে যাওয়া এবং দুই শক্তির হাতেই পরমাণু অস্ত্রের মজুদ থাকা। শত্রুকে মারলে আমিও মরব- এই ভয়ই কেবল পরমাণু যুদ্ধ থেকে বিশ্বকে এখন পর্যন্ত হেফাজত করে এসেছে, বর্তমানেও তাই। এখনও পৃথিবী মোটামুটি দুইটি শিবিরেই বিভক্ত। পার্থক্য হচ্ছে- সরাসরি ওই দুই শিবিরের অন্তর্ভুক্ত না হয়েও অনেক রাষ্ট্র পরামাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং এই রাষ্ট্রগুলোও আজ হোক কাল হোক শত্রুকে বাগে পেলে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার ঘটাতে এতটুকু দ্বিধা করবে না। কত কোটি মানুষ মরল, কত কোটি গাছ-পালা, স্থাপনা ধ্বংস হলো তা দেখবে না। শত্রুকে ধ্বংস করতে হবে এটাই শেষ কথা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কিম জং উনকে ডাকেন ‘লিটল রকেট ম্যান’ নামে, আর মি: কিমের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছে ‘ভীমরতিগ্রস্ত এক বৃদ্ধ’। মানবজাতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে- এই লিটল রকেট ম্যান ও ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধদের হাতেই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ! এরাই ঠিক করে দিচ্ছে আগামী বছর মানবজাতি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে, নাকি পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে!
নিছক ‘ভয়’ এর উপর নির্ভর করে আজ যে আত্মাহীন, জড়বাদী সভ্যতাটি দাঁড়িয়ে আছে, যে সভ্যতার প্রাণভ্রমরা লুকিয়ে আছে পরমাণু বোমার সুইচের ভেতরে, সেটাকে কি সভ্যতা বলা যায়? এই বিবেকবর্জিত যন্ত্রসর্বস্বতার নাম যদি সভ্যতা হয় তাহলে অসভ্যতা কাকে বলে?

অভুক্ত শিশুর জন্য কেন আসমানী খাবার আসে না? (ফেসবুক পোস্ট)

‘ধর্মের আল্লাহ যদি কমলাপুর বস্তির অভুক্ত শিশুদের জন্য আসমান থেকে কয়েকটি পাওরুটি এনে দিতে পারতেন কতই না ভাল হত।’ গতকাল এমনই একটি মন্তব্য করেছেন @Shamin Bin Saleh। লোকটাকে যে জবাব দিয়েছিলাম সেটা এখানে তুলে দিলাম-
‘‘কয়েকটি পাওরুটি দিয়ে ঐ শিশুদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। বড়জোড় করুণা দেখানো যাবে, যেটা মানুষ প্রায়ই করে থাকে। তাতে ঐ শিশুদের আসলেই কোনো উপকার হয় কিনা তা আমরা সবাই জানি। অথচ করুণা পাওয়া নয়, মানুষের মত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটা ঐ শিশুদের জন্মগত অধিকার, যা আমরা মানুষরাই হরণ করে নিয়েছি। তাদের মুখের খাবার, তাদের বসবাসের ঘর, আমরাই কেড়ে নিয়েছি।
আল্লাহ চান ঐ অভুক্ত শিশুরা সমাজের আর দশজন স্বচ্ছল মানুষের মত সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। যদি কয়েকটি পাওরুটি পাঠিয়েই তাদের চোখের অশ্রু দূর করা যেত তবে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু না, পাওরুটি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না বলেই আল্লাহ পাঠিয়েছেন দ্বীন (জীবনব্যবস্থা)। সেই দ্বীন প্রয়োগ করলে অর্থনৈতিক অবিচার দূর হবে, শোষণ দূর হবে, কোথাও সম্পদের হাহাকার আর কোথাও অঢেল সম্পদের প্রাচুর্য তৈরি হবে না, ধনী-দরিদ্রের মর্যাদার ভেদাভেদ দূর হবে, কাউকে না খেয়ে থাকতে হবে না, মানুষ ভোগবাদী না হয়ে ত্যাগী হবে। প্রকৃত ইসলামের ইতিহাস দেখুন- মানুষ উটের পিঠে খাবার বোঝাই করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত কিন্তু গ্রহণ করার মত লোক পেত না।
সমস্ত দুনিয়ার মানুষের ক্রন্দন দূর করার জন্য আল্লাহ ‘দ্বীন’ পাঠালেন, আর আপনি ভিক্ষা করছেন কিনা ‘পাওরুটি’। এত প্রায়ান্ধ হলে চলে না। দৃষ্টি বড় করুন।’

যাদের অধিকার নেই পৃথিবীতে বসবাসের


Image may contain: 1 person

কথা হচ্ছিল ফয়সাল মাহমুদের (ছদ্মনাম) সাথে। তিনি ভারতের আসাম রাজ্যের একজন বাসিন্দা; শিক্ষিত, বয়সে তরুণ। তিনি বারবার আকুতি জানাচ্ছিলেন যেন আসামের ব্যাপারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নীরব না থাকে, জোরালো ভূমিকা পালন করে। পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন ভারতের আসামে কী ঘটছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গত বছর আসামে সরকার গঠন করেই অভিযোগ তোলে যে, অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় হিন্দুদের কর্মসংস্থান নষ্ট করে দিচ্ছে। কাজেই ‘অবৈধ’ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় একটি আদমশুমারি চালানো হয় এবং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। নাগরিক নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা রয়টার্সকে বলেন, “আসামে বসবাসরত ‘অবৈধ’ বাংলাদেশি’দের চিহ্নিত করতেই এনআরসি করা হয়েছে। এতে যাদের নাম থাকবে না, তাদের ফেরত পাঠানো হবে।” তবে বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দু আসামে গিয়েছেন তাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। বিষয়টি কেবল আসামে নয়, সারা বিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে।
ফয়সাল মাহমুদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম আসামের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘আমাদের বেদনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু এটুকু বলি, আমরা না হতে পারলাম বাঙালি, না আসামি, শুধু বাংলাদেশী অপবাদ! নরকে বসবাস করা আর এখানে বসবাস করা একই কথা!’ ফয়সালের এই অভিব্যক্তি শুনে বিবেকবান মানুষমাত্রই চিন্তিত হবেন। ফয়সাল ‘নরক’ বলছে অন্য কোনো দেশকে নয়, তার নিজের মাতৃভূমিকে। যে মাটিতে পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, যেখানে জন্ম নিয়েছেন, যেখানকার আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন, যে মাটিতে ফসল ফলিয়ে ক্ষুধা নিবরণ করেছেন, কতখানি অপমান বঞ্চনা নিগ্রহ আর আঘাত পেলে কারো কাছে সেই মাটিকে ‘নরক’ মনে হতে পারে?
সেই নরকযন্ত্রণার কথাই জানতে চাইলাম তার কাছে। ফয়সাল এক কথায় যা বললেন তা হচ্ছে-‘আমাদেরকে দমন করে রাখা হয়েছে।’ আমাদেরকে মানে বাংলাভাষীদেরকে, আরও সুস্পষ্ট করে বললে বাঙালি মুসলমানদেরকে। ইচ্ছে ছিল খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নিই ঠিক কী ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার মধ্যে রাখা হয়েছে তাদেরকে। পরে মনে হলো তার দরকার নেই। কারণ এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয় কোপানল ও জাতিগত বিদ্বেষ কোনো জনগোষ্ঠীর জীবনে কতবড় অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে তার উদাহরণ খুঁজতে তো বহুদূর যেতে হয় না, পার্শ্ববর্তী রোহিঙ্গাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে, ভিটেমাটি হারিয়ে, স্বজন হারিয়ে, কেবল নিজের প্রাণটুকু হাতে নিয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়েছে। কতখানি অসহায় হলে কেউ মাতৃভূমি ছাড়ার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না! কেউ পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কেউ নদীতে ডুবে মারা পড়েছে। কেউ বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়েই অনাহারে মারা পড়েছে। আর যারা শেষপর্যন্ত প্রাণটা বাঁচাতেই পেরেছে, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় হয়েছে বা হয় নি, তাদের জীবনযাপনকে কোনোভাবেই মানুষের জীবনযাপন বলা যায় না! পেছনে রেখে আসা মৃত্যুর সাথে এই জীবনের পার্থক্য খুব বেশি নয়, একটা মরে যাওয়া অন্যটা মরে বেঁচে থাকা- এইটুকুই।
ফয়সালদের সৌভাগ্য যে, তাদের নরকযন্ত্রণা ঐ পর্যন্ত পৌঁছে নি! তারা এখনও নিজেদের জন্মভূমিতে পথ চলতে পারছেন- অন্তত যতদিন তার সুযোগ থাকে। ‘যতদিন সুযোগ থাকে’ কথাটা এইকারণে বলতে হচ্ছে যে, ইতোমধ্যেই আসামের নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে এবং তা থেকে অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না অচীরেই আসামের একটি বিরাট মুসলিম জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে যে, তাদের কোনো দেশ নেই, মাটি নেই, থাকার জায়গা নেই, যেন তারা মিয়ানমারেরও না, বাংলাদেশেরও না, কার্যত পৃথিবীতে বসবাসের অধিকারই নেই তাদের, তেমনটাই ঘটতে যাচ্ছে সম্ভবত আসামের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর জীবনে। কিছুদিন বাদে হয়ত জানা যাবে- এদেরও পৃথিবীতে বসবাসের অধিকার নেই, এরাও বাংলাদেশরও না, ভারতেরও না!
গত ৩১ ডিসেম্বর ভারতের আসামের নাগরিক তালিকার প্রথম খসড়া প্রকাশ করেছে রাজ্য সরকার। নাগরিকদের এ তালিকায় ১ কোটি ৩৯ লাখ বাসিন্দার নাম বাদ পড়েছে। যদিও বলা হচ্ছে আরও অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করে পরবর্তী খসড়া প্রকাশ করা হবে তারপরও খুব বেশি আশ্বস্ত হবার কারণ নেই। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ববর্তী সময় থেকে ২০ লাখেরও বেশি মুসলিম ভারতের আসাম রাজ্যে গেছেন। নাগরিক স্বীকৃতি পেতে তাদের ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে সেখানে বসবাসের পারিবারিক প্রমাণপত্র দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলিমদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের পূর্বসূরীরা এসব প্রমাণ বা নথি সংরক্ষণ করার কথা বুঝতে পারেননি। নাগরিক প্রমাণের মতো যথেষ্ট কাগজপত্র নেই অনেকেরই। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই আসামি মুসলিমদের প্রচুর মিল আছে রোহিঙ্গাদের সাথে। আজ বাদে কাল যদি ভারত সরকার দাবি করে- এরা (কাগজহীন আসামি বাঙালিরা) আমাদের নয়, যথারীতি তখন বাংলাদেশও বলবে এরা আমাদের নয়। এক দেশ জোর করে নির্বাসনে পাঠাবে, অন্য দেশ জোর করে অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখবে। ভাবটা এমন যে, তোমরা পারলে অন্য কোনো গ্রহে চলে যাও, পৃথিবীতে তোমাদের বাস করার অধিকার নেই।
এই যে মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ফেলা- এটা কেবল ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নয়, সারা পৃথিবীতেই এক চিত্র। দেশ নাই, ভূখণ্ড নাই, থাকার জায়গা নাই এবং যাওয়ারও জায়গা নাই- এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় এবং সেই সংখ্যাটি দিনদিন বেড়েই চলেছে। কেউ আসামি মুসলিমদের মত নাগরিক অধিকার হারাবার পথে আছে, কেউ রোহিঙ্গাদের মত নাগরিক অধিকার হারিয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে, কেউ নাগরিক অধিকার থাকার পরও যুদ্ধ-সংঘাত ও দুর্ভিক্ষের কারণে স্বদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু কোথায় যাবে নিজেরাই জানে না। আবার কেউ নিজের দেশেই ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। যেমন লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের মানুষ। কেউ নেই তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। ইউরোপে ঢোকার আশায় প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ কেবল ভূমধ্যসাগরেই ডুবে মারা যাচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। যারা ঢুকতে পারছে তারাও যে মানুষের মত বাঁচতে পারছে তা নয়। পুরুষকে পর্যন্ত দেহব্যবসায় জড়াতে হচ্ছে! পৃথিবীতে এই অসহায় দিশেহারা মানুষের সংখ্যা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি!
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার ২০১৭ সালে দেওয়া তথ্যমতে, ‘বিশ্বজুড়ে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা রেকর্ড ৬ কোটি ৫৬ লাখ। তাদের বাৎসরিক প্রতিবেদনে ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ উদ্বাস্তু মানুষের এ পরিসংখ্যান দিয়েছে, যা ২০১৫ সালের চেয়ে ৩ লাখ বেশি। ২০১৬ সালে দক্ষিণ সুদান থেকে প্রতিবেশী উগান্ডায় পালিয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। সিরিয়া থেকে পালানো মানুষের সংখ্যা এবছর ছিল ২ লাখ।’ তবে এই পরিসংখ্যানে ২০১৭ সালের তথ্য না থাকায় সবচাইতে বড় শরণার্থী সমস্যাটাই এটাতে স্থান পায় নি। গত বছরের শেষ দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছাড়তে বাধ্য হয়, যাদেরকে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। এই তাণ্ডবে হাজার হাজার মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে, শত শত শিশুর প্রাণহীন দেহ নাফ নদীতে ভেসে গেছে, শ্লীলতাহানি হয় নি এমন রোহিঙ্গা নারী খুব বেশি নেই। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদী ইজরাইল আস্ত একটা দেশকেই গায়েব করে দিচ্ছে শক্তির জোরে। তাদের অত্যাচারে ফিলিস্তিনিরা নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে আছে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। তাদেরও পেছনে মৃত্যু আর সামনে সীমানাপ্রাচীর! পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দুর্যোগ এসেছে, বহু যুদ্ধ-রক্তপাত হয়েছে, শোষণ-বঞ্চনাও কম হয় নি, কিন্তু এ যেন সমস্ত অন্যায়-অবিচারকে হার মানায়। এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি বলেছেন, “শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব অপারগ হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।”
এই সেদিনও পৃথিবীতে শরণার্থী সঙ্কট এরকম ভয়াবহ ছিল না। মানুষ যেখানে ইচ্ছা যেতে পারত, যেখানে ইচ্ছা বসবাস করতে পারত। কোনো দুর্যোগে বা যুদ্ধ-রক্তপাতে ঘর-বাড়ী হারালে অন্যত্র গিয়ে পুনর্বাসিত হতে পারত। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়, টাকা-পয়সা, গায়ের রঙ, ভাষা ইত্যাদির প্রভাব থাকলেও তা বর্তমানের মত ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে নি। কিন্তু পশ্চিমা ধর্মহীন বস্তুবাদী সভ্যতা ঐ ধর্ম, ভাষা, গায়ের রঙ ইত্যাদি ভেদাভেদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে।
মানুষমাত্রই বিশ্ব নাগরিক, সারা বিশ্বের উপর তার অধিকার আছে- এই অধিকারটা কেড়ে নেওয়া হলো এবং বিভিন্ন সংকীর্ণ পরিচয়ের ভিত্তিতে পৃথিবীর বুকে দাগ দিয়ে সীমান্তরেখা অঙ্কিত করা হলো। এই বিষবৃক্ষেরই বিষফল ভোগ করছে বিশ্বের কোটি কোটি নিপীড়িত উদ্বাস্তু মানুষ। যাদের জন্মগত অধিকার ছিল পৃথিবীতে গৌরবের সাথে বসবাস করার, তারা আজ এতটাই অসহায় যে, ৫১ কোটি বর্গকিলোমিটার পৃথিবীতে তাদের থাকার জায়গা নেই, যাবার জায়গা নেই। পক্ষান্তরে অল্প জনসংখ্যার বহু রাষ্ট্র পৃথিবীর বিরাট এলাকা দখল করে সেটার প্রাকৃতিক সম্পদ রাজার হালে ভোগ করছে।
বর্তমানে তুলনামূলকভাবে অল্প জনসংখ্যার কিন্তু বিরাট ভূ-ভাগের অধিকারী এমন রাষ্ট্র আছে যেখানে যে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন হয় তার একটা বিরাট অংশ জাহাজে করে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিতে হয়। মাইলের পর মাইল কোনো মানুষ নজরে পড়ে না। প্রতি জনের ভাগে লক্ষ লক্ষ একর জমি পড়ে এবং তারপরও লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল অনাবাদি পড়ে থাকে চাষ করার মানুষের অভাবে। কিন্তু ঐ যে ছয় কোটি ঘরবাড়িহীন অসহায় মানুষের কথা বলা হলো, এদের কেউ একজন এইসব রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে চাইলে ঢুকতে দেওয়া দূরে থাক গুলি করে মেরেও ফেলা হতে পারে। এর চেয়ে বড় যুলুম, এর চেয়ে বড় অবিচার আর কী হতে পারে?

