আমাদের সমাজে ডাক্তারের দরকার আছে, সুতরাং ডাক্তারী শিক্ষার বিকল্প নেই, ইঞ্জিনিয়ারের দরকার আছে, সুতরাং ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাও লাগবে। আবার আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাইলে যে কোনো জাতিরই অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি দরকার হয়, যার জন্য বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়াও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান প্রত্যেকের থাকা দরকার। এই সকল চাহিদা পূর্ণ হচ্ছে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে, যা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার অপরিহার্যতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন তোলা হয় মাদ্রাসাশিক্ষা সমাজের কোন চাহিদা পূরণ করে- তার স্পষ্ট ও সর্বজনগ্রাহ্য জবাব কিন্তু আমরা পাই না।
সম্প্রতি উদারবাদী আলেম হিসেবে পরিচিত শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম ফরীদ উদ্দীন মাসউদ এ প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন তাঁর ‘‘কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম’’ শিরোনামের একটি লেখায়। সেখানে তিনি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে বলেন,
‘‘আমাদের সমাজে ডাক্তারের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা রয়েছে ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, সমাজবিদ, আইনজ্ঞ ও সাহিত্য সংস্কৃতির অধিকারীদেরও। . . . সবাইকে এক সঙ্গে যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, আইনবিদ যোগ্যতায় অভিসিক্ত করা বাতুলতা তেমন প্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে চোখ বুঁজে থাকাও বিবেচনা যোগ্য নয়। বরং যে শ্রেণির যা বানানো হবে সে হিসাবে তার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রম তৈরি করে অগ্রসর হতে হবে।’’
এরপরই তিনি অনেকটা জোর দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার দরকারী দিকটি আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন,
‘‘নৈতিক মানবিক গুণ সম্পন্নতা এবং সরল ধার্মিকতার প্রয়োজন ও চাহিদা সমাজে কী অস্বীকার করার উপায় আছে? . . . মাদ্রাসাসমূহ বুনিয়াদীভাবে সমাজের এই অপরিহার্য চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের নিয়ামক হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে।’’
অর্থাৎ সহজ ভাষায় তিনি বোঝাতে চান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরি করার জন্য যেমন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, তেমনি ‘নৈতিক মানবিক গুণসম্পন্ন ধার্মিক মানুষ’ তৈরি করার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার দরকার। দু’টোই লাগবে।
আপাতদৃষ্টিতে তার বক্তব্যটি গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে, কিন্তু একটু খেয়াল করলেই কথাটির অসারতা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। তিনি দুইটি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে স্পষ্ট বিভেদরেখা টেনে দিয়ে বলে দিলেন- একটি শিক্ষাব্যবস্থার কাজ সমাজের প্রয়োজনে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরি করা, অন্যটির কাজ নৈতিক গুণসম্পন্ন ধার্মিক মানুষ তৈরি করা। নৈতিক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরির লক্ষ্যে আপনি যখন আলাদা একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বলবেন, তার মানে এটাই দাঁড়ায় যে, আপনি বলতে চাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় যারা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হচ্ছে তারা নৈতিক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হচ্ছে না। যিনি ডাক্তার আপনার মতে তিনি কেবল ডাক্তারই, তিনি কোনো নৈতিক গুণসম্পন্ন মানুষ নন, ধার্মিক নন। যিনি বিজ্ঞানী তিনি কেবল বিজ্ঞানীই, নৈতিক গুণসম্পন্ন ধার্মিক মানুষ তিনি নন। কিন্তু যেহেতু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বিজ্ঞানীর মত নৈতিক গুণসম্পন্ন মানুষেরও দরকার আছে সমাজে, তাই তেমন মানুষ তৈরির জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থাও লাগবে! সেটাই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। কী হাস্যকর যুক্তি!
