Friday, April 7, 2017

কালো পাথরে চুম্বনের উদ্দেশ্য কী?

হাদিসে হাজরে আসওয়াদকে বেহেশতি পাথর বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোকনে আসওয়াদ অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম বেহেশতের দুটো ইয়াকুত পাথর।’(তিরমিজি)
.
প্রতিবছর হজের সময় হাজিদের অন্যতম কাজ আল্লাহর প্রেমে ব্যাকুল হয়ে পবিত্র কাবাঘর জিয়ারত ও তাওয়াফ করা। হাজরে আসওয়াদ তাওয়াফ শুরুর স্থানে অবস্থিত। প্রথমে এখান থেকেই তাওয়াফ শুরু করতে হয়। ‘বায়তুল্লাহ’ বা কাবাগৃহ তাওয়াফ ও প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ ও চুম্বন করতে হয়।
.
হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়ার ফজিলত নিয়ে আলোচনা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এর কারণ কী, এতে ব্যক্তির কী লাভ হয়, জাতির কী লাভ হয় তা আমরা অনেকেই জানি না। আজকে এ বিষয়ে কিছু কথা বলব।
.
হজ্বের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার মূলে আছে জাতির চারিত্রিক প্রশিক্ষণ। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ঐক্য সৃষ্টি। পবিত্র ক্বাবা হচ্ছে উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। সেই ঐক্যের কেন্দ্রভূমিতে বছরে একবার উপস্থিত হয়ে মুসলমানরা উপলব্ধি করে যে, তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, যে অবস্থাতেই থাকুক, তারা এক অখণ্ড জাতি এবং সেই অখণ্ডতার প্রতীক হচ্ছে পবিত্র ক্বাবা। এই চেতনা থেকে যখন তারা ক্বাবায় মিলিত হয়, তখন সেই ক্বাবাগৃহের নির্দিষ্ট একটি ঐতিহ্যবাহী পাথর, হাজরে আসওয়াদ হয়ে ওঠে জাতির ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মূর্ত প্রতীক।
.
চুম্বন হচ্ছে সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার প্রকাশ। আরবরা তাদের পাস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা প্রকাশ করে চুম্বনের মাধ্যমে। এই ভালোবাসার বন্ধনকে হজ্বে আগত লাখ লাখ মুসলমানের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহ একটি নির্দিষ্ট পাথরকে ব্যবহার করেছেন- এই হচ্ছে মূল বিষয়।
.
সব মানুষ একটি নির্দিষ্ট পাথরে চুমু খাওয়ার মাধ্যমে কার্যত নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধনকেই আরও দৃঢ় করার প্রয়াস পায়। অথচ এক ময়দানে সমবেত হয়ে এক পাথরকে চুমু খেয়ে বাড়ি ফিরে আজ এই জাতি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, একে অপরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ রটনা করে, একে অপরকে বোমা মেরে হত্যা করে, একজন অপরজনের ক্ষতি করে বেড়ায়। যেখানে আল্লাহ ঐক্যসৃষ্টির বহু বহু ব্যবস্থা রাখার পর শেষাবধি একটি পাথরকেও জাতির ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব তৈরির অনুষঙ্গ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন, সেখানে এই জাতি কীভাবে নিজেদের মধ্যে হাজারো বিভেদের দেয়াল তৈরি করে রাখে?
.
অনেকে বলতে পারেন- কাবা তাওয়াফের জন্য, অর্থাৎ কতবার চক্কর দেওয়া হলো তার গণনার সুবিধার্থে এটা একটি চিহ্নিত স্থান হিসেবে কাজে লাগে। হ্যা, সেটা হতে পারে। তবে তা আমার বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে না। হাজরে আসওয়াদে চুম্বনের এটাই যৌক্তিক কারণ বলে আমার ধারণা। অন্য কোনো যৌক্তিক কারণ কারও জানা থাকলে আমাকে জানালে খুশি হব।

ফরাসি বিপ্লব কি ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল?

ধর্মের অপব্যবহারের রূপ কত কদর্য হতে পারে, কত পাশবিক হতে পারে, তা উপলব্ধি করার জন্য বিপ্লবপূর্ব ফরাসি সমাজটি বিবেচনায় আনা যথেষ্ট। প্রাকবিপ্লব ফরাসি সমাজে যখন শাসক ও সামন্তপ্রভুরা সাধারণ নিরীহ কৃষক-শ্রমিক জনতার রক্ত শুষে খাচ্ছিল, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য যোগাতে না পেরে নিজ সন্তানদেরকে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন মানবতার বাণী নিয়ে আসা ধর্মও তাদের নিয়ে কৌতুক করতে ছাড়ে নি। 
.
প্রাকবিপ্লব ফ্রান্সে ধনে-মানে শীর্ষে ছিল যাজকশ্রেণি। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও ফ্রান্সের এক দশমাংস, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি হাজার বর্গমাইল জমি এই শ্রেণির দখলে ছিল। এর ওপর ছিল কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করা ‘টাইদ’। টাইদ হচ্ছে এক প্রকার করের মত, ফসল কিংবা পালিত পশুর একাংশ বাধ্যতামূলকভাবে টাইদ আদায়কারীদেরকে দিতে হত যা অনেকাংশেই গরীব কৃষকদের উপর বোঝা হয়ে চেপেছিল। এইসব বিত্ত-বৈভব জমা হত চার্চের ঊর্ধ্বতন অধিকর্তা ‘বিশপ’ বা ‘অ্যাবট’দের হাতে। এরা সবাই ছিল অভিজাত বংশোদ্ভূত।
.
প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের চার্চ শুধু ধনীই নয়, ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। চার্চ কোনো কর দিত না। উচ্চতর যাজকরা সরকারের নীতির ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলত। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল চার্চের নিয়ন্ত্রণে। চার্চ নিজস্ব আদালত চালাত। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেন্সরশিপের দায়িত্ব নিয়ে এরা তথ্যের উৎসগুলোকে মুঠোয় পুরে রাখে। নিরক্ষর কৃষকদের কাছে সরকারি নির্দেশাবলির ইচ্ছামত ব্যাখ্যা দিত যাজকরা। এসব কারণে ক্রমশই ফ্রান্সের সাধারণ জনগণের মধ্যে চার্চের প্রতি আস্থা কমতে থাকে এবং এক সময় চার্চবিরোধী সেন্টিমেন্ট দানা বাঁধে। এদিকে একই সময়ে ২০-২৫ হাজার খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী এবং প্রায় ৪০ হাজার সন্ন্যাসিনী তখন দিন কাটাচ্ছিল গভীর নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।
.
সময়টি কল্পনা করুন। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকের ফ্রান্স। একদিকে দরিদ্র-বুভূক্ষু সাধারণ জনগণ, যাদের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র নেই, পেটে খাদ্য নেই, চাষ করবার জমি নেই, আছে কেবল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর অপমান, যাদের সম্পর্কে ইংরেজ পর্যটক টোবিয়াস স্মলেট বলেছিলেন- এরা মানুষ নয়, হাড়জিরজিরে কঙ্কাল; অন্যদিকে অফুরন্ত ভোগ-বিলাসিতার মধ্যে ডুবে থাকা যাজক-পুরোহিত শ্রেণি, যারা ধর্মকে বানিয়েছে নিপীড়নের কল। এই কুৎসিত চিত্র যে সমাজের মানুষকে দিনের পর দিন দেখে যেতে হয়েছে, নিজের কষ্টার্জিত ফসল নিরূপায় হয়ে চার্চের হাতে তুলে দিতে হয়েছে, আর সন্তানদের অনাহারী মুখ নীরবে সয়ে যেতে হয়েছে, তারা ধর্মবিমুখ হবে না তো কে হবে?
.
এরকম একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন একদল নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামবে, অন্যায়কে উৎখাত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সামনে এগোবে, তখন স্বভাবতই তারা চাইবে ধর্মের নামে গড়ে ওঠা স্বার্থের ইমারতটাকেও ধ্বংস-বিধ্বস্ত করতে। তখন ‘অভিজাতরা নিপাত যাক’ ‘যাজকরা ধ্বংস হোক’- এমন স্লোগান তাদের মুখে মানায় এবং ভালোভাবেই মানায়। যাজকতন্ত্র ধ্বংস না হলে মুক্তির কথা কল্পনাও করা যেত না।
.
ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা বিকাশের পথে ফরাসি বিপ্লব ছিল বিরাট একটি মাইল ফলক। এই বিপ্লব সারা পৃথিবীতে একটি বার্তা পৌঁছে দেয় যে, ধর্ম যা-ই বলবে, ধর্মের নামে যা-ই বলা হবে, তাকে নীরবে সইতে হবে এমন কথা নেই। ধর্মের ধ্বজাধারীদেরও অবাধ্য হওয়া যায় এবং বিদ্রোহ করা যায়। এই যে নিপীড়িত-আর্তপীড়িত দরিদ্র-অনাহারী মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের দুঃসাহসিক সংগ্রামে নামল এবং তা করতে গিয়ে একেবারে ধর্মের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে গেল, এটা কি অন্যায় ছিল? আমি তা মনে করি না। মানবকল্যাণে আসা ধর্ম যখন একটি শ্রেণির বাণিজ্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়, ধর্মকে কুক্ষিগত করে সাধারণ মানুষের উপর অন্যায়, অবিচারমূলক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, রাজা বা সমাজপতিদের অন্যায়কে ধর্ম দিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা হয় তখন স্বভাবতই মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ক্ষোভ জাগ্রত হয় ধর্মের প্রতিও। সেই ক্ষোভের ন্যায়সঙ্গত বিস্ফোরণ আজ হোক কাল হোক হবেই। সেটাকে অন্যায় ভাবার কারণ নেই।
.
আসলে বিপ্লব হয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। ধর্ম ও অন্যায় তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল বলেই আমাদের বিভ্রম হয় যে, ধর্ম উৎখাতই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। বস্তুত ওই সমাজে ধর্মের ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিল ধর্মের নামে গড়ে ওঠা কিছু অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, যাও কালক্রমে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। আর ছিল সীমাহীন অন্যায়, অবিচার, অনাচার, শোষণ আর বঞ্চনা। এসবের বিরুদ্ধে যারা ন্যায় ও মানবতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমি তাদেরকেই ধর্মের ধারক বলব। ধর্ম তখন চার্চে ছিল না, রাজদরবারেও ছিল না, ধর্ম ছিল নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মন্ত্রণায়। সেই মন্ত্রণায় যারা উজ্জীবিত হয়ে মানবতার কল্যাণে আত্ম উৎসর্গ করেছিল তারাই ধর্মের সৈনিক, অথচ আজকে তাদেরকে পরিচয় করানো হয় ধর্মদ্রোহী হিসেবে। ধর্মদ্রোহী ছিল ওই যাজকরা, ওই অভিজাতরা, ওই রাজ-রাজড়া ও জমিদাররা যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। যাদের পাশবিক ভোগ-বিলাসিতার রসদ যোগাতে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিককে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। একটি কথা আমাদেরকে আত্মায় গেঁথে নিতে হবে যে, ধর্ম কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়, নয় কোনে আচার-প্রথার নাম, ধর্ম হচ্ছে ন্যায়, সত্য, মানবতা ও মুক্তির নাম।

দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান ঘুঁচবে কিসে?

জনৈক জনদরদী ব্যক্তি কয়েকজন মদখোরকে বাড়িতে ডেকে আনলেন। উদ্দেশ্য- তাদেরকে তিনি হাতে কলমে মদের অপকারিতা বোঝাবেন। এজন্য তিনি দু’টি পাত্র নিলেন। একটি পাত্রে আছে পানি, অপরটিতে নির্ভেজাল মদ। জনদরদী ব্যক্তি প্রথমে পানির পাত্রে একটি কেঁচো ছেড়ে দিলেন। কেঁচোটি স্বাভাবিকভাবে নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল। এবার তিনি পানির পাত্র থেকে তুলে কেঁচোটিকে মদের পাত্রে রাখলেন। তাতে দেখা গেল কেঁচোটি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল।
অতঃপর মদখোরদের জিজ্ঞাসা করলেন- এবার বলো তো, এই ঘটনা থেকে কী বুঝলে? আসলে এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, মদ আমাদের শরীরের জন্য কত ক্ষতিকর পদার্থ। কিন্তু মদখোরগুলো উত্তর দিল- যা বুঝলাম তা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকের নিয়মিত মদ খাওয়া উচিত, তাহলে শরীরে কেচো ও ক্রিমি জন্মাবে না!
আমাদের অবস্থা হয়েছে ওই জনদরদী ব্যক্তির মত। জঙ্গিবাদকে আমরা যতটা গর্হিত কাজ বলে উপস্থাপন করছি, জঙ্গিরা এই কাজকে ততই পুণ্য ও কল্যাণকর কাজ বলে মনে করছে। আমরা চিন্তা করছি- আহারে, কেবল বোঝার ভুলে এই অল্পবয়সী তরুণগুলোর জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর তারা ভাবছে- আমাদের কী ভাগ্য! আমরা শহীদের মর্যাদা লাভ করছি, যে শহীদের মর্যাদা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নবী-রসুলদেরও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জীবন সার্থক! আমরা সফল!
আমরা ভাবছি- আহারে! এই লোকগুলো নিজেরা তো ধ্বংস হচ্ছেই, তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎও অন্ধকার করে যাচ্ছে। ওরা ভাবছে- আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছি। আমরাও সফল হচ্ছি, আমাদের সন্তানরাও সফল হবে।
আমরা ভাবছি- এই লোকগুলো কেন ওইপথে গেল? ওদের কি জীবন উপভোগ করার ইচ্ছা হয় না? জীবনের প্রতি তাদের এত অবজ্ঞা কেন? আমরা একটা তেলাপোকা দেখে আঁৎকে উঠি, আর তারা হাঁসিমুখে ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে- এত সাহস তাদের আসে কোত্থেকে? অন্যদিকে ওরা ভাবে- এই তো জীবন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করার মাঝেই জীবনের সফলতা। আমরা এই কাজ করে জীবনের হক্ব আদায় করছি, আর অন্যরা যাচ্ছেতাইভাবে জীবন কাটিয়ে জীবনের প্রতি অবজ্ঞা করছে!
এই যে দৃষ্টিভঙ্গির আকাশ-পাতাল ফারাক, এ ফারাক সহজে ঘোঁচার নয়। আপনার জায়গা থেকে আপনি যতটা সঠিক, ওদের জায়গা থেকে ওরাও ততটাই সঠিক। আপনার জায়গায় আপনি যতটা যুক্তিবাদী, ওদের জায়গায় ওরা ততটাই যুক্তিবাদী। আপনার মনে ওদের প্রতি যতটা ক্ষোভ, ওদের মনেও আপনার প্রতি ততটাই ক্ষোভ। আপনি ওদেরকে অপরাধী ভাবেন জবাই করে নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য, ওরা ‍আপনাকে অপরাধী ভাবে আকাশ থেকে বোমা ফেলে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ হত্যার জন্য। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি, দু’টি মানদণ্ড মুখোমুখী দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আঘাত যদি করতে হয় তবে সেটা করতে হবে ওই ‘মানদণ্ডে’। যদি ওই বিপথগামী লোকগুলোর প্রতি আপনার-আমার এতই দরদ থাকে, যদি তাদের বিপথগামিতা আমাদেরকে সামান্য পরিমাণও ব্যথিত করে থাকে, তাহলে কেবল নিজেদের মানদণ্ড থেকে কথা বললে ও ভাবনা-চিন্তা করলে হবে না, ওদের মানদণ্ডকেও বিবেচনায় আনতে হবে। এখানেই আসে আদর্শিক মোকাবেলার প্রশ্ন। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে জঙ্গিদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর বিজয়ী করার প্রশ্ন। আমাদের আদর্শ দিয়ে তাদের আদর্শকে ‘ভুল’ প্রমাণ করার প্রশ্ন। তা করতে চাইলে আমরা যে মানদণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত সেটা হতে হবে শক্তিশালী, অন্তত জঙ্গিদের চেয়ে দুর্বল হলে চলবে না। সোজা কথায়- আমাদেরকে একটি নির্ভুল আদর্শের ধারক হতে হবে, আদর্শবান হতে হবে।
আমরা যদি সত্য ও ন্যায়ের ধারক হই, তাহলে আমাদের জন্য খুবই সহজ হয়ে যাবে জঙ্গিদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে, তাদের মানদণ্ডকে বা আদর্শিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও দুর্বল করে দেওয়া। ভুলে গেলে চলবে না- জঙ্গিদের আদর্শিক ভিত্তিটাই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আদর্শহীনতা তথা অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, শোষণ, খুন, ধর্ষণ, ব্যাভিচার, জবরদস্তি, দমন-পীড়ন, নির্যাতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নৈরাজ্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থার উপর। সুতরাং আমরা সত্য ও ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান হবার সাথে সাথে জঙ্গিবাদী আদর্শের ভিত্তি এমনিতেই দুর্বল হয়ে যাবে। আর আমরা অন্যায়ে লিপ্ত থাকলে তারা আদর্শিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে। এ কারণেই যদি আমরা তাদের বিপথগামিতা নিয়ে সত্যিই চিন্তিত বোধ করি তার প্রমাণ রাখতে হবে ন্যায় ও সত্যকে ধারণ করার মাধ্যমে। এতে একদিকে আমাদের কল্যাণ হবে, অন্যদিকে ওরাও নিজেদের আদর্শিক দ্বৈন্যতা দেখে ভুল পথ পরিহার করবে।
আর যদি আমরা অস্ত্রের জোরেই বিষয়টির মীমাংসা করতে চাই, তবে সত্যনিষ্ঠ বা আদর্শবান হওয়া-না হওয়া বিষয় নয়। আমরা যা বলব সেটাই সঠিক, আমরা যাকে ন্যায় বলব সেটাই ন্যায়, যাকে অন্যায় বলব সেটাই অন্যায়- এর বিকল্প চিন্তা করা যাবে না। যদি কেউ ন্যায়-অন্যায়ের অন্য কোনো মানদণ্ড নিয়ে হাজির হয় তবে তার মোকাবেলা হবে কেবল অস্ত্রের ভাষায়। শক্তি যতক্ষণ আমার হাতে ততক্ষণ আমার মানদণ্ড থাকবে, শক্তি যখন অন্যের হাতে তখন তার মানদণ্ড চলবে। শক্তির ফয়সালাই হবে চূড়ান্ত ফয়সালা। ন্যায়-অন্যায় বিষয় নয়, রাজত্ব হবে বোমা আর বন্দুকের।
এই যদি হয় আমাদের ধারণা, তাহলে তো কথাই নেই। সেক্ষত্রে আমরা একেকজন আদর্শহীন, নীতিহীন, নৈতিকতাবর্জিত জন্তু-জানোয়ার হলেও সমস্যা নেই। কারণ আমাদের হাতে আছে শক্তিশালী আধুনিক মারণাস্ত্র আর প্রশিক্ষিত সব বাহিনী। সুতরাং যতক্ষণ জঙ্গিরা শক্তিতে, সংখ্যায় আমাদের সমতুল্য না হতে পারবে ততক্ষণ আমাদেরই জয় হবে। আমরা এখনও যথেষ্ট নিরাপদ। যেহেতু নিরাপদ, সুতরাং নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যায়।
আমার কথা হচ্ছে- ঘুমুচ্ছেন ঘুমান। কিন্তু ঘুম থেকে হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠে- হায় হায় আমার তরুণ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, হায় হায় জঙ্গিদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোর কী হবে, হায় হায় শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান, হায় হায় ছেলেটা ভালো গান গাইতে পারত, হায় হায় মেয়েটা হয়ত বড় ডাক্তার হতে পারত- এসব আহাজারি বা মায়াকান্না করবেন না। ভুলে যাবেন না আপনারা শক্তিতে বিশ্বাসী, যুদ্ধে আস্থাবান। শত্রু মরে যাচ্ছে দেখে কান্নাকাটি করে যারা, তারা যোদ্ধা হতে পারে না। এমনিতেই আপনারা আদর্শ হারিয়েছেন, এখন যোদ্ধা চরিত্রও হারিয়ে ফেললে বড় বিপদে পড়বেন।

