Sunday, July 10, 2016

প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ কে?


‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি যেন গোলআলুতে পরিণত হয়েছে, যে যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করছে, নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে প্রত্যেকে ধর্মনিরপেক্ষতার যুগসই ব্যাখ্যা প্রদান করছে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ সংবিধানের চারটি মূলনীতির অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও এদেশের মানুষের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ এখনও আলো-আঁধারে ঢাকা। কোন পরিস্থিতিতে কোন আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম হলো, কীভাবে সেটা অতি দ্রুত সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল এবং কী ফল বয়ে আনল সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন এমন সচেতন মানুষ এদেশে খুব কমই আছেন। ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতা হলো রাষ্ট্রীয় বিষয়, একটি রাজনীতিক সিস্টেম, অথচ সম্যক ধারণাহীনতার কারণে আজকাল অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে থাকেন, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব ধারণা। অবশ্য রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতাও যে খুব বাস্তব তা বলছি না।
ধর্মনিরপেক্ষতা কী- এই বিভ্রান্তিটার আগে নিরসন হওয়া দরকার। বস্তুত বাংলায় যেটাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হচ্ছে এবং ব্যাখ্যাসাপেক্ষে যেসব অর্থ করা হচ্ছে, ইংরেজি সেক্যুলারিজম (Secularism) শব্দে সেই জটিলতা নেই। সহজ একটি টার্ম- সেক্যুলারিজম, যা নির্দেশ করে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার যাতে রাষ্ট্র বা সরকারের সাথে ধর্মের কোনো যোগাযোগ থাকবে না অর্থাৎ ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র তার জনসাধারণের মধ্যে কে কোন ধর্ম পালন করল, কে করল না সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করবে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার-দণ্ডবিধি, শিক্ষাব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে ধর্মের কোনো প্রবেশাধিকার থাকবে না। যে কোনো মতবাদ, তন্ত্র বা ইজম রাষ্ট্র যাচাই-বাছাই করে দেখবে, পছন্দ হলে গ্রহণ করবে, অপছন্দ হলে ছুঁড়ে ফেলে দিবে কিন্তু ধর্ম যতই বাস্তবিক রাষ্ট্রীয় নীতি, বিচারব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি হাজির করুক তা শুধু এই যুক্তিতে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে যে, সেটা ধর্র্মীয় মতবাদ।
এখন দেখা যাক বাস্তবতা। আমাদের দেশের রাজনীতিক অঙ্গনে ধর্ম বরাবরই এক নাম্বার ইস্যু হয়ে থাকে, অথচ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত আজ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ এবং একই সাথে ধর্মীয় উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চারণক্ষেত্র। (ধর্মীয় ইফতার মাহফিলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর মুনাজাতের ছবি আশা করি সকলেই দেখেছেন) ধর্মনিরপেক্ষ মিয়ানমারে চলছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি দমন-পীড়ন-নির্যাতন। এশীয়ার বৃহৎ পরাশক্তি ধর্মনিরপেক্ষ চীন সে দেশের উইঘুর মুসলিমদের রোজা রাখা ও দাড়ি রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মুসলিমদেরকে তারা স্বজাতি বলেই মনে করে না। ধর্মনিরপেক্ষতার তীর্থভূমি ইউরোপ আমেরিকায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অস্বাভাবিক বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে মুসলিম সংখ্যালঘুদের। রাষ্ট্র সেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, নিরপেক্ষও নয়, বরং অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক। আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান প্রকাশ্যে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিল, তবু তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাতে ব্যাঘাত ঘটল না। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো প্রত্যহ বাক-স্বাধীনতার ছবক দেয়, তারাই অনর্গল ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণায় নিত্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। তাহলে কে ধর্মনিরপেক্ষ? আসলে ধর্মনিরপেক্ষ বলে কোনো রাষ্ট্র নেই, কোনো জাতি নেই, থাকা সম্ভবও নয়।
