আজকের একটি জাতীয় দৈনিকের ধর্ম পাতায় পাঠকের প্রশ্ন ছিল-
ঘড়ি কোন হাতে পরতে হয়?
রাতে নখ কাটতে শরীয়তে নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা?
অমুসলিম বাবুর্চির রান্না করা খাবার খাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা?
শরীরে ইনজেকশন নিলে কি অজু ভঙ্গ হবে?
অজ্ঞান অবস্থায় যে নামাজ কাযা হয়ে যায় তা কি পরে পড়তে হবে?
যারা প্রশ্নগুলো করেছেন তাদের ব্যাপারে শেষে বলব, যারা এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন বা দিচ্ছেন আগে তাদের প্রসঙ্গে বলি। যারা উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবেন আমাদের সমাজে তারা পরিচিত মাওলানা, মৌলভী, আলেম সাহেব হিসেবে। সওয়াল-জবাব বিষয়টিকে সৃষ্টি ও আজ পর্যন্ত টিকিয়েও রেখেছেন এরাই। এর সাথে ইসলামের কতখানি সম্পর্ক তা আমি মাপতে যাবো না, কারণ সেটা আমার অনধিকার চর্চা। ফতোয়া নিয়ে কথা বলার অধিকার সবার নেই। এ নিয়ে কথা বলার জন্য আপনার প্রথমত যেটা লাগবে তা হলো আরবীয় পোশাক ও দাড়ি, দ্বিতীয়ত কোর'আনের কিছু আয়াত ও হাদীসের বাণী হুবহু মুখস্ত থাকা, তৃতীয়ত আরবী ব্যাকরণ সম্পর্কে বিশেষ করে উচ্চারণরীতি সম্পর্কে বিশেষ পাণ্ডিত্য। এই সব যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলেই আপনি একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবীদ হতে পারবেন আর তখন অন্যান্য বিষয়ের ফতোয়াবাজী করার সাথে সাথে ফতোয়া নিয়েও ফতোয়াবাজী করার অধিকার লাভ করবেন। তাই ফতোয়া নিয়ে কথা বলে নিজ কপালে নাস্তিক বা কাফের ট্যাগ ধারণ করতে আপাতত আমি রাজি নই। আমার কথা উত্তরদাতাকে নিয়ে। মানুষ অজ্ঞ। তারা নামাজ জানে না, কালাম জানে না, কোর'আন জানে না, হাদীস জানে না, আরবী জানে না, দোয়া জানে না, দরুদ জানে না, শরীয়ত জানে না, মারেফত জানে না, ইজমা জানে না, কিয়াস জানে না, তওহীদ জানে না, রিসালাত জানে না, কী যে জানে না তা-ই জানে না। অন্যদিকে আলেম সাহেবরা, ইমাম সাহেবরা, ওয়ায়েজরা কী জানেন না তা খুজে বের করা মুশকিল। তারা কোর'আনের একটা আয়াতের দশটা করে ব্যাখা জানেন, একটা হাদীসের দশ জায়গার দশ রকমের বর্ণনা জানেন, যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্বসুরীরা নিরন্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চালিয়ে, তর্ক-বিতর্ক করে যে মাসলা-মাসায়েলের পর্বত নির্মাণ করেছেন তাকে এরা ধারণ করেন। বিশাল ফিকাহ শাস্ত্র তাদের ঠোটের আগায় এসে থাকে। কোন নবীকে কীভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, কোন নবীকে সত্য বলার কারণে হত্যা করা হয়েছে, কোন নবীর কোন অনুসারীর বুকে পাথর চেয়ে নির্মম শাস্তি দেওযা হয়েছে সে ইতিহাসও তাদের পেটে ভুটভাট করছে। যখন তখন তারা সেগুলোকে উদগীরণ করে নিজেদের জ্ঞান জাহির করেন। এত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে তারা কি নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেন? পারেন না। তাই তারা জাতির প্রশ্ন শুনেন, চিন্তা করেন, উত্তর দেন। এমন কোনো প্রশ্ন নাই যার উত্তর তারা দিতে পারেন না। আমার দীর্ঘ ২০ বছরের জীবনে কোনো মোল্লার কাছে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করে উত্তর পাওয়া যায় নি এমন ঘটনা একটাও দেখি নি। কারণ সম্ভবত তারা সর্বজ্ঞ। তারা সর্বসেরা। তাদের জ্ঞানের কোনো শেষ নেই। কোনো পরিধি নেই। তাদের কোনো ভুল নেই। কোনো অপরাধ নেই। অতএব বোঝা গেল, সাধারণ মানুষ যতখানি অজ্ঞ, মোল্লারা ঠিক ততখানিই