সালাহ (নামাজ) আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

সালাহ বা নামাজ হলো ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদী বিধানের দ্বিতীয়টি। ঠিক ঈমানের পরেই সালাহ’র স্থান। কেউ কলেমায় ঐক্যবদ্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য অন্যান্য ফরদের মত সালাহও ফরদ হয়ে যায়। সালাহ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কোর’আনে আল্লাহ বিরাশি বারেরও বেশি সালাহর কথা বলেছেন।
.
সালাহ কায়েম করার জন্য পাড়ায়-মহল্লায় হাজার হাজার আলীশান মসজিদ তৈরি হচ্ছে। টাইলসের মসজিদ, এসি মসজিদ তো হচ্ছেই, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে পৃথিবীর অনেক জায়গায় সোনার গম্বুজওয়ালা মসজিদও তৈরি হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে মসজিদ স্থাপনও আজকাল প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
.
এদিকে সালাহ যাতে সহিহ-শুদ্ধ হয়, আল্লাহর কাছে কবুল হয়, এ উদ্দেশ্যে নিখুঁতভাবে ওজু-দোয়া-দরুদ ইত্যাদি করার জন্য বাজার সয়লাব হয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের নামাজ শিক্ষার বই দিয়ে। এমনকি শুধু নিয়মিত নামাজ পড়ার উপদেশ দেওয়ার জন্যই গড়ে উঠেছে বহু সংস্থা, সংগঠন, দল-উপদল। কিন্তু এত কিছুর পরও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় এই যে, আল্লাহ কেন নামাজের বিধান দিয়েছেন, নামাজের উদ্দেশ্য কী, নামাজ আমাদেরকে কী শিক্ষা দেয় সেই আকীদাটাই আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে।
.
যে কোনো কিছুরই সৃষ্টির উদ্দেশ্য আছে। আসমান-জমিনসহ কোনো বস্তুই আল্লাহ উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেন নি। তেমনি ইসলামেরও একটি উদ্দেশ্য আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে- মানবজাতির জীবনের যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের উদ্দেশ্য। একইভাবে দ্বীনের যেসব আমলের নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন, সেগুলোরও উদ্দেশ্য আছে। তাহলে সালাহ’র মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান, যাকে আল্লাহ কোর’আনে বিরাশি বারেরও বেশি উল্লেখ করলেন তা কি বিনা উদ্দেশ্যে হতে পারে? অবশ্যই তার একটি উদ্দেশ্য আছে। সেটা কী?
.
সেটা হচ্ছে সালাহ’র মাধ্যমে মু’মিনদেরকে মানসিক, আধ্যাত্মিক ও শারীরিকভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা। যেন সে নিজেকে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করার চারিত্রিক গুণ (ধঃঃৎরনঁঃব) ও আত্মিক শক্তি লাভ করে যাবতীয় লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়।
যেমন-
.
ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি:
সালাহ জাতিকে ‘ঐক্য’ শিক্ষা দেয়। লক্ষ্যের ঐক্য, উদ্দেশ্যের ঐক্য। একেকজন একেক স্থান থেকে এসে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে কাতারবদ্ধ হয়ে একটি নির্দিষ্ট দিকে অর্থাৎ ক্বাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর মাধ্যমে মু’মিনদের মধ্যে একদিকে লক্ষ্যের ঐক্য তৈরি হয়, অন্যদিকে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। তারা মনে করে- আমার পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি আমারই ভাই। আমরা একই প্রভুর সৃষ্টি। নিজেদের মধ্যে যতই বিভেদের কৃত্রিম আবহ তৈরি করে রাখি না কেন, আল্লাহর সামনে আমাদের অবস্থান একই সারিতে। আমাদের যাত্রাও একই অভিমুখে, সত্য ও ন্যায় তথা আল্লাহর অভিমুখে। আমার পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি শিক্ষিত নাকি নিরক্ষর, দরিদ্র নাকি ধনী, সাদা নাকি কালো তা আমি দেখব না।
.
নামাজের কাতারকে বলা হয় ‘সফ’। কেন সফ বলা হয় তার উত্তর আল্লাহ সুরা সফেই দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন- আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা সীসাগলানো প্রাচীরের মত ‘সারিবদ্ধভাবে’ তাঁর পথে সংগ্রাম করে (সফ: ০৪)। অর্থাৎ সালাহ’র এই সফ কেবল সালাহ’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই সফ আসলে মু’মিনদের বাস্তব জীবনের ঐক্যের প্রতীক। সুতরাং যারা সালাহ কায়েম করবে তারা সর্বদা মনে রাখবে আমরা সজাগ-সচেতন থাকব যাতে আমাদের জাতির মধ্যে কেউ ঐক্য নষ্ট করতে না পারে, ভ্রাতৃত্বে ফাটল ধরাতে না পারে। ঐক্য নষ্ট হয় এমন কথা বলব না, এমন কাজ করব না। শিরক, কুফর, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সমস্ত জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকব।
দৈনিক পাঁচবার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এই অনুপম শিক্ষা দেয় সালাহ। এ কারণে সালাহ এত গুরুত্বপূর্ণ।
.
শৃঙ্খলাবোধ সৃষ্টি:
কীভাবে ওজু করব, কীভাবে দাঁড়াবো, কীভাবে পোশাক-পরিচ্ছেদ পরব, কীভাবে ওঠা-বসা করব, কীভাবে রুকু করব, কীভাবে সেজদা করব ইত্যাদি প্রায় শতাধিক নিয়ম-শৃঙ্খলা মাথায় রেখে সালাহ কায়েম করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে সালাতে সামিল হতে হয়, কাতার ধনুকের ছিলার মত সোজা করতে হয়, এক পায়ে দাঁড়ানো যাবে না, এদিক ওদিক তাকানো যাবে না, চোখ বন্ধ রাখা যাবে না, রুকুতে পিঠ কুঁজো হওয়া যাবে না, ঢিলেঢালাভাবে সালাহ করা যাবে না, মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হবে, ইমামের তকবিরের আগে বা পরে রুকু-সেজদা-উঠা-বসা করা যাবে না, হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে আনুগত্য করতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সুরা-কেরাত-তাসবিহ পাঠ করতে হবে- এভাবে বলতে গেলে সালাহ’তে নিয়ম শৃঙ্খলা অসংখ্য। এই সবগুলো নিয়ম-শৃঙ্খলা মাথায় রেখে সালাহ কায়েম করার ফলে মু’মিনদের চরিত্রে অসাধারণ শৃঙ্খলাবোধ তৈরি হয়। তাদের প্রত্যেকটি কাজ হয় শৃঙ্খলামাফিক। যার যেমন খুশি তেমন না করে তারা জাতিগতভাবে সুশৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে জাতীয় যে কোনো সমস্যার মোকাবেলা করে। যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের মত যে কোনো অন্যায় দূর করার জন্য এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতির কোনো বিকল্প নেই।
.
আনুগত্যবোধ সৃষ্টি:
জামাতে ফরদ সালাতে ইমামের কোনো বিকল্প নেই। ইমামের তকবিরের সাথে সাথে মুসল্লিরা রুকু করবে, সেজদা করবে, সালাম ফেরাবে ইত্যাদি। অর্থাৎ ইমামের হুকুম পালন করতে হবে। কেউ ইমামের আনুগত্যের বাইরে গেলে সালাহ হয় না। প্রতিদিন একজন লোক ১৭ রাকাত ফরদ সালাহতে ইমামের আনুগত্য করে। ইমাম রুকুতে গেলে সে রুকুতে যায়, ইমাম সেজদায় গেলে সে সেজদায় যায়। এক মুহূর্তের জন্যও সে ইমাম সাহেবের কমান্ডের বাইরে যেতে পারে না। এভাবে তার চরিত্রে আনুগত্যবোধ তৈরি হয়।
.
এটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, কোনো জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত শক্তিশালী হতে পারবে না যতক্ষণ তাদের মধ্যে একজন আদেশদাতা না থাকে এবং সেই আদেশদাতার আদেশ শর্তহীন, প্রশ্নহীন, দ্বিধাহীনভাবে পালন করা না হয়। এ কারণেই আল্লাহর রসুল বলেছেন- আমীর নাক কানকাটা, ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের নিগ্রো ক্রীতদাস হলেও তার আনুগত্য করবে (হাদীস)। কারণ একজন নেতার কথাকে যদি জাতির সকলে শর্তহীনভাবে আনুগত্য না করে তবে জাতি বড় কোনো সঙ্কট মোকাবেলা করা তো দূরের কথা, নিজেরাই নিজেদের সঙ্কট হয়ে দাঁড়াবে। সালাহ থেকে নির্দ্বিধায় আদেশ পালনের শিক্ষা নিয়ে যখন একটি জাতি তাদের আদেশদাতার প্রতিটি আদেশ পালন করাকে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব মনে করবে তখন সেই জাতি পৃথিবীর যে কোনো সঙ্কটকে অবলীলায় মোকাবেলা করতে পারবে সন্দেহ নেই।
.
আজকে মুসলিম বিশ্বের একক কোনো আদেশদাতা নাই। সরকারগুলো যত ভালো নির্দেশই দিক দেখা যায় সে নির্দেশ মানার চেয়ে না মানার দিকেই জনসাধারণের ঝোঁক থাকে বেশি। জাতির মধ্যে কোনো আনুগত্যবোধ নেই। কারণ নামাজের যে প্রকৃত শিক্ষা তা তারা জানেও না, বোঝেও না, তাই চরিত্রে ধারণ করতেও পারে না। নামাজের কয়েক মিনিট ছাড়া মসজিদের বাইরে ইমাম সাহেবের মতামতেরও কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। ইমাম সাহেব যতই সুদ, ঘুষ, অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলুক, মানুষ শোনে না। তাকে ভাবা হয় নামাজের ইমাম, কেবল নামাজের সময়েই যার নির্দেশ মানার যোগ্য; সমাজ নিয়ে, বাস্তব দুনিয়া নিয়ে তার কথা বলার অধিকারই নেই। একই ধারণা পোষণ করেন ইমামরাও। অথচ নামাজের প্রকৃত আকীদা জানা থাকলে এমনটা হবার কথা ছিল না। নামাজ মু’মিনদের মধ্যে আনুগত্যবোধ তৈরি করত। যে কোনো ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ-উপদেশ, তা সরকারের পক্ষ থেকেই আসুক বা ইমাম সাহেবের পক্ষ থেকেই আসুক, তা শর্তহীন-প্রশ্নহীনভাবে মান্য করার দায়বদ্ধতা তৈরি হত।
.
শারীরিক প্রশিক্ষণ:
মানসিক প্রশিক্ষণের সাথে সাথে নামাজ মুসল্লিদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সালাহ’র যে উঠা-বসা, রুকু, সেজদা ইত্যাদির নিয়ম-কানুন, এসব যদি ঢিলেঢালা বা দায়সারাভাবে না করে রসুলের হাদীস মোতাবেক সঠিকভাবে করা হয়, অর্থাৎ পিঠ, ঘাড়, কোমর, পায়ের পাতা, আঙ্গুল, হাতের তালু, হাঁটু, নাক, কপাল ইত্যাদি অঙ্গসমূহ হাদীসে যেভাবে সঞ্চালন করতে বলা হয়েছে সেভাবে যদি করা হয় এবং এভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরদ সালাহসহ নফল, সুন্নত কায়েম করা হয় তাহলে তা ব্যায়ামের মতই কার্যকরী হবে। শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতে সালাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে যুবুথুবু হয়ে সালাহ কায়েম করা হয় তা মুসল্লিদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
.
সালাহর আত্মিক ভাগ:
এতক্ষণ আলোচনা করেছি সালাহ’র মানসিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষ যেমন দেহ-আত্মার সমন্বয়ে সৃষ্ট জীব, তেমন দ্বীনুল হক্বকেও আল্লাহ দেহ ও আত্মা উভয়ের জন্যই উপযোগী ও ভারসাম্যপূর্ণ করে তৈরি করেছেন। ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতই সালাহও তাই কেবল জাতির বাহ্যিক, মানসিক বা শারীরিক প্রশিক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়, এর আত্মিক ভাগও যথেষ্ট প্রবল।
.
মু’মিন যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন সে মনে মনে ভাববে- হে আল্লাহ, তুমি তোমার নবীর মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে মহাদায়িত্ব অর্পণ করেছো (পৃথিবীতে ন্যায় ও শান্তি স্থাপন করা), সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য যে চরিত্র দরকার, সেই চরিত্র সৃষ্টির প্রশিক্ষণ নিতে তোমার সামনে দাঁড়িয়েছি। তুমি দয়া করে আমাদেরকে সেই চরিত্র, আত্মিক শক্তি দান কর যাতে আমরা মানবজীবনে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অটল থাকতে পারি, আমাদের জীবন-সম্পদ, পুত্র-পরিজন মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করতে পারি।
.
সালাতে দাঁড়িয়ে মু’মিনরা সর্বদা মনে রাখবে- আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী, তিনি সবার মনের খবর জানেন। যখন একজন মু’মিন রুকুতে যায় তখন সে কার্যত আল্লাহর বিশালত্বের সামনে বিনীত ও বিনয়নম্র হয়, আত্মসমর্পিত ভঙ্গিতে আল্লাহর মহীমা ঘোষণা করে। তারপর যখন সেজদায় যায় তখন সে কার্যত ত্রুটিহীন (সোবহান) প্রভুর সামনে তার দেহ-মনসহ সমস্ত সত্ত্বাকে সমর্পণ করে। সে মুখে আল্লাহর বিশালত্ব ও অসীম উচ্চতার ঘোষণা দেয় এবং মাথা মাটিতে ঠেকানোর মাধ্যমে নিজের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষুদ্রতা স্বীকার করে নেয়।
.
একজন মু’মিন যখন সর্বাবস্থায় স্রষ্টার অসীম উচ্চতার সাপেক্ষে নিজের ক্ষুদ্রতার কথা স্মরণ রাখে, তখন সে আর উদ্ধত, অহংকারী ও স্বৈরাচারি হতে পারে না। বাস্তব জীবনে সে আল্লাহর প্রতিটি হুকুম মেনে চলে। মানুষের সাথে বিনীত ও মার্জিত আচরণ করে। শয়তানের প্ররোচনায় কখনও গাফেল হয়ে গেলে, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলে, ঐক্য নষ্ট করলে, অপর কোনো মু’মিন ভাইয়ের সাথে খারাপ আচরণ করলে, পরবর্তী ওয়াক্তে সালাতে দাঁড়িয়েই সে লজ্জিত হবে, অনুতপ্ত হবে এবং নিজেকে সংশোধন করবে। এজন্যই সালাহর আরেক নাম হলো সংস্কার। সালাহ শব্দটি এসেছে আসলাহা থেকে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘সংশোধন’ বোঝাতে (সুরা আন’আম ৪৮)।
.
যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা (জেহাদ):
অর্থাৎ বোঝা গেল- সালাহ বা নামাজের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, সময়ানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া এবং মানবতার কল্যাণে জীবন-সম্পদকে উৎসর্গ করার আত্মিক দৃঢ়তা দান করা। কেন এসব শিক্ষা/প্রশিক্ষণ দিতে হবে তার উদ্দেশ্য যদিও প্রথমে বলে এসেছি এখানে আবারও বলছি। সেটা হচ্ছে- যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিজয়ী হবার উপযোগী চরিত্র তৈরি করা। নামাজ অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চরিত্র তৈরি করে বলেই আল্লাহ বলেছেন- নিশ্চয়ই নামাজ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। (সুরা আনকাবুত ৪৫)
.
বস্তুত অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা প্রত্যেক মু’মিনের দায়িত্ব। এ কাজ না করে কেউ মু’মিন থাকতে পারে না। মু’মিন হওয়ার অর্থই তাকে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে। কিন্তু কেবল প্রতিবাদী হলেই তো হবে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফলও হতে হবে, সেই সফলতার জন্য জাতির মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও আত্মিক প্রেরণার বিকল্প নেই। সেটা সৃষ্টি করে সালাহ।

