Saturday, September 10, 2016

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে, নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে নয় কেন?

স্বাধীনতার পর আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ‘দারিদ্র্য’। গত চার দশক ধরে দরিদ্রতার বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই চালিয়ে এসেছি আমরা। লড়াই এখনও চলছে ও চলবে। তবে ইতোমধ্যেই আমরা সফলতার পাল্লাকে কিছুটা হলেও ভারি করতে পেরেছি- এটা বলাই যায়। গড়পরতা হিসাব করলে সাধারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে স্বচ্ছল। আধুনিক প্রযুক্তিতে কৃষিকাজ, শিল্প কারখানার প্রসার, বিদেশি রেমিটেন্স ও দেশে-বিদেশে ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং জনগণের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে।
.
যে কিশোরকে দেখেছি সারাদিন পচা পানিতে শালুক তুলে চামড়া কালো করে বাড়ি ফিরেছে, খোঁজ নেয়ারও কেউ ছিল না, সিদ্ধ শালুক খেয়ে দিনাতিপাত করেছে, সে জায়গা-জমি বেচে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমানোর পর এখন লাখোপতি হয়েছে। দেশে বছর বছর জমি কিনছে। দেখেছি দিনমজুর বাবাদেরকে, যারা সারাদিন মাঠে-ঘাটে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে ৭০-৮০ টাকা পারিশ্রমিক হাতে বাড়ি ফিরেছেন। সন্ধ্যায় ছেলেমেয়ে একটু আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমোবে- অভাবের সংসার বাধ সেধেছে তাতেও। অসুস্থ মা সারাদিন অন্যের বাড়িতে ধান ভেঙে খুদ হাতে বাড়ি ফিরেছে। সেই খুদের জাও খেয়ে ছেলে-মেয়েরা রাত কাটিয়েছে। নতুন বউ নতুন শাড়ি পরেছে সেই বিয়ের দিন। তারপর কত বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন শাড়ি পরার সৌভাগ্য আর আসে নি। স্কুলের ফার্স্ট বয় স্কুল শেষে বা স্কুল কামাই করে অন্যের ক্ষেতে কামলা খেটেছে, নিজের পড়ার খরচ নিজেকেই যোগাতে হয়েছে। এভাবে একের পর এক জেনারেশন পার হয়ে গেছে।
.
কিন্তু এখন দিন বদলেছে। প্রতিনিয়ত গ্রামে-গঞ্জে পাকা দালান উঠছে। বাড়ির বউরা নিত্য নতুন শাড়ি পরছে। সংসারের আয় বেড়েছে। ঘরের কাছে ব্যাংক হয়েছে, বুথ হয়েছে। রাস্তা পাকা হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎ এসেছে। ঘর ঘরে চলছে টিভি, শোভা পাচ্ছে ফ্রিজ, দামী আসবাবপত্র। হাতে হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট। ডিশ এন্টেনার সংযোগ সর্বত্র। সাইকেল বেচে কেনা হচ্ছে মোটর সাইকেল। পায়ে ঠেলা ভ্যানের দখল নিচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা, সিএনজি। না খেয়ে রাত পার করে এমন মানুষ আজ চোখে পড়া দায়। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি না করেও বউ-বাচ্চা নিয়ে বেঁচে থাকার মত অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ক্ষেতের শ্রমিকদের (স্থানীয় ভাষায় কামলা) ডিমান্ড বেড়েছে। হাজার খোঁজাখুঁজি করেও ক্ষেতের শ্রমিক পাওয়া যায় না। ছেলে-মেয়েরা বাবা-মার কাছে শখের জিনিস কিনতে বায়না ধরছে। বাচ্চারা এখন বাঁশের পাতার নৌকা চালায় না। তারা চালাচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি, ড্রোন, হেলিকপ্টার। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমরা কিছুটা হলেও সফল হয়েছি।
.
কিন্তু একটি জাতিতে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার চেয়েও বেশি প্রয়োজন যে সামাজিক নিরাপত্তা, সেই ‘নিরাপত্তা’র বাস্তবিক অবস্থাটাও ভেবে দেখা দরকার। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আমরা যতটা সচেতন, নিরাপত্তার প্রশ্নে তার চেয়েও বেশি সচেতন থাকার কথা ছিল। দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারের যত অঙ্গীকার, কর্মপরিকল্পনা ও আমাদের যত প্রত্যাশা, সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতেও সরকার ও জনগণের ততটাই সোচ্চার হবার কথা ছিল। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কয়জন লড়াই করছি, আমাদের রাষ্ট্র এ বিষয়ে কতটা জোর দিচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় অনায়াসেই।