পশ্চিমা বিশ্ব বর্তমানে যে সফলতার আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলছে তা যে রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতারই দান তা অস্বীকার করছি না, তবে ওই ধর্মনিরপেক্ষতা শাশ্বত নয়। যে আদর্শ পশ্চিমা বিশ্বে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের সফলতা এনে দিয়েছিল সেটা বর্তমান সময়ে এসে সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের সকল মানুষকে সফলতার স্বাদ আস্বাদন করাবে এমনটাও তো আশা করা যায় না। তাছাড়া পাশ্চাত্যের সফলতার দিক বিবেচনা করুন, বুঝতে পারবেন পাশ্চাত্যের যত উন্নতি সব বস্তুগত ও অর্থনীতিসম্পর্কিত। যখন থেকে পাশ্চাত্য ধর্ম ছেড়েছে এবং জাতীয় ধর্মহীনতার চাপে ব্যক্তিগতভাবেও মানুষ যতই বস্তুবাদী হতে শুরু করেছে ততই আধ্যাতিক বা নৈতিক দিক দিয়ে সমাজ অধঃপতিত হয়েছে। এই নৈতিক অধঃপতনেরই চূড়ান্ত রূপ হলো চরম ভোগবাদী জীবনযাপন, বিবাহ ও পারিবারিক কাঠামো ধ্বংস, অবৈধ কুরুচিপূর্ণ যৌনাচার, চরম মানসিক বিকারগ্রস্ততা ও শেষ জীবনের হতাশা। অর্থনীতিক সমৃদ্ধিই যে একমাত্র সফলতা নয়, তা পাশ্চাত্য দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। আর ধর্মকেও যে ইচ্ছা করলেই রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখা যায় না, সেটাও বোধ করি এতদিনে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে যোগ হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার জন্মলগ্নে ইউরোপের সামনে দু’টি পথ ছিল, হয় ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করে নাস্তিক হয়ে যাওয়া, নয়তো ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনের সংকীর্ণ পরিধির মাঝে নির্বাসন দেওয়া। সেই সিদ্ধান্তের পরিণতি ভোগ করা থেকে আজ পৃথিবীর কেউ বাদ নেই। ইউরোপ-আমেরিকা ভোগ করছে ব্যক্তিজীবনে ধর্মবিশ্বাস না থাকার পরিণতি, আর আমরা ভোগ করছি ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসকে অপপ্রয়োগের পরিণতি। এ ব্যর্থতা আর কারও নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা নামক অপ্রাকৃতিক ও অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার। ধর্মকে মুছে ফেলার ব্যর্থ প্রয়াস না চালিয়ে যদি তারা ধর্মের বিকৃতিগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারত, মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঠিক প্রয়োগ ঘটানো যেত, কতই না ভালো হতো।
এদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়ে অনেকে রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যক্তিগত জীবনেও চর্চা করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এরা আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বুঝেন ও বোঝাতে চান তা পরিষ্কার নয়। যদি বলি- আমি ভাষানিরপেক্ষ, কোনো অর্থ হয়? ভাষানিরপেক্ষ অর্থ দাঁড়ায় যে কোনো ভাষাতেই বিশ্বাসী নয়, অর্থাৎ ভাষাহীন, নির্বাক। একইভাবে পুরুষ হয়েও যদি বলি আমি লিঙ্গনিরপেক্ষ, সেটারও কোনো অর্থ হয় না। সব কিছুতে নিরপেক্ষতা চলে না। প্রকৃতির দিকে লক্ষ করুন, ধ্বংস হবার অসংখ্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই পৃথিবী লক্ষ-কোটি বছর অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখনও স্বাভাবিক রয়েছে একমাত্র তার স্বীয় ধর্ম মেনে চলার কারণে। সমগ্র সৃষ্টিজগৎ, গ্রহ-উপগ্রহ, তারকারাজি, জীব-অনুজীব, উদ্ভিদকূল, প্রাণীকূল লাখো-কোটি বছর টিকে আছে নিজ নিজ ধর্ম মেনে। এক মুহূর্তের জন্যও যদি সেই ধর্ম থেকে তারা বিচ্যুত হতো আজ হয়তো তাদের অস্তিত্বই থাকতো না। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান নেই। অথচ মানুষ হয়ে, আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ হবার ভান করি। প্রশ্ন করতে পারেন- সৃষ্টিজগতের ধর্ম আর মানুষের ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম ইত্যাদি কি সমার্থক? হ্যাঁ, সমার্থক, কিন্তু আমরা সেটা বুঝিনা আমাদেরই অজ্ঞতার কারণে। পৃথিবীতে প্রচলিত সকল ধর্মের উৎপত্তি এক স্রষ্টা থেকেই, তিনিই যুগে যুগে নবী-রসুল-অবতার পাঠিয়ে পথভ্রষ্ট মানুষকে সঠিক পথের দিশা প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে মানুষ সেগুলোকে নিজেদের স্বার্থে বিকৃত করেছে, মতভেদ করেছে। যখন তাদের বিকৃতিকে শুধরে দেবার জন্য নতুন কোনো পথনির্দেশক এসেছেন, তাদের কেউ তাকে গ্রহণ করেছে, কেউ করে নি। যারা করে নি তারা আগের ধর্মের বিকৃত রূপকেই আকড়ে ধরে রেখেছে আর যারা নতুন নবীকে গ্রহণ করল তাদের পালিত ধর্ম নতুন নামে পরিচিত হয়েছে। এভাবেই বিভিন্ন ধর্মের জন্ম। প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মের অন্তর্গত সত্য হলো- মানবতার কল্যাণ। মানবতাই মানবধর্ম। যার ভেতরে মানবতা আছে সে ধার্মিক অর্থাৎ মানুষ, আর যার ভেতরে মানবতা নেই সে অধার্মিক অর্থাৎ পশু। এখানে নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইতালীর কবি দান্তে বোধহয় এ কারণেই বলেছিলেন যে, The hottest place in hell are reserved for those who, in time of moral crisis maintain their neutrality. অর্থাৎ জাহান্নামের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান লাভ করবে ওইসকল ব্যক্তি যারা নৈতিক সঙ্কট উপস্থিত হলে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলে। - See more at: http://www.istishon.com/?q=node/16493#sthash.RpkZPMmg.dpuf

No comments:

Post a Comment