কোর’আনের একটি আয়াতকে (মায়েদা ৫১) প্রায়শই আমাদের সর্বধর্মীয় বক্তব্যের বিপরীতে ঢাল হিসেবে দাঁড় করেন নাস্তিকরা। সর্বধর্মীয় ঐক্যের পক্ষে আপনি যতই কোর’আনের আয়াত উদ্ধৃত করুন, রসুলের জীবন থেকে উদহরণ টানুন, কোনো কথাই তারা শুনবে না। আল্লাহ ইহুদি ও খৃষ্টানদের সাথে মু’মিনদেরকে গভীর বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, ব্যস, এখানেই যা হবার তা হয়ে গেছে, ওই আয়াতের পর আর কোনো কথা থাকে না, কারণ ওখানে আল্লাহ নাকি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছেন (নাউজুবিল্লাহ)! আসলেই কি তাই? আজ এ ব্যাপারে আলোচনায় যাব। আগ্রহীরা সাথে থাকবেন আশা করি।
আল্লাহ বলেছেন- হে মু’মিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে আউলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু, অভিভাবক, সাহায্যকারী) হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের আউলিয়া। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না (মায়েদা: ৫১)।
প্রথম কথা হচ্ছে,
এই আয়াতে আল্লাহ ‘মুসলমানদেরকে’ সম্বোধন করেন নি। তিনি বলেছেন ‘ইয়া আয়্যুহাল্লাজিনা আমানু’। অর্থাৎ নির্দেশটি মু’মিনদের প্রতি। এখন জানতে হবে মু’মিন কারা। একজন মানুষ প্রচলিত অর্থে মুসলমান না হয়েও কিন্তু মু’মিন হতে পারেন। আবার মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও অনেকে মু’মিন নাও হতে পারে। মু’মিন ও মুসলিম শব্দদ্বয়ের মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ আছে। আল্লাহ এখানে যে নির্দেশ দিচ্ছেন তা প্রচলিত অর্থে ধর্মীয় সম্প্রদায় বলতে যা বোঝানো হয় তেমন কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে দিচ্ছেন না, তাঁর এই নির্দেশ কেবল মু’মিনদের জন্য, যাদের অবস্থান সকল প্রকার জাতি-গোত্র-আচার-প্রথা-রীতি-নীতি-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে। জাতিতে তারা ইহুদিও হতে পারে, খৃষ্টানও হতে পারে, মুসলমানও হতে পারে। এ কথায় যারা আপত্তি করবেন তাদেরকে অনুরোধ করব সুরা বাকারার ৬২ নম্বর আয়াতটি পড়ার জন্য। সেখানে আল্লাহ বলেছেন-
‘নিঃসন্দেহে যারা মুসলিম হয়েছে এবং যারা ইহুদি, নাসারা ও সাবেইন, যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কেয়ামত দিবসের প্রতি, সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনোই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।’
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
‘আরবরা বলে আমরা ঈমান এনেছি (অর্থাৎ মু’মিন হয়েছি), বলুন- তোমরা ঈমান আনো নি, বরং বল, আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি (মুসলিম হয়েছি)। এখনও তোমাদের অন্তরে ঈমান জন্মেনি (হুজরাত ১৪)।’
মুসলিম হওয়া এবং ঈমান আনয়ন করা যে ভিন্ন বিষয় তার আরও একটি দৃষ্টান্ত আমরা পাই রসুলের জীবনীতে। সা’দ (রা.) বলেন-
একবার আমি রসুলাল্লাহর (সা.) কাছে বসা ছিলাম যখন তিনি একদল লোককে দান করছিলেন। সেখানে এমন একজন লোক বসা ছিলেন যাকে আমি একজন উত্তম মো’মেন বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তিনি তাকে কিছুই দিলেন না। এ দেখে আমি বললাম ইয়া রসুলাল্লাহ, আপনি ওনাকে কিছু দিলেন না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি একজন মো’মেন। রসুলাল্লাহ (সা.) বললেন মো’মেন বলো না মুসলিম বলো। আমি কিছু সময় চুপ থেকে আবার ঐ কথা বললাম এবং তিনিও আবার ঐ জবাবই দিলেন-মো’মেন বলো না মুসলিম বলো। তৃতীয়বার আমি ঐ কথা বললে রসুলাল্লাহ বললেন সা’দ! আমি অপছন্দনীয় লোকদেরও দান করি এই কারণে যে আমার আশংকা হয় তারা অভাবের চাপে জাহান্নামের পথে চলে যেতে পারে (হাদীস- বোখারী)’।
