Friday, April 7, 2017

ফরাসি বিপ্লব কি ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল?

ধর্মের অপব্যবহারের রূপ কত কদর্য হতে পারে, কত পাশবিক হতে পারে, তা উপলব্ধি করার জন্য বিপ্লবপূর্ব ফরাসি সমাজটি বিবেচনায় আনা যথেষ্ট। প্রাকবিপ্লব ফরাসি সমাজে যখন শাসক ও সামন্তপ্রভুরা সাধারণ নিরীহ কৃষক-শ্রমিক জনতার রক্ত শুষে খাচ্ছিল, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য যোগাতে না পেরে নিজ সন্তানদেরকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন মানবতার বাণী নিয়ে আসা ধর্মও তাদের নিয়ে কৌতুক করতে ছাড়ে নি। 
.
প্রাকবিপ্লব ফ্রান্সে ধনে-মানে শীর্ষে ছিল যাজকশ্রেণি। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও ফ্রান্সের এক দশমাংস, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি হাজার বর্গমাইল জমি এই শ্রেণির দখলে ছিল। এর ওপর ছিল কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করা ‘টাইদ’। টাইদ হচ্ছে এক প্রকার করের মত, ফসল কিংবা পালিত পশুর একাংশ বাধ্যতামূলকভাবে টাইদ আদায়কারীদেরকে দিতে হত যা অনেকাংশেই গরীব কৃষকদের উপর বোঝা হয়ে চেপেছিল। এইসব বিত্ত-বৈভব জমা হত চার্চের ঊর্ধ্বতন অধিকর্তা ‘বিশপ’ বা ‘অ্যাবট’দের হাতে। এরা সবাই ছিল অভিজাত বংশোদ্ভূত।
.
প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের চার্চ শুধু ধনীই নয়, ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। চার্চ কোনো কর দিত না। উচ্চতর যাজকরা সরকারের নীতির ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলত। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল চার্চের নিয়ন্ত্রণে। চার্চ নিজস্ব আদালত চালাত। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেন্সরশিপের দায়িত্ব নিয়ে এরা তথ্যের উৎসগুলোকে মুঠোয় পুরে রাখে। নিরক্ষর কৃষকদের কাছে সরকারি নির্দেশাবলির ইচ্ছামত ব্যাখ্যা দিত যাজকরা। এসব কারণে ক্রমশই ফ্রান্সের সাধারণ জনগণের মধ্যে চার্চের প্রতি আস্থা কমতে থাকে এবং এক সময় চার্চবিরোধী সেন্টিমেন্ট দানা বাঁধে। এদিকে একই সময়ে ২০-২৫ হাজার খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী এবং প্রায় ৪০ হাজার সন্ন্যাসিনী তখন দিন কাটাচ্ছিল গভীর নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।
.
সময়টি কল্পনা করুন। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকের ফ্রান্স। একদিকে দরিদ্র-বুভূক্ষু সাধারণ জনগণ, যাদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র নেই, পেটে খাদ্য নেই, চাষ করবার জমি নেই, আছে কেবল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর অপমান, যাদের সম্পর্কে ইংরেজ পর্যটক টোবিয়াস স্মলেট বলেছিলেন- এরা মানুষ নয়, হাড়জিরজিরে কঙ্কাল; অন্যদিকে অফুরন্ত ভোগ-বিলাসিতার মধ্যে ডুবে থাকা যাজক-পুরোহিত শ্রেণি, যারা ধর্মকে বানিয়েছে নিপীড়নের কল। এই কুৎসিত চিত্র যে সমাজের মানুষকে দিনের পর দিন দেখে যেতে হয়েছে, নিজের কষ্টার্জিত ফসল নিরূপায় হয়ে চার্চের হাতে তুলে দিতে হয়েছে, আর সন্তানদের অনাহারী মুখ নীরবে সয়ে যেতে হয়েছে, তারা ধর্মবিমুখ হবে না তো কে হবে?
.
এরকম একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন একদল নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামবে, অন্যায়কে উৎখাত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সামনে এগোবে, তখন স্বভাবতই তারা চাইবে ধর্মের নামে গড়ে ওঠা স্বার্থের ইমারতটাকেও ধ্বংস-বিধ্বস্ত করতে। তখন ‘অভিজাতরা নিপাত যাক’ ‘যাজকরা ধ্বংস হোক’- এমন স্লোগান তাদের মুখে মানায় এবং ভালোভাবেই মানায়। যাজকতন্ত্র ধ্বংস না হলে মুক্তির কথা কল্পনাও করা যেত না।
.
ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা বিকাশের পথে ফরাসি বিপ্লব ছিল বিরাট একটি মাইল ফলক। এই বিপ্লব সারা পৃথিবীতে একটি বার্তা পৌঁছে দেয় যে, ধর্ম যা-ই বলবে, ধর্মের নামে যা-ই বলা হবে, তাকে নীরবে সইতে হবে এমন কথা নেই। ধর্মের ধ্বজাধারীদেরও অবাধ্য হওয়া যায় এবং বিদ্রোহ করা যায়। এই যে নিপীড়িত-আর্তপীড়িত দরিদ্র-অনাহারী মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের দুঃসাহসিক সংগ্রামে নামল এবং তা করতে গিয়ে একেবারে ধর্মের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে গেল, এটা কি অন্যায় ছিল? আমি তা মনে করি না। মানবকল্যাণে আসা ধর্ম যখন একটি শ্রেণির বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়, ধর্মকে কুক্ষিগত করে সাধারণ মানুষের উপর অন্যায়, অবিচারমূলক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, রাজা বা সমাজপতিদের অন্যায়কে ধর্ম দিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা হয় তখন স্বভাবতই মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ক্ষোভ জাগ্রত হয় ধর্মের প্রতিও। সেই ক্ষোভের ন্যায়সঙ্গত বিস্ফোরণ আজ হোক কাল হোক হবেই। সেটাকে অন্যায় ভাবার কারণ নেই।
.
আসলে বিপ্লব হয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। ধর্ম ও অন্যায় তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল বলেই আমাদের বিভ্রম হয় যে, ধর্ম উৎখাতই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। বস্তুত ওই সমাজে ধর্মের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিল ধর্মের নামে গড়ে ওঠা কিছু অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, যাও কালক্রমে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। আর ছিল সীমাহীন অন্যায়, অবিচার, অনাচার, শোষণ আর বঞ্চনা। এসবের বিরুদ্ধে যারা ন্যায় ও মানবতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমি তাদেরকেই ধর্মের ধারক বলব। ধর্ম তখন চার্চে ছিল না, রাজদরবারেও ছিল না, ধর্ম ছিল নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মন্ত্রণায়। সেই মন্ত্রণায় যারা উজ্জীবিত হয়ে মানবতার কল্যাণে আত্ম উৎসর্গ করেছিল তারাই ধর্মের সৈনিক, অথচ আজকে তাদেরকে পরিচয় করানো হয় ধর্মদ্রোহী হিসেবে। ধর্মদ্রোহী ছিল ওই যাজকরা, ওই অভিজাতরা, ওই রাজ-রাজড়া ও জমিদাররা যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। যাদের পাশবিক ভোগ-বিলাসিতার রসদ যোগাতে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিককে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। একটি কথা আমাদেরকে আত্মায় গেঁথে নিতে হবে যে, ধর্ম কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়, নয় কোনে আচার-প্রথার নাম, ধর্ম হচ্ছে ন্যায়, সত্য, মানবতা ও মুক্তির নাম।

No comments:

Post a Comment