জনৈক জনদরদী ব্যক্তি কয়েকজন মদখোরকে বাড়িতে ডেকে আনলেন। উদ্দেশ্য- তাদেরকে তিনি হাতে কলমে মদের অপকারিতা বোঝাবেন। এজন্য তিনি দু’টি পাত্র নিলেন। একটি পাত্রে আছে পানি, অপরটিতে নির্ভেজাল মদ। জনদরদী ব্যক্তি প্রথমে পানির পাত্রে একটি কেঁচো ছেড়ে দিলেন। কেঁচোটি স্বাভাবিকভাবে নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল। এবার তিনি পানির পাত্র থেকে তুলে কেঁচোটিকে মদের পাত্রে রাখলেন। তাতে দেখা গেল কেঁচোটি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল।
অতঃপর মদখোরদের জিজ্ঞাসা করলেন- এবার বলো তো, এই ঘটনা থেকে কী বুঝলে? আসলে এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, মদ আমাদের শরীরের জন্য কত ক্ষতিকর পদার্থ। কিন্তু মদখোরগুলো উত্তর দিল- যা বুঝলাম তা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের নিয়মিত মদ খাওয়া উচিত, তাহলে শরীরে কেচো ও ক্রিমি জন্মাবে না!
আমাদের অবস্থা হয়েছে ওই জনদরদী ব্যক্তির মত। জঙ্গিবাদকে আমরা যতটা গর্হিত কাজ বলে উপস্থাপন করছি, জঙ্গিরা এই কাজকে ততই পুণ্য ও কল্যাণকর কাজ বলে মনে করছে। আমরা চিন্তা করছি- আহারে, কেবল বোঝার ভুলে এই অল্পবয়সী তরুণগুলোর জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর তারা ভাবছে- আমাদের কী ভাগ্য! আমরা শহীদের মর্যাদা লাভ করছি, যে শহীদের মর্যাদা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নবী-রসুলদেরও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জীবন সার্থক! আমরা সফল!
আমরা ভাবছি- আহারে! এই লোকগুলো নিজেরা তো ধ্বংস হচ্ছেই, তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎও অন্ধকার করে যাচ্ছে। ওরা ভাবছে- আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছি। আমরাও সফল হচ্ছি, আমাদের সন্তানরাও সফল হবে।
আমরা ভাবছি- এই লোকগুলো কেন ওইপথে গেল? ওদের কি জীবন উপভোগ করার ইচ্ছা হয় না? জীবনের প্রতি তাদের এত অবজ্ঞা কেন? আমরা একটা তেলাপোকা দেখে আঁৎকে উঠি, আর তারা হাঁসিমুখে ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে- এত সাহস তাদের আসে কোত্থেকে? অন্যদিকে ওরা ভাবে- এই তো জীবন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করার মাঝেই জীবনের সফলতা। আমরা এই কাজ করে জীবনের হক্ব আদায় করছি, আর অন্যরা যাচ্ছেতাইভাবে জীবন কাটিয়ে জীবনের প্রতি অবজ্ঞা করছে!
এই যে দৃষ্টিভঙ্গির আকাশ-পাতাল ফারাক, এ ফারাক সহজে ঘোঁচার নয়। আপনার জায়গা থেকে আপনি যতটা সঠিক, ওদের জায়গা থেকে ওরাও ততটাই সঠিক। আপনার জায়গায় আপনি যতটা যুক্তিবাদী, ওদের জায়গায় ওরা ততটাই যুক্তিবাদী। আপনার মনে ওদের প্রতি যতটা ক্ষোভ, ওদের মনেও আপনার প্রতি ততটাই ক্ষোভ। আপনি ওদেরকে অপরাধী ভাবেন জবাই করে নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য, ওরা আপনাকে অপরাধী ভাবে আকাশ থেকে বোমা ফেলে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ হত্যার জন্য। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি, দু’টি মানদণ্ড মুখোমুখী দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আঘাত যদি করতে হয় তবে সেটা করতে হবে ওই ‘মানদণ্ডে’। যদি ওই বিপথগামী লোকগুলোর প্রতি আপনার-আমার এতই দরদ থাকে, যদি তাদের বিপথগামিতা আমাদেরকে সামান্য পরিমাণও ব্যথিত করে থাকে, তাহলে কেবল নিজেদের মানদণ্ড থেকে কথা বললে ও ভাবনা-চিন্তা করলে হবে না, ওদের মানদণ্ডকেও বিবেচনায় আনতে হবে। এখানেই আসে আদর্শিক মোকাবেলার প্রশ্ন। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে জঙ্গিদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর বিজয়ী করার প্রশ্ন। আমাদের আদর্শ দিয়ে তাদের আদর্শকে ‘ভুল’ প্রমাণ করার প্রশ্ন। তা করতে চাইলে আমরা যে মানদণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত সেটা হতে হবে শক্তিশালী, অন্তত জঙ্গিদের চেয়ে দুর্বল হলে চলবে না। সোজা কথায়- আমাদেরকে একটি নির্ভুল আদর্শের ধারক হতে হবে, আদর্শবান হতে হবে।
