হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে ২০১৩-১৪ সালে ‘দৈনিক দেশেরপত্র’ নামক একটি জাতীয় পত্রিকা সম্পাদনা করা হত। পত্রিকাটির সাপ্তাহিক সংকলনে অনেক লেখক-গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাপানো হত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়েও অনেক মতামত থাকত ওইসব প্রবন্ধে। যে কারণেই হোক বর্তমানে পত্রিকাটি আমাদের হাতে নেই, আমরা এখন দৈনিক বজ্রশক্তি নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছি। কিন্তু ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, একটি শ্রেণি দুই বছর আগে প্রকাশিত দৈনিক দেশেরপত্রের ওসব গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের খণ্ডিত কিছু লাইন উল্লেখ করে লিফলেট বানিয়ে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ও ঘৃণা বিস্তারের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের কোনো অংশবিশেষের বিরুদ্ধে যদি কারো কোনো আপত্তি থাকে তাহলে সেটার জন্য যথাযথ নিয়মে তারা পত্রিকা অফিসে প্রতিবাদ পাঠাতে পারেন, প্রতিবাদের জবাব মনঃপুত না হলে আদালতে মামলা করতে পারেন। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্টসহ সংবাদপত্রের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যেসব আইন-কানুন, শক্ত নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, তার সহায়তা নিতে পারেন যে কেউ। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে পত্রিকার বিভিন্ন প্রবন্ধের খ-িত বক্তব্য সংবলিত লিফলেট প্রচার করে একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো এবং ধর্মভীরু মানুষকে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের উসকানি দেওয়া নৈতিক ও আইনগত বিচারে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া যখন ওই প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয়েছে তখন তারা সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। কয়েক বছর পর আজ হঠাৎ কেন হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলেন সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন।
সম্মানিত আলেম সাহেবদের প্রতি আমাদের অনুরোধ হচ্ছে আপনারা আমাদের বক্তব্যগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। যে প্রবন্ধগুলোকে খ-িত আকারে উপস্থাপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে সেসব প্রবন্ধের মূল বক্তব্যগুলো আমরা আপনাদেরকে জানাতে চাই। অতঃপর আমাদের বক্তব্যের কোথাও ভুল রয়েছে কিনা, ইসলামবিরোধী কিছু বলা হয়েছে কিনা, উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া কোনো বক্তব্য পেশ করা হয়েছে কিনা সেটা আপনারাই বিবেচনা করবেন এবং যদি ভুল মনে হয় অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন।
আমাদের ম্যাগাজিন থেকে কয়েকটি খ-িত লাইন টেনে অপপ্রচারকারীরা বলতে চায় আমরা নাকি দাবি করেছি ‘প্রাক-ইসলামী কোনো ধর্মকে আল্লাহ বাতিল করেন নি, তাই অন্য ধর্মের মানুষও জান্নাতে যাবে, অন্য ধর্মের বিধান মোতাবেক বিচার-ফয়সালা করা যাবে।’’ তারা ২০১৪ সালে প্রকাশিত দৈনিক দেশেরপত্রের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের (সংখ্যা ২৪) যে প্রবন্ধটির রেফারেন্স দিয়ে এই অভিযোগ করেন তার শিরোনাম ছিল ‘আল্লাহর পছন্দনীয় ধর্ম কোনটি’। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক রিয়াদুল হাসান। তিনি কোর’আন হাদীস থেকে উপযুক্ত যুক্তি-তথ্য সহকারে প্রমাণ করেছেন যে, ‘কোর’আনের কোথাও আল্লাহ পূর্ববর্তী ধর্মের ঐশী ধর্মগ্রন্থগুলোকে রদ করা বা বাতিল করার ঘোষণা দেন নি।’ বাতিলের ঘোষনা তো দেনই নি, উপরন্তু কোর’আনকে আল্লাহ পূর্ববর্তী কিতাবগুলোর সত্যায়নকারী ও সমর্থক বলে উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ বলেন-