একজন বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হিসেবে জনাব ফরীদ উদ্দীন মাসউদের বোঝা উচিত ছিল ‘নৈতিক মানবিক গুণসম্পন্নতা ও সরল ধার্মিকতা’ সৃষ্টি করা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাতেও সম্ভব এবং শুধু সম্ভব নয় সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থারও লক্ষ্য সেটাই। যিনি ডাক্তার হবেন বা যিনি ইঞ্জিনিয়ার হবেন তিনি কি নৈতিক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হবেন না? অবশ্যই হতে হবে। তাকে জানতে হবে কোন কাজ নৈতিক, আর কোনটা অনৈতিক। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। জানতে হবে ধর্মীয় মূল্যবোধ, থাকতে হবে হারাম-হালালের সুস্পষ্ট জ্ঞান। তা না থাকলে তার সামান্য নৈতিক পদস্খলনও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদেরও ইসলামের মর্মবাণী জানতে হবে। আল্লাহর রসুল মানুষের কল্যাণে, মানবতার মুক্তির জন্য সারাটি জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে ন্যায়, সুবিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার ইতিহাস জেনে তারা অনুপ্রাণিত হবেন। অসুস্থকে সেবাকারীর যে মর্যাদা ইসলাম ঘোষণা করেছে তা জেনে একজন ডাক্তার উজ্জীবিত হবেন। আরও বেশি করে মানুষের কল্যাণচিন্তায় মনোযোগী হবেন। ‘‘জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনদেশে যাও’’- রসুলের এই উৎসাহব্যঞ্জক বাণী একজন বিজ্ঞানীকে তার গবেষণার কাজে প্রেরণা যোগাবে। রাস্তা থেকে কলার খোসা সরানোও যদি পূন্যের কাজ হয়, তাহলে যে লোকটি তার সমস্ত মেধা ব্যয় করে জাতিকে প্রকৌশল সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি কি পূন্যের কাজ করছেন না? অবশ্যই পূন্যের কাজ করছেন, ধর্মের কাজ করছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ইসলামের আদর্শ তার চলার পাথেয় হবে।

এটা কি ধর্মের কাজ নয়?
সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, হারাম-হালাল, নৈতিক-অনৈতিক, সত্য-মিথ্যার জ্ঞান লাভ করার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করে যখন একজন ব্যক্তি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিল্পি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন তখন ঐ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের ধার্মিক বলতে যিনি কুণ্ঠিত হবেন বুঝতে হবে ইসলাম সম্পর্কে তার ধারণা, আকীদা পরিষ্কার নয়। প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক কারা এটাই তিনি জানেন না। ধার্মিক ব্যক্তি বলতেই আমাদের চোখের সামনে যে ‘জুব্বা-পাঞ্জাবি-আলখেল্লা-টুপি-পাগড়িওয়ালা ব্যক্তি’র চিত্র ফুটে ওঠে সেটা ইসলামকে সম্যকভাবে বোঝার ব্যর্থতার ফল। আসলে পোশাক-আশাক দিয়ে ধার্মিক চেনা যায় না। ধার্মিক তিনিই যিনি সত্য ও ন্যায়কে ধারণ করতে পারেন। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে যিনি সোচ্চার থাকেন। স্যুট-বুট পরলেই যেমন কেউ অধার্মিক হয়ে যায় না, তেমনি গায়ে আরবীয় আলখেল্লা চাপালেই কেউ ধার্মিক ও উৎকৃষ্ট নৈতিক গুণসম্পন্ন মানুষ হয়ে যায় না। কোর’আনের তিরিশ পারা মুখস্থ থাকলেই তাকে আমরা ধার্মিক বলে দিতে পারি না, যদি তার জীবনচরিতে কোর’আনের আদর্শের প্রতিফলন না ঘটে। আবার কোনো ব্যক্তির হয়ত কোর’আনের একটি সুরার বেশি মুখস্থ নেই, কিন্তু তিনি তার বাস্তব জীবনে আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে অতি সাবধানে অনুসরণ করে চলেন। তো কোর’আন মুখস্থ নেই বলে কি তাকে অধার্মিক বলা হবে? বস্তুত যিনি ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান তিনিই ধার্মিক। কে নৈতিক গুণসম্পন্ন, আর কে নৈতিক গুণসম্পন্ন নয়, কে ধার্মিক আর কে অধার্মিক তা চিনতে হবে কর্ম তথা ‘আমল’ দেখে, চেহারা দেখে নয়, লেবাস দেখে নয়, ধর্মের বয়ান শুনে নয় এবং কোন মাধ্যমে লেখাপড়া করেছে বা আদৌ লেখাপড়াই করে নি তার ভিত্তিতেও নয়। আল্লাহ বলেন, ‘‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক মর্যাদাবান (অর্থাৎ ধার্মিক) যে সর্বাধিক মুত্তাকি (হুজরাত ১৩)। এখানে মুত্তাকি হচ্ছেন ঐ সকল লোক যারা ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করে সর্বাবস্থায় ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকেন।