এখানে মহানবীর কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে মো’মেন ও মুসলিম এক নয়। আর যে আয়াত নিয়ে কথা হচ্ছে সেই আয়াতের নির্দেশনা কেবলই মু’মিনদের জন্য- এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের সামনে এগোতে হবে।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে,
আয়াতটিতে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ‘আউলিয়া’। আউলিয়া অর্থ অভিভাবক, সাহায্যকারী, অন্তরঙ্গ বন্ধু ইত্যাদি। খুবই স্বাভাবিক কথা। মু’মিনদের অভিভাবক ও বন্ধু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারও কৃপাপ্রার্থী হওয়া মো’মেনদের জন্য সাজে না। যে কোনো অবস্থায় মো’মেনরা কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে, আল্লাহকে ভরসা করবে- এটাই মোমেনদের চরিত্র।
তৃতীয় কথা হচ্ছে,
আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপটে নাজেল হয়েছিল সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। মদীনায় মু’মিনদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অনেক মুনাফিক তলে তলে ইহুদিদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হত। এ ষড়যন্ত্র প্রকট আকার ধারণ করত যখন মুসলমানরা কুরাইশ বা অন্য কোনো প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হত কিংবা বড় ধরনের কোনো বিপদের মুখে পড়ত। এ গুপ্তচরবৃত্তি ঠেকানোর জন্য আল্লাহ মু’মিনদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যেন তারা ইহুদি ও খৃষ্টানদের ব্যাপারে সাবধান থাকে। সেই সাথে যেসব মুনাফিক গুপ্তচরবৃত্তি করত আখেরাতে তাদের পরিণতি কী হবে সেটাও এর পরবর্তী আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে।” ভুলে গেলে চলবে না যে, তখন ইহুদিরা ছিল মদীনার বিরাট একটি রাজনৈতিক শক্তি। আল্লাহর রসুলের উদারতা ও ঐক্যপ্রচেষ্টার ফলেই তাদের সাথে মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল এবং একই রাষ্ট্রের অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিল। কিন্তু ইহুদিরা মনে-প্রাণে চাইত মুসলমানরা কোরাইশদের হাতে পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাক। এই লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রেরও কোনো ত্রুটি রাখে নি ইহুদিরা। রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক এ সকল কর্মকাণ্ড যে ঘটছে তা আল্লাহর রসুল জানতেন। তিনি পারতেন মুসলিমদেরকে নিয়ে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ব্যবস্থাগ্রহণ করতে, কিন্তু আল্লাহ তা চান নি। আল্লাহ বরং মু’মিনদেরকেই বারবার সাবধান করেছেন, কড়া ভাষায় আদেশ করেছেন- ওদেরকে নিজেদের অভিভাবক বানিও না খবরদার। যদি কর তবে ওদের যা পরিণতি হবে তোমাদেরও তাই হবে। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় এ আয়াত অনিবার্য রক্তপাত এড়ানোর প্রচেষ্টামাত্র।

খন্দকের যুদ্ধে মদীনা যখন ভয়ানক সংকটকাল অতিক্রম করছিল, তখন সুযোগ বুঝে ইহুদি গোত্র বনি কুরায়জা মুসলিমদের সাথে চুক্তিভঙ্গ করে কুরাইশদের সাথে হাত মেলায়।
চতুর্থ কথা হচ্ছে,
আয়াতটিতে মু’মিনদেরকে বলা হচ্ছে তারা যেন ওই সকল লোককে নিজেদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী বন্ধু মনে না করে যারা নিজেদেরকে ইহুদি ও খৃষ্টান বলে দাবি করে। ইহুদি ও খৃষ্টান বলতে আল্লাহ কাদেরকে বোঝাচ্ছেন, ইহুদি কারা, খৃষ্টান কারা- এ বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে এ আয়াতের মর্মার্থ পরিপূর্ণভাবে বোঝা যাবে না। কাজেই আমরা এবার সে আলোচনায় প্রবেশ করব। জানার চেষ্টা করব ইহুদি ও খিৃষ্টানদেরকে অভিভাবক (আউলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে মু’মিনদের ক্ষতিটা কোথায়।