‘তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি কেতাব (কোর’আন) অবতীর্ণ করেছেন যা তা পূর্বের কেতাবের ‘সমর্থক’। আর তিনি অবতীর্ণ করেছেন তওরাত ও ইঞ্জিল (সুরা ইমরান ৩)।’ আরেকটি আয়াতে বলেন- ‘হে মোহাম্মদ, আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সুরা মায়েদা: ৪৮)।’
এই আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইবনে কাসির লিখেছেন,
‘‘কোর’আনে যা কিছু রয়েছে, পূর্ববর্তী কিতাবগুলোতে সেগুলোই ছিল।’’
সুতরাং আল কোর’আন পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোকে বাতিল করে না, সমর্থন করে ও সত্যায়ন করে- এটা আমাদের কথা নয়, আল্লাহর কথা। লেখক তার প্রবন্ধে এ কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন মাত্র।
আল্লাহ আরও বলেন,
‘‘বলুন, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের উপর, ইব্রাহীম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তাঁদের সন্তানবর্গের উপর, আর যা কিছু পেয়েছেন মুসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবী রসুলগণ তাঁদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে (সুরা ইমরান: ৮৩-৮৪)।’’
এই আয়াতটিতেও স্পষ্টাক্ষরে আল্লাহ বলে দিয়েছেন কার কার প্রতি ঈমান আনা মু’মিনদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর উপর, আখেরী নবীর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব কোর’আনের উপর এবং পূর্বের নবী-রসুলগণের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবগুলোর উপর। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থগুলোকে বাতিল করা তো দূরের কথা, সেগুলোর প্রতি ঈমান না রাখলে কারও ঈমানই পূর্ণ হবে না। কোর’আনের পাশাপাশি পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতেও ‘ঈমান’ রাখতে হবে- এটাই আল্লাহর ঘোষণা।
এখানে ‘পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতেও ঈমান রাখতে হবে’ বলতে এটা বোঝানো হচ্ছে না যে, মো’মেনরা কোর’আন ছেড়ে তওরাত-ইঞ্জিলের বিধান সন্ধান করবে। এমন ধারণা করলে ভুল হবে। মো’মেনরা অবশ্যই কোর’আনের বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করবে, কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোও আল্লাহর পক্ষ থেকেই নাজেলকৃত। তবে ওগুলো সার্বজনীন নয়। নির্দিষ্ট স্থান-কালের জন্য নাজেল হয়েছিল। ফলে যুগের প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হবার সাথে সাথে ওই কিতাবগুলোর অনেক বিধান আজ অকার্যকর হয়ে গেছে। তাছাড়া আল্লাহর দেওয়া বিধানকে বদল করে নিজেদের খেয়াল খুশিমত বিধান রচনা করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে (সুরা বাকারা ৭৯)। সব মিলিয়ে ধর্মগ্রন্থগুলো এখন আগের জায়গায় নেই, অনেকাংশে বিকৃত হয়ে গেছে যা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। কিন্তু এত বিকৃতি সত্ত্বেও এটা ভুলে যাওয়া চলবে না যে, ওগুলোতেও অনেক ঐশী সত্য আছে। সত্য যে আছে তার প্রমাণ আজও বাইবেল, তওরাতসহ পূর্বের যে কোনো ধর্মগ্রন্থ খুলে দেখুন আল কোর’আনের সাথে শত শত বাক্যের মিল পাবেন। এই ‘সত্যগুলো’কে শুধু কি এই কারণে অস্বীকার করা হবে যে এগুলো পূর্বের নবী-রসুলদের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে?