সময় ও জীবন

সময় পরিবর্তনশীল। জীবন পরিবর্তনশীল। তাই মানুষের জীবনপ্রণালী যদি সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন না করা হয় তাহলে একসময় সেই জীবনপ্রণালী আর মানুষকে শান্তি দিতে পারে না, মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর উপযুক্ত সমাধান দিতে পারে না, ফলে তা মানুষের কাছে আর গৃহীত হয় না। তখন জোর করে সেটা প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়, ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, ভালোবাসা বিদ্বেষে পরিণত হয়। 
.

যেমন একটি শিশু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার পোশাকগুলো ছোট হয়ে যায়, নতুন পোশাক পরাতে হয়। আল্লাহ তাঁর আখেরি নবীর মাধ্যমে যে শেষ জীবনব্যবস্থাটি দিয়েছেন সেটি এমনভাবে প্রণয়ন করেছেন যা অত্যন্ত প্রাকৃতিক। প্রকৃতি যেমন নিয়ত পরিবর্তনশীল তেমনি মানুষের জীবনেও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আসে, ইসলাম সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সমানভাবে যৌক্তিক ও প্রয়োগযোগ্য থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Pragmatic.
.
অক্সিজেন যেভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রাণবায়ু হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং হবে, ইসলামও তেমনি হাজার বছর আগে যেমন সমাজ থেকে শোষণ, বঞ্চনা দূর করতে পেরেছে তেমনি সবযুগেই পারবে। এটি হচ্ছে মৌলিক একটি সত্য। শর্ত হচ্ছে একে কোনোভাবে নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না।

সন্ত্রাসবাদের দায় কোর’আন/গীতার নয়

হিন্দুত্ববাদী ভায়েরা যখন কোর’আনকে ‘জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা বই’ বলে তিরস্কার করেন তখন তাদের প্রতি আমার করুণা হয়। জানতে ইচ্ছা করে এই তিরস্কারকারীরা গীতার ব্যাপারে কী মতামত দেন। তারা কি গীতায় ঈমান রাখেন না?
.

কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে অর্জুন তাকিয়ে দেখলেন তার প্রতিপক্ষ যোদ্ধারা আর কেউ নয় তারই বংশের লোক, তারই আত্মীয়-স্বজন, চাচাত ভাই, পিতামহ। তাদেরকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। 
.
অর্জুনের হৃদয় হাহাকার করে উঠল। আমি কেন আমার বংশের লোককে হত্যা করব? আমার কী লাভ হবে? কেবল রাজ্য অধিকার করার জন্য আপন আত্মীয়দেরকে হত্যা করতে হবে? কী দরকার সেই রাজ্যের? স্বজনদের মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে রাজ্য শাসনের সুখ তো আমি পাব না। বরং অনুশোচনার গ্লানি আমার বাকি জীবনের সমস্ত আনন্দকে নিঃশেষ করে দেবে। না, এ কাজ আমি করতে পারি না।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈজীবিতেন বা।
.
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা খুলে বললেন। এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। অর্জুনের যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার অর্থ হচ্ছে পাণ্ডবদের নিশ্চিত পরাজয়- এ কথা শ্রীকৃষ্ণ ভালোমতই জানেন। তা হতে দেওয়া যায় না। শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন কেবলই স্বজনপ্রেমে বিগলিত হয়ে ন্যায়-অন্যায়বোধ, যুক্তিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে অর্জুন।
.
ফলে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাতে লাগলেন কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায়। তিনি বুঝিয়ে দিলেন- এ যুদ্ধ কোনো রাজ্য অধিকারের যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ প্রতিশোধেরও যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এ যুদ্ধ অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে নিপীড়িত প্রজাদেরকে মুক্ত করার যুদ্ধ। ধর্মের জন্য যুদ্ধ করতে হবে, সুখভোগের জন্য নয়। তুমি কেবল নির্বিকারভাবে কর্ম করে যাও, ফল ভোগের আশা, কামনা-বাসনা ত্যাগ কর। খাবার খাও, কিন্তু খাবারে আসক্ত হইও না। অস্ত্র উঠাও অর্জুন, যুদ্ধ কর।
‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হূদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ’
.
তিনি অর্জুনকে বোঝালেন- এ যুদ্ধ তুমি আয়োজন করছো না অর্জুন, এটা প্রকৃতির আয়োজন। সমাজ যখন অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারে ছেয়ে যায়, তখন প্রকৃতি নিজেই যুদ্ধের আয়োজন করে। অন্যায় চিরদিন চলতে পারে না। ঈশ্বর ন্যায় দিয়ে অন্যায়ের মস্তকে আঘাত করবেনই। তোমার সৌভাগ্য যে, তুমি ন্যায়ের পথে লড়াই করতে পারছ। সুতরাং দ্বিধা না করে ঈশ্বরের নির্দেশ পালন কর।
.
এই যে অর্জুনের যুদ্ধ করতে অপারগতা প্রকাশ, আর যুদ্ধের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণের অনুপ্রেরণা প্রদান- এরই লিখিত রূপ আজকের গীতা। গীতার আগা-গোড়া পুরোটাই যুদ্ধের উৎসাহে ভরা।
.
কিন্তু যুদ্ধের উৎসাহ আছে বলেই কি গীতাকে ‘জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা বই’ বলে তীরস্কার করব? কখনই না। গীতাই বলেন আর কোর’আনই বলেন, কোনো ধর্মগ্রন্থই ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। ধর্মগ্রন্থে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ বলতে ওই যুদ্ধকে বা সংগ্রামকে বোঝানো হয় যা ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য করা হয়। অত্যাচারী শক্তির হাত থেকে নিরীহ-নিরাপরাধ মানুষকে মুক্ত করাই জিহাদের লক্ষ্য। এজন্যই শ্রীকৃষ্ণ যোদ্ধা ছিলেন। এজন্যই মোহাম্মদ (সা.) যোদ্ধা নবী ছিলেন।
.
যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম না হলে মানবজাতি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। উপাসনালয়ে বসে বসে হাজারো জিকির-আজগার, পূজা-পার্বণ করে সে ধ্বংস এড়ানো যেত না।

রসুল (সা.) কি মিথ্যার সাথে আপস করেছিলেন?