.
এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বস্তুগত উন্নতির সূচকে জাতি হিসেবে আমরা যতটা উপরে উঠেছি, আত্মিক বা নৈতিকভাবে ততটাই নিচে নেমে গেছি। ইতিহাসের সবচাইতে অনিরাপদ সময় অতিক্রম করছি আমরা। সামান্য স্বার্থের বশবর্তী হয়ে মানুষ পাশবিক আচরণ করতে দ্বিধা করছে না। বাবা সন্তানকে গলাটিপে মারছে। সন্তান বাবার গলায় ছুরি চালাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, ব্যাভিচার প্রতারণা, জালিয়াতি। রক্ষকরা হয়ে উঠছে ভক্ষক। রাজনৈতিক হানাহানি, রক্তারক্তি, চরমপন্থা পৌঁছেছে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে। অফিস, আদালত, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ তো বটেই, এমনকি নিজ বেডরুমেও মানুষ নিরাপত্তাবোধ করে না। অজানা আতঙ্ক, অজানা আশঙ্কা মানুষের নিত্যসঙ্গী। ছোট ছোট শিশুদেরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে, গলা কেটে, শ্বাসরোধ করে, ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হচ্ছে। নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, হত্যা শত আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। আরও আছে। বলে শেষ করা যায় না। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ফিরিস্তি বর্ণনা করতে গেলে একটা ‘বই’ হয়ে যাবে।
.
জাতির অর্থনৈতিক অগ্রাযাত্রার বিপরীতে সামাজিক নিরাপত্তার এই যে করুণ চিত্র, এর বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে, জাতীয়-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের সংগ্রামে অবতীর্ণ না হলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের সমস্ত অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা যদি কোনো ভবনের খাট-পালঙ্ক, দরজা-জানালা হয়ে থাকে, নিরাপত্তা হচ্ছে সে ভবনের খুঁটি। খুঁটি কার্যকারিতা হারালে পুরো ভবনটিই ধ্বসে পড়বে। মূল্যবান আসবাব গড়াগড়ি খাবে ধুলোমাটিতে।
.
আমাদের তরুণরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার জন্য সাত-সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিচ্ছে, কিন্তু এই নিরাপত্তাহীনতা থেকে বাঁচার জন্য তারা কী করবে সেটা ভাবা হচ্ছে তো?
LikeShow more reactions
Comment
3 Comments
Comments
Aminul Islam Aminul সঠিক, সহমত
Farid Ahmed Musafir বন্ধু,পুঁজিবাদ হচ্ছে অনেকটা রেইসলিং রেইসলিং খেলা |জিতলে মেডেল|হারলে লাতির কাঠাল| তাই সিলেটগামী ট্রেনে উঠে ঢাকা পৌছার স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়ন হয়না|
Asad Ali ধরে নিলাম পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে অন্য কোনো ব্যবস্থায় ভালো ফল পাওয়া গেল, দারিদ্র্য একেবারেই নির্মূল হয়ে গেল, কিন্তু দারিদ্র্যের চাইতেও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নিরাপত্তাহীনতা, তার কী হবে? সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় কী?
Farid Ahmed Musafir বন্ধু, আপনার প্রশ্নের জন্য অশেষ ধন্যবাদ |||| আসলে নিরাপত্তাহীনতার উৎসটা কি? শুধু নিরাপত্তাহীনতা নয়, সবকিছুর নষ্টের মুল উৎস হচ্ছে ব্যাক্তি মালিকানা| লাগামহীন ব্যাক্তি মালিকানা মানুষকে হায়েনার চেয়ে ও নিকৃষ্ট করতে পারে|পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে উঠেছে ব্যাক্তি মালিকানার নামে লুটপাটের কারবার |উক্ত লুটপাটের মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত কিছু লুটপাটকারীদের দখলে চলে গিয়েছে|হাতে গোনা কয়েক শত লুটপাটকারীদের দখলে চলে আজ গিয়েছে গোটা বিশ্বের সম্পদ|ঐসব লুটপাটকৃত অবৈধ সম্পদ পাহারা দেওয়ার জন্য এখন গড়ে উঠেছে বিশাল এক সিকিউরিটি সমাজ ব্যাবস্হা|এবং উক্ত সিকিউরিটি ব্যাবস্হার চুড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা|

No comments:

Post a Comment