আমাদের কথা হচ্ছে ইসলাম একটি সার্বজনীন দ্বীন। এই দ্বীনকে যারা ধারণ করবেন তাদেরকেও সার্বজনীন চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অন্য দশটা সম্প্রদায়ের মত নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডিতে বা খোপে আবদ্ধ হয়ে থাকা মো’মেনদের শোভা পায় না। বর্তমানে ইহুদি ধর্ম, খৃষ্টধর্ম ইত্যাদির মতই ইসলামকে নিছক আরেকটি ধর্মবিশ্বাস বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ইসলাম হচ্ছে পূর্বের সমস্ত নবী-রসুলের মাধ্যমে আসা দ্বীনের শাশ্বত, পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন সংস্করণ। সুতরাং এই দ্বীনকে অন্যান্য দ্বীন থেকে পৃথকভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ নেই। আল্লাহর নবী বলেন-
‘‘আমরা নবীরা পরস্পরের ভাই, আমাদের সবারই দ্বীন এক (অর্থাৎ ইসলাম)।’’
আমরা যদি গোড়ায় যাই দেখব দ্বীন মূলত দুইটি। আল্লাহর প্রেরিত দ্বীন এবং মানুষের নিজের তৈরি করে নেওয়া দ্বীন। এর মধ্যে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য দ্বীন কোনটা? এ প্রশ্নেরই উত্তর আল্লাহ দিচ্ছেন যে, ‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন হচ্ছে ইসলাম (ইমরান ১৯), অর্থাৎ যেটা তিনি যুগে যুগে তাঁর নবী-রসুলগণের মাধ্যমে মানবজাতিকে প্রদান করেছেন সেটা; যার শেষ ও চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে এসেছেন বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)। এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ তাঁর প্রেরিত দ্বীন অর্থাৎ ইসলামের বিপরীতে মানুষের যাবতীয় মনগড়া দ্বীনগুলোকে বাতিল করেছেন, আহলে কিতাবীদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বাতিল করেন নি।
পত্রিকার ম্যাগাজিনে লেখা হয়েছে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ দিয়েও বিচার-ফয়সালা করা যাবে। এ কথাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে একটি শ্রেণি হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে। এটা নাকি ইসলামবিরোধী কথা যদিও আমাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে কোর’আন-হাদীসভিত্তিক যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসে পাই মহানবী মোহাম্মদ (সা.) যখন মদীনায় রাষ্ট্রশক্তির অধিকারী হলেন তিনি ইহুদি বা খ্রিস্টানদের উপর কোর’আনের বিধি-বিধান চাপিয়ে দেন নি। এবং ইহুদিরাও আল্লাহর রসুলকে শাসক হিসাবে মেনে নিলেও বিচারক হিসাবে মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আল্লাহর রসুল তখন তাদেরকে তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তওরাতের বিধান দিয়েই বিচার করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তওরাতে যে বিধান দিয়েছেন সেই বিধান যদি ইহুদিরা মান্য করে সেটাই যথেষ্ট। বরঞ্চ আল্লাহ সেদিকেই তাদেরকে আহ্বান করেছেন, কোর’আন মানতে বাধ্য করেন নি। কারণ তওরাতও আল্লাহরই হুকুম। তিনি পবিত্র কোর’আনে প্রশ্ন রেখেছেন যে,
“তারা আপনাকে কেমন করে বিচারক নিয়োগ করবে অথচ তাদের কাছে তওরাত রয়েছে। তাতে আল্লাহর নির্দেশ আছে। অতঃপর তারা পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা কখনোই বিশ্বাসী নয়। আমিই তওরাত অবতীর্ণ করেছি। এতে রয়েছে হেদায়াত ও আলো। আল্লাহর আজ্ঞাবহ নবী, দরবেশ ও আলেমরা এর মাধ্যমে ইহুদিদেরকে ফায়সালা দিতেন। কেননা তাদেরকে এই ঐশীগ্রন্থের তত্ত্বাবধান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এর রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিলেন। অতএব তোমরা মানুষকে ভয় কোরনা, আমাকে ভয় করো এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্য গ্রহণ করো না। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী ফায়সালা (হুকুম) করে না, তারাই কাফের (সুরা মায়েদা ৪৩-৪৪)।
