
একজন মানুষ হত্যা করাকে আল্লাহ সমস্ত মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন। আবার তিনিই কোর’আনে মু’মিনদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছেন, শত্রু সেনার সাথে সর্বাধিক কঠোর আচরণের নির্দেশ দিচ্ছেন। আপাতদৃষ্টে বিষয়টি সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। কিন্তু না, সাংঘর্ষিক নয়। কেন নয় তা মহাভারতের একটি ঘটনার আলোকে বলছি।
আমরা সবাই জানি মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহীনী মানুষ মারা গিয়েছিল। এরকম ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ তার আগে কখনও ঘটেছে বলে জানা যায় না। ওই যুদ্ধে যুধিষ্ঠির ছিলেন পাণ্ডববাহিনীর নেতৃত্বে। সেই যুধিষ্ঠিরের ব্যাপারে জানা যায়, তিনি নাকি স্বশরীরে স্বর্গে আরোহন করেছিলেন, আর সেই স্বর্গারোহনের সময় তার সঙ্গী ছিল একটি কুকুর।
কুকুরটিকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে, স্বর্গেও তিনি কুকুর নিয়েই প্রবেশ করতে চাইছিলেন। কিন্তু তাতে বাধা দিয়ে বলা হয় যে- কুকুর নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করা যাবে না! এতে ব্যথিত হন ধর্মরাজ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন- স্বর্গে যদি যাই তবে একে নিয়েই যাব, স্বার্থপরের মত ওকে ছেড়ে যেতে পারব না। যাহোক, পরে অবশ্য জানা গেল- স্বয়ং ধর্ম দেবতাই কুকুরের বেশ ধরে তার সততার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন।
প্রশ্ন হলো- একটা কুকুরের প্রতি যে যুধিষ্ঠিরের এত ভালোবাসা, এত মায়া, সেই যুধিষ্ঠিরই কুরুক্ষেত্র ঘটিয়ে অবলীলায় লাখো-কোটি মানুষ হত্যা করলেন কোন যুক্তিতে? তখন কি তার মধ্যে মানবতা ছিল না? অবশ্যই ছিল। বস্তত মানবতার কল্যাণকামী হয়েই তিনি যুদ্ধ করেছেন, মানুষ হত্যা করেছেন, লাশের স্তুপ গড়েছেন, মানবতা ধ্বংস করতে নয়।
মানুষ কখনও কখনও এতই কলুষিত ও বিষাক্ত হয়ে পড়ে যখন একটা কুকুরের যে মূল্য থাকে, মানুষের প্রাণ তার চেয়েও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। দূষিত হয় সমাজ, সভ্যতা, বিশ্ব। সেই দূষণ সংক্রমিত হতে থাকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম। ন্যায়-অন্যায়বোধ বলতে কিছু থাকে না। মানুষ পশুর মত ভোগবাদী-আত্মকেন্দ্রিক-স্বার্থপরতায় ডুবে যায়। মানুষের মানবিক গুণগুলো ক্রমেই ঝরে পড়তে থাকে। অন্যদিকে পাশবিক গুনের বিস্তার ঘটে মহামারী আকারে। তখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়- মানুষ বাঁচবে নাকি মানবতা। যুধিষ্ঠির মানুষ মেরে মানবতা বাঁচিয়েছিলেন। যুদ্ধ তো মানুষেরই কর্মফল! সমাজ যখন কলুষিত হয়ে পড়ে তখন সে নিজেই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নেয় নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য।
বস্তুত এই মানবতা বাঁচানোর জন্যই আল্লাহ নরহত্যার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন, আর ওই মানবতা বাঁচানোর জন্যই যুদ্ধের নির্দেশও দিয়েছেন।
বিভাগ:
No comments:
Post a Comment