রসুলাল্লাহ বলেন-
আমরা সব নবীরা পরস্পরের বৈমাত্রেয় ভাই, আমাদের সবারই দ্বীন এক। (বুখারী ও মুসলিম)
ইসলামের এই মৌলিক সূত্রটি ভুলে গেলে আপনি যত বড় গাণিতিকই হোন, ইসলামের অঙ্ক মেলাতে পারবেন না। যখনই আপনি আন্তধর্মীয় আলোচনায় যাবেন, ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মের সম্পর্ক বিশ্লেষণের চেষ্টা করবেন, অবশ্য অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যুগে যুগে আল্লাহ যত নবী পাঠিয়েছেন সবাই এসেছেন একই দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে। যুগের প্রেক্ষাপটের সাথে হারাম-হালাল, করণীয়-বর্জনীয়র বিধান অর্থাৎ শরীয়তে পরিবর্তন এলেও দ্বীন সবযুগে একটাই ছিল। সেটা আল্লাহর প্রেরিত দ্বীন, দ্বীনুল হক্ব, দ্বীনুল কাইয়েমা বা সনাতন দ্বীন। ঈসা (আ.) এর অনুসারী দাবিদাররা আজকে যে দ্বীন অনুসরণ করেন তার নাম ‘খ্রিষ্টধর্ম’। অথচ সারা জিন্দেগীতে ঈসা (আ.) ‘খ্রিষ্টধর্ম’ বলে কোনো শব্দই শোনেন নি। একইভাবে আজকে অনেকে ইসলামকে বলেন ‘মোহাম্মদী ধর্ম’, যে নাম মোহাম্মদ (সা.) কখনই শোনেন নি। নবী-রসুলগণ গত হয়ে যাবার পর এভাবেই নবী-রসুলদের নাম ব্যবহার করে আল্লাহর প্রেরিত দ্বীনুল হক্বকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করার ঘটনা ইতঃপূর্বে ঘটেছে। জুডাই ধর্ম, খৃষ্টধর্মের নামকরণ হয়েছে এভাবেই। সুতরাং ইসলাম ধর্ম থেকে জুডাই ধর্ম ও খৃষ্টধর্মকে পৃথক করে ফেললে হবে না। মনে রাখতে হবে ধর্ম একটাই, পার্থক্য কেবল স্থান-কাল-পাত্রে।

মূল ধর্ম এক বটে, বিভিন্ন আধার/ জল এক ভিন্ন তটে, ভিন্ন জলাশয়
ঈসা (আ.) এর নবী হিসেবে আগমণই প্রমাণ করে ইহুদিরা তখন মুসা (আ.) এর মাধ্যমে আসা দ্বীনুল হক্ব বা ইসলাম থেকে সরে গেছে। ঠিক যতখানি সরে গেলে নতুন নবী পাঠিয়ে সংশোধন করার দরকার পড়ে ততখানিই সরে গেছে। ফলে ঈসা (আ.) এলেন ইহুদি জাতির ধর্মান্ধতা দূর করে পুনরায় তাদেরকে মুসা (আ.) এর আনিত দ্বীনে (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। নতুন কোনো ধর্ম তৈরি করার কথা তিনি ভাবতেও পারতেন না। আল্লাহ বলেন-
‘‘মারইয়াম তনয় ঈসাকে তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে উহাদের পশ্চাতে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাহাকে ইনজীল দিয়েছিলাম; উহাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো।”
কোন পথের নির্দেশ? যে পথ দিয়ে ইহুদি জাতি বিকৃতির গহ্বর থেকে বেরিয়ে পুনরায় আল্লাহর দ্বীনে (ইসলাম) প্রবেশ করতে পারে সেই পথ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইহুদি জাতি সে পথ গ্রহণ করল না। তারা আল্লাহর দ্বীনের বহির্গতই রয়ে গেল, আগের মতই তারা আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে পুরোহিত রাব্বাই-ফরিসিদের আনুগত্য করে যেতে থাকল। অন্যদিকে ঈসা (আ.) এর আহ্বান যখন ইহুদিরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করল, ঈসা (আ.) আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেন, তখন তাঁর অল্পকিছু অনুসারী চিন্তা করল- নবীর শিক্ষাকে এভাবে বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। পল নামের একজন ব্যক্তি, যিনি ঈসা (আ.) এর কাছ থেকে সরাসরি কোনো শিক্ষা লাভ করেন নি, তিনি প্রস্তাব দিলেন- এই শিক্ষা ইহুদিদের বাইরে প্রচার করা হোক। সেটাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এ ছাড়া ঈসা (আ.) এর শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখার অন্য কোনো উপায় তখন ছিল না। ফলে ঈসা (আ.) এর নির্দেশ অমান্য করে তাঁরই শিক্ষাগুলোকে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ নাম দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার শুরু হলো। রোমের রাজা কনস্টানটাইন সেই ধর্ম গ্রহণ করে নিলে রাজশক্তির আনুকুল্য পেয়ে অল্পদিনের মধ্যে ইউরোপের প্রধান ধর্মে পরিণত হলো ‘খ্রিষ্টধর্ম’। এই যে নতুন আরেকটি ধর্মের বিকাশ হলো, তার বিপদটা কোন জায়গায় তা বুঝতে হলে আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