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট হলো যে, কেবল কোর’আন দিয়েই যে ফায়সালা দিতে হবে তা আল্লাহ বলেন নি, তিনি বলেছেন ‘আনযাল্লাহু’ অর্থাৎ আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান। তওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি আল্লাহর অবতীর্ণ, সেগুলি দিয়ে ফায়সালা দিলেও সেটা ইসলামেরই ফায়সালা, সেটাই সমাজে শান্তি আনবে। আর কাফের তো তারাই যারা আল্লাহর কোন বিধান দিয়েই ফায়সালা দিতে রাজি না, যারা নিজেদের মনগড়া বিধানের পক্ষপাতী। সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সেটা শান্তি আনবে না।
একদিন বিশ্বনবীর কাছে এক ইহুদি পুরুষ ও ইহুদি নারীকে আনা হল। তারা দু’জনেই যিনা করেছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ সম্পর্কে তোমরা তোমাদের কিতাবে কী পাচ্ছ? তারা বলল, আমাদের পাদ্রীরা চেহারা কালো করার ও দু’জনকে গাধার পিঠে উল্টো বসিয়ে প্রদক্ষিণ করার নিয়ম চালু করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রসুল, তাদেরকে তাওরাত নিয়ে আসতে বলুন। এরপর তা নিয়ে আসা হল। তাদের একজন রজমের আয়াতের উপর নিজের হাত রেখে দিল এবং এর আগে-পিছে পড়তে লাগল। তখন ইবনু সালাম (রা.) তাকে বললেন, তোমার হাত উঠাও। দেখা গেল তার হাতের নিচে রয়েছে রজমের আয়াত। তারপর রসুলাল্লাহ (সা.) তাদের দু’জনের ব্যাপারে আদেশ দিলেন। তখন উভয়কে পাথর মেরে হত্যা করা হল (হাদীস: আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, বুখারী)।
কেউ কেউ বলেন, ‘যখন আল্লাহর রসুল তওরাতের বিধান দিয়ে ইহুদিদেরকে ব্যাভিচারের শাস্তি দিয়েছেন তখনও কোর’আনে এ সংক্রান্ত কোনো আয়াত নাজেল হয়েছিল না, কিন্তু যখন কোর’আনে ব্যাভিচারের শরিয়াহ এসে গেল তখন তওরাতের বিধান অকার্যকর হয়ে যায়।’ এ যুক্তিও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় যখন আমরা দেখি খন্দকের যুদ্ধ হয়ে যাবার পর বনি কুরায়জার বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও পুনরায় তওরাতের বিধান অনুযায়ী ফয়সালা দেওয়া হলো। বনি কুরায়জার বিচারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাদ ইবনে মোয়াজ (রা.)। তিনি ইহুদি গোত্রটির দাবি মোতাবেক তাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার রায় ঘোষণা করেছিলেন তওরাতের বিধান অনুযায়ী, যা বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থগুলোতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তওরাতের বিধান দিয়ে বিচার করা যদি অন্যায় হত, অনৈসলামিক হত, তবে আল্লাহর রসুল তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করতেন না। অথচ সেদিন ঐ বিচারপ্রক্রিয়া দেখে মু’মিনরা তো নয়ই কোনো মুনাফিকও এ অভিযোগ করেনি যে, সাদ (রা.) কোর’আনকে এড়িয়ে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ মোতাবেক রায় দিলেন কেন। কারও কোনো আপত্তি না থাকার কারণ সবাই জানত আল্লাহর বিধান দিয়েই বিচার হচ্ছে।
আমাদের বিরুদ্ধে আরেকটি জঘন্য অপপ্রচার হলো আমরা নাকি বলেছি সব সম্প্রদায়ের মানুষ জান্নাতে যাবে। এ ধরনের দাবি আমরা কীভাবে করতে পারি যখন কোর’আনের সর্বত্র আল্লাহ কেবল মো’মেনদেরকে জান্নাত প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অন্য কাউকে নয়। আমাদের লেখায় আমরা উল্লেখ করেছি জান্নাতের পূর্বশর্ত হিসেবে মো’মেন হতে হবে। তবে মো’মেন কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই আছেন অন্য সম্প্রদায়ে নেই- প্রচলিত এই ধারণার অসারতাও আমরা কোর’আন-হাদীস থেকে তুলে ধরেছি। আহলে কিতাবদের মধ্যেও মো’মেন আছে। যেমন আল্লাহ বলছেন-
‘‘তারা সবাই সমান নয়, আহলে কিতাবদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সেজদা করে। তারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়; অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে। আর এরাই হল সৎকর্মশীল। তারা যেসব সৎকাজ করবে, কোন অবস্থাতেই সেগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হবে না। আর আল্লাহ মুত্তাকিদের বিষয়ে অবগত (ইমরান: ১১৩-১১৫)।’’
তাহলে আহলে কিতাব হলেই কেউ জাহান্নামে যাবে এমন ধারণা কোথা থেকে এলো?