বিশ্বনবী যখন আরবদেরকে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দিলেন তাঁর কথায় কার স্বার্থে আঘাত লাগল আর কে খুশি হলো তা কখনও ভাবেননি তিনি। কোন কথা জনগণ খাবে, কোন কথা বললে নারাজি হবে- সে হিসাবও কষেন নি কখনও। যা মিথ্যা তাকে মিথ্যা বলতে কুণ্ঠিত হন নি। যা সত্য তাকে সত্য বলতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি। উদাহরণ মিরাজের ঘটনা।


আল্লাহ তাঁর রসুলকে মিরাজে নিয়ে গেলেন। মিরাজে গিয়ে রসুল বাইতুল মোকাদ্দাস ও সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ করলেন, পূর্বের নবী-রসুলগণের সাথে পরিচিত হলেন, জান্নাত-জাহান্নাম দেখলেন, আল্লাহর সাথে কথা বললেন। এ ঘটনা ‘সত্য’। তিনি এ সত্য প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু রসুলাল্লাহ যখন এ কথা বাইরে প্রচার করতে সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর চাচাত বোন উম্মে হানি জামা টেনে ধরল। অনুরোধ করতে লাগল- আপনার কথা সত্য তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ কথা লোকজনকে বলবেন না। ওরা আপনাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করবে। আল্লাহর রসুল সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। ‘আল্লাহর কসম, আমি যা দেখেছি তা বলবই’- এই বলে তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

বিশ্বনবী কি জানতেন না মিরাজের কথা প্রকাশ করলে কাফেররা তাঁর বিরোধিতার মস্ত বড় সুযোগ পেয়ে যাবে? অবশ্যই জানতেন। কিন্তু তিনি গোপন করলেন না, যা দেখেছেন তা স্পষ্টাক্ষরে বলে দিলেন। তাঁর কথা শুনে ঈমানদারদের মধ্যেও অনেকে ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেল, কাফের-মোশরেকরা জনাকীর্ণ পরিবেশে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ শুরু করল, হাততালি দিয়ে অপমান করল, হয়ত যারা মনে করছিল মোহাম্মদ (সা.) নবী হলেও হতে পারেন তাদের ঈমানের প্রদীপটি জ্বলতে গিয়েও ধুপ করে নিভে গেল।

কিন্তু রসুল (সা.) তাঁর বক্তব্যে অটল। তিনি দাঁড়িয়েছেন সত্য নিয়ে, সত্য থেকে মিথ্যাকে পৃথক করাই তাঁর দায়িত্ব। সেই তিনি কীভাবে সত্যকে চেপে যেতে পারেন? সারা পৃথিবীর মানুষ মিথ্যা বললেও সত্য সত্যই থাকে, সারা পৃথিবীর মানুষ সত্য বললেও মিথ্যা সত্য হয়ে যায় না। আল্লাহর রসুল অন্ধ জনসমর্থন লাভের জন্য আন্দোলন করছেন না, তাঁর আন্দোলন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেছেন- বলুন সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল (বনি ইজরাইল ৮১)। সুতরাং মিথ্যাকে বিলুপ্ত করার পূর্বশর্ত সত্যের প্রকট হওয়া। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য স্পষ্ট না হলে সারা আরবের মানুষও যদি রসুলকে অন্ধভাবে সমর্থন করত তবু মিথ্যা বিলুপ্ত হত না। তাই ইতিহাসে পাই নবুয়্যত লাভের দিনটি থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত এক দিনের জন্যও মিথ্যার সাথে বিন্দুমাত্রও আপস করেন নি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহামানব।

একটি অপপ্রচারের জবাব

কোর’আনের একটি আয়াতকে (মায়েদা ৫১) প্রায়শই আমাদের সর্বধর্মীয় বক্তব্যের বিপরীতে ঢাল হিসেবে দাঁড় করেন নাস্তিকরা। সর্বধর্মীয় ঐক্যের পক্ষে আপনি যতই কোর’আনের আয়াত উদ্ধৃত করুন, রসুলের জীবন থেকে উদহরণ টানুন, কোনো কথাই তারা শুনবে না। আল্লাহ ইহুদি ও খৃষ্টানদের সাথে মু’মিনদেরকে গভীর বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, ব্যস, এখানেই যা হবার তা হয়ে গেছে, ওই আয়াতের পর আর কোনো কথা থাকে না, কারণ ওখানে আল্লাহ নাকি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছেন (নাউজুবিল্লাহ)! আসলেই কি তাই? আজ এ ব্যাপারে আলোচনায় যাব। আগ্রহীরা সাথে থাকবেন আশা করি।
আল্লাহ বলেছেন- হে মু’মিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে আউলিয়া (অন্তরঙ্গ বন্ধু, অভিভাবক, সাহায্যকারী) হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের আউলিয়া। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না (মায়েদা: ৫১)।

প্রথম কথা হচ্ছে,
এই আয়াতে আল্লাহ ‘মুসলমানদেরকে’ সম্বোধন করেন নি। তিনি বলেছেন ‘ইয়া আয়্যুহাল্লাজিনা আমানু’। অর্থাৎ নির্দেশটি মু’মিনদের প্রতি। এখন জানতে হবে মু’মিন কারা। একজন মানুষ প্রচলিত অর্থে মুসলমান না হয়েও কিন্তু মু’মিন হতে পারেন। আবার মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও অনেকে মু’মিন নাও হতে পারে। মু’মিন ও মুসলিম শব্দদ্বয়ের মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ আছে। আল্লাহ এখানে যে নির্দেশ দিচ্ছেন তা প্রচলিত অর্থে ধর্মীয় সম্প্রদায় বলতে যা বোঝানো হয় তেমন কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে দিচ্ছেন না, তাঁর এই নির্দেশ কেবল মু’মিনদের জন্য, যাদের অবস্থান সকল প্রকার জাতি-গোত্র-আচার-প্রথা-রীতি-নীতি-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে। জাতিতে তারা ইহুদিও হতে পারে, খৃষ্টানও হতে পারে, মুসলমানও হতে পারে। এ কথায় যারা আপত্তি করবেন তাদেরকে অনুরোধ করব সুরা বাকারার ৬২ নম্বর আয়াতটি পড়ার জন্য। সেখানে আল্লাহ বলেছেন-
‘নিঃসন্দেহে যারা মুসলিম হয়েছে এবং যারা ইহুদি, নাসারা ও সাবেইন, যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কেয়ামত দিবসের প্রতি, সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনোই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।’
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
‘আরবরা বলে আমরা ঈমান এনেছি (অর্থাৎ মু’মিন হয়েছি), বলুন- তোমরা ঈমান আনো নি, বরং বল, আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি (মুসলিম হয়েছি)। এখনও তোমাদের অন্তরে ঈমান জন্মেনি (হুজরাত ১৪)।’
মুসলিম হওয়া এবং ঈমান আনয়ন করা যে ভিন্ন বিষয় তার আরও একটি দৃষ্টান্ত আমরা পাই রসুলের জীবনীতে। সা’দ (রা.) বলেন-
একবার আমি রসুলাল্লাহর (সা.) কাছে বসা ছিলাম যখন তিনি একদল লোককে দান করছিলেন। সেখানে এমন একজন লোক বসা ছিলেন যাকে আমি একজন উত্তম মো’মেন বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তিনি তাকে কিছুই দিলেন না। এ দেখে আমি বললাম ইয়া রসুলাল্লাহ, আপনি ওনাকে কিছু দিলেন না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি একজন মো’মেন। রসুলাল্লাহ (সা.) বললেন মো’মেন বলো না মুসলিম বলো। আমি কিছু সময় চুপ থেকে আবার ঐ কথা বললাম এবং তিনিও আবার ঐ জবাবই দিলেন-মো’মেন বলো না মুসলিম বলো। তৃতীয়বার আমি ঐ কথা বললে রসুলাল্লাহ বললেন সা’দ! আমি অপছন্দনীয় লোকদেরও দান করি এই কারণে যে আমার আশংকা হয় তারা অভাবের চাপে জাহান্নামের পথে চলে যেতে পারে (হাদীস- বোখারী)’। 
এখানে মহানবীর কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে মো’মেন ও মুসলিম এক নয়। আর যে আয়াত নিয়ে কথা হচ্ছে সেই আয়াতের নির্দেশনা কেবলই মু’মিনদের জন্য- এ বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের সামনে এগোতে হবে।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে,
আয়াতটিতে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ‘আউলিয়া’। আউলিয়া অর্থ অভিভাবক, সাহায্যকারী, অন্তরঙ্গ বন্ধু ইত্যাদি। খুবই স্বাভাবিক কথা। মু’মিনদের অভিভাবক ও বন্ধু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারও কৃপাপ্রার্থী হওয়া মো’মেনদের জন্য সাজে না। যে কোনো অবস্থায় মো’মেনরা কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে, আল্লাহকে ভরসা করবে- এটাই মোমেনদের চরিত্র।