মাদকের সর্বনাশা ছোবল! সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা?


No automatic alt text available.

মাদকে বুঁদ হয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম, আর সেই সাথে ক্ষয়ে যাচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রাণশক্তি। মাদকের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন হচ্ছে, টিভি অনুষ্ঠান হচ্ছে, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, পুস্তিকা-হ্যান্ডবিল ইত্যাদি প্রচার করা হচ্ছে, ওয়াজ-নসিহতে ধর্মীয় উপদেশবাণী প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাদক কী কী ক্ষতি বয়ে আনে সেগুলো তরুণ প্রজন্মকে শেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন মাদকের সর্বনাশা বিস্তার রুদ্ধ হবার নয়। সমস্ত শুভ প্রচেষ্টাই ব্যর্থতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ হয়ে উঠছে মাদকের অভয়ারণ্য।
তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যেই মাদকের খপ্পরে পড়ে গেছে। বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা। একবার মাদকাসক্ত হলেই আর রক্ষা নেই। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে না শাস্তি দিয়ে ফেরানো যায়, না বুঝিয়ে ফেরানো যায়। মাদকের টাকা যোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই, রক্তপাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও অহরহ ঘটছে, যার কোনো সুরাহা খুঁজে পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক পরিষ্কার ভাষাতেই জানিয়ে দিয়েছেন মাদক নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তিনি দুইটি বিষয়কে সামনে এনেছেন। প্রথমটি হচ্ছে, মাদক একটি আসক্তি। জেল-জরিমানা করে আসক্তি দূর করা যায় না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মাদক আসছে প্রতিবেশী দেশ থেকে। প্রায় একশ’ কিলোমিটার সীমান্ত প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে। এছাড়াও মাছের নৌকায়, সবজির নৌকায় মাদক চলে আসে। এটা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

তবে আইজিপি’র এই বক্তব্যের বাইরেও কথা আছে। আছে বহু প্রশ্ন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে মাদকের এমন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে গ্রাম পর্যন্ত শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কেউ উৎপাদনের সাথে, কেউ কাঁচামাল কেনাবেচার সাথে, কেউ মাদক তৈরিতে, কেউ বিপণনে, কেউ চোরা-চালানে, আর কেউ চোরাচালানে সহযোগিতায় জড়িত। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক হর্তাকর্তারাই এর মূল বেনিফিশিয়ারি হয়ে থাকে।
সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেশের মাদক গডফাদারদের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে। দেশজুড়ে যার সংখ্যা ১৪১ জন। এতে ক্ষমতাধর অনেক রাজনীতিকের ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে এসেছে। ৩১ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়। ঐ তালিকায় থাকা কয়েকজন মাদক গডফাদারের নাম প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে, যার মধ্যে একজন সংসদ সদস্যের নামও রয়েছে। তার ব্যাপারে বলা হয়, ঐ সংসদ সদস্যই হচ্ছেন দেশের ইয়াবা জগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী। তার ইশারার বাইরে কিছুই হয় না। দেশের ইয়াবা আগ্রাসন বন্ধের জন্য তার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’ তবে শুধু রাজনৈতিক নেতাই নয়, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীদেরও নাম রয়েছে ঐ মাদক গডফাদারদের নামের তালিকায়। এ ধরনের প্রভাবশালী ও বিত্তশালীদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে মাদকের বিস্তার রোধ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এ অঞ্চলে মাদকের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে- রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই মূলত মাদকের প্রসার ঘটেছে। আফিম চাষ ও আফিম ব্যবসা চালু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে আফিম উৎপাদন করে চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করত। সে সময় স্থানীয়ভাবে বিক্রির জন্যও আফিমের দোকান চালু করা হয়। কোম্পানির মাদক ব্যবসা থেকে শুরু হয় ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব আদায়। আফিম, মদ ও গাঁজা ছাড়াও আফিম ও কোকেন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রসার ঘটানো হয় নানান কৌশলে। এ ব্যাপারে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার বিস্তারিত একটি আইন প্রণয়ন করে। এসবই করা হয় মাদকের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে। বর্তমানে ইংরেজ নেই, কাজেই সরকারিভাবে মাদকের প্রসার ঘটানোর চক্রান্তও নেই, কিন্তু মাদকের সর্বনাশা স্রোত এখনও বন্ধ হয় নি। দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যে সবাই মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও লোকচক্ষুর আড়ালে মাদকের রমরমা প্রসার ঘটিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছে অনেকেই। 
তারাই আবার রাজনীতিতে জড়িত হয়ে ব্যাপক ক্ষমতার অধিপতি হয়ে উঠছে, কিংবা পয়সা ঢেলে ক্ষমতাবানদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে প্রশাসনের নাকের ডগাতেই মাদকব্যবসা ও চোরচালান চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মোকাবেলায় সাধারণ জনগণ দূরে থাক, প্রশাসনও অসহায়। পরিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যখন প্রশাসনের সদস্যরাও মাদকব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে যান!

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক কামনাশীষ সরকারকে গাঁজা ও ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করা হয় সদ্যবিদায়ী বছরের ২৫ নভেম্বর। এ সময় তার অফিস থেকে ৬৮ কেজি গাঁজা ও ২৪ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মো. নাজমুল কবিরকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদক। তার অফিসের ড্রয়ার থেকে ঘুষের দুই লাখ টাকা ছাড়াও আরও কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- বাংলা মদের এক কারবারির লাইসেন্স নবায়ন বাবদ ডিডি মো. নাজমুল কবির তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। পরে দুই লাখে রফা হয়। এছাড়া গত ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ দুইজন সেনা সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করা হলে দুইজনকে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে প্রশাসন ও সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময় মাদকের প্রসারে ভূমিকা রাখার অভিযোগ ওঠে! প্রশ্ন হচ্ছে, সর্ষের ভেতরের ভুত তাড়াবে কে?
সাধারণত বিশেষজ্ঞরা বলেন সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে, এটাই ফলপ্রসূ সমাধান। কিন্তু শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদকের যে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা দেখা যাচ্ছে, তার বিপরীতে কেবল উপদেশ প্রচার করে খুব একটা আশাবাদী হবার সুযোগ আছে কি? এই প্রশ্নটি রেখেছিলাম হেযবুত তওহীদ আন্দোলনের ইমাম জনাব হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম- এর কাছে। তাঁর মতে মাদকের মত সঙ্কটগুলো আসলে প্রচলিত জীবনব্যবস্থার আনুষঙ্গিক রেজাল্ট।
তিনি বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেন- ‘‘একটি জীবনব্যবস্থা তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে যখন তাতে মানুষের দেহ-আত্মা ও দুনিয়া-পরকালের ভারসাম্য বজায় থাকে। আমাদের যে জীবনব্যবস্থা আমরা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানি করে নিজেদের উপর চাপিয়ে রেখেছি এতে কেবল একটি দিক আছে- দেহের দিক, বস্তুর দিক। আত্মা ও পরকালের দিক এতে নেই। ফলে মানুষ অন্যায় করবে, মাদক খাবে, মাদকের ব্যবসা করবে, নয়ত মাদকের ব্যবসায় সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু ¯্রষ্টাহীন জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি, আল্লাহর ভয়ের প্রশ্ন আসে না, পরকালের জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে না, আইন দিয়েই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়, কাজেই আইনের চোখে ফাঁকি দিতে পারলেই বা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারলেই সে দুরাচারী হয়ে উঠবে। কাজেই আমি প্রথমেই বলব এই সমাজব্যবস্থা পাল্টাতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা কার্যকরী করতে হবে যেটাতে একদিকে মানুষের নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকবে, অন্যদিকে কঠোর আইনও থাকবে, দুর্নীতির বা অপরাধের সুযোগ থাকবে না। এই গোড়ায় হাত না দিয়ে আপনি যতই কোর’আন-হাদীসের উপদেশবাণী শোনান, কাজ হবে না। আল্লাহর রসুল যখন আরবে আবির্ভুত হলেন তখন সেখানকার অবস্থা আরও খারাপ ছিল। মানুষ মদ খেয়ে অচেতন হয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকত, মাদকের বেনিফিশিয়ারি ছিল তৎকালীন সমাজের হর্তাকর্তা ওতবা-শায়বারা। রসুল (সা.) কিন্তু তৎকালীন জনসাধারণকে ওয়াজ করে করে মাদকের কুফল শিক্ষা দেন নি। কারণ তিনি জানতেন এটা সমাধান নয়, যেহেতু এখানে বিরাট সিন্ডিকেট আছে। কাজেই রসুল একেবারে গোড়ায় হাত দিলেন। রাষ্ট্রব্যবস্থাটাকেই পাল্টে ফেললেন।
আমাদেরকেও বর্তমানের এই দুর্নীতিবাজ ও ধান্দাবাজ তৈরির রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে সত্যনিষ্ঠ মানুষ তৈরির রাষ্ট্রব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। তখন মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের ভারসাম্যপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা রাষ্ট্র থেকেই অর্জন করবে। জীবনের উদ্দেশ্য জানবে কাজেই জীবনকে অহেতুক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। আর যদি কেউ জাতিবিনাশী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে, একজনের শাস্তি দেখলে একশ’ জন সোজা হয়ে যাবে। আমার এই কথাগুলো আপনি ফেলে দিতে পারতেন, অলীক কল্পনা বলতে পারতেন যদি ইতিহাসে এর কোনো নজির না থাকত। তা তো নয়। যে ব্যবস্থা অতীতে মানুষকে ভয়াবহ সঙ্কট থেকে মুক্তি দিয়েছে, তা আজকেও মুক্তি দিতে পারে, যে ওষুধ অতীতে রোগ সারিয়েছে তা আজও সারাতে সক্ষম।’’