আমাদের ম্যাগাজিন থেকে যে অংশটি খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তা হলো-
‘‘ইসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাবার পরও ইসলাম গ্রহণ না করে পূর্ববর্তী ধর্ম বিশ্বাসে স্থির থেকে কেউ কি স্বর্গে যেতে পারবে? এর জবাব হচ্ছে হ্যাঁ, অবশ্যই তাদেরও জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে।’’ (সাপ্তাহিক সংকলন, দৈনিক দেশেরপত্র, ২৪তম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২৫)।
সম্মানিত আলেম সাহেবরা খেয়াল করুন কীভাবে একটি বাক্যকে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে ‘‘জান্নাতে যাওয়ার পথ খোলা আছে’’। জান্নাতে যাবে এমনটা কিন্তু কোথাও বলা হয় নি। এ থেকেই বোঝা যায় জান্নাতে যাওয়ার জন্য কেবল পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে স্থির থাকাই যথেষ্ট নয়, তাকে আরও কিছু করতে হবে। সেই ‘কিছু’টা কী তা আমাদের পূর্ণ প্রবন্ধটি যারা পড়বেন তারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। ওই প্রবন্ধেরই অন্যত্র এর জবাব দেওয়া হয়েছে যা অপপ্রচারকারীরা তাদের অপপ্রচারের স্বার্থে পুরোপুরি চেপে গেছে। সেটা হলো-
(জান্নাতে যাওয়ার) শর্ত হলো তাদেরকে শেষ নবী ও শেষ গ্রন্থ কোর’আনকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে। এটি শাশ্বত সত্য যে, বিশ্বাসী হিসাবে পরিগণ্য হতে হলে ধর্মের কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর বিশ্বাস থাকতেই হবে। সেগুলো হচ্ছে- আল্লাহর উপর, মালায়েকদের উপর, সকল ঐশীগ্রন্থের উপর, সকল নবী-রসুলগণের উপর, কেয়ামত দিবসের উপর, ভাগ্যের ভালো-মন্দের নিয়ন্ত্রক আল্লাহ এ কথার উপর এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর। তাই শেষ নবী এবং শেষ কেতাবের উপর অবিশ্বাস রেখে জান্নাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তেমনিভাবে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীরাও পূর্ববর্তী কোনো নবী-রসুল-অবতার এবং তাঁদের আনীত কেতাবের প্রতিও অবিশ্বাস রেখে জান্নাতে যাওয়ার আশা করে লাভ নেই। এটাই রসুলাল্লাহ সুস্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘আমার আহ্বান যার কানে পৌঁছালো সে যদি আমার উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করে তবে সে অবশ্যই জাহান্নামী (হাদীস)। (সাপ্তাহিক সংকলন, দৈনিক দেশেরপত্র, ২৪তম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২৫)।
এখন আপনারাই বলুন আমাদের ভুল হয়েছে কোথায়?