ছবিটি ‘‘উমর বিন খাত্তাব’’ নামক একটি সিরিজ থেকে নেওয়া। বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে মদীনার মুসলিম (ধার্মিক) ও মক্কার মুশরিকদের (অধার্মিক) মধ্য থেকে কয়েকজন দ্বন্দ্বযুদ্ধ লিপ্ত হচ্ছেন। ছবিটিতে লক্ষ করুন- উভয় পক্ষের মধ্যে বাহ্যিক পোশাক আশাক ইত্যাদিতে কোনো পার্থক্য আছে কি? উভয় পক্ষই অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। উভয়পক্ষের শরীরেই একই ধরনের পোশাক। কিন্তু পোশাক একই হওয়া সত্ত্বেও একপক্ষ আল্লাহর পছন্দনীয়, অপরপক্ষ আল্লাহর শত্রু। কারণ একটাই, মুসলিমরা ছিল সত্য ও ন্যায়ের ধারক, মুশরিকরা ছিল মিথ্যার ধারক।
একজন ডাক্তার যখন অর্থের লোভে দুর্নীতির আশ্রয় নেন তখন তার কর্ম দেখে বোঝা যায় যে, তিনি অধার্মিক, তার নৈতিক চরিত্র নেই, মানবিক গুণাবলি নেই। আর যখন তিনি নিঃস্বার্থভাবে মানবসেবা করে যান, চিকিৎসাসেবাকে আল্লাহর ‘এবাদত’ জ্ঞান করেন, তখন তার কর্ম সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি ‘নৈতিক গুণসম্পন্ন ধার্মিক’ ব্যক্তি। অন্যদিকে জনাব ফরীদ উদ্দীন মাসউদ যাদেরকে ‘নৈতিক গুণসম্পন্ন ধার্মিক’ বোঝাতে চাইছেন তাদের ‘কর্ম’ দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই তারা কতটা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি চরিত্রে ধারণ করতে পারল। কারণ তাদের কর্মজীবন নামাজ পড়ানো, মুর্দা দাফন করা, বিয়ে পড়ানো, কুরবানির গরু জবাই দেওয়া, মিলাদ পড়ানো ইত্যাদি কতিপয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ এই প্রত্যেকটি কাজ সাধারণ মানুষ নিজেরাই করতে পারে। এসব ধর্মীয়-সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য আলাদা একটি পেশাজীবী পুরোহিত শ্রেণির প্রয়োজন ইসলামে নেই। যেমন ধরুন নামাজ। নামাজ পড়ানোর জন্য মসজিদে একজন মাদ্রাসা শিক্ষিত ইমাম সাহেব রাখা হয়। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ঐ ইমাম সাহেব প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটি ভাতা বা বেতন পান মুসল্লিদেরকে নামাজ পড়ানোর জন্য। লক্ষনীয় বিষয় হলো- ঐ ইমাম সাহেবের পেছনে যে মুসল্লিগণ নামাজ পড়েন তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন জীবিকার মাধ্যম থাকে, পেশা থাকে। তারা কেউ ব্যবসা করেন, কেউ চাকরি করেন, কেউ কৃষিকাজ করেন ইত্যাদি। কিন্তু ঐ ইমাম সাহেবের পেশা? তার পেশা ‘নামাজ পড়ানো’। অর্থাৎ ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকরির মত নামাজকেও একটি স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে নেওয়া হয়, যে পেশায় চাকরি করার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষিত হওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ এটা ইতিহাস যে, আল্লাহর রসুলের যুগে সমাজের নেতৃস্থানীয়রাই নামাজের ইমামতি করত। যিনি ছিলেন সমাজের নেতা, তিনিই ছিলেন নামাজের ইমাম (নেতা)। ইমামতি কোনো পেশা ছিল না। যিনি ইমামতি করতেন তার অন্য কোনো পেশা থাকত। যারা মুর্দা দাফন করতেন, বিয়ে পড়াতেন, কুরবানির গুরু জবাই দিতেন, এগুলোকে তারা জীবিকার মাধ্যম বা পেশা বানিয়ে নিতেন না, স্বভাবতই তাদের অন্য পেশা থাকত। আর জাতির সমষ্টিগত চরিত্র ছিল মানবজাতির মুক্তির জন্য জীবন-সম্পদ উৎসর্গকারী সংগ্রামী চরিত্র। ধার্মিকতার পরিচয় দিতে হত ঐ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে, ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্য দিয়ে নয়। অথচ বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যই হচ্ছে এমন একদল মানুষ তৈরি করা যারা আরবি, ফারসি, কোর’আন, হাদীস, ফিকাহ, তাসফির ইত্যাদিতে বিশেষ পা-িত্য অর্জন করে সমাজজীবনে বিভিন্ন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনে ভূমিকা রাখবে। যেন এসব ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাই ইসলামের সারবস্তু! মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ‘ধার্মিকতা’ বলতে খুব সম্ভব এই ‘ধমীয় আনুষ্ঠানিকতা’ই বুঝিয়েছেন।

কোরবানির গরু জবাইয়ে জন্য মাদ্রাসা শিক্ষিত হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। যিনি কোরবানি দিবেন পশু জবাইয়ের দায়িত্ব তার নিজেরই।
যে ব্যক্তি কোথাও চাকরিই পেল না, সে যতই ঘুষ খাওয়াকে অন্যায়, অনৈতিক বা অমানবিক কাজ মনে করুক, তাতে সমাজের কোনো লাভ হবে কি? ঘুষ খাওয়াকে অন্যায় ও অনৈতিক মনে করা দরকার ঐ ব্যক্তির যে চাকরি করে, যার পদস্খলন হলে জাতির ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। একইভাবে মাপে কম দেওয়া যাবে না, পণ্যে ভোজাল মেশানো যাবে না ইত্যাদি নৈতিক মূল্যবোধ কার দরকার? অবশ্যই যিনি ব্যবসা করবেন তার। মানুষের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষা কার দরকার? যিনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে জড়িত থাকেন তার। শাসন হতে হবে স্বচ্ছ ও ন্যায়নিষ্ঠ এবং শাসককে হতে হবে সত্যের অনুগামী, শাসকের ধর্ম হবে ন্যায়ের দণ্ড ধারণ করা, এই মূল্যবোধ কার জন্য? অবশ্যই যিনি রাষ্ট্র চালাবেন তার জন্য। এভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধ তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা সমাজকে বিভিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে স্বীয় যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। যারা সমাজের কোনো পর্যায়েই নেই, যাদের কাছ থেকে সমাজ কোনো সার্ভিসই পায় না তারা ইসলামী অনুশাসন ও মূল্যবোধের জ্ঞান দিয়ে মগজ ভরিয়ে ফেললেও সমাজের কী লাভ? উপরন্তু ঐ ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন জ্ঞানকেই যদি নিজেদের আয়-রোজগারের মাধ্যম বানিয়ে নেওয়া হয় তবে সেটা স্বার্থোদ্ধারেই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতাটা এখানেই। সমাজের ‘নৈতিক-মানবিক গুণসম্পন্নতা ও সরল ধার্মিকতা’র চাহিদা পূরণের কথা বলা হলেও বাস্তবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কোনো সেক্টরে দায়িত্ব পালন করার জন্য যে যোগ্যতা দরকার হয় তা প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অর্জন করা সম্ভব হয় না। কার্যত এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সমাজ কোনো দিক দিয়েই লাভবান হয় না- এটাই বাস্তবতা।

সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই ১৫ হাজার মাদ্রাসায়।
আল্লাহর রসুলের সাহাবীদের মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা যেত, বাকি সবাই ছিলেন নিরক্ষর, পৃথিবী সম্পর্কে অজ্ঞ- এটা ইতিহাস। কিন্তু তাদের ব্যাপারেই রসুলাল্লাহ বলেছেন- তারা উজ্জ্বল তারকার ন্যায়, তাদের যে কাউকে আমরা অনুসরণ করতে পারি। এই জন্য বলেছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও ঐ লোকগুলোর কাছে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ধর্ম-অধর্ম, বৈধ-অবৈধ’র জ্ঞান দিবালোকের মত স্পষ্ট ছিল এবং তারা প্রত্যেকে তাদের কর্মজীবনে ছিলেন ন্যায় ও সত্যের ধারক। তারা যেটুকু জানতেন তার উপর আমল করতেন। কেউ শুধু কর্ম করবে, আর কেউ শুধু ধর্মের জ্ঞান আহরণ করবে - বর্তমানের মত এমন শ্রেণিবিভাগ ঐ সমাজে ছিল না। তারা সবাই সত্য-মিথ্যার জ্ঞান অর্জন করতেন এবং সবাই সেই জ্ঞান অনুযায়ী আমল করতেন। তাদের দ্বীন ও দুনিয়া আলাদা ছিল না। সুতরাং দ্বীনের জন্য এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আর দুনিয়ার জন্য আরেক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থারও দরকার পড়ত না। আমরা দ্বীন ও দুনিয়াকে আলাদা করে ফেলেছি বলেই এ সঙ্কটের মুখোমুখী হতে হচ্ছে। আল্লাহর রসুলের আসহাবদেরকে অনুসরণ করতে গেলে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা- উভয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