ইসলামবিদ্বেষ প্রসঙ্গে কিছু কথা


Image may contain: text

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একজনের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকদের সাথে ডিবেট করতে প্রস্তাব দিলেন। কী মনে করে দিলেন তিনিই ভালো জানেন। হয়ত তিনি মনে করেছেন আমাদের আদর্শিক লেখা ও বক্তব্যগুলো ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকরা খণ্ডন করতে পারবেন বা তাদেরটা আমরা খণ্ডন করতে পারব। যাহোক আমি তাকে বলেছিলাম হেযবুত তওহীদের সদস্যদেরকে ইসলামবিদ্বেষীদের সাথে বাহাস-বিতর্কে বসানোর কোনো ইচ্ছা থাকলে সে ইচ্ছা যেন তিনি এখনই ধুয়ে মুছে ফেলেন, ওটা কখনই হবার নয়। কেন হবার নয় তা ব্যাখ্যাসমেত তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং সেটাই বজ্রশক্তির পাঠকদের কাছে তুলে ধরব আজকে। আশা করি এই লেখাটি পড়ার পর পাঠকরা ইসলামবিদ্বেষীদের ব্যাপারে হেযবুত তওহীদের আদর্শিক অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন।
১. ইসলামবিদ্বেষীদের প্রধান বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ আছেন কি নেই? প্রথমত, আল্লাহ আছেন কি নেই এটা কেউ বিতর্ক করে বা যুক্তি দিয়ে সন্দেহতাতীতভাবে প্রমাণ করার সামর্থ্য রাখে না। আমরা যেমন বিশ্বাস করি যে, আল্লাহর অস্তিত্ব আছে, তিনি সমস্ত সৃষ্টিজগতের ইলাহ ও রব এবং এর পক্ষে বহু যুক্তি উত্থাপন করতে সক্ষম, একজন নাস্তিক তেমন বিশ্বাস করে আল্লাহর অস্তিত্ব নেই, সৃষ্টিজগত এমনি এমনিই অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়ে গেছে। দু’টোই কিন্তু বিশ্বাস। আস্তিকরা যেমন আল্লাহর আরশে গিয়ে আল্লাহকে দেখে আসে নি, নাস্তিকরাও তেমন ¯্রষ্টা তো দূরের কথা, সৃষ্টিরই একটি অতি সামান্য অংশের আংশিক জ্ঞান অর্জন করেই অনুমান করে নিচ্ছে আল্লাহ বলে কেউ নেই। যদি যুক্তিকেই একমাত্র কষ্টিপাথর হিসেবে ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে নাস্তিকতার স্বপক্ষের যুক্তির তুলনায় আস্তিকতার স্বপক্ষের যুক্তিই বহুগুণ শক্তিশালী। তবে যতই শক্তিশালী হোক, কেউ যদি বলেন আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখাতে পারলে প্রমাণিত হবে আল্লাহ আছেন, তাছাড়া নয়, তাহলে তাকে স্বচক্ষে দেখিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের সামর্থ্য আমাদের কারোই নেই এবং আল্লাহ সেটা চানও না। আল্লাহ যদি নিজেকে চাক্ষুস দেখিয়েই মানুষের ঈমান আনাতে চাইতেন তাহলে মানুষ নামের এই সৃষ্টিটি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হতে পারত না। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে তাঁকে না দেখেই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাঁর প্রতি ঈমান আনবে (আন’আম: ৩৫) কিন্তু তিনি তা করবেন না। কারণ মানুষকে আল্লাহ যুক্তি, বুদ্ধি, উপলব্ধির শক্তি দিয়েছেন এই কারণে যে, মানুষ এগুলো ব্যবহার করে আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করবে। যারা এই শক্তির ব্যবহার করবে না, অযৌক্তিক দাবি করে বলবে আল্লাহ থাকলে তিনি কেন আমাদের সামনে আসেন না, তারা আল্লাহর দেওয়া বিশেষ নেয়ামত যুক্তি বুদ্ধি উপলব্ধির শক্তিকে খাটাতে চান না। তারা ধোঁয়া দেখেন কিন্তু যেহেতু যুক্তির শক্তিকে ব্যবহার করতে পারেন না কাজেই এই সহজ বিষয়টি তাদের বুঝে আসে না যে, আগুন না থাকলে ধোঁয়া আসতে পারে না, স্রষ্টা না থাকলে সৃষ্টি হতে পারে না। এই যুক্তিজ্ঞানহীন ব্যক্তিদের সামনে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করানোর সাধ্য আর যাই হোক আমাদের নেই! এদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যদি তাদের কাছে ফেরেশতাদেরকে অবতরণ করতাম এবং তাদের সাথে মৃতরা কথাবার্তা বলত এবং আমি সব বস্তুকে তাদের সামনে জীবিত করে দিতাম, তথাপি তারা বিশ্বাস স্থাপনকারী হত না (আন’আম: ১১১)।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ থাকা বা না থাকার অর্থাৎ আস্তিকতা বা নাস্তিকতার বিষয়টি এমন নয় যে, এই বিষয়ে সবাই একমত না হলে হেযবুত তওহীদ যে উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। কখনই তা নয়। হেযবুত তওহীদ সম্বন্ধে যাদের মোটামুটি ধারণা আছে তারা জানেন আমরা বাস্তব সঙ্কট নিয়ে কথা বলি এবং তার সমাধান হিসেবে প্রকৃত ইসলামের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরি বাস্তবসম্মত কারণেই। আল্লাহ থাকলেও ইসলাম বাস্তবসম্মত জীবনব্যবস্থা, না থাকলেও বাস্তবসম্মত ও সফল জীবনব্যবস্থা এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো দেশের সবাই আল্লাহ ও রসুলে বিশ্বাসী না হয়েও যদি কোর’আনের পথনির্দেশনা ও মহানবীর আদর্শ মোতাবেক নিজেদের সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্তে নেয় তারা অন্তত পার্থিব দিক দিয়ে সফলকাম হবেই। আপনি ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং এই সাক্ষ্য দিন যে, সমাজের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করব না, ব্যস, সমাজ জীবনে আপনার কাছে ইসলাম এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না। এইটুকুর বিনিময়ে ইসলাম আপনাকে দেবে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তা। হেযবুত তওহীদ আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সবার কাছে এই দাবিটুকুই কেবল করে চলেছে। তবে হ্যা, পৃথিবীতে আল্লাহর অস্তিত্ব অবিশ্বাস করে ও আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে মৃত্যুবরণ করলে কেউ পুলসিরাতের বৈতরণী পার হতে পারবেন না। নাস্তিকরা তখন আল্লাহকে তাদের যুক্তি, বুদ্ধি, উপলব্ধির শক্তি ব্যবহার না করার কৈফিয়ত দিবেন, সেটা আল্লাহর সাথে তাদের বোঝাপড়া। তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলছে!
২. এবার আসুন দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। নাস্তিকদের কথা হচ্ছে ইসলাম মোহাম্মদ (সা.) এর নিজের তৈরি জীবনব্যবস্থা (নাউজুবিল্লাহ)। কারণ কেউ কোনোদিন জিবরাইল (আ.) কে দেখে নাই, মিরাজেও একমাত্র রসুল (সা.) গিয়েছিলেন, অন্য কেউ যায় নাই ইত্যাদি। এই অভিযোগ শুনে ইসলামের প-িতরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন এটা প্রমাণ করতে যে, ‘না- ইসলাম মোহাম্মদ (সা.) এর নিজের তৈরি হতেই পারে না! কেউ কেউ আবার কোর’আন থেকে উদ্ধৃতি দেন যেখানে আল্লাহ নিজেকে কোর’আনের রচয়িতা বলেছেন!’ এগুলোও অহেতুক নিষ্ফল বিতর্কমাত্র। আপনাকে বুঝতে হবে যুক্তিবোধহীন ইসলামবিদ্বেষীদের সামনে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ যেমন অসম্ভব, তেমনি ইসলাম যে মহানবীর নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত দ্বীন নয়, আল্লাহরই প্রেরিত দ্বীন সেটাও অনন্তকাল ধরে চেষ্টা করলেও ইসলামবিদ্বেষীরা যেমন প্রমাণ চায় তা কেউ দিতে পারবে না। আমাদের কথা হচ্ছে, একটা সিস্টেম ভালো কি মন্দ তা নির্ভর করে ঐ সিস্টেম প্রয়োগে সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার আসে কিনা তার উপর। যদি শান্তি এনে দিতে পারে তাহলে ঐ সিস্টেমের প্রণেতা আল্লাহ নাকি মানুষ তা নিয়ে বাহাস করা রীতিমত আহাম্মকী ছাড়া কিছু নয়। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। ইসলামের ফল হয়েছিল শান্তি এটা তো ইতিহাস। প্রকৃত ইসলাম যখন আরবে প্রতিষ্ঠিত হলো সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, কুপ্রথা, রক্তপাত ধুয়ে মুছে গেল। এমন সামাজিক নিরাপত্তা এলো মাসের পর মাস আদালতে কোনো অপরাধসংক্রান্ত মামলা আসত না। এমন অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এলো যাকাতের সম্পদ নিয়ে মানুষ পথে পথে ঘুরত কিন্তু গ্রহণ করার মত লোক পাওয়া যেত না। পরবর্তীতে ইসলামের অনেক অপব্যবহার হয়েছে যেটা বর্তমান কালেও অনেক আদর্শের ক্ষেত্রে হচ্ছে। এই অপব্যবহারটা বন্ধ করতে পারলে আজও ইসলাম দিয়েই সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। পক্ষান্তরে পশ্চিমাদের অনুকরণে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা থেকে ইসলামকে নির্বাসনে পাঠানোর পর ধর্মহীন যে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা আমরা কার্যকর করেছি তা শান্তির ‘শ’ দিতে পারে নি এবং পারবেও না কোনোদিন। সুতরাং ইসলাম আল্লাহর বানানো নাকি মানুষের বানানো সেটা নিয়ে নাস্তিকদের সাথে নিষ্ফল বিতর্কে যাবার মানে হয় না, শান্তি আনয়নে ইসলাম অনন্য এই সত্যটুকু মেনে নিলেই হয় এবং এই কথাটির দিকেই আমাদের আহ্বান, আস্তিকের প্রতিও, নাস্তিকের প্রতিও।
৩. ইসলামবিদ্বেষীরা বলেন রসুল রক্তপাত করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, এগুলো মেনে নেওয়া যায় না। এই নিয়ে অনেক বিতর্কও করেছেন ধর্মীয় নেতাদের সাথে। অথচ এটাও কোনো বিতর্কের বিষয়ই নয়। প্রথমত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার প্রত্যেক মানুষের আছে। শুধু অধিকার নয়, এটা মানুষের কর্তব্য, এটা পশুর সাথে তার পার্থক্যরচনাকারী। রসুল (সা.) যখন নিশ্চিত হলেন যে, তাঁর কাছে যে আদর্শটি আছে তা প্রয়োগ করলে পৃথিবীর সমস্ত অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত, শোষণ, বঞ্চনা বন্ধ হয়ে যাবে তখন তিনি সেটাকে প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছু করেছেন এবং তা অবশ্যই মানবজাতির স্বার্থেই। অন্যায়কারী, অত্যাচারী রাষ্ট্রশক্তির অধিকারীরা জনগণের ভালো-মন্দ ভেবে তাঁর বিনীত অনুরোধ মেনে নিয়ে ঐ আদর্শকে কার্যকরী করবে না, তারা তাদের কায়েমী স্বার্থকেই রক্ষা করবে তা তিনি ভালো করেই জানতেন, ওপথে তিনি বহু প্রচেষ্টাও করেছেন। কিন্তু শেষাবধি যুদ্ধ রসুলকে করতে হয়েছে এবং তিনি যুদ্ধ করেছেন বলেই অর্ধপৃথিবীর মানুষ ইসলামের মত সুমহান আদর্শের ছায়াতলে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছিল। দ্বিতীয়ত, কোনো আদর্শই শক্তি প্রয়োগ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা যায় নি, গনতন্ত্রও না, সমাজতন্ত্রও না, ইসলামবিদ্বেষীরা শুধু দেখতে পায় ইসলামকে। ইসলামের যুদ্ধনীতি দেখে তারা আঁতকে ওঠেন, কিন্তু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় ভায়োলেন্স তাদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। তালেবানরা আফগানিস্তানে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে সেটা তারা ভালোমতই দেখতে পান, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তানকে গণকবর বানিয়ে ফেলল সেটা তারা দেখতে পেলেন না। স্বভাবতই পুঁজিবাদী গণতন্ত্র তাদের কাছে হুমকি নয়, হুমকি কেবল কোর’আন আর হাদিস। এই প্রায়ান্ধদের সাথে কীসের বিতর্ক করবেন? এরা যুক্তির শক্তি ব্যবহার করে অমন ইসলামবিদ্বেষী হলে একটা কথা ছিল, উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে বোঝানো যেত। কিন্তু এদের যুক্তিবোধেই সমস্যা, বিতর্ক করবেন কীসের ভিত্তিতে? না, যারা ভাবছেন যুক্তি দিয়ে, বাহাস করে এদেরকে ইসলামের মাহাত্ম্য বোঝাবেন তারা ভুল ভাবছেন, তার চেয়ে আল্লাহর দেওয়া নির্ভুল জীবনব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠা করুন এবং তার মাধ্যমে এমন ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার আনয়ন করুন যেটা অন্য কোনো জীবনদর্শন ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে সেটাই হবে ইসলামবিদ্বেষীদের সমুচিত জবাব!
৪. ইসলামবিদ্বেষীরা আল্লাহ-রসুলের বিরুদ্ধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাক্যব্যয় করতে পারেন, বিতর্কের নামে প্রচলিত ইসলামকে আক্রমণ করতে পারেন, কিন্তু আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ কাকে তাদের ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করবে, প্রচলিত ইসলামের বিকল্প হিসেবে কোন আদর্শকে গ্রহণ করে নিবে সেই রূপরেখার ব্যাপারে এক মিনিটও সময় দিতে রাজি নন। কারণ তারা এই বিষয়ে কপর্দকশূন্য, ভা-ার খালি, তাই ওপথ মাড়ান না। কিন্তু হেযবুত তওহীদের মূল কাজ এটাই, মানুষের বাস্তব সঙ্কটের বাস্তব সমাধান তুলে ধরা। এই কাজটি যদি ইসলামবিদ্বেষীরা করতেন, যদি আমাদের প্রস্তাবিত আদর্শের বিপরীতে তারা অন্য কোনো আদর্শ প্রচার করতেন তাহলে এই দুই আদর্শের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার একটা সুযোগ থাকত। যেহেতু তা নয়, তাদের লক্ষ্য ও আমাদের লক্ষ্য, তাদের পথ ও আমাদের পথ সমান্তরাল নয়, কাজেই তাদের পুরো ব্যাপারটাই হেযবুত তওহীদের কাছে অবান্তর!
আমরা কী করছি? হাজার বছরের বিকৃতির জঞ্জাল সরিয়ে আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি যেটা কিনা একাধারে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক সঙ্কটের সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান এনে দিতে পারে। পক্ষান্তরে ইসলামবিদ্বেষীরা সমস্যার জটেই আটকে আছেন, সমাধান নিয়ে ভাবার আগ্রহ ও সামর্থ্য কোনোটিই তাদের নেই। ভোগবাদী স্বার্থপরতার যুগে মানুষ যখন আপন পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, তখন আমরা প্রকৃত ইসলামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেদের জীবন-স¤পদ উৎসর্গ করে যাচ্ছি। ইসলামবিদ্বেষীরা কয়জনকে জীবন-স¤পদ উৎসর্গ করা শেখাতে পেরেছেন? হিমালয় পর্বত অতিক্রম করা সহজ, কিন্তু মানুষকে নিঃস্বার্থ বানানো কঠিন। মানুষ মারা সহজ, জীবন দেওয়া কঠিন। সমালোচনা করা সহজ, সঠিক পথ দেখানো কঠিন। আমরা সেই কঠিন কাজটি কাঁধে তুলে নিয়েছি। 
৫. যুক্তির আদালতে কেবল ইসলামবিদ্বেষীরাই কাঠগড়ায় দাঁড়াবে কিন্তু যাদের অন্ধত্ব ও কূপম-ূকতা দেখে মানুষ নাস্তিকতার দিকে ধাবিত হলো সেই ধর্মব্যবসায়ীরা হিসাবের বাইরেই থেকে যাবে তা হবার নয়। ধর্মের নামে অযৌক্তিক ও হাস্যকর কর্মকা-, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানহীনতা, ধর্মব্যবসা, সন্ত্রাস ইত্যাদি দেখে চিন্তাশীল মানুষমাত্রই বিচলিত হন! ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে থাকেন। মনে করেন ধর্ম বুঝি এমনই। শেষাবধি তারা ধার্মিক থাকতে পারেন না ধর্মের নামে এসব অহেতুক অযৌক্তিক বানোয়াট কর্মকা- দেখে। সম্প্রতি আমাদের দেশেরই অন্তত একজন জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলার এবং একজন মুফতির ইসলাম ত্যাগ করে নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা করার খবর ইন্টারনেটে বহুল আলোচিত হয়েছে। ইসলাম ত্যাগের পর থেকে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে অবিশ্রান্তভাবে লেখালেখি ও বক্তৃতা করে যাচ্ছেন এবং মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন ইসলামের ব্যাপারে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জনের পরেও আমরা ইসলাম ত্যাগ করেছি কারণ ইসলামে নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু নাই, মানবতা নাই ইত্যাদি। তারা ধার্মিক বলে নিজেদের দাবি করলেও আদতে তারা প্রকৃত ধর্ম দেখেন নি, বোঝেনও নি। তারা সারাজীবন ইসলামের নামে যে ধর্মবিশ্বাসটি দেখে এসেছেন এবং নিজেরাও লালন করে এসেছেন সেটা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা লেবাসী ধর্ম, প্রতিষ্ঠাননির্ভর আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব একটা বিশ্বাসমাত্র। ধর্মের আত্মাটাই সেটাতে ছিল না। তাই ঐ ধর্মের জ্ঞানে মহাপ-িত হলেও বিবেকের কাছে তারা ছিলেন দেউলিয়া। বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত হয়েছেন এবং স্বভাবতই সেই প্রশ্নের জবাব তারা যেখানে বিকৃত ধর্ম শিখেছেন তারা দিতে পারে নি। সেখান থেকেই অংকুরিত হয়েছে সংশয়ের বীজ, কালক্রমে আজ যা মহীরুহ। হেযবুত তওহীদ সেই সংশয়ের পথটাই রুদ্ধ করে দিচ্ছে আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে, ধর্মব্যবসার গুমর ফাঁস করে দেওয়ার মাধ্যমে, জঙ্গিবাদের অসারতা প্রমাণের মাধ্যমে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে, যুক্তিবুদ্ধির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে; কী প্রয়োজন একজন একজন করে নাস্তিক খুঁজে বিতর্ক করতে থাকার?