আবিসিনিয়ার খৃষ্টান বাদশাহ নাজ্জাশি ইন্তেকাল করলে নবী করিম (সা.) সাহাবীদের নিয়ে তার গায়েবানা জানাজা পড়েছিলেন এবং তার জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আহলে কিতাব হওয়া সত্ত্বেও মো’মেন ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবেন এটা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নাজ্জাশি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি নবী করিম (সা.) এর বিপদগ্রস্ত সাহাবীদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেছেন, নবীকে (সা.) উপহার পাঠিয়েছেন, যারা তাঁর বিরোধিতা করেছে তিনি তাদেরকে তিরস্কার করেছেন। নাজ্জাশি প্রসঙ্গে পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন,
আহলে কেতাবদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত হয়ে তাঁর প্রতি এবং তিনি যা তোমাদের ও তাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তাতে অবশ্যই ঈমান আনে এবং আল্লাহর আয়াত তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে না। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত লোক যাদের জন্য আল্লাহর নিকট পুরস্কার রয়েছে (সুরা ইমরান ১৯৯)।
এই আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইবনে কাসীর লিখেছেন,
এরূপ লোক আল্লাহর নিকট পূণ্য প্রাপ্ত হবে যারা ইহুদিই হোক আর খ্রিষ্টানই হোক। (তাফসির ইবনে কাসীর, চতুর্থ খণ্ড, ২৬২ পৃষ্ঠা)।
এরপরও কি এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে যে, অন্য ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও মো’মেন থাকতে পারেন?
কোর’আনে এমন আরও অনেক আয়াত আছে যেখানে আল্লাহ আহলে কিতাব হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ জান্নাতে যাবে এমন নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-
‘‘নিঃসন্দেহে যারা মুসলিম হয়েছে এবং যারা ইহুদি, নাসারা ও সাবেইন, যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কেয়ামত দিবসের প্রতি, সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনোই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।’’ (বাকারা ৬২)
এই আয়াতেও আল্লাহ মুসলিম ও ‘ইহুদি-নাসারা-সাবেইন’দের মধ্যে জান্নাতে যাবার ব্যাপারে কোনো পার্থক্য রাখেন নি। কারণ সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই মো’মেন আছেন।
যাই হোক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হচ্ছে আমরা আমাদের লেখায় এই প্রসঙ্গগুলোর অবতারণা করতে গিয়েছিলাম কেন? বিষয়টি সম্মানিত আলেম সাহেবদেরকে বুঝতে হবে। আমরা সবাই জানি সমগ্র পৃথিবী আজকে ‘ধর্ম’ ইস্যুতে টালমাটাল। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে সাম্রাজ্যবাদী দখলদার শক্তিগুলো সমস্ত পৃথিবীতে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। একটার পর একটা মুসলিম দেশ ধ্বংস করে ফেলছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির মত বোমা ফেলে নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা করছে। আজকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম বাড়িছাড়া, দেশছাড়া হয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। একটুখানি আশ্রয়ের সন্ধানে, বাঁচার আশায় ধর্মান্তরিত হচ্ছে। ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছে। দেড় কেজি চালের বিনিময়ে গর্ভজাত সন্তানকে বিক্রি করে দিচ্ছে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের এই ডামাডোল দেখে চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। তারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন। কেউ বলছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইতোমধ্যেই লেগে গেছে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ সেই মহাযুদ্ধের জ্বালানি, আর কুশীলব পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। যদি তাই হয় তবে বলাই যায় আমাদের সবুজ দেশটাও নিরাপদ থাকবে না। আজ হোক কাল হোক আমরাও আক্রান্ত হব। বৈশ্বিক তাণ্ডবের প্রভাব থেকে কোনো দেশই মুক্ত থাকতে পারে না। চ্যালেঞ্জ আসবে এবং তাকে মোকাবেলা করতে হবে- এটাই বাস্তবতা। আর তা করতে গেলেই প্রধান ও প্রথম যে শর্তটি পূরণীয় তা হচ্ছে ১৬ কোটি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করা। আল্লাহর রহমে এই ঐক্যবদ্ধ করার কাজটিই হেযবুত তওহীদ করে চলেছে নিঃস্বার্থভাবে, শুধুই মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হয়ে। এজন্য আমাদেরকে সকল ধর্মের মানুষের কাছে যেতে হয়েছে। সভা-সেমিনারে তাদের বক্তব্য শুনতে হয়েছে। তারা যেসব প্রশ্ন করেছেন তার সন্তোষজনক জবাব আমাদেরকে দিতে হয়েছে। তারা অনেকেই বলেছেন- ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে তো আপনারা অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরকে ধ্বংস করে দিবেন’। এই আতঙ্ক বহু শতাব্দী ধরে ইসলামবিদ্বেষীরা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করে রেখেছে। তখন আমরা তাদেরকে বলেছি যে, ‘না। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা হলে কারো ধর্মের উপরই জোর জবরদস্তি চলবে না, যার যার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে সে যদি তাদের ধর্মীয় কেতাবের ফায়সালা মানতে চায় তাহলে তার এই ধর্মীয় অধিকার ইসলাম দিবে। কিন্তু মো’মেনরা শুধু শেষ কেতাবের ফায়সালা মান্য করবে।” কেউ আবার জানতে চেয়েছেন অন্যান্য ধর্মের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, অন্য ধর্মের মানুষ তার নিজ ধর্মে বিশ্বাস রেখেও জান্নাতে যেতে পারবে কিনা ইত্যাদি। তাদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব আমাদেরকে দিতে হয়েছে। কারণ ইসলামের ব্যাপারে যে সন্দেহপ্রবণতা তাদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষীরা গেঁথে দিয়েছে তার নিরসন না হলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়, আর জাতি ঐক্যবদ্ধ না হলে আমরা কেউই বাঁচব না। আমাদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের দেশটাকেও ইরাক-সিরিয়ার মত মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলবে। তখন দেশও যাবে, ধর্মও যাবে। এমতাবস্থায় ইসলামের আকীদা মোতাবেক যত ন্যূনতম শর্তের ভিত্তিতে আন্তধর্মীয় দূরত্ব কমানো যায় এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় সে চেষ্টাই আমাদেরকে করতে হয়েছে। আমরা তাদেরকে এমন জবাব দিয়েছি যেন তারা মুসলিমদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় এবং ইসলামের মূলনীতিও ঠিক থাকে। এই চেষ্টা আল্লাহর রসুলও করেছিলেন। আহলে কিতাবদেরকে কী বলে ঐক্যের ডাক দিতে হবে আল্লাহ সেটা কোর’আনে বলে দিয়েছেন যে,
‘‘বলুন, হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে এসো যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান, সেটা হচ্ছে আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। (সুরা ইমরান ৬৪)।