ঈসা (সা.) নবীকে উঠিয়ে নেবার পর বা বাইবেলের ভাষায় ক্রুশবিদ্ধ করার পর পলের নেতৃত্বে ঈসা (আ.) এর সঙ্গী-সাথীরা জেরুজালেমের বাইরে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন।
আগেই বলা হয়েছে ঈসা (আ.) এসেছিলেন কেবল মুসা (আ.) এর আনিত দ্বীনটিকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, বিকৃতিগুলোকে দূর করতে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তওরাত তখন পর্যন্ত মোটামুটি অবিকৃতই ছিল, সমস্যা হয়েছিল দ্বীনের আত্মিক ভাগটায়। ধর্মকর্মের আনুষ্ঠানিকতাই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন, অন্যদিকে মানবতার দিকটা উপেক্ষিত হচ্ছিল ভয়ানকভাবে। সেই মানবতার ভাগটাকে যথাস্থানে স্থাপনের দায়িত্ব ছিল ঈসা (আ.) এর উপর। তাই তিনি তাঁর নবী জীবনে মানবতার কথা বেশি বলেছেন, অসুস্থ-রোগগ্রস্থ মানুষের উপকার করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচানোও ধর্মেরই কাজ। এটাকে উপেক্ষিত রেখে যত নিখুঁতভাবে শরীয়তের বিধান মান্য করা হোক আল্লাহ কবুল করবেন না। মোটকথা তিনি ইহুদিদের পালন করা দ্বীনটিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। দ্বীনের শরীয়ত ও আত্মিক ভাগটাকে একসূত্রে গেঁথে দেওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু ঈসা (আ.) গত হয়ে যাবার পর, তাঁর নাম ব্যবহার করে বনি ইজরাইলের বাইরে পৃথিবীময় যে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রচার আরম্ভ হলো তাতে স্বাভাবিকভাবেই স্থান পেল কেবল মানবতার কথা, উদারতার কথা, অর্থাৎ দ্বীনের ওই হারিয়ে যাওয়া আত্মিক ভাগটা। কিন্তু শরীয়ত? শরীয়ত তো তাওরাতে। ঈসা (আ.) কোনো শরীয়ত নিয়ে আসেন নি, তার প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু এখন প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কারণ শরীয়ত ছাড়া কোনো দ্বীন চলতে পারে না। সমস্যাটা বাঁধল এখানেই। ইহুদিদের বাইরে ‘খ্রিষ্টধর্মে’র নাম করে যে ধর্মটি প্রচার করা শুরু হলো তা সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন একটি দ্বীন। দুই পায়ে ভর করে চলার কথা যে মানুষের, তাকে এক পায়ে ভর দিয়ে চলতে বাধ্য করা হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মুখ থুবড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঘটনাচক্রে খ্রিষ্টধর্ম তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও ধর্মটি অনেক পথ পাড়ি দিতে পেরেছে। ইনকুইজিশনের মত বর্বরতার সাহায্য নিয়ে হলেও পেরেছে।

ধর্মের নামে ইউরোপের মধ্যযুগীয় বর্বরতার চিত্র।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে- যে ধর্মবিশ্বাসটির জন্মই হলো ঈসা (আ.) এর আদেশ লঙ্ঘন করে, যে জাতিগোষ্ঠী আল্লাহর দেওয়া সত্যদ্বীন পেল না, পেল একটি ভারসাম্যহীন অপ্রাকৃতিক দ্বীন যা মানবসমাজকে শান্তি দিতে অক্ষম, সেই জাতি-গোষ্ঠীকে সত্যের সন্ধান দিতে যে নবীর আগমণ ঘটল সেই বিশ্বনবীর অনুসারীরা কেন ওই বিপথগামী জাতিকে নিজেদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে? মু’মিনদের কাছে আছে সেই সত্য, যা যুগে যুগে নবী-রসুলগণ শিক্ষা দিয়েছেন। যে সত্য ঈসা (আ.) পেয়েছিলেন, যে সত্য মুসা (আ.) পেয়েছিলেন, সেই সত্যেরই চূড়ান্ত ভার্সন তখন মু’মিনদের হাতে। ওই সত্যের অনুগামী না হয়ে তারা কেন ঈসা (আ.) এর অনুসারী দাবিদারদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে? বাস্তবতার নিরিখে ভাবলে ওরা তো ঈসা (আ.) এর প্রকৃত অনুসারী নয়। বরং প্রকারান্তরে মু’মিনরাই ঈসা (আ.) এর প্রকৃত অনুসারী।
