Friday, April 7, 2017

ইসলামের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রশক্তি দখল করা নয়

কোরাইশরা দু’টি উপায় বের করেছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা থামানোর জন্য।
একটি উপায় হচ্ছে- মুসলমানদেরকে নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করা ও অন্যদেরকে ইসলাম গ্রহণে বিরত রাখা, অপরটি হচ্ছে- যে কোনো কিছুর বিনিময়ে রসুলের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যেন তিনি চুপ থাকেন।

এই লক্ষ্যে কোরাইশরা তাদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উতবা ইবনে রাবিআ’কে পাঠাল রসুলের কাছে। সে গিয়ে রসুলকে বলল, ‘মোহাম্মদ, তুমি তো আমাদেরই লোক। কত উচ্চ বংশে তোমার জন্ম তুমি তো জানই। কত পুরনো খান্দানী ঘর তোমাদের। তুমি তোমার জাতির কাছে এসেছো এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে। কিন্তু তুমি তাদের জীবনধারাকে উপহাস করছো, বলছো তারা অবিশ্বাসী। আমার কথা শোনো। কতগুলো প্রস্তাব এনেছি। এর যে কোনোটা তুমি গ্রহণ করতে পার।’’

রসুলাল্লাহ প্রস্তাবগুলো শুনতে চাইলেন। সে বলল ‘তুমি যদি টাকা চাও তোমাকে মক্কার সবচেয়ে বিত্তশালী লোক বানিয়ে দিব, যদি নারী চাও কোরাইশদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তুমি বিয়ে করতে পার, আর যদি সার্বভৌমত্ব চাও, তবে তোমাকে আমাদের বাদশাহ বানিয়ে দিব। শর্ত একটাই, আমাদের দেব-দেবী নিয়ে তুমি কোনো কথা বলবে না।’’

এ প্রস্তাবের জবাবে আল্লাহর রসুল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি দৌলত চান না, নারী চান না এবং তিনি সাম্রাজ্যের ভিখিরিও নন। তিনি আল্লাহর বার্তাবাহক। তিনি এমন উপদেশবাণী নিয়ে এসেছেন যা গ্রহণ করলে সবারই ইহকাল ও পরকাল শান্তিপূর্ণ হবে।

রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা ও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া যে এক জিনিস নয় তা বুঝতে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে মূল্যায়ন করতে হবে। যারা হেকমতের দোহাই দিয়ে অনায়াশে ইসলামের মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করে আর দশটা রাজনৈতিক দলের মত যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করেন, তাদের বোঝা উচিত যে, মক্কার মোশরেক নেতারা যখন রসুলকে আরবের বাদশাহ বানাতে প্রস্তাব দিয়েছিল এই শর্ত্তে যে, তিনি তাদের দেব-দেবীগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলবেন না, তখন তিনি ‘হেকমতের’ কথা চিন্তা করলে এই ভাবতে পারতেন যে, আরবের বাদশাহ হলে আমি যা করতে চাই তা অনেক সহজ হয়ে যাবে। কারণ তখনকার দিনের বাদশাহী আজকের দিনের বাদশাহদের মত ছিলো না, তখনকার দিনের রাজা-বাদশাহরা ছিলেন সর্বেসর্বা, তাদের হুকুমই ছিলো আইন। মানুষের প্রাণের মালিক ছিলেন রাজা-বাদশাহরা। হাজার মানুষের মাথা কাটার হুকুম দিলেও তা বিনা প্রশ্নে কাটা হতো।

মহানবী ভাবতে পারতেন কিছুদিনের জন্য দেব-দেবীদের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করে রাজশক্তি হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে সমাজকে বদলিয়ে তওহীদে পরিবর্তিত করলে তো খুব ‘হেকমতের’ সঙ্গে কাজ করা হয়, তাতে অনেক কম কষ্ট হবে, অনেক প্রাণ বেঁচে যাবে, আমার কাজও হয়ে যাবে। তিনি তা ভাবেন নি, করেনও নি। তিনি আপোসহীন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এটা এই জন্য যে, ইসলাম কোনো ‘চাপিয়ে’ দেওয়ার বিষয় নয়। শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করা আর ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সমান কথা নয়। ইসলাম একটি মূল্যবোধ।

ইসলাম এমন এক মূল্যবোধ যা মানবজাতির জাতীয়, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি, দৈহিক ও আত্মিক চাহিদার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। ‘চোরদের হাত কাটা আর ব্যাভিচারীকে বেত্রাঘাত করা’র মত শরীয়তের কয়েকটি আল্টিমেট বিধান কার্যকর করাই যদি ইসলামের সারবস্তু হত তবে আল্লাহর রসুল মক্কাবাসীর প্রস্তাব সানন্দে মেনে নিতেন এবং তখনই ইসলামের আবির্ভাব সার্থক হয়ে যেত। রসুলাল্লাহ ও তাঁর আসহাবদেরকে বারবার প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হত না। স্বদেশ থেকেও বিতাড়িত হবার দরকার পড়ত না।

No comments:

Post a Comment