
মুসলমানরা প্রথম ঈদ উদযাপন করে মদীনায়, মদীনা সনদের ভিত্তিতে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ নিরাপদ রাষ্ট্র ঘোষিত হবার পর। মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না- এই ছিল আল্লাহর রসুলের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি।
এই নীতির আলোকে সকল ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করেছে এমন ইতিহাস কেউ দেখাতে পারবেন না। আগে পারস্পরিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে, সন্ত্রাস সৃষ্টির রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে, তারপর এসেছে উৎসবের বিধান। কারণ এটা কমন সেন্স যে, আনন্দ-উৎসব কেবল সেখানেই মানায় যেখানে অনিরাপত্তা ও অশান্তি নেই, সন্ত্রাস ও রক্তপাত নেই, সাম্প্রদায়িক সংঘাত নেই।
আজ ঈদ। বাংলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে আনন্দের জোয়ার বইছে। কিন্তু ঈদ উদযাপনের পূর্বশর্ত যে শান্তি, সম্প্রীতি ও সকল ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- তার বাস্তবিক অবস্থা কী সেটা আমরা সকলেই জানি। ঈদের দিনেই দেশের সবচাইতে বড় জামাতের পাশে ভয়াবহ বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছে দুই পুলিশসহ চারজন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধারাবাহিকভাবে ঘটছে এসব। শুধু চলতি বছরে সারা দেশে অন্তত ২৬ জন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে, জবাই করে বা গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ে যজ্ঞেশ্বর রায় নামের হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস। এরপর ৩০ এপ্রিল জবাই করে নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দার হত্যা এবং ১৪ মে বান্দরবানে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে জবাই করে হত্যা করা হয়। এরপর ২০ মে কুষ্টিয়ায় একজন অমুসলিম হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারকে হত্যা করা হয় এবং একইদিনে নাটোরে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গমেজকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জবাই করে হত্যা করা হয়। খ্রিস্টান হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস। তারপর ৭ জুন ঝিনাইদহে বৃদ্ধ পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে এবং ১০ জুন পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দায় স্বীকার করে আইএস। এর কিছুদিন পর ১ জুলাই ঝিনাইদহে হিন্দু সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে ও বান্দরবানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগ নেতা মংশৈনু মারমাকে হত্যা করা হয়। সেদিনই দিবাগত রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারী রেস্তোরায় হামলা চালিয়ে ১৭ জন বিদেশি ও ৩ জন বাংলাদেশিকে জবাই করে হত্যা করে। পরদিন সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় হিন্দু পুরোহিত ভবসিন্ধু বরকে কুপিয়ে আহত করা হয় এবং কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের নগুয়া এলাকায় বিবেকানান্দ পাঠাগার ও মন্দিরের সেবায়েতের উপর হামলা হয়।
দেশের অবস্থা যখন এই, ভিন্নধর্মের মানুষের প্রাণ যখন তলোয়ারের নিচে ঝুলছে, সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া হামলায় সরকার চিন্তিত ও প্রশাসন দিশেহারা; সিরিয়ার মত ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা, তখন কোথায় সারা জাতিতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হবে, হামলার শিকার ও হুমকির মুখে থাকা ভিন্নধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সকলে মিলে উঠেপড়ে লাগবে, ইসলামের নামে ভিন্নধর্মের মানুষ হত্যার ঘটনায় মুসলমানরা লজ্জিত হয়ে শোচনীয় আত্মগ্লানিতে ডুবে থাকবে, তা নয় তারা তারা বুঁদ হয়ে আছে ঈদের আনন্দে।
সবার আনন্দ-উৎসবের বাহার দেখলে মনেই হবে না দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বগলে জায়নামাজ আর মাথায় টুপি পরে হাজার হাজার মানুষ শোলাকিয়ার ইদগাহে গেল, নামাজ পড়ল, হাসিমুখে বাড়ি ফিরে গেল, কিন্তু তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে যে দুইজন পুলিশ সদস্যকে প্রাণ হারাতে হলো, আহত হয়ে জীবনসঙ্কটের মুখোমুখী হলো আরও অন্তত দশজন পুলিশ সদস্য, তাদের নিয়ে ওই নামাজীদের কোনো মাথাব্যথা আছে কি? নেই। তারা ঠিকই বাড়িতে গিয়ে পোলাও-কোর্মা নিয়ে বসে পড়েছেন।
দেশ, জাতি ও মানবতার সঙ্কটকালে ঈদের নামে এই পাশবিক উল্লাসকে ধিক্কার জানাই। আমাকে কেউ ঈদ মোবারক বলবেন না।
বিভাগ:
No comments:
Post a Comment