Friday, April 7, 2017

সন্ত্রাসবাদের দায় কোর’আন/গীতার নয়

হিন্দুত্ববাদী ভায়েরা যখন কোর’আনকে ‘জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা বই’ বলে তিরস্কার করেন তখন তাদের প্রতি আমার করুণা হয়। জানতে ইচ্ছা করে এই তিরস্কারকারীরা গীতার ব্যাপারে কী মতামত দেন। তারা কি গীতায় ঈমান রাখেন না?
.

কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে অর্জুন তাকিয়ে দেখলেন তার প্রতিপক্ষ যোদ্ধারা আর কেউ নয় তারই বংশের লোক, তারই আত্মীয়-স্বজন, চাচাত ভাই, পিতামহ। তাদেরকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। 
.
অর্জুনের হৃদয় হাহাকার করে উঠল। আমি কেন আমার বংশের লোককে হত্যা করব? আমার কী লাভ হবে? কেবল রাজ্য অধিকার করার জন্য আপন আত্মীয়দেরকে হত্যা করতে হবে? কী দরকার সেই রাজ্যের? স্বজনদের মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে রাজ্য শাসনের সুখ তো আমি পাব না। বরং অনুশোচনার গ্লানি আমার বাকি জীবনের সমস্ত আনন্দকে নিঃশেষ করে দেবে। না, এ কাজ আমি করতে পারি না।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈজীবিতেন বা।
.
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা খুলে বললেন। এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। অর্জুনের যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে পাণ্ডবদের নিশ্চিত পরাজয়- এ কথা শ্রীকৃষ্ণ ভালোমতই জানেন। তা হতে দেওয়া যায় না। শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন কেবলই স্বজনপ্রেমে বিগলিত হয়ে ন্যায়-অন্যায়বোধ, যুক্তিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে অর্জুন।
.
ফলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে লাগলেন কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়। তিনি বুঝিয়ে দিলেন- এ যুদ্ধ কোনো রাজ্য অধিকারের যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ প্রতিশোধেরও যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে নিপীড়িত প্রজাদেরকে মুক্ত করার যুদ্ধ। ধর্মের জন্য যুদ্ধ করতে হবে, সুখভোগের জন্য নয়। তুমি কেবল নির্বিকারভাবে কর্ম করে যাও, ফল ভোগের আশা, কামনা-বাসনা ত্যাগ কর। খাবার খাও, কিন্তু খাবারে আসক্ত হইও না। অস্ত্র উঠাও অর্জুন, যুদ্ধ কর।
‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হূদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ’
.
তিনি অর্জুনকে বোঝালেন- এ যুদ্ধ তুমি আয়োজন করছো না অর্জুন, এটা প্রকৃতির আয়োজন। সমাজ যখন অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারে ছেয়ে যায়, তখন প্রকৃতি নিজেই যুদ্ধের আয়োজন করে। অন্যায় চিরদিন চলতে পারে না। ঈশ্বর ন্যায় দিয়ে অন্যায়ের মস্তকে আঘাত করবেনই। তোমার সৌভাগ্য যে, তুমি ন্যায়ের পথে লড়াই করতে পারছ। সুতরাং দ্বিধা না করে ঈশ্বরের নির্দেশ পালন কর।
.
এই যে অর্জুনের যুদ্ধ করতে অপারগতা প্রকাশ, আর যুদ্ধের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের অনুপ্রেরণা প্রদান- এরই লিখিত রূপ আজকের গীতা। গীতার আগা-গোড়া পুরোটাই যুদ্ধের উৎসাহে ভরা।
.
কিন্তু যুদ্ধের উৎসাহ আছে বলেই কি গীতাকে ‘জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা বই’ বলে তীরস্কার করব? কখনই না। গীতাই বলেন আর কোর’আনই বলেন, কোনো ধর্মগ্রন্থই ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। ধর্মগ্রন্থে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ বলতে ওই যুদ্ধকে বা সংগ্রামকে বোঝানো হয় যা ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য করা হয়। অত্যাচারী শক্তির হাত থেকে নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষকে মুক্ত করাই জিহাদের লক্ষ্য। এজন্যই শ্রীকৃষ্ণ যোদ্ধা ছিলেন। এজন্যই মোহাম্মদ (সা.) যোদ্ধা নবী ছিলেন।
.
যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম না হলে মানবজাতি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। উপাসনালয়ে বসে বসে হাজারো জিকির-আজগার, পূজা-পার্বণ করে সে ধ্বংস এড়ানো যেত না।

No comments:

Post a Comment