তৃতীয় কথা হচ্ছে,
আয়াতটি কোন প্রেক্ষাপটে নাজেল হয়েছিল সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। মদীনায় মু’মিনদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অনেক মুনাফিক তলে তলে ইহুদিদের সাথে মিলিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হত। এ ষড়যন্ত্র প্রকট আকার ধারণ করত যখন মুসলমানরা কুরাইশ বা অন্য কোনো প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হত কিংবা বড় ধরনের কোনো বিপদের মুখে পড়ত। এ গুপ্তচরবৃত্তি ঠেকানোর জন্য আল্লাহ মু’মিনদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যেন তারা ইহুদি ও খৃষ্টানদের ব্যাপারে সাবধান থাকে। সেই সাথে যেসব মুনাফিক গুপ্তচরবৃত্তি করত আখেরাতে তাদের পরিণতি কী হবে সেটাও এর পরবর্তী আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে।” ভুলে গেলে চলবে না যে, তখন ইহুদিরা ছিল মদীনার বিরাট একটি রাজনৈতিক শক্তি। আল্লাহর রসুলের উদারতা ও ঐক্যপ্রচেষ্টার ফলেই তাদের সাথে মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল এবং একই রাষ্ট্রের অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিল। কিন্তু ইহুদিরা মনে-প্রাণে চাইত মুসলমানরা কোরাইশদের হাতে পরাজিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাক। এই লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রেরও কোনো ত্রুটি রাখে নি ইহুদিরা। রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক এ সকল কর্মকাণ্ড যে ঘটছে তা আল্লাহর রসুল জানতেন। তিনি পারতেন মুসলিমদেরকে নিয়ে ইহুদিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ব্যবস্থাগ্রহণ করতে, কিন্তু আল্লাহ তা চান নি। আল্লাহ বরং মু’মিনদেরকেই বারবার সাবধান করেছেন, কড়া ভাষায় আদেশ করেছেন- ওদেরকে নিজেদের অভিভাবক বানিও না খবরদার। যদি কর তবে ওদের যা পরিণতি হবে তোমাদেরও তাই হবে। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় এ আয়াত অনিবার্য রক্তপাত এড়ানোর প্রচেষ্টামাত্র।

খন্দকের যুদ্ধে মদীনা যখন ভয়ানক সংকটকাল অতিক্রম করছিল, তখন সুযোগ বুঝে ইহুদি গোত্র বনি কুরায়জা মুসলিমদের সাথে চুক্তিভঙ্গ করে কুরাইশদের সাথে হাত মেলায়।


চতুর্থ কথা হচ্ছে,
আয়াতটিতে মু’মিনদেরকে বলা হচ্ছে তারা যেন ওই সকল লোককে নিজেদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী বন্ধু মনে না করে যারা নিজেদেরকে ইহুদি ও খৃষ্টান বলে দাবি করে। ইহুদি ও খৃষ্টান বলতে আল্লাহ কাদেরকে বোঝাচ্ছেন, ইহুদি কারা, খৃষ্টান কারা- এ বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে এ আয়াতের মর্মার্থ পরিপূর্ণভাবে বোঝা যাবে না। কাজেই আমরা এবার সে আলোচনায় প্রবেশ করব। জানার চেষ্টা করব ইহুদি ও খিৃষ্টানদেরকে অভিভাবক (আউলিয়া) হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে মু’মিনদের ক্ষতিটা কোথায়।
রসুলাল্লাহ বলেন-
আমরা সব নবীরা পরস্পরের বৈমাত্রেয় ভাই, আমাদের সবারই দ্বীন এক। (বুখারী ও মুসলিম)
ইসলামের এই মৌলিক সূত্রটি ভুলে গেলে আপনি যত বড় গাণিতিকই হোন, ইসলামের অঙ্ক মেলাতে পারবেন না। যখনই আপনি আন্তধর্মীয় আলোচনায় যাবেন, ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মের সম্পর্ক বিশ্লেষণের চেষ্টা করবেন, অবশ্য অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যুগে যুগে আল্লাহ যত নবী পাঠিয়েছেন সবাই এসেছেন একই দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে। যুগের প্রেক্ষাপটের সাথে হারাম-হালাল, করণীয়-বর্জনীয়র বিধান অর্থাৎ শরীয়তে পরিবর্তন এলেও দ্বীন সবযুগে একটাই ছিল। সেটা আল্লাহর প্রেরিত দ্বীন, দ্বীনুল হক্ব, দ্বীনুল কাইয়েমা বা সনাতন দ্বীন। ঈসা (আ.) এর অনুসারী দাবিদাররা আজকে যে দ্বীন অনুসরণ করেন তার নাম ‘খ্রিষ্টধর্ম’। অথচ সারা জিন্দেগীতে ঈসা (আ.) ‘খ্রিষ্টধর্ম’ বলে কোনো শব্দই শোনেন নি। একইভাবে আজকে অনেকে ইসলামকে বলেন ‘মোহাম্মদী ধর্ম’, যে নাম মোহাম্মদ (সা.) কখনই শোনেন নি। নবী-রসুলগণ গত হয়ে যাবার পর এভাবেই নবী-রসুলদের নাম ব্যবহার করে আল্লাহর প্রেরিত দ্বীনুল হক্বকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করার ঘটনা ইতঃপূর্বে ঘটেছে। জুডাই ধর্ম, খৃষ্টধর্মের নামকরণ হয়েছে এভাবেই। সুতরাং ইসলাম ধর্ম থেকে জুডাই ধর্ম ও খৃষ্টধর্মকে পৃথক করে ফেললে হবে না। মনে রাখতে হবে ধর্ম একটাই, পার্থক্য কেবল স্থান-কাল-পাত্রে।

মূল ধর্ম এক বটে, বিভিন্ন আধার/ জল এক ভিন্ন তটে, ভিন্ন জলাশয়

ঈসা (আ.) এর নবী হিসেবে আগমণই প্রমাণ করে ইহুদিরা তখন মুসা (আ.) এর মাধ্যমে আসা দ্বীনুল হক্ব বা ইসলাম থেকে সরে গেছে। ঠিক যতখানি সরে গেলে নতুন নবী পাঠিয়ে সংশোধন করার দরকার পড়ে ততখানিই সরে গেছে। ফলে ঈসা (আ.) এলেন ইহুদি জাতির ধর্মান্ধতা দূর করে পুনরায় তাদেরকে মুসা (আ.) এর আনিত দ্বীনে (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। নতুন কোনো ধর্ম তৈরি করার কথা তিনি ভাবতেও পারতেন না। আল্লাহ বলেন-
‘‘মারইয়াম তনয় ঈসাকে তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে উহাদের পশ্চাতে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাহাকে ইনজীল দিয়েছিলাম; উহাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো।”
কোন পথের নির্দেশ? যে পথ দিয়ে ইহুদি জাতি বিকৃতির গহ্বর থেকে বেরিয়ে পুনরায় আল্লাহর দ্বীনে (ইসলাম) প্রবেশ করতে পারে সেই পথ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইহুদি জাতি সে পথ গ্রহণ করল না। তারা আল্লাহর দ্বীনের বহির্গতই রয়ে গেল, আগের মতই তারা আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে পুরোহিত রাব্বাই-ফরিসিদের আনুগত্য করে যেতে থাকল। অন্যদিকে ঈসা (আ.) এর আহ্বান যখন ইহুদিরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করল, ঈসা (আ.) আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেন, তখন তাঁর অল্পকিছু অনুসারী চিন্তা করল- নবীর শিক্ষাকে এভাবে বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। পল নামের একজন ব্যক্তি, যিনি ঈসা (আ.) এর কাছ থেকে সরাসরি কোনো শিক্ষা লাভ করেন নি, তিনি প্রস্তাব দিলেন- এই শিক্ষা ইহুদিদের বাইরে প্রচার করা হোক। সেটাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এ ছাড়া ঈসা (আ.) এর শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখার অন্য কোনো উপায় তখন ছিল না। ফলে ঈসা (আ.) এর নির্দেশ অমান্য করে তাঁরই শিক্ষাগুলোকে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ নাম দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার শুরু হলো। রোমের রাজা কনস্টানটাইন সেই ধর্ম গ্রহণ করে নিলে রাজশক্তির আনুকুল্য পেয়ে অল্পদিনের মধ্যে ইউরোপের প্রধান ধর্মে পরিণত হলো ‘খ্রিষ্টধর্ম’। এই যে নতুন আরেকটি ধর্মের বিকাশ হলো, তার বিপদটা কোন জায়গায় তা বুঝতে হলে আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

ঈসা (সা.) নবীকে উঠিয়ে নেবার পর বা বাইবেলের ভাষায় ক্রুশবিদ্ধ করার পর পলের নেতৃত্বে ঈসা (আ.) এর সঙ্গী-সাথীরা জেরুজালেমের বাইরে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন।