এক কথায় আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আজ সামনে আমাদের উত্তাল সমুদ্র, আর পেছনে কুয়ো, পুকুর, খাল ইত্যাদি। ইসলামবিদ্বেষীরা পড়ে আছেন ঐ কুয়ো আর পুকুর নিয়ে। কুয়োর বাসিন্দারা কুয়োকেই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করছেন, পুকুরের বাসিন্দারা পুকুরকে! কেউই জীবনে সমুদ্র দেখেন নি, বোঝেনও নি। তাদেরকে সমুদ্র বোঝানোর বিতর্কে গিয়ে লাভ নেই। যদি কোনোদিন সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য তাদের হয় তাহলে নিজেরাই দেখবেন সমুদ্রের উন্মত্ততা, গভীরতা ও বিশালতাকে এবং এক বাক্যে মেনে নিবেন এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাহাসও লাগবে না, বিতর্কও লাগবে না।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।

আবারও কি সহিংস হয়ে উঠবে রাজপথ?


No automatic alt text available.

২০১৮ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বছরটি সহিংসতার বছর হয়ে ওঠে কিনা সেটাই বিরাট প্রশ্ন। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোই আবারও সামনে আসতে শুরু করেছে। এ নিয়ে সুধী মহল ও রাজনৈতিক শিবির ক্রমশই সরগরম হয়ে উঠছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, কিভাবে এবং কাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে, নির্বাচনের সময় সংসদ থাকবে না-কি ভেঙ্গে দেয়া হবে, এবং নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কি-না, হলে কিভাবে হবে- এ বিতর্ক যতই দিন যাচ্ছে ঘনীভূত হচ্ছে, আর সেই সাথে আশঙ্কার পারদও চড়ছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি। বিএনপিসহ বড় কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংস আন্দোলন শুরু করে। ওই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে চার বছর পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র অবস্থান আগের জায়গাতেই আছে। আওয়ামী লীগের চাওয়া হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক, আর বিএনপির চাওয়া দলনিরপেক্ষ একটি সরকার। বোঝাই যাচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সরগরম থাকবে ২০১৮ সাল। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি বিএনপির দাবি উপেক্ষা করেই সরকার আবারও নির্বাচন করে ফেলতে চায় তাহলে বিএনপি’ আবারও সহিংসতার পথে হাঁটবে কিনা?
বিএনপি বলছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি মানা না হলে আবারো আন্দোলনের পথেই হাঁটবেন তারা। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকালীন নতুন কোন নিরপেক্ষ সরকারের ধারণা আবারও উড়িয়ে দিয়েছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কয়েকদিন আগেই বলেছেন, ‘আমাদের দাবি পরিষ্কার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না, পার্লামেন্ট বহাল রেখে নির্বাচন হতে পারে না। একটি সংসদ থাকবে, সংসদ সদস্যরা সরকারি প্রটোকল নিয়ে নির্বাচন করবে। আর একজন সাধারণ মানুষ তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, মন্ত্রীরা মন্ত্রী থাকবে, এটা কখনো সমতল ভ‚মি হতে পারে না।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। তার আগের ৯০ দিনের মধ্যেই যে নির্বাচন হবে, বর্তমান সরকার সেই নির্বাচনকালীন সময়ে ক্ষমতায় থাকবে। তারা দৈনন্দিন কাজ করবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে, যেরকম অন্যান্য দেশেও হয়। এখানে যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে আমাদের তো কিছু করার নেই। নির্বাচন হবেই এবং সেই নির্বাচন হবে সংবিধানের ভিত্তিতে। এর বাইরে ক্ষমতাসীন দল বা আমাদের জোট যাবে না।’
বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকারের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রথম ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে সময়কার ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অধীনে, যার তিনটিই ছিল সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার। তবে ১৯৯১ সালের নির্বাচনটি করে সব দলের ঐকমত্যে গঠিত একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৯৯৬ সাল থেকে পরপর ৩টি নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। ২০১১ সালে সংবিধানে সংশোধনী এনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানে ফিরে যায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে অস্বীকৃতি জানায় বিএনপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে লাগাতার হরতাল-অবরোধসহ আন্দোলনের নানা কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। দাবি পূরণ না হলে এবারো দলটির নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আন্দোলনের কথাই বলছেন। তবে এবার তত্ত্বাবধায়কের বদলে ‘সহায়ক সরকার’ এর কথা বলছেন দলটির নেতারা। কিন্তু এ নিয়ে সু¯পষ্ট কোনো রূপরেখা এখনো ঘোষণা করেনি বিএনপি।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা একটি নাম বলেছি যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি সহায়ক সরকার। যে নামেই হোক না কেন, মূল কথাটা হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার। এই সরকারের রূপরেখা আমরা দেব, আমাদের নেত্রী উপযুক্ত সময়ে এই রূপরেখা দেবেন। সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা এই রূপরেখা নিয়ে জনগণের কাছে যাবো এবং এই জনগণকে নিয়েই আমরা আগামী নির্বাচনের সময় পর্যন্ত থাকতে চাই। যদি সরকার ২০১৪ সালের পথে হাঁটে তাহলে জনগণ রাস্তায় নেমে তাদের ভোটের অধিকার আদায় করে নিবে।’
বিএনপি জনগণের অধিকার আদায়ের কথা বললেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলনে দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষরাই। এবারো পরিস্থিতি সেদিকে গড়াবে কি-না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। সুধী মহল থেকে যে আলোচনার কথা উঠছে সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন কোনো আলোচনায় বসতে আওয়ামী লীগ আগ্রহী নয়, সংবিধানে যা আছে তার ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে দুই দল আবারও মুখোমুখী দাঁড়িয়ে পড়ছে বলেই মনে হচ্ছে, যেন হাতছানি দিচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন আরেক অধ্যায়!
নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সহিংসতা যেন দেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৫১৯, আর একই সময়ে কম-বেশি আহত হয়েছেন দেড় লাখ মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, নির্বাচনী সহিংসতা এবং দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যমের জরিপ অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারের শাসনামলে সহিংসতা ঘটেছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ১৭৪ জন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৭৬৭ জনের। পরবর্তী ২০০১ থেকে ২০০৬ সালÑ এ ৫ বছরে বিএনপির সরকারের শাসনামলে নির্বাচনী হত্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭২ জনে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে মারা গেছে ৫৬৪ জন মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে জনসাধারণ।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের’ হিসাবে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। অধিকার বলছে, শুধু ২০০১ সাল থেকে ২০১৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৯২৬ এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৫৮ হাজার ২১১ জন। এর মধ্যে ২০০১ সালেই মারা গেছেন ৬৫৬ জন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ১৯৮ আর ২০১৬ সালে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। মানবাধিকার সংগঠন ‘আসক’ এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৬৪টি রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, যাতে নিহত হয়েছেন ১৪৭, আর আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৩৭৩ জন। এদিকে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক বিবৃতিতে জানায়, ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সহিংসতায় ১৪৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৮৮৬ জন আহত হন।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ১৯ জন। নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এ নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও ইউপি নির্বাচনেও সহিংসতা পিছিয়ে নেই। অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনী সহিংসতা। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর তথ্য মতে, ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপেই নিহত হয় ১০০ এর বেশি মানুষ। 
সুজনের দাবি, এর আগে ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সবচেয়ে বেশি সহিংসতাপূর্ণ ও প্রাণঘাতী ছিল। ওই নির্বাচনে ৮০ জনের প্রাণহানি হয়।

তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার সবচেয়ে নির্মম অধ্যায়টি রচিত হয় ২০১৫ সালে, পেট্রল বোমাবাজীর মাধ্যমে। নিরাপরাধ জনগণকে বাসের মধ্যে পেট্রল বোমা মেরে ঝলসে দেওয়ার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে কিনা সেটাই সুস্থচিন্তার মানুষের সামনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে!

