Friday, April 7, 2017

কোর’আন কেন একদিনে নাজেল হলো না?

সমগ্র কোর’আন কি একদিনে নাজেল হতে পারত না? অবশ্যই পারত। কিন্তু আল্লাহ তা করেন নি। কোর’আন নাজেল হয়েছে প্রয়োজন অনুসারে, ধাপে ধাপে, দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে। এর কারণ কী?
.
এর নির্ভুল উত্তর একমাত্র তিনিই জানেন যিনি কোর’আনের রচয়িতা। আমরা কেবল সম্ভাবনার কথাটুকু বলতে পারি। যদি সমগ্র কোর’আন একইদিনে, যেমন ধরা যাক আল্লাহর রসুল যেদিন নবুয়্যত লাভ করলেন সেদিনই নাজেল হত, তবে ঐ আইয়ামে জাহেলিয়াতের অনৈক্য-সংঘাত, হানাহানিতে লিপ্ত, বিশৃঙ্খল ও অবাধ্য প্রকৃতির লোকগুলোকে একটির পর একটি ধাপ অতিক্রম করে অর্থাৎ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহর রসুল যেভাবে ঐক্যবদ্ধ, সৃশৃ্ঙ্খল ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন সেটা আর সম্ভব হত না। সোজা ভাষায় বললে- কোর’আনের বাস্তবায়ন সম্ভব হত না। বিষয়টা আরেকটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা যাক।
.
এটা ইতিহাস যে, বিশ্বনবী তাঁর নবীজীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় ধরে কেবল এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের চেষ্টা করেছেন যে জাতিটি আল্লাহর দেওয়া ন্যায় ও সত্যকে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ ও ধারণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আদেশ আসবে তা বিনা শর্তে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করবে এবং যা নিষেধ করা হবে তা থেকে দূরে থাকবে। এতে ঐ জাতির সদস্যদের লাভ কী হবে আর না করলে ক্ষতি কী হবে- এটাই ছিল কোর’আনে অবতীর্ণ তখনকার আয়াতগুলোর মূলকথা। মাক্কী সুরাগুলোতে তাই জান্নাত-জাহান্নামের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। বিশদ পরিসরে হারাম-হালালের বিধান তখন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ছিল।
.
কিন্তু দেখা গেল মক্কায় শত চেষ্টাতেও তিনি সফল হতে পারলেন না, মক্কাবাসী আল্লাহকে তাদের ‘ইলাহ’ হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিল না। অন্যদিকে মদীনার মানুষ রসুলের কথা শুনল। মদীনার মানুষের কাছ থেকে বিশ্বনবী অঙ্গীকার (আকাবার প্রথম বায়াত) নিলেন। মদীনাবাসী সেদিন কী অঙ্গীকার করেছিল? আমরা চুরি-ব্যভিচারের ধারে কাছেও যাব না, নিজেদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করব না, কারো উপর মিথ্যা অপবাদ দিব না, চোগলখুরি করব না, রসুলের আনুগত্য করব এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ‘ইলাহ’ হিসেবে গ্রহণ করব না। 
.
এই যে আল্লাহকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে মদীনাবাসী প্রতিশ্রুতি প্রদান করল- আল্লাহর রসুলের দীর্ঘ এক যুগের অবিশ্রান্ত সংগ্রামের সফলতাটা কিন্তু নিহিত ছিল ওখানেই। এই প্রথম তিনি একটি জনসমষ্টি পেলেন যারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ড দ্বারা জীবনযাপন করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসলো। তারা যখন সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিল যে, এখন থেকে আল্লাহর পক্ষ হতে যে ফয়সালাই আসুক আমরা তা প্রশ্নহীন ও শর্তহীনভাবে মেনে চলব, তখন আল্লাহর রসুল মক্কা থেকে মদীনায় হেজরত করলেন। আজকে ‘কোর’আনের আইন’ বা ‘Shariah law’ বলতে আমরা যে বিধি-বিধানগুলো বুঝি সেগুলো সবই হেজরতের পর নাজেল হয়েছিল, অর্থাৎ জাতি গঠিত হবার পর।
.
মদীনার সব গোত্রের মানুষ পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হলো। ফলে একটি উম্মাহ (জাতি) গঠিত হলো। এরপর আল্লাহ কোর’আনে ঐ উম্মাহর জাতীয়-সামাজিক-পারিবারিক-অর্থনৈতিক-দণ্ডবিধি এক কথায় সামষ্টিক জীবনের দিক-নির্দেশনা দান করতে লাগলেন এবং আল্লাহর রসুল তার যথোপযুক্ত প্রয়োগ ঘটাতে লাগলেন। তখন প্রশ্ন আসল চুরির শাস্তি কী হবে, ব্যাভিচারের শাস্তি কী হবে, জাতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে, সেনাবাহিনী পরিচালনা কীভাবে হবে, যুদ্ধের নীতিমালা কী হবে, সন্ধির শর্ত কী হবে ইত্যাদি। আরও প্রশ্ন আসল জাতির শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক কেমন হবে, পারিবারিক সিস্টেম কেমন হবে, সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা কীভাবে হবে ইত্যাদি। এভাবে একদিকে নতুন নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হতে লাগল, নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হতে লাগল, অন্যদিকে আল্লাহ কোর’আনে তার সমাধান দিতে থাকলেন। যখন কোনোকিছুই আর বাদ থাকল না, একটি জাতির সামষ্টিক জীবনের পূর্ণ গাইডলাইন দেওয়া হয়ে গেল, তখন আল্লাহ ঘোষণা করলেন- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম (মায়েদা ০৩)।