আমরা যদি সত্য ও ন্যায়ের ধারক হই, তাহলে আমাদের জন্য খুবই সহজ হয়ে যাবে জঙ্গিদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে, তাদের মানদণ্ডকে বা আদর্শিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও দুর্বল করে দেওয়া। ভুলে গেলে চলবে না- জঙ্গিদের আদর্শিক ভিত্তিটাই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আদর্শহীনতা তথা অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, শোষণ, খুন, ধর্ষণ, ব্যাভিচার, জবরদস্তি, দমন-পীড়ন, নির্যাতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নৈরাজ্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থার উপর। সুতরাং আমরা সত্য ও ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান হবার সাথে সাথে জঙ্গিবাদী আদর্শের ভিত্তি এমনিতেই দুর্বল হয়ে যাবে। আর আমরা অন্যায়ে লিপ্ত থাকলে তারা আদর্শিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে। এ কারণেই যদি আমরা তাদের বিপথগামিতা নিয়ে সত্যিই চিন্তিত বোধ করি তার প্রমাণ রাখতে হবে ন্যায় ও সত্যকে ধারণ করার মাধ্যমে। এতে একদিকে আমাদের কল্যাণ হবে, অন্যদিকে ওরাও নিজেদের আদর্শিক দ্বৈন্যতা দেখে ভুল পথ পরিহার করবে।
আর যদি আমরা অস্ত্রের জোরেই বিষয়টির মীমাংসা করতে চাই, তবে সত্যনিষ্ঠ বা আদর্শবান হওয়া-না হওয়া বিষয় নয়। আমরা যা বলব সেটাই সঠিক, আমরা যাকে ন্যায় বলব সেটাই ন্যায়, যাকে অন্যায় বলব সেটাই অন্যায়- এর বিকল্প চিন্তা করা যাবে না। যদি কেউ ন্যায়-অন্যায়ের অন্য কোনো মানদণ্ড নিয়ে হাজির হয় তবে তার মোকাবেলা হবে কেবল অস্ত্রের ভাষায়। শক্তি যতক্ষণ আমার হাতে ততক্ষণ আমার মানদণ্ড থাকবে, শক্তি যখন অন্যের হাতে তখন তার মানদণ্ড চলবে। শক্তির ফয়সালাই হবে চূড়ান্ত ফয়সালা। ন্যায়-অন্যায় বিষয় নয়, রাজত্ব হবে বোমা আর বন্দুকের।
এই যদি হয় আমাদের ধারণা, তাহলে তো কথাই নেই। সেক্ষত্রে আমরা একেকজন আদর্শহীন, নীতিহীন, নৈতিকতাবর্জিত জন্তু-জানোয়ার হলেও সমস্যা নেই। কারণ আমাদের হাতে আছে শক্তিশালী আধুনিক মারণাস্ত্র আর প্রশিক্ষিত সব বাহিনী। সুতরাং যতক্ষণ জঙ্গিরা শক্তিতে, সংখ্যায় আমাদের সমতুল্য না হতে পারবে ততক্ষণ আমাদেরই জয় হবে। আমরা এখনও যথেষ্ট নিরাপদ। যেহেতু নিরাপদ, সুতরাং নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যায়।
আমার কথা হচ্ছে- ঘুমুচ্ছেন ঘুমান। কিন্তু ঘুম থেকে হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠে- হায় হায় আমার তরুণ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, হায় হায় জঙ্গিদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোর কী হবে, হায় হায় শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান, হায় হায় ছেলেটা ভালো গান গাইতে পারত, হায় হায় মেয়েটা হয়ত বড় ডাক্তার হতে পারত- এসব আহাজারি বা মায়াকান্না করবেন না। ভুলে যাবেন না আপনারা শক্তিতে বিশ্বাসী, যুদ্ধে আস্থাবান। শত্রু মরে যাচ্ছে দেখে কান্নাকাটি করে যারা, তারা যোদ্ধা হতে পারে না। এমনিতেই আপনারা আদর্শ হারিয়েছেন, এখন যোদ্ধা চরিত্রও হারিয়ে ফেললে বড় বিপদে পড়বেন।
No comments:
Post a Comment