‘নৈতিক গুণাগুণ সম্পন্ন ধার্মিক মানুষ’ তৈরির জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা কেন উঠছে তা আমরা বুঝি। বর্তমানে যে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থাটি চালু আছে তা নৈতিক গুণাগুণসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে নৈতিকতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে ধর্ম, কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার সেক্যুলারকরণ (secularization) করতে গিয়ে কার্যত ধর্মকেই পরিহার করা হয়েছে। ফলে ধর্মহীন বস্তুবাদী শিক্ষা মানুষের আত্মার চাহিদা পূরণ করতে না পারায় সমাজ ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়ের মুখে পড়ছে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করে যারা বের হচ্ছে তারা ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা তো পাচ্ছেই না, উপরন্তু ধর্ম সম্পর্কে এক ধরনের হীনম্মন্যতা নিয়ে বের হচ্ছে। অনেকে ইসলামবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে। নৈতিক মূল্যবোধ শিথিল হয়ে পড়ায় সমাজ ভরে যাচ্ছে অন্যায়, অবিচার, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, দমন, পীড়ন, নির্যাতন, অশ্লীলতা, বেহায়াপনায়। এসব দেখে প্রচলিত বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে যদি মনে করা হয় প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে এই ‘নৈতিকতার সঙ্কট’ দূরীভূত করা যাবে- সেটাও হবে অলীক কল্পনা।
তাহলে কী করণীয়?
করণীয় হচ্ছে আমাদেরকে উভয় শিক্ষাব্যবস্থাই ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে শিক্ষার সার্থকতা কোথায়, শিক্ষার উদ্দেশ্য কী। একজন মানুষকে স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদিতার জীবন থেকে মানবতা, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও পরোপকারিতার দিকে চালিত করাই হচ্ছে শিক্ষার মূখ্য উদ্দেশ্য, এর বাইরে আর যা আছে সব আনুষঙ্গিক। শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে এমন এক ছাঁচ, যেখানে স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ঢুকবে, কিন্তু বের হবে পরোপকারী, আত্মত্যাগী, প্রবল নৈতিক শক্তিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক হয়ে, যে কিনা মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যে জীবনের সার্থকতা ও স্রষ্টার সান্নিধ্য খুঁজে পাবে। একজন মানুষের মধ্যে এই চারিত্রিক পরিবর্তনটি আনতে পারাই একটি শিক্ষাব্যবস্থার মূল চ্যালেঞ্জ। প্রচলিত ভারসাম্যহীন উভয় শিক্ষাব্যবস্থাকেই এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে যা সবার আগে শিক্ষার্থীর এই মানসিক পরিবর্তনটি ঘটাবে। শিক্ষার্থীর মধ্যে ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম, সত্য-মিথ্যা, হারাম-হালালের শক্তিশালী বোধ জাগ্রত করবে। সমাজের স্বার্থে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে। এরপর প্রশ্ন আসবে একজন শিক্ষার্থী কোন প্রক্রিয়ায় সমাজকে সার্ভিস দিবে সেটা। সে কি ডাক্তার হবে, নাকি ইঞ্জিনিয়ার হবে, নাকি শিক্ষক হবে, নাকি শিল্পী হবে, নাকি সাহিত্যিক হবে তা নির্ণিত হবে তার দক্ষতা, পছন্দ ও সামাজিক চাহিদার ভিত্তিতে। ওটা অনেক পরের প্রশ্ন। আগে তো সে মানুষ হোক।
No comments:
Post a Comment