ধর্মবিশ্বাসে জোর জবরদস্তি চলে না


No automatic alt text available.

ইসলামের বিরুদ্ধে বহুল উত্থাপিত একটি অভিযোগ হচ্ছে- ‘ইসলাম বিকশিত হয়েছে তলোয়ারের জোরে’। পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া, লেখক, সাহিত্যিক এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত গোষ্ঠী এই অভিযোগটিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তাদের প্রচারণায় অনেকে বিভ্রান্তও হচ্ছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রতি অনেকের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি ইসলাম প্রচারে জোর-জবরদস্তির কোনো স্থান আছে? রসুলাল্লাহ ও তাঁর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী জাতির ইতিহাস কী বলে?
ইসলাম প্রতিষ্ঠার নীতিমালা আল কোর’আন থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। এই দীনে কোনো জোর জবরদস্তির স্থান আল্লাহ রাখেন নি। তিনি বলেছেন- দীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, কারণ সত্য থেকে মিথ্যা পৃথক হয়ে গেছে (সুরা বাকারা, ২৫৬)। অন্যত্র তিনি বলছেন-আল্লাহ কখনও কাউকেই তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না (সুরা বাকারা, ২৮৬)। কোর’আনে রসুলাল্লাহর যে দায়িত্ব আল্লাহ সুনির্দিষ্ট করে দিলেন সেখানেও জোর জবরদস্তির কোনো স্থান রাখলেন না। কোর’আনে আল্লাহ রসুলকে বলছেন, তুমি তোমার মালিকের পথে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ সহকারে উৎকৃষ্ট পন্থায় আহ্বান করো। (সুরা নাহল, ১২৫) তোমার কাজ হচ্ছে শুধু ঠিক ঠিক মতো পৌঁছে দেওয়া। (সুরা আন নুর, ৫৪; সুরা ইয়াসীন, ১৭)। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে- আল্লাহ কারও ধর্মবিশ্বাসের ওপর জোর-জবরদস্তি চালিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করছেন না। আল্লাহর নীতি হলো বুঝিয়ে, যুক্তি দিয়ে, বলে-লিখে, বক্তৃতা করে ইত্যাদি যত শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্ভব মানুষের সামনে সত্যকে উপস্থাপন করা, হক্বের পথে আহ্বান করা, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিবে মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর হুকুম অমান্য করার শামিল। ধর্মবিশ্বাস নিয়ে, সত্য গ্রহণ বা বর্জন করা নিয়ে, আল্লাহর প্রতি, রসুলের প্রতি, কেতাবের প্রতি ঈমান আনা নিয়ে কোনো জবরদস্তি চলে না। সত্যকে দেখে যারা গ্রহণ করে নেবে তারা আলোকিত হবে, আর যারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তারা অন্ধকারেই রয়ে যাবে। সত্যের বার্তাবাহকদের এ ক্ষেত্রে একটি মাত্রই কাজ, সত্য উপস্থাপন করা। এমনভাবে উপস্থাপন করা যার বিরোধিতা করার মতো বা ত্রুটি বের করার মতো কোনো সুযোগ না থাকে। যার সংস্পর্শে আসলেই মানুষ সত্যকে চিনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু আজ ইসলামের নাম করে নিজেদের মনগড়া মতামতকে অন্যের বিশ্বাস ও মতের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটা ইসলাম নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রক্রিয়াও নয়।
জবরদস্তি বিভিন্ন প্রকারের আছে। শুধু ইসলাম নয়, যারা আজ ইসলামের সমালোচনা করেন, সেই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ইতিহাসও জোর-জবরদস্তিমূলক ইতিহাস। দেশে দেশে গণতন্ত্রকে গেলানোর জন্য কত কিছুই না করা হচ্ছে। পৃথিবীতে সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের বসবাস। এই সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের রুচি-অভিরুচি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, মননশীলতা, স্বভাব, পছন্দ-অপছন্দ এক নয়। একেক দেশের মানুষের চরিত্র একেক ধরনের। যে গণতন্ত্র ইউরোপের মানুষকে কিছুটা সাফল্যের ভাগী করতে পেরেছে সেই গণতন্ত্র এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষকে সাফল্য নাও দিতে পারে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে যে সিস্টেম ফলপ্রসূ সেটা আমেরিকার জনজীবনে হয়তো খাপ খাওয়ানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। বড় কথা হচ্ছে- এসব সিস্টেম মানবসৃষ্ট হওয়ায় এবং মানুষের শক্তি-ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় মানুষের তৈরি এসব সিস্টেম পৃথিবীর কোনো এক ক্ষুদ্র অংশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও সারা পৃথিবীতে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, যেমন আজ হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতা ও তার তল্পিবাহক মিডিয়া এই প্রাকৃতিক সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা যে কোনো উপায়ে সারা পৃথিবীতে কথিত গণতন্ত্র কায়েম করার প্রচেষ্টায় মত্ত। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন জাতির বিশ্বাসপ্রসূত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, শক্তি প্রয়োগ করছে। যারা তাদের মতবাদ মানতে চায় না তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, আর তাতেও ফল না হলে সামরিক হামলা করে দেশ দখল করছে, ঘর-বাড়ি, স্থাপনা ধ্বংস করছে। এখানে মানবতার কোনো বালাই নেই, জনগণের মতামতের কোনো জায়গা নেই। বৈধ-অবৈধ’র কোনো মানদণ্ড নেই। যার যে বিশ্বাসই থাকুক, যে জাতি যে মতবাদই পছন্দ করুক পশ্চিমা সভ্যতার কাছে তার কোনো দাম নেই। পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সবাইকে মানতে হবে, সব জাতিতে কার্যকর করতে হবে এটাই যেন শেষ কথা। প্রশ্ন হচ্ছে- যারা দু’বেলা ‘তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রচার হয়েছে’ বুলি আউড়িয়ে সত্যের উপর মিথ্যার প্রলেপ লাগাচ্ছে তারাই আবার কোন যুক্তিতে একটি নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বাধীন দেশের মাটিতে বোমা ফেলছে?
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আল্লাহর রসুল মক্কা জীবনে বহু জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু প্রতিপক্ষকে কোনো আঘাত করেন নি। দৃষ্টান্তহীন নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি তাঁর অনুসারীদের বলতেন- আসবের আসবের, সবর কর। তিনি কারও উপর ক্রুদ্ধ হন নি, অভিশাপ দেন নি, বরং ওই নির্যাতনকারী মানুষগুলোর পক্ষ নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন। তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করেছেন। এরপর যখন তারা ঈমান আনলো, সত্যকে আলিঙ্গন করল তখন ওই মানুষগুলোই রসুলাল্লাহকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে শুরু করল। উমর (রা.) রসুলকে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে হত্যা করতে ছুটে গেলেন, কিন্তু অচীরেই রসুলের চরণতলে নিজেকে নিবেদন করলেন- এই পরিবর্তন কি তলোয়ারের শক্তিতে হয়েছিল?
ইতিহাস মতে রসুলাল্লাহ ও তাঁর জাতি যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছিল এবং রক্তপাত ঘটিয়েছিল সেটা কারও ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিল না। আসলে ওই যুদ্ধ-বিগ্রহগুলো হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। এই জাতির ইতিহাস পড়লে খুব সহজেই বোঝা যায় যে, রসুলের হাতে গড়া ওই উম্মতে মোহাম্মদী জাতি কোনোদিন কোনোজাতির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে নি। মুসলিম শাসনের অধীনে থেকে অন্যান্য ধর্মের মানুষ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করে গেছে। এমনকি তাদের কেউ কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তি কোন ধর্মের বিধান থেকে দেওয়া হবে সেটাও বেছে নিয়েছে ওই অপরাধীই, উম্মতে মোহাম্মদী তা কার্যকর করেছে মাত্র। শুধু তাই নয়, ওই জাতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও কতটা সচেতন ছিল তা বোঝা যায় ওমর (রা.) এর একটি ঘটনা থেকে। ওমর (রা.) তখন আমিরুল মু’মিনিন, জাতির ইমাম বা নেতা। পবিত্র জেরুজালেম শহর মুজাহিদ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ঘুরে ঘুরে শহরের দর্শনীয় বস্তুগুলি দেখার সময় যখন খ্রিস্টানদের একটি অতি প্রসিদ্ধ গীর্জা দেখছিলেন তখন নামাযের সময় হওয়ায় তিনি গীর্জার বাইরে যেতে চাইলেন। জেরুজালেম তখন সবেমাত্র মুসলিমদের অধিকারে এসেছে, তখনও কোন মসজিদ তৈরিই হয় নি, কাজেই নামায খোলা ময়দানেই পড়তে হতো। জেরুজালেমের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ বিশপ সোফ্রোনিয়াস ওমরকে (রা.) অনুরোধ করলেন ঐ গীর্জার মধ্যেই তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামায পড়তে। ভদ্রভাবে ঐ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ওমর (রা.) গীর্জার বাইরে যেয়ে নামায পড়লেন। কারণ কি বললেন তা লক্ষ্য করুন। বললেন- আমি যদি ঐ গীর্জার মধ্যে নামায পড়তাম তবে ভবিষ্যতে মুসলিমরা সম্ভবতঃ একে মসজিদে পরিণত করে ফেলত।
আজকে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতা ধরে আছেন, প্রচলিত পুঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকেই উৎকৃষ্ট পন্থা বিবেচনা করেন, ইসলামকে মনে করেন প্রগতিবিরোধী, বাকস্বাধীনতা-বিরোধী, তাদের প্রতি প্রশ্ন- প্রকৃত ইসলাম মানুষকে যে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিল, নিরাপত্তা দিয়েছিল আজকের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কি তার এক ভগ্নাংশও দিতে পেরেছে? এটা ঠিক যে, কূপমণ্ডূক সংকীর্ণমনা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে ইসলামের প্রকৃত রূপ আজ হারিয়ে গেছে। তাদের অতি বিশ্লেষণ, বাড়াবাড়ী আর সত্যকে অস্বীকার করার কারণে ইসলাম আজ আর আল্লাহ রসুলের সেই ইসলাম নেই। কিন্তু প্রকৃত ইসলামের বিপরীতমুখী এই বিকৃত ইসলাম দেখে ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করা নিশ্চয়ই বোকামি। আল্লাহর অসীম করুণা যে, প্রকৃত ইসলামের জ্ঞান তিনি হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। সেই প্রকৃত ইসলামের অনাবিল রূপটি আমরা সর্বস্তরের মানুষের সামনে উপস্থাপন করছি।

প্রকৃত জ্ঞানী কে?