আগেই বলা হয়েছে ঈসা (আ.) এসেছিলেন কেবল মুসা (আ.) এর আনিত দ্বীনটিকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, বিকৃতিগুলোকে দূর করতে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তওরাত তখন পর্যন্ত মোটামুটি অবিকৃতই ছিল, সমস্যা হয়েছিল দ্বীনের আত্মিক ভাগটায়। ধর্মকর্মের আনুষ্ঠানিকতাই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন, অন্যদিকে মানবতার দিকটা উপেক্ষিত হচ্ছিল ভয়ানকভাবে। সেই মানবতার ভাগটাকে যথাস্থানে স্থাপনের দায়িত্ব ছিল ঈসা (আ.) এর উপর। তাই তিনি তাঁর নবী জীবনে মানবতার কথা বেশি বলেছেন, অসুস্থ-রোগগ্রস্থ মানুষের উপকার করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোঁচানোও ধর্মেরই কাজ। এটাকে উপেক্ষিত রেখে যত নিখুঁতভাবে শরীয়তের বিধান মান্য করা হোক আল্লাহ কবুল করবেন না। মোটকথা তিনি ইহুদিদের পালন করা দ্বীনটিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। দ্বীনের শরীয়ত ও আত্মিক ভাগটাকে একসূত্রে গেঁথে দেওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু ঈসা (আ.) গত হয়ে যাবার পর, তাঁর নাম ব্যবহার করে বনি ইজরাইলের বাইরে পৃথিবীময় যে ‘খ্রিষ্টধর্ম’ প্রচার আরম্ভ হলো তাতে স্বাভাবিকভাবেই স্থান পেল কেবল মানবতার কথা, উদারতার কথা, অর্থাৎ দ্বীনের ওই হারিয়ে যাওয়া আত্মিক ভাগটা। কিন্তু শরীয়ত? শরীয়ত তো তাওরাতে। ঈসা (আ.) কোনো শরীয়ত নিয়ে আসেন নি, তার প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু এখন প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কারণ শরীয়ত ছাড়া কোনো দ্বীন চলতে পারে না। সমস্যাটা বাঁধল এখানেই। ইহুদিদের বাইরে ‘খ্রিষ্টধর্মে’র নাম করে যে ধর্মটি প্রচার করা শুরু হলো তা সম্পূর্ণ ভারসাম্যহীন একটি দ্বীন। দুই পায়ে ভর করে চলার কথা যে মানুষের, তাকে এক পায়ে ভর দিয়ে চলতে বাধ্য করা হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মুখ থুবড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঘটনাচক্রে খ্রিষ্টধর্ম তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও ধর্মটি অনেক পথ পাড়ি দিতে পেরেছে। ইনকুইজিশনের মত বর্বরতার সাহায্য নিয়ে হলেও পেরেছে।

ধর্মের নামে ইউরোপের মধ্যযুগীয় বর্বরতার চিত্র।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে- যে ধর্মবিশ্বাসটির জন্মই হলো ঈসা (আ.) এর আদেশ লঙ্ঘন করে, যে জাতিগোষ্ঠী আল্লাহর দেওয়া সত্যদ্বীন পেল না, পেল একটি ভারসাম্যহীন অপ্রাকৃতিক দ্বীন যা মানবসমাজকে শান্তি দিতে অক্ষম, সেই জাতি-গোষ্ঠীকে সত্যের সন্ধান দিতে যে নবীর আগমণ ঘটল সেই বিশ্বনবীর অনুসারীরা কেন ওই বিপথগামী জাতিকে নিজেদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে? মু’মিনদের কাছে আছে সেই সত্য, যা যুগে যুগে নবী-রসুলগণ শিক্ষা দিয়েছেন। যে সত্য ঈসা (আ.) পেয়েছিলেন, যে সত্য মুসা (আ.) পেয়েছিলেন, সেই সত্যেরই চূড়ান্ত ভার্সন তখন মু’মিনদের হাতে। ওই সত্যের অনুগামী না হয়ে তারা কেন ঈসা (আ.) এর অনুসারী দাবিদারদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে? বাস্তবতার নিরিখে ভাবলে ওরা তো ঈসা (আ.) এর প্রকৃত অনুসারী নয়। বরং প্রকারান্তরে মু’মিনরাই ঈসা (আ.) এর প্রকৃত অনুসারী।
অন্যদিকে ইহুদিদের প্রসঙ্গেও একই কথা। তারা মুসা (আ.) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত দ্বীনকে মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের কমপক্ষে পাঁচশ বছর আগেই এতখানি বিকৃত করে ফেলেছিল যার জন্য তাদের সংশোধন করতে আল্লাহকে নতুন নবী পাঠাতে হয়েছে। সেই নবীকেও তারা গ্রহণ করে নি। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও পাঁচশ’ বছর। ততদিনে বিকৃতির স্তর আরও পুরু হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ পাঠিয়েছেন আখেরী নবীকে। সেই আখেরী নবীর মাধ্যমে আসা সত্যকে যে মু’মিনরা ধারণ করল, তারা কেন শত শত বছর পূর্বেই মুসা (আ.) এর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া একটি জাতিকে নিজেদের অভিভাবক ও পথপ্রদর্শক বানাবে? যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ নেয় না, যারা স্বার্থের বশবর্তী হয়ে আল্লাহর প্রেরিত নবীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না, আর যাই হোক মু’মিনদের অভিভাবক বা সাহায্যকারী বন্ধু হবার যোগ্যতা তাদের নেই। এ কারণেই আল্লাহর সোজা নির্দেশ- মু’মিনরা যেন ইহুদি ও খৃষ্টানদেরকে নিজেদের অভিভাবক মনে না করে। ওদের অভিভাবক বলে স্বীকার করার অর্থ তাদের কথামত চলা। যেহেতু তাদের কাছে সত্য নেই, তারা নিজেরা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে, কাজেই মু’মিনরা তাদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করলে তারা মু’মিনদেরকেও সত্যবিচ্যুত করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে বাধ্য করবে, বিপথগামী করবে। সমস্যাটা এখানেই। ইহুদি ও খ্রিষ্টান বলে যারা পরিচিত তাদের কাছে যদি সত্য থাকত তবে আল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন না। সত্য নেই বলেই এই বাড়তি সতর্কতা।
কোর’আন ইঞ্জিলকে স্বীকৃতি দেয়, তাওরাতকেও স্বীকৃতি দেয়। কেন দিবে না? কোর’আন তো তাওরাত, ইঞ্জিলসহ যত ধর্মগ্রন্থ আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সবগুলোর আপডেট সংকলন। কিন্তু একটি কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে- আপনি জন্মের দশ মাস বয়সে যে খানা খেয়েছেন দশ বছর বয়সের জন্য তা যথেষ্ট নয়। আবার দশ বছর বয়সে যে পোশাক পরেছেন পরিণত বয়সে তা অনুপযুক্ত। মানবজাতিও শিশুকাল থেকে শৈশব-কৈশোর পার হয়ে যৌবনে উপনীত হয়েছে। যুগে যুগে তার বয়সের অনুপাতে আল্লাহ খাদ্য-বস্ত্র নির্ধারণ করেছেন। এখন তার পরিণত বয়স। এখন তাকে সাগু খাইয়ে রাখলে হবে না। এখন সে নরম খাবার খাবে, শক্ত খাবারও খাবে। সাত্ত্বিক খাবার খাবে, তামসিক খাবারও খাবে। শেষ ইসলাম হচ্ছে মানবজাতির পরিণতি বয়সের উপযোগী দ্বীন। যারা এই যুগোপযোগী সত্য এসে পড়ার পরও প্রাচীনত্বের মোহ ত্যাগ করতে পারছেন না তারা তাদের মত থাকলে কোনোই অসুবিধা নেই। কেউ সারাজীবন শুধু সাগু খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলে ভাত-মাছওয়ালাদের আপত্তি খাকার কথা নয়। কিন্তু একটি কথা প্রাচীনপন্থীদের জেনে রাখতে হবে, নতুনের প্রাণে যে তারুণ্যের উদ্যোম সৃষ্টি হয়েছে তা কখনও প্রাচীনের কাছে মাথানত করবে না, করতে পারে না। যদি সে প্রাচীনের কাছে আত্মসমর্পণ করে তবে প্রাচীন তাকে গ্রাস করে নিবে, নতুনের অগ্রযাত্রা শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। এটা প্রাকৃতিক সত্য। তাই এ সত্যের যিনি স্রষ্টা তাঁর পক্ষ থেকে প্রাচীনের কাছে মাথানত না করার এমন স্পষ্ট সতর্কবাণী।

নবীজীর কোন দাস ছিল না


নবীজির কোনো দাস ছিল না, ভৃত্য ছিল, খাদেম ছিল। কোর'আনে দাস বোঝাতে রাকাবাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়, ঘোড়ার রেকাব আর রাকাবাত একই রুট, অর্থ রশি দিয়ে বাধা। তিনি নবী হওয়ার আগেও দাস রাখেন নি, নবী হওয়ার পরে প্রশ্নই আসে না। যায়েদকে (রা.) তিনি ২৫ বছর বয়সেই আজাদ করে দেন এবং যায়েদ স্বেচ্ছায় আজীবন তার সঙ্গে থেকেছেন। তাকে তিনি কেবল মুক্