অন্যদিকে ইহুদিদের প্রসঙ্গেও একই কথা। তারা মুসা (আ.) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত দ্বীনকে মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের কমপক্ষে পাঁচশ বছর আগেই এতখানি বিকৃত করে ফেলেছিল যার জন্য তাদের সংশোধন করতে আল্লাহকে নতুন নবী পাঠাতে হয়েছে। সেই নবীকেও তারা গ্রহণ করে নি। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও পাঁচশ’ বছর। ততদিনে বিকৃতির স্তর আরও পুরু হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ পাঠিয়েছেন আখেরী নবীকে। সেই আখেরী নবীর মাধ্যমে আসা সত্যকে যে মু’মিনরা ধারণ করল, তারা কেন শত শত বছর পূর্বেই মুসা (আ.) এর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া একটি জাতিকে নিজেদের অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক বানাবে? যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ নেয় না, যারা স্বার্থের বশবর্তী হয়ে আল্লাহর প্রেরিত নবীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না, আর যাই হোক মু’মিনদের অভিভাবক বা সাহায্যকারী বন্ধু হবার যোগ্যতা তাদের নেই। এ কারণেই আল্লাহর সোজা নির্দেশ- মু’মিনরা যেন ইহুদি ও খৃষ্টানদেরকে নিজেদের অভিভাবক মনে না করে। ওদের অভিভাবক বলে স্বীকার করার অর্থ তাদের কথামত চলা। যেহেতু তাদের কাছে সত্য নেই, তারা নিজেরা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে, কাজেই মু’মিনরা তাদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করলে তারা মু’মিনদেরকেও সত্যবিচ্যুত করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে বাধ্য করবে, বিপথগামী করবে। সমস্যাটা এখানেই। ইহুদি ও খ্রিষ্টান বলে যারা পরিচিত তাদের কাছে যদি সত্য থাকত তবে আল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন না। সত্য নেই বলেই এই বাড়তি সতর্কতা।
কোর’আন ইঞ্জিলকে স্বীকৃতি দেয়, তাওরাতকেও স্বীকৃতি দেয়। কেন দিবে না? কোর’আন তো তাওরাত, ইঞ্জিলসহ যত ধর্মগ্রন্থ আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সবগুলোর আপডেট সংকলন। কিন্তু একটি কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে- আপনি জন্মের দশ মাস বয়সে যে খানা খেয়েছেন দশ বছর বয়সের জন্য তা যথেষ্ট নয়। আবার দশ বছর বয়সে যে পোশাক পরেছেন পরিণত বয়সে তা অনুপযুক্ত। মানবজাতিও শিশুকাল থেকে শৈশব-কৈশোর পার হয়ে যৌবনে উপনীত হয়েছে। যুগে যুগে তার বয়সের অনুপাতে আল্লাহ খাদ্য-বস্ত্র নির্ধারণ করেছেন। এখন তার পরিণত বয়স। এখন তাকে সাগু খাইয়ে রাখলে হবে না। এখন সে নরম খাবার খাবে, শক্ত খাবারও খাবে। সাত্ত্বিক খাবার খাবে, তামসিক খাবারও খাবে। শেষ ইসলাম হচ্ছে মানবজাতির পরিণতি বয়সের উপযোগী দ্বীন। যারা এই যুগোপযোগী সত্য এসে পড়ার পরও প্রাচীনত্বের মোহ ত্যাগ করতে পারছেন না তারা তাদের মত থাকলে কোনোই অসুবিধা নেই। কেউ সারাজীবন শুধু সাগু খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলে ভাত-মাছওয়ালাদের আপত্তি খাকার কথা নয়। কিন্তু একটি কথা প্রাচীনপন্থীদের জেনে রাখতে হবে, নতুনের প্রাণে যে তারুণ্যের উদ্যোম সৃষ্টি হয়েছে তা কখনও প্রাচীনের কাছে মাথানত করবে না, করতে পারে না। যদি সে প্রাচীনের কাছে আত্মসমর্পণ করে তবে প্রাচীন তাকে গ্রাস করে নিবে, নতুনের অগ্রযাত্রা শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। এটা প্রাকৃতিক সত্য। তাই এ সত্যের যিনি স্রষ্টা তাঁর পক্ষ থেকে প্রাচীনের কাছে মাথানত না করার এমন স্পষ্ট সতর্কবাণী।
No comments:
Post a Comment