বিজ্ঞ। অন্যদিকে এই মহান বিজ্ঞজনেরা যেহেতু ইসলামী জ্ঞানের ধারক ও বাহক, সুতরাং তাদের কোনো অপরাধও নেই। তারা ফুলের চেয়েও নিষ্পাপ, সূর্যের চেয়েও প্রতাপশালী। কিন্তু রাত না থাকলে যেমন দিনের মূল্য কেউ দিতো না, অসুন্দর না থাকলে সুন্দরের মূল্য বুঝতো না, তেমনই অজ্ঞ সাধারণ মানুষ যতদিন আছে, ততদিনই বিজ্ঞরা এক্সট্রা সম্মানের অধিকারী হয়ে বাচতে পারবে। অজ্ঞরা যদি একবার বিজ্ঞদের মুখাপেক্ষী হওয়া ছেড়ে দেয়, নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করে নিতে শিখে, ধর্মীয় বিষয়ে নিজেরাই কোর'আন-হাদীস বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে তাহলে এদের জ্ঞানসমুদ্র শুকিয়ে মরা জলাশয়ে পরিণত হবে অল্প দিনেই। সুতরাং আর যাই হোক- অজ্ঞ মানুষ তাদের প্রয়োজন। আপনি অজ্ঞদের দলে থাকলে তাদের মঙ্গল। আপনি জানেন না, আপনি বুঝেন না- এ কথা তাদেরকে স্বর্গের সুখ প্রদান করে। এরপর জানার জন্য যখন তাদের দুয়ারে কড়া নাড়েন তখনই কেবল তারা জ্ঞানের প্রকৃত সার্থকতা উপলব্ধি করেন। নিজের অজান্তেই বলে উঠেন- আলহামদুলিল্লাহ। তাদের নিজেদের জ্ঞানকে সার্থক করার জন্য তাই দরকার আপনার জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করা। আপনাকে ছোট করা, খাটো করা। এ কারণে আপনার মতো বা আমার মতো সাধারণ মানুষ যখন ইসলাম নিয়ে কোনো বক্তব্য পেশ করতে চায়, মাকড়শার জালে আটকে পড়া জাতিটিকে বন্ধন ছিন্ন করে মুক্ত করতে চায় তখন তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাদের আশঙ্কা প্রশ্ন হয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে- তোরা ইসলামের কী বুঝিস? ইসলাম এত সহজ? তোরা আরবী জানিস? মুখে দাড়ি আছে? আসলে তারা ইসলাম নিয়ে ভাবেন না, ভাবেন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে। কথিত বিজ্ঞ সম্প্রদায়ের ওই স্বার্থের বেদিতে বলি হয় কথিত অজ্ঞ সম্প্রদায়। তবু এই অজ্ঞরা ইসলাম শিখতে কথিত বিজ্ঞদের কাছেই যাবে, এবং প্রতারিত হবে। পতঙ্গ যেমন আগুনের শিখা দেখে ঝাপিয়ে পড়ে, তারাও ঝাপিয়ে পড়বে। তাদেরকে বাচাবে কে যখন তারা নিজেরাই নিজেদেরকে আগুনের মাঝে সোপর্দ করছে? পত্রিকার ধর্ম পাতায় প্রকাশিত পাঠকদের প্রশ্নগুলো আরেকবার পড়ার অনুরোধ করছি। প্রশ্নগুলো পড়ুন, বারবার পড়ুন। ওই প্রশ্নগুলোর মাঝেই বর্তমান মুসলিম জাতির স্পষ্ট চিত্র ফুঠে উঠেছে। সমস্ত পৃথিবী যখন এ জাতির শত্রুতে পরিণত হয়েছে, প্রতিদিনই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যে জাতি নির্যাতিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, অনেক জায়গায় নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের নেশায় মাতাল হয়ে আছে, তখন এই জাতির ধর্মভীরু মানুষগুলো জাতির নিশ্চিত ধ্বংস দেখেও বিচলিত নয়, যতখানি বিচলিত ঘড়ি ডান হাতে পরতে হবে নাকি বাম হাতে, অজ্ঞান অবস্থায় নামাজ কাযা হলে আবার নামাজ পড়তে হবে কিনা, অমুসলিম বাবুর্চির হাতের রান্না খাওয়া যাবে কিনা- এই সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে। এদের এই কূপমণ্ডূকতা, এই অজ্ঞতা, এই মুর্খতা তথা এই হাস্যকর অবস্থার জন্য কাদের দায়ী করবেন? আল্লাহকে? রসুলকে? ইসলামকে? নাকি এদের অজ্ঞতাপূর্ণ ও মুর্খতায় ভরা এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য যারা নিরন্তর ফিকাহর পাতা মুখস্ত করে চলেছে সেই বিজ্ঞজনদের? - See more at: http://www.istishon.com/?q=node/17980#sthash.QaYoBGdA.dpuf
No comments:
Post a Comment