প্রকৃত জ্ঞানীদের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যেমন- তিনি জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে কোনো সীমানা খোঁজেন না, আকাশ-পাতালের, দৃশ্য-অদৃশ্যের সকল বস্তু, প্রাণী বা সত্ত্বা সম্পর্কে তার কৌতুহল থাকে। কাউকে অবহেলা করা, নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা বা অহংবোধ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। বিশেষত, কখনই নিজেকে ‘জ্ঞানী’ বলে পরিচয় প্রদান করেন না।
ঘরের চার দেওয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থেকে এই বিশাল-বিস্তৃত ব্রহ্মাণ্ডের আদ্যপান্ত রূপ-মাধুর্য অবলোকন করা যেমন অসম্ভব, তেমনই মনের কুঠোরে কোনোরূপ সংকীর্ণতা, অন্ধত্ব বা সীমাবদ্ধতাকে প্রশ্রয় দিয়ে জ্ঞানের উচ্চশিখরে আরোহন করাও অসম্ভব। জ্ঞানীরা তাই সকল প্রকার ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে থাকতে চান। তারা ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানবসম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। আর সে কারণেই তারা বিবেচিত হন সমস্ত বিশ্বের, সমস্ত মানবজাতির সম্পদ হিসেবে। জ্ঞানীর কলমের কালিকে শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র বলা হয় এজন্যই।
জ্ঞান দুই প্রকার। একটি হলো স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞান, যা ঐশ্বরিক; অপরটি-মানুষের অর্জিত জ্ঞান, তথা পার্থিব। এই দুই জ্ঞানের মিলন ঘটে যে সত্ত্বায় তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত জ্ঞানী। তার দ্বারা মানবতার কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু সম্ভব নয়। আর যার মধ্যে এই ভারসাম্য থাকে না, অর্থাৎ যে ব্যক্তি শুধুমাত্র স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞানকেই একমাত্র জ্ঞান মনে করেন, এর বাইরের কিছুকে মূল্যায়ন করেন না তিনি প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানী নন। তার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ, সংকীর্ণ, ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ। অন্যদিকে যিনি স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞানকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র মানুষের গবেষণালব্ধ বা অর্জিত জ্ঞানকেই একমাত্র জ্ঞান মনে করেন তিনিও ভারসাম্যহীন, প্রকৃত জ্ঞানী নন।
উড়ন্ত পাখির ডানাযুগল হতে একটি ডানা বিকল হয়ে গেলে কার্যক্ষেত্রে বাকি ডানার কোনো মূল্য থাকে না, ওটা পাখির পতন ঠেকাতে পারে না। আজকের পৃথিবীর কথিত জ্ঞানীদের অবস্থাও তাই। একদিকে দুনিয়াবিমুখ মাসলা-মাসায়েলসর্বস্ব জ্ঞান অন্যদিকে স্রষ্টাহীন আত্মাহীন একপেশে বস্তুসর্বস্ব জ্ঞান মানবজাতির পতন ঠেকাতে পারছে না।
একটি শ্রেণি বেদ, কোর’আন, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক ইত্যাদি নিয়ে নিরন্তর অধ্যাপনা করে চলেছে, চূলচেরা বিশ্লেষণ করছে, গ্রন্থগুলোর প্রতিটি আয়াত, ভার্স বা শ্লোক নিয়ে গবেষণা করছে, বইয়ের পর বই রচনা করছে, নতুন নতুন তাফসির, টিকা-ভাষ্য রচনা করছে; কিন্তু পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এরা যা-ই করেন, যা-ই দেখেন সবই ঐ ধর্মগ্রন্থের আলোকে। এমনকি এর বাইরের জ্ঞানকে কেউ কেউ শয়তানের জ্ঞান বলেও অভিহিত করেন। এদের ধারণা অনেকটা এমন যে, ‘আমি যা জানি সেটাই যথেষ্ট। এর বাইরে অন্য কিছুর দরকার নেই। এটুকু জানলেই স্রষ্টা আমার প্রতি খুশি থাকবেন, জান্নাত-স্বর্গ বা হ্যাভেনে প্রবেশ করাবেন, বেশি বুঝলে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে, তাই আর কোনো জ্ঞানের দরকার নেই।’
ভারসাম্যহীন ধর্মীয় মাসলা-মাসায়েলের জ্ঞান অর্জন করে তারা উপাধি গ্রহণ করেন আলেম, পুরোহিত, রাব্বাই, ফাদার, মাওলানা, মোফাসসের ইত্যাদি। কিন্তু উপাধি যত বড়ই হোক কার্যক্ষেত্রে তাদেরকে থাকতে হয় ‘কুয়োর ব্যাঙ’ হয়ে। গতিশীল পৃথিবীর সাথে তাদের থাকে না সমন্বয়। পৃথিবী যখন নতুন নতুন আবিষ্কারে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অভাবনীয় উন্নতি করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন তারা নিজেদের গুটিয়ে রাখে উপাসনালয়ের চার দেওয়ালের অভ্যন্তরে। স্রষ্টা প্রদত্ত মেধাকে, মননশীলতাকে, সৃজনশীলতাকে আবদ্ধ করে রাখে মাসলা-মাসায়েলের পাতায় এবং তাদের ব্যক্তিগত অন্ধত্ব, ক্ষুদ্রতাকে জাতির ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে। ধর্মপ্রাণ মানুষ যেহেতু তাদেরকে ধর্মেরই ধারক-বাহক মনে করে তাই খুব সহজেই তারাও ঐ অন্ধত্ব ও সংকীর্ণতায় দীক্ষিত হয়ে বাস্তব জীবনে স্থবির, অসার হয়ে পড়ে।
পক্ষান্তরে আরেকটি শ্রেণি সৃষ্টির অণু-পরমাণু, কার্যপদ্ধতি, গঠনপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছে, এরা গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে, অনুজীব- যাকে খালি চোখে দেখা তো দূরের কথা যার অস্তিত্ব অনুভব করাই কষ্টসাধ্য এরা তার জীবনধারণের পদ্ধতি, খাদ্য, বংশবিস্তার ইত্যাদি অতি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করছে, এরাই বিংশ শতাব্দীর দু’টি বিস্ময়কর বস্তু- রেডিও ও টেলিভিশন আবিষ্কার করেছে; ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় মহাবিপ্লব সাধন করেছে। এরা সৃষ্টির অতি সূক্ষ্মতম পদার্থেরও ধর্ম বা স্বভাব নির্ণয় করছে অতি সহজভাবে, পৃথিবী থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্রের মেনে চলা নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার বর্ণনা দিচ্ছে; কিন্তু এত কিছু করলেও প্রতিটি বস্তুর অন্তর্নিহিত এই ধর্ম, এই শৃঙ্খলা যে কারও না কারও পরিকল্পনারই অংশ এবং তা যে কেউ না কেউ পরিচালনা করছে তারা তা দেখতে পাচ্ছে না।
তারা সৃষ্টি দেখে, সৃষ্টির অভ্যন্তরীণ বিস্ময়কর স্বভাব বা গুণ দেখেও স্রষ্টার অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারছে না। কারণ, তাদের একচোখ অন্ধ। তারা কেবল জড়, বস্তু ও দেহ-ই দেখতে পায়। জীবন, আত্মা ও আধ্যাত্মিকতা তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। অর্থাৎ ঐ ভারসাম্যহীনতা।

এর ফল হয়েছে এই যে, তারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যা কিছু আবিষ্কার করছে, দেখা যাচ্ছে তার সবগুলোরই অপব্যবহার হচ্ছে। একটি পারমাণবিক বোমা হিরোসিমা-নাগাসাকিতে যে হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহার কতটা ভয়ানক হতে পারে তার কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, কোটি কোটি আদম সন্তান প্রাণ হারিয়েছে। এবার কড়া নাড়ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে যুদ্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ অপব্যবহার পৃথিবীবাসী দেখবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিজ্ঞান যেমন আবিষ্কারকে সহজ করেছে, সৃজনশীলতাকে বিকশিত করেছে, তেমনি ধ্বংসকেও অতি সহজ বিষয়ে পরিণত করেছে। কিন্তু যাদের হাতে সে ক্ষমতা তারা যদি বস্তুবাদী না হতেন, তাদের জ্ঞান যদি স্রষ্টাবর্জিত না হতো, অর্থাৎ ভারসাম্যযুক্ত হতো তাহলে পৃথিবীবাসী কখনই ধ্বংস দেখতো না, কেবল সৃজনশীলতারই চর্চা হতো। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষতা থেমে থাকতো না, থেমে থাকতো তার অপব্যবহার।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে জ্ঞানের বিকাশ ভারসাম্যে। স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী ধ্যান ধারণা পোষণ করে যা কিছুই অর্জন করা হোক সেটা জ্ঞান নয়। ঐ জ্ঞান দিয়ে মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। আবার মানুষের অর্জিত জ্ঞানকে তুচ্ছ মনে করে, অবহেলা প্রদর্শন করে শুধুই স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞানের চর্চা করাও জড়বুদ্ধিতার শামিল। স্রষ্টা অন্ধত্ব ও সংকীর্ণতার পক্ষপাতী নন। তিনি জ্ঞানার্জনকে পছন্দ করেন, ধার্মিকদের পছন্দ করেন, ধর্মান্ধদের নয়। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মানুষ একাধারে স্রষ্টার পরিচয় জানবে, মানুষ হিসেবে তার কাজ কী, সে কোথা থেকে এসেছে সেসব প্রশ্নের উত্তর লাভ করবে; সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য জানবে এবং স্রষ্টার বিজ্ঞানময় সৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে, গবেষণা করে তার মাধ্যমেও স্রষ্টাকে চিনবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানবতার কল্যাণ সাধনে স্বীয় অবদান রাখবে, মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করবে। যিনি এতে সফল হবেন তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। তিনি মানবতার সম্পদ, মানবজাতির সম্পদ।
দৈনিক বজ্রশক্তি, 07.02.2018

প্রকৃত ধার্মিক কারা?

অনেক ধার্মিক আছেন, যারা ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন, কিন্তু সমাজ নিয়ে সামান্য ভাবনা নেই। চরম আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরের মত বেঁচে থাকেন। তারা দামি রেস্টুরেন্টের দামি খাবার খান, মহামূল্যবান পোষাক পরেন, বিলাসবহুল গাড়িতে যাতায়াত করেন, কিন্তু একটিবারও সমাজের বুভুক্ষু, হাড্ডিসার, আর্তপীড়িত মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র তাদের চোখে ভাসে না, অন্তরে রেখাপাত করে না।
আরেকটি শ্রেণি রয়েছে যাদের মন-মগজ মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডার চার-দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ। এরা সারাদিন রোজা রাখেন, গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়েন, পূজার বেদিতে প্রসাদ অর্পণ করেন, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, রোজ রোজ জীবে প্রেম করার শপথ বাক্য পাঠ করেন, জপমালা জপেন, শ্রদ্ধার সাথে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন, কিন্তু ঐ মসজিদ, ঐ মন্দির, ঐ প্যাগোডা বা ঐ গীর্জার পাশেই যে বুভুক্ষু হাড্ডিসার দুর্বল মানুষটি দু’দিন হলো না খেয়ে পড়ে আছে তার দিকে ভুলেও চেয়ে দেখেন না। এই কথিত ধার্মিকরা সমাজের অত্যাচারিত, মজলুম, আর্তপীড়িত মানুষের ক্রন্দনের দিকে ভ্রুক্ষেপ করেন না কারণ ওটা তাদের কাছে দুনিয়াদারী। তারা এই দুনিয়াদারী না করে সদা ধর্মপালনে রত থাকেন! এদের এই দুনিয়াবিমুখ ধর্মকর্ম দিয়ে কার কী লাভ হচ্ছে তারাই ভালো জানেন। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো ধর্মেরই নবী-রসুল-অবতার-মহামানবরা এমন দুনিয়াবিমুখ ধর্মকর্ম করে যান নি। তারা মানুষ নিয়ে ভেবেছেন, মানুষের জন্যই সংগ্রাম করে গেছেন।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক শৈলেন্দ্র বিশ্বাস এম. এ প্রণীত সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধানে ‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে- ‘স্বভাব, শক্তি, গুণ’ অর্থাৎ বস্তুর অভ্যন্তরস্থ সেই নীতি যা সে মেনে চলতে বাধ্য থাকে। প্রতিটি পদার্থ, প্রতিটি প্রাণীরই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতিগত কিছু গুনাগুণ থাকে যাকে উক্ত পদার্থ বা প্রাণীর ধর্ম বলে। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, উত্তাপ দেওয়া, আলো দেওয়া। আগুনের এই গুণ সনাতন, শাশ্বত। লক্ষ বছর আগেও আগুন পোড়াতো, লক্ষ বছর পরও পোড়াবে। এটাই তার ধর্ম। এখন যদি আগুন কোন কারণে পোড়াতে ব্যর্থ হয়, উত্তাপ না দেয়, আলো নির্গত না করে তবে ঐ আগুনকে কি আগুন বলা যাবে? সে তো শুধু আগুনের প্রতিচ্ছবি, অর্থাৎ শুধুমাত্র আগুনের অবয়ব ধারণ করে আছে।
একইভাবে হীরক যদি তার কাঠিন্য, ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য হারায় তবে তাকে আপনি কী বলবেন? বাঘ যদি তার হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা, শক্তি, সাহস হারায় তবে সে বড় দেহধারী বিড়াল ছাড়া আর কী? একইভাবে মানুষেরও কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, ধর্ম রয়েছে; এই ধর্মগুলির কারণেই সে মানুষ, তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের সেই ধর্মগুলি হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্যতা, বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবেই পরিগণিত হবার যোগ্য। এই ধার্মিকের জন্য প্রয়োজন নামাজ, রোজা, প্রার্থনা ইত্যাদি, যেন তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পায়, সে আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, আরও বেশি করে নিজেকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করার প্রেরণা লাভ করে। যদি কারো মধ্যে সহজাত মানবীয় গুণাবলীই না থাকে তাহলে সে তো মানুষই না। ধার্মিক হবার প্রশ্নই আসে না, তার আবার নামাজ কী, রোজা কী, পূজা কী, প্রার্থনা কী? এদের ব্যাপারে আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন, ‘তারা চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মত, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট (সুরা আ’রাফ- ১৭৯)।’
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আজকে আমরা ধার্মিক বলতে মানবতা বা মনুষ্যত্ব ধারণকারীদের বুঝি না, বুঝি ঐ দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি, টিকি, তিলক, ক্রুশ, তসবীহ, জপমালা তথা ধর্মীয় বেশ-ভূষা ধারণকারীদেরকে; যদিও আল্লাহ বলেছেন, আমি মানুষের পোশাক দেখি না, দেখি অন্তর ও তার কাজ (হাদিসে কুদ্সী)। খুবই স্বাভাবিক, কারণ মানুষের পোশাক আশাক, আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা-উপাসনা দিয়ে স্রষ্টা কী করবেন? তিনি অমুখাপেক্ষী, তিনি আমাদের উপাসনার কাঙাল নন। ওসব আনুষ্ঠানিকতা মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই। আমি এত বড় ধার্মিক হলাম, এত বড় আবেদ হলাম, এত বড় সাধক হলাম, কিন্তু আমার দ্বারা মানুষ উপকৃত হলো না, তাহলে ঐ ধার্মিকতার কোনো মূল্য রইল না। স্রষ্টা তেমন ধার্মিকতা চান না।
মানুষের শান্তিতে স্রষ্টার সন্তুষ্টি, মানুষের অশান্তিতে স্রষ্টার অসন্তুষ্টি। তাই মহাপ্রভু আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুল-মহামানব পাঠিয়ে মানুষকে শান্তির পথনির্দেশ করেছেন। মহামানবরা এসে তাদের যার যার জাতিকে বুঝিয়েছেন সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হলো মানুষের প্রকৃত এবাদত। এই এবাদত করার জন্য শুধু বহিঃশত্রুই নয়, আপন লোকের সাথেও লড়াই করেছেন তারা। তারা বসে বসে শুধু স্রষ্টার স্তুতিকীর্তন করেন নি, তারা যা করেছেন সম্পূর্ণটাই ছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতার জন্য। তাদের জীবন ছিল সংগ্রামী, বহির্মুখী। গৌতম বুদ্ধ কি পারতেন না তার সম্পদশালী পিতাকে বলে রাজভবনের কোনো এক জায়গায় একটি মন্দির বা উপাসনালয় নির্মাণ করে আরাধনা, পূজা-অর্চনা করতে? বেশ পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি রাজ্য, স্ত্রী-সন্তান, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে মানুষের দুঃখের কারণ কী, দুঃখ নিবারণের উপায় কী- তা সন্ধান করার জন্য অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। তিনি হাসিমুখে গৃহত্যাগ করেছেন কেবলমাত্র মানুষের শান্তির উপায় অন্বেষণ করার জন্য, মানবতার তাগিদে। অথচ তার অনুসারীরা আজ কী করছে?
ইবরাহীম (আ.) সংগ্রাম করলেন তাঁর বাবার বিরুদ্ধে, মুসা (আ.) সংগ্রাম করলেন তাঁর আশ্রয়দাতা ফেরাউনের বিরুদ্ধে, আখেরী নবী সংগ্রাম করলেন আপন চাচার বিরুদ্ধে। এদিকে ভারতবর্ষের ধর্মগ্রন্থগুলো খুলে দেখুন- শ্রীকৃষ্ণ সংগ্রাম করলেন আপন মামার বিরুদ্ধে, যুধিষ্ঠির সংগ্রাম করলেন আপন চাচার বিরুদ্ধে, এটাই হলো মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, অশান্তিকে শান্তি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। তাঁরা এত বড় ত্যাগ সাধন করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁরা মহামানব। কিন্তু তাঁরা যে সংগ্রাম করে মানবজাতির মধ্যে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে গেলেন আমাদের ধার্মিক সমাজের কাছে সেই সংগ্রামের কোনো অর্থই নেই। ঐ মহামানবদের অনুসারী দাবিদার আজকের ধার্মিকরা ধর্মের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে ফেলেছেন, মানবতার কল্যাণ নয় বরং উপাসনা, পূজা-অর্চনা, নামাজ-রোজাই তাদের কাছে আসল ধর্ম-কর্ম! সত্যের কি নিদারুন বিকৃতি!
দৈনিক বজ্রশক্তি, 08/02/2018