.
দীর্ঘ ২৩ বছরে নানামুখী প্রশ্ন, সমস্যা, সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ধাপে ধাপে আল্লাহ যে সমাধান দিলেন তারই একত্রিত রূপ আজকের এই পবিত্র কোর’আন। কোর’আন ছিল মানুষের বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান। আগে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তারপর সমাধান এসেছে। আগে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তারপর উত্তর এসেছে। আগে কোর’আনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, তারপর কোর’আনের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। কোর’আন যদি একদিনে নাজেল হত তবে সমস্যাটা দাঁড়াত এই প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গিয়ে। একটি বর্বর জাতিকে রাতারাতি কোর’আনের বিধান মানিয়ে সোনার মানুষে পরিণত করার চেষ্টা হত সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক একটি প্রচেষ্টা। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়- এটা রাতারাতি ঘটে যাবার ব্যাপার নয়, এটা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ব্যাপার।
.
উদাহরণস্বরূপ কোর’আনে মদ হারাম করা হয়েছে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রথমে বলা হলো- এতে ভালো ও মন্দ দুই-ই আছে, তবে মন্দটাই বেশি। অর্থাৎ মদ খাবার ব্যাপারে হালকা নিরুৎসাহ। এতে মদ খাওয়া কিছুটা কমে গেল। তারপর বলা হলো মাতাল অবস্থায় সালাহ করবে না। অর্থাৎ মৃদু নিষেধাজ্ঞা। দেখা গেল ব্যক্তিগতভাবে আরও কিছু লোক মদ খাওয়া ছেড়ে দিল। যারা ছাড়ল না তারা অন্তত এটুকু বার্তা পেল যে, মদ খাওয়াটা ভালো কাজ নয়। তারপর স্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো- মদ খাওয়া হারাম। এবার বাকিরাও পুরোপুরি মদ খাওয়া ত্যাগ করতে পারল খুব সহজেই।
.
আজ আমরা একবিংশ শতাব্দীর এমন এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছি যখন আমাদের সমাজ আইয়ামে জাহেলিয়াতের মতই অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, রক্তারক্তি, গুম, খুন, নারী নির্যাতন, শ্রমিক নিষ্পেষণ, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বর্বরতা, অনৈক্য, সংঘাতে পরিপূর্ণ। মানুষ জানে না কোনটা ধর্ম, কোনটা অধর্ম। জানে না কোনটা বৈধ কোনটা অবৈধ। জিহাদের নামে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ নিরীহ বনি আদমের রক্ত ঝরছে প্রতিনিয়ত। ধর্মের চিরাচরিত ঔজ্জ্বল্য চাপা পড়েছে সাম্প্রদায়িকতার কালিতে। রাতের আঁধারে জেহাদী জোশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়, লুটপাট করা হয়। খৃষ্টান মারো, গীর্জা ভাঙ্গো- স্লোগান দিয়ে দিনে দুপুরে হামলা করে মানুষ জবাই করে ফেলা হয়। হুজুগ ও গুজবনির্ভর হয়ে উঠেছে মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট। স্বার্থান্বেষী মহল যেদিকে পারছে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে অপব্যবহার করছে। কেউ মনে করছে মাজারে টাকা দিয়েই বুঝি জান্নাত পেয়ে যাব। কেউ ভাবছে বিধর্মী হত্যা করতে পারলেই জান্নাত নিশ্চিত। কেউ আবার ভোটের ব্যালটকে জান্নাতের টিকিট বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। 
.
এমতাবস্থায় সমাজের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে গভীর অন্ধকারে, অস্বচ্ছতায় রেখে যারা ‘কোর’আনের আইন’ প্রতিষ্ঠার স্লোগান তুলছেন, ব্যালট কিংবা বুলেটের মাধ্যমে কথিত ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন তারা যে ব্যর্থ হবেন তাতে সন্দেহ নেই।
.
মানুষকে আগে জানাতে হবে ইসলাম কী, কেন, কীভাবে। জানাতে হবে কোনটা ধর্ম কোনটা অধর্ম। জানাতে হবে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। যতদিন তাদের কাছে সত্য-মিথ্যা স্পষ্ট না হচ্ছে, সবার চোখে ন্যায়-অন্যায় পৃথক হয়ে না যাচ্ছে, ধর্ম-অধর্ম স্পষ্ট না হচ্ছে ততদিন কোরআনের আইন, ইসলামের শাসন- ইত্যাদি প্রসঙ্গ টানাটাই অবান্তর। 
.
কোর’আন হচ্ছে হেদায়াহ। হেদায়াহ কার জন্য দরকার? যারা মুত্তাকি হতে চায় তাদের জন্য, তাই নয় কি? সেই মুত্তাকি হবার জন্য আপনাকে আগে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য জানতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যাবতীয় অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। অতঃপর ঐ ঐক্যবদ্ধ জাতির জন্য হেদায়াহ বা দিক নির্দেশনা হচ্ছে কোর’আন। যারা ন্যায়-অন্যায়ই বুঝে না কোর’আন তাদের জন্য নয়।

No comments:

Post a Comment