আমাদের এই যৌক্তিক ও প্রামাণ্য বক্তব্য যাদের মনোপুত হয় না তারা অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রশ্নের কী জবাব দিতেন আল্লাহই ভালো জানেন। অবশ্য যারা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই রাখেন না বরং এ সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোকে তলোয়ারের ফয়সালার উপর ছেড়ে দিতে চান তারা আমাদের বক্তব্য যতই যৌক্তিক হোক মেনে নিতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক। তারা ধর্মীয় ব্যাপারে যতটা সংকীর্ণমনা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার চেয়েও কূপমণ্ডূক। সমস্যা হচ্ছে হেযবুত তওহীদ তাদের মত সংকীর্ণমনা নয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব, ইহকাল ও পরকাল- সব কিছু নিয়েই হেযবুত তওহীদকে ভাবতে হয়। কিন্তু এসব আবার তাদের মাথায় ধরে না। তারা মজে আছে ফতোয়াবাজীতে। হেযবুত তওহীদের সদস্যরা অধঃপতিত মুসলিম জাতির মুক্তির জন্য জীবনের সমস্ত সুখ-আহ্লাদ, চাওয়া-পাওয়াকে কোর’বান করে জীবন-সম্পদ, পুত্র-পরিজন, ঘর-বাড়ি সমস্তকিছু আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে সংগ্রাম করছে- এটা তাদের ধর্মান্ধ দৃষ্টিতে ধরা পড়ল না, আমাদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনার কোনো ভালো দিকই তাদের নজরে পড়ল না, তারা খুঁজে পেল পত্রিকার ম্যাগাজিনের নির্দিষ্ট একটা প্রবন্ধের নির্দিষ্ট কয়েকটা খণ্ডিত বাক্য, যাকে পুঁজি করে ফতোয়া দিয়ে দিল হেযবুত তওহীদ ‘কুফরী সংগঠন’। অথচ তারা নিজেরা বসে আছে ঘরের চৌহদ্দির ভেতরে চোখ-কান বন্ধ করে। জাতির দুর্দশা ঘোঁচাতে যাদের ন্যূনতম কোনো অবদান নেই।
সম্মানিত আলেম সাহেবদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ অনুরোধ হচ্ছে- আপনারা অপপ্রচারকারীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের প্রতারণার সহজ শিকারে পরিণত হবেন না। রসুল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হবার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোন তাই প্রচার করে (যাচাই করে না)। সুতরাং তাদের কোনো কথা বিশ্বাস করার আগে অবশ্যই সত্যাসত্য যাচাই করে করুন, আমাদের ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলে খোলা মনে ব্যক্ত করুন। আমরা জবাব দিতে কুণ্ঠিত নই। মানবীয় ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আমাদের লেখায়, বক্তৃতায় ভুল থাকতে পারে। কিন্তু তাকে পুঁজি করে আমরা যেন অনৈক্য ও বিদ্বেষের চর্চা শুরু না করি যা কেবল ইসলামবিরোধী শক্তিকে লাভবান করে থাকে। আমাদের কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে ইসলামের স্বার্থে ধরিয়ে দিবেন, ইনশা’আল্লাহ আমরা সংশোধিত হব। সবশেষে মৌলিক কয়েকটি বিষয়ের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আপনাদের মতামত জানতে চাচ্ছি।
- ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলে কোর’আন ছাড়াও আহলে কেতাবদেরকে তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে ফয়সালা দেওয়া যাবে কিনা?
- মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের তাদের বিশ্বাসে স্থির থেকে এবং শেষ নবীর উপরও বিশ্বাস করে জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ আছে কিনা?
- পূর্ববর্তী কেতাবগুলো আল্লাহর রচিত নয়- এই বলে আল্লাহ কোথাও পূর্ববর্তী কেতাবগুলোকে বাতিল ঘোষণা করেছেন কিনা?
- সমস্ত মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব উম্মতে মোহাম্মদীর উপর অর্পিত আছে। কিন্তু আমরা জানি মানবজাতির মধ্যে প্রধান যে কয়েকটি ধর্ম রয়েছে, যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদি- তাদের সম্মিলিত সংখ্যা মুসলিমদের চাইতে কয়েকগুণ, প্রায় ৫০০ কোটি। এই বিরাট সংখ্যার কেতাবধারী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ন্যূনতম কতটুকু ছাড় দেওয়ার সুযোগ রয়েছে? যেখানে যেখানে ইসলামের সঙ্গে ঐসব ধর্মের মিল রয়েছে সেই মিলগুলো তুলে ধরে ঐক্যপ্রচেষ্টা করা দোষের কিনা? কেউ এই ঐক্যপ্রচেষ্টার উদ্যোগ নিলে সেটাকে ‘নতুন ধর্ম বানানোর চেষ্টা’- এমন ফতোয়া দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা?
No comments:
Post a Comment