মশা মারার ফতোয়া (ফেসবুক পোস্ট)


No automatic alt text available.

‘‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামের একটা গ্রুপে এই পোস্টটি করা হয়েছে আবু জুনাইদ নামের একটি আইডি থেকে। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘‘মশা মারার জন্য বাজারে এক ধরনের ইলেকট্রিক র‌্যাকেট পাওয়া যায়। এই ধরনের ইলেকট্রিক র‌্যাকেট দিয়ে মশা মারলে এক ধরনের স্ফূলিঙ্গ বের হয় এবং মশা মারা যায়। প্রশ্ন হলো- এই ধরনের বস্তু দিয়ে মশা মারা জায়েজ হবে কিনা।’’
এর জবাবে আইনশাস্ত্রের রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়- ‘কোনো ক্ষতিকর প্রাণীকেও আগুনে পুড়িয়ে মারা জায়েজ নাই। রসুলাল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ ব্যতীত আর কারো অধিকার নাই আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়ার। সহিহ আল বোখারী, হাদীস ৩০১৬। উক্ত ব্যাট দিয়ে আঘাত করলে যেহেতু মশা পুড়ে মারা যায় তাই তার দ্বারা মশা মারা জায়েজ হবে না।’ আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৯৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৬/৩৬১; ফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়া ২/৩৪৮; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৭৫২
এই ফতোয়া ঠিক না বেঠিক সেটা মুফতি সাহেবরা দেখবেন, আমাদের কথা হচ্ছে, একটা মশা পুড়িয়ে মারার ক্ষেত্রে যাদের এত সতর্কতা, তারাই আবার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারেন কোন নীতিতে? ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গিয়ে নিরীহ মানুষকে পেট্রল বোমা দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার সময় এই ফতোয়াগুলোর বিস্মরণ ঘটে যায় কীভাবে?
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলায় ২০১৬ সালের ১৪ মার্চের ঘটনা সবগুলো মিডিয়াতে এসেছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো হেযবুত তওহীদের দুইজন সদস্যকে। ফেসবুকে শত শত পোস্ট দিয়ে সাধারণ মানুষকে উস্কানী দেওয়া হলো হেযবুত তওহীদের লোকদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। মসজিদের মাইক ব্যবহার করে আলেম সাহেবরা ফতোয়া দিলেন হেযবুত তওহীদ খ্রিস্টান, হেযবুত তওহীদ গীর্জা বানাচ্ছে, কাজেই খৃস্টান মারো, গীর্জা ভাঙ্গো। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের দুইজন ভাইকে জবাই করে ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে হত্যা করল।
সেই ফতোয়াবাজরাই আজকে যখন মশা মারার ফতোয়া জানতে চায় তখন বুঝি আল্লাহর রসুল কেন এই ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাপারে বলেছিলেন তাদের কথা হবে কোমল, মোলায়েম, কিন্তু অন্তর হবে হায়েনার মত হিংস্র। ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা মারা তাদের কাছে নাজায়েজ, কিন্তু মানুষ মারা খুব সওয়াবের কাজ!
একজন ইরাকী একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আব্দুল্লাহ, হজ্বের সময় যদি ভুল করে মশা মাছি বা এমন কিছু মেরে ফেলি তাহলে তার কাফফারা কী হবে? এই প্রশ্ন শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে জবাব দিয়েছিলেন- যে ইরাকিরা আল্লাহর রসুলের নয়নের মনি হোসেনকে শহীদ করল সেই ইরাকীরা কিনা মাছি মারার কাফফারা জিজ্ঞেস করে!
এই প্রায়ান্ধ শ্রেণি অতীতেও ছিল, আজও আছে। বিরাট বিশাল পাহাড় তারা দেখতে পায় না। পাবে কীভাবে? তারা তো পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট ছোট বালুকণার গায়ে আতশী কাঁচ ঠেকিয়ে পাহাড় দেখার চেষ্টা করছে। ফলে পাহাড়ের গায়ে লেগে থেকেও সমগ্র পাহাড় তাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে এবং ঐ ছোট ছোট বালুকণাকেই পাহাড় মনে করছে। এটার নামই আকীদার বিকৃতি। এদের এই মাসলা-মাসায়েল আর ফতোয়াবাজীর ইসলাম দিয়ে মশা-মাছির কোনো উপকার হবে কিনা জানি না, মানুষের কোনো উপকার অতীতেও হয় নাই আজও হবে না।

আমি স্রষ্টাকে দেখেছি নিপীড়িতের আর্তনাদে

কেবল নামাজ পড়ে স্রষ্টাকে পাওয়ার চেষ্টা আমিও করেছি, হন্যে হয়ে খুঁজেছি স্রষ্টাকে এক নজর দেখব বলে। হৃদয়ের সবটুকু চাওয়াকে একত্রিত করে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রার্থনা করেছি- হে আল্লাহ, তোমার সাক্ষাৎ চাই, তোমার সন্তুষ্টি চাই, তোমার সান্নিধ্য চাই। তোমার করুণার অমৃতসুধা পান করে জীবনকে সার্থক করতে চাই। দেখা দাও খোদা, এ অন্তরকে সিক্ত কর। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি- স্রষ্টাকে একবারের জন্যও পাই নি।
স্রষ্টাকে অন্তরদৃষ্টিতে দেখব বলে একমনে তসবিহ জপেছি। একবার নয় বারবার। প্রশংসাবাক্য পাঠ করে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, তাও একরাত নয়, বহুরাত। হাটে-বাজারে, দোকানপাটে, রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজে, ওয়াজে-মাহফিলে, বিছানায়, পড়ার টেবিলে, জোছনা রাতে, প্রখর রোদ্রৌজ্বল দুপুরে, প্রভাতে- সর্বদা কেবল স্রষ্টাকেই জপেছি, স্রষ্টাকেই চেয়েছি, স্রষ্টাকেই খুঁজেছি। যত্ন করে ফুল-চন্দনে সাজিয়েছি অন্তঃপুরের সিংহাসন- স্রষ্টাকে বসতে দেব বলে। কিন্তু, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি- তসবীহর দানায় স্রষ্টাকে পাই নি।
রমজানে ক্ষুধা-তেষ্টায় কাতরাতে কাতরাতে ঝাঁপশা নয়নে অপলক চেয়ে থেকেছি কেবল স্রষ্টাকে দেখব বলে। লাইলাতুল কদরে গভীর রজনীতে সেজদায় পড়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি স্রষ্টাকে পাব বলে। ওয়াজ-মাহফিলে মাওলানার মুখঃনিসৃত তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠের ধ্বনি অন্তরে তুফান সৃষ্টি করেছে, শহীদী যোশে আল্লাহু আকবার বলে রক্তলোলুপ হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে কাফের-মুশরিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়েছি শুধু স্রষ্টাকে পাব বলে। মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য পকেটের শেষ আধুলিটাও দান করেছি কেবল স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাব বলে। কিন্তু বিশ্বাস করুন- কোথাও আল্লাহকে পাই নি, এক দিনের জন্যও পাই নি, এক সেকেন্ডের জন্যও পাই নি।
তবে আজ আমি স্রষ্টাকে পেয়েছি। এখন আমায় স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়াতে হয় না। যেদিকে তাকাই স্রষ্টাকেই দেখি। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি এই প্রকৃততিতে, গাছপালায়, বনে-জঙ্গলে, মাটিতে, পানিতে, বাতাসে, আকাশে, মেঘমালায়, গ্রহ-নক্ষত্রে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি পীচঢালা রাজপথে, অলিতে-গলিতে, পচা ডোবায়, নালায়, খাল-বিল-ঝিলে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি জীবন্ত কঙ্কাল হয়ে বেঁচে থাকা পথশিশুর প্রতি ফোটা অশ্রুর অনু-পরমাণুতে, আমি স্রষ্টাকে দেখেছি অত্যাচারী শাসকের নির্মমতার শিকার হওয়া অসহায় শাসিতের ভারী দীর্ঘশ্বাসে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি মৃত্যুপথযাত্রী অনাহারী সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে অপারগ পিতার নিষ্ঠুর নীরবতায়।
আমি স্রষ্টাকে দেখেছি সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা শিশু আইলানের জড়সড় প্রাণহীন দেহে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি রাকিব-রাজনদের মৃত্যুপূর্বের প্রতিটি আর্তচিৎকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি তালাবদ্ধ ঘরে চাচার লাগানো আগুনে পুড়ে মরা ভাতিজাদের পোড়া মাংসের গন্ধে। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি দুই কেজি চালের বিনিময়ে গর্ভজাত সন্তানকে বিক্রি করতে উদ্যত সিরিয়ান মায়েদের স্পর্ধায়, আমি স্রষ্টাকে দেখেছি কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর প্রতি ফোটা রক্তের কণায়। আমি স্রষ্টাকে দেখেছি ধর্ষিতার নীরব আহাজারীতে।
বিশ্বাস করুন- আমি এখন রোজ স্রষ্টাকে দেখি। একদিনও স্রষ্টাকে না দেখে থাকতে হয় না।

জাফর ইকবালের ওপর হামলা! এই ধর্মান্ধতার শেষ কোথায়?

Image may contain: 1 person, smiling
আরও একটি কালো অধ্যায় রচিত হলো। আবারও চাপাতি, আবারও ধর্মান্ধতা! এবার ছুরিকাহত হলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল যাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। দেশের হাজার হাজার তরুণ মেধাবী ছেলে-মেয়ে যে মানুষটার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে পারলে ধন্যবোধ করে, সেই জাফর ইকবালের মাথায় ছুরি ও রডের আঘাত করে বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে, বাংলাদেশের মানুষ গুণের কদর করতে জানে না! বাংলাদেশের মানুষ গুণীর সুরক্ষা দিতে জানে না! তার চেয়েও মর্মান্তিক বিষয় এই যে, হামলাকারী তরুণ ফয়জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি বলেন, ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি’। শনিবার রাতে র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ এই কথা বলেন। কী অন্ধ চিন্তাধারা- শুনলেও গা শিউরে ওঠে!

বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে যে, এ দেশে ভিন্নমতের মানুষরা ক্ষণিকের জন্যও নিরাপদ নয়! এখানে ধর্মের নামে মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়, মানুষ কী বলবে আর কী বলবে না, কী লিখবে আর কী লিখবে না- তা ঠিক করে দেয় ধর্মের ধ্বজাধারী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। ধর্মকে কুক্ষিগত করে রেখে তারা নিজেদের মনগড়া ফতোয়াকে ধর্মের বিধান বলে চালিয়ে দেয়, কিন্তু কারো কিছু বলার নেই। মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে নিয়ে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হয়, কোর’আন-হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়, ভিন্নমতের মানুষকে উৎখাত করা হয়, কিন্তু কারো সাধ্য নেই প্রতিবাদ করার। করলেই তাকে ফতোয়া দেওয়া হয় নাস্তিক, মুরতাদ, ইহুদি-খৃষ্টানের দালাল, ইসলামের শত্রু এবং আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কথিত ঐ ইসলামের শত্রুদের বিচার করার দায়িত্বও তারা নিজেদের হাতে তুলে নেন। চাপাতি, কিরিচ, রড, ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইসলামকে শত্রুমুক্ত করতে! ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ইসলামের সাথে কবে কোথায় কী শত্রুতা করেছেন তা একমাত্র ঐ হামলাকারীই হয়ত বলতে পারবে, তবে ‘ইসলামের শত্রু’ আখ্যা দিয়ে হামলার ঘটনাটি যে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, দেশে সহিংস ধর্মীয় উন্মাদনার তালিকায় নতুন সংযোজনমাত্র তা বুঝতে পণ্ডিত হবার প্রয়োজন পড়ে না।
এই ব্রেইন ওয়াশড তরুণরা কবে বুঝবে- ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালরা ইসলামের শত্রু নয়, ইসলামের শত্রু তারাই যারা তাদেরকে কোর’আন-হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে জাতিবিনাশী হত্যাকা-ে লিপ্ত করে রেখেছে? তারাই বড় শত্রু, যারা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম বানিয়েছে এবং যাদের কূপম-ূকতা, অন্ধত্ব, পশ্চাদপদতা, বিজ্ঞানবিমুখতা, অসহিষ্ণুতা ও সংকীর্ণতার কারণে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ‘হাসি-তামাশার’ বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। যারা জোর করে ড. জাফর ইকবালের মত ব্যক্তিত্বকে ইসলামের শত্রু বলে আখ্যা দিতে চায়, কিন্তু ইসলামের আসল শত্রুকে দৃষ্টির আড়ালেই রেখে দেয়। সমস্ত পৃথিবীতে সা¤্রাজ্যবাদী অপশক্তিগুলো নিরীহ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, একটার পর একটা মুসলিমপ্রধান দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে, ওরা এই প্রায়ান্ধদের দৃষ্টিতে ইসলামের শত্রু হলো না, ওদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা হুংকার তুলতে পারল না, তারা নামল জাফর ইকবালকে হত্যা করতে! অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, কাপুরুষতা আর মানসিক বিকৃতি বোধহয় একেই বলে।
ইসলাম যেন এক ‘পিতৃমাতৃহীন পথশিশু’, দেখার কেউ নেই, পরিচর্যার কেউ নেই। ১৬০ কোটির মুসলমান জাতি, এক আল্লাহ এক রসুল এক কিতাবে তাদের বিশ্বাস, কিন্তু সিদ্ধান্তের বেলায় তাদের অবস্থা ‘হ-য-ব-র-ল’, কোনো একক নেতা নেই, কর্তৃপক্ষ নেই। হালবিহীন মাঝিবিহীন নৌকার মত বাতাসের তোড়ে ভাসছে, যে যার মত করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। প্রকৃত ইসলাম কি এমন ছিল? ইতিহাস তো সেটা বলে না। যারা কোর’আন-হাদীসের ইচ্ছেমত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, অমুক কাফের, অমুক মুরতাদ, অমুক ইসলামের শত্রু- ওকে কতল কর ইত্যাদি রায় দিচ্ছেন, আদতে ইসলামের কোনো বিষয়ে রায় দেওয়ার অধিকার তাদের আছে কিনা? তারা আল্লাহর রসুলের সুন্নাহর অনুসরণ করতে চান কিন্তু আল্লাহর রসুল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন, প্রধান বিচারক ছিলেন, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, সেনাপ্রধান ছিলেন, পক্ষান্তরে তাদের পরিচয় কী? কুয়োর ব্যাঙ! কাকের ময়ুরপুচ্ছ ধারণের মত করে পাড়া-মহল্লার কোনো এক মসজিদের ইমাম, কোনো এক মাদ্রাসার মুফতি হয়েই তারা ‘মহামান্য’ বিচারকের মত দ- ঘোষণা করেন, অথচ সে অধিকার তাদের আছে কিনা ভেবে দেখেন না।
কোর’আনের বহু আয়াত, শরীয়তের বহু বিধান আছে যেগুলো ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, প্রত্যেক মো’মেন-মুসলিম সেগুলোর আমল করতে পারেন। কিন্তু অনেক বিধান আছে রাষ্ট্রশক্তির জন্য প্রযোজ্য, যেগুলো পালন করার জন্য রাষ্ট্রীয় অথরিটি প্রয়োজন হয় যেমন- যুদ্ধ ঘোষণা করা, কারো অপরাধের বিচার করা ইত্যাদি। এগুলো তো মসজিদপতি ও মাদ্রাসাপতিদের কাজ নয়, এগুলো রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সেনাপতিদের কাজ। তারা কেন নিজেদের অবস্থান বোঝেন না? কেন কোমলমতি তরুণদেরকে কথিত জিহাদী বয়ান দিয়ে বিপথগামী করেন? কবে আমরা এই ধর্মান্ধতার কফিনে পেরেক ঠুকতে পারব? আর কতকাল মানুষ ইসলাম নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ পেতে থাকবে? আর কতদিন পবিত্র ইসলাম কলঙ্কিত হতে থাকবে?
তবে এতদিনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শুধু শক্তি প্রয়োগ করে এই ধর্মান্ধতার মোকাবেলা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে অনেক আগেই হয়ে যেত। পত্যেক নাগরিকের পেছনে তো আর পুলিশ মোতায়েন করে রাখা যায় না, তারপরও রাষ্ট্রশক্তি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে। এখন এর সাথে আদর্শিক মোকাবেলা যোগ হলে অর্থাৎ প্রকৃত ইসলামের আকীদা (সামগ্রিক ধারণা) সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা গেলে ধর্মান্ধতার মূলোৎপাটন সহজ হয়ে যাবে।

এ ধরনের হামলা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, ইসলামের পরিপন্থী!


No automatic alt text available.

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে একটি নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তা যে উদ্দেশ্যেই হোক, আর যারাই করুক। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পর অভিযুক্তকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। শুধু অধ্যাপক জাফর ইকবাল কেন, যে কোনো মানুষ, যদি সে অপরাধীও হয়ে থাকে তার জন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। অতর্কিত আক্রমণ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা করার এখতিয়ার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও নেই। এই ধরনের সন্ত্রাসীপনা রাষ্ট্রীয় আইন ও ধর্মীয় আইন উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই অন্যায়, অপরাধ।
দ্বিতীয়ত, হামলাকারী ফয়জুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল- কেন সে হামলা করেছে? সে জানায় ‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু, তাই তাকে মেরেছি।’ কিন্তু মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কোনো লেখা সে পড়েছে কিনা জানতে চাইলে জানায়, সে তাঁর কোনো বই পড়েনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কে ইসলামের বন্ধু আর কে শত্রু- তা নির্ধারণের গুরুতর দায়িত্ব এই ফয়জুর রহমানরা কোথা থেকে পেল, যে কিনা একজন মানুষকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অথচ লোকটা সত্যিই ইসলামের শত্রু কিনা জানার জন্য একটা লেখা পড়ার প্রয়োজন মনে করল না? শুধু শত্রু ‘নির্ধারণ’ই নয়, কথিত ঐ ‘ইসলামের শত্রু’কে মৃত্যুদ- প্রদানের জন্য ছুরি হাতে ঝাঁপিয়েও পড়ল!
এভাবে যাকে-তাকে ইসলামের শত্রু আখ্যা দেওয়া এবং তাকে খতম করতে সশস্ত্র হামলা করা কোনোকালেই ইসলামে বৈধ ছিল না, আজও নেই। আমরা নিশ্চিত যে, হামলকারী ফয়জুল কোনো সুযোগসন্ধানী, স্বার্থান্বেষী, ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে এবং এ ধরনের ঘটনা ইতিপূর্বে বহুবার ঘটানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের গুপ্তহামলা চালিয়ে দায়স্বীকার করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী। তারপর কী হয়? সংশ্লিষ্ট দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়, একটার পর একটা রক্তারক্তি চলতেই থাকে, অবশেষে সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। বহু মুসলমানপ্রধান দেশ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে। তবে সবচাইতে বড় ক্ষতিটা হয়েছে এই যে, বিশ্বময় ইসলাম সম্পর্কে একটা ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। যারা চায় দুনিয়া থেকে ইসলামের নামটুকুও মুছে যাক সেই ইসলামবিদ্বেষীরা তাদের মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রচারের সুযোগ পেয়েছে যে, ‘ইসলাম সন্ত্রাস শেখায়, ইসলাম জঙ্গি বানায়, ইসলাম মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, ইসলাম জবরদস্তিতে বিশ্বাস করে।’ অথচ প্রকৃত ইসলাম তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
যদি কারো লেখায় বা বক্তব্যে ইসলামবিদ্বেষী কিছু থাকে সেটাকে মোকাবেলা করার যথাযথ প্রক্রিয়া ইসলামে রয়েছে। ইসলাম যুক্তির ধর্ম, কাজেই যুক্তি দিয়ে, আদর্শিক মোকাবেলা করে ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা খুবই সম্ভব। কিন্তু তার বদলে যখন ছুরি-চাপাতি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া হয় তখন ইসলামবিদ্বেষীরা আরও বেশি করে প্রচারের সুযোগ পায়- ‘ঐ দ্যাখো, ইসলামের ধ্বজাধারীরা যুক্তিতে না পেরে গায়ের জোরে নিজেদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে, আসলে ইসলাম এমনই, এভাবেই ইসলাম কায়েম হয়েছে, নবীজী এরকমই ছিলেন (নাউজুবিল্লাহ)।’ প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে সঠিক আকীদা (পূর্ণাঙ্গ ধারণা) না থাকায় মানুষ সহজেই ওদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সূর্যের মত মহাসত্যটি সবার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে যে, বিশ্বনবীর বিজয় যতটা সমরাঙ্গনে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি হয়েছিল মানুষের আত্মায়, মনোজগতে। রাজ্য জয় তো চেঙ্গিস খানও করেছিল, ইসলাম জয় করেছিল মানুষের হৃদয়! ঐ বিজয় নিছক সামরিক নয়, ছিল আদর্শিক!
এই যে সমরাঙ্গনের কথাটা উঠল- ইসলামের ইতিহাসে এটা কখনকার ঘটনা? আল্লাহর রসুল কখন যুদ্ধ করেছেন? যখন তিনি মদীনার সর্বজনস্বীকৃত রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি ছিলেন একাধারে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির সর্বোচ্চ নেতা, প্রধান বিচারক ও সেনাপ্রধান। কাজেই অনেক সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। যুদ্ধের প্রয়োজন দেখা দিলে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে ভেতর-বাইরের শত্রুদের দমন করতে হয়েছে, সেনা পাঠাতে হয়েছে। একজন বিচারক হিসেবে অপরাধীকে দ- দিতে হয়েছে। সবই তিনি করেছেন মহান এক উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও ঐক্য-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য, কাউকে ধর্মান্তরিত করার জন্য নয়। আবার এমনও হয়েছে যে, কেউ ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হয়ে গেছে, অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, যেটা স্পষ্টত রাষ্ট্রদ্রোহের সমান অপরাধ! তাদেরকে যে শাস্তি দেওয়া হয় সেটা ইসলাম ত্যাগের শাস্তি ছিল না, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামায় প্ররোচনা দেওয়ার শাস্তি ছিল। সেই শাস্তিটাও কি যে কেউ ইচ্ছে হলো আর দিয়ে দিলাম- এমন ছিল? কখনই নয়। শাস্তি দিয়েছেন আল্লাহর রসুল অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো ছিল না, এখনও নেই।
কোর’আনের বহু আয়াত, শরীয়তের বহু বিধান আছে যেগুলো ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, প্রত্যেক মো’মেন-মুসলিম সেগুলোর আমল করতে পারেন। কিন্তু অনেক বিধান আছে রাষ্ট্রশক্তির জন্য প্রযোজ্য, যেগুলো পালন করার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব (অঁঃযড়ৎরঃু, হুকুম দেবার ও তা তামিল করাবার ক্ষমতা বা অধিকার) প্রয়োজন হয় যেমন- যুদ্ধ ঘোষণা করা, কারো অপরাধের বিচার করা ইত্যাদি। এগুলো তো ফয়জুলদের কাজ নয়, এগুলো রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সেনাপতিদের কাজ। আজকে ইসলামের প্রকৃত আকীদা হারিয়ে যাবার কারণে কোন আমল কার জন্য, কোনটার পূর্বশর্ত কোনটা, কোনটা আগে কোনটা পরে, কোনটা ছাড়া কোনটার মূল্য নেই- এই ধারণাগুলো হারিয়ে গেছে। ফলে ইসলাম বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে, প্রতিপক্ষকে নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে ফায়দা হাসিলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপর হামলার কিছুদিন পূর্বেই আমরা দেখলাম সিলেটে ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় একটি গোষ্ঠী হামলা করে অপর গোষ্ঠীর কথিত ‘মুরতাদ’কে হত্যা করল। তারা উভয়েই ইসলামের সঠিক পথের অনুসারী বলে নিজেদেরকে দাবি করে। এই সব দাঙ্গা-সন্ত্রাসের সঙ্গে আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামের দূরতম সম্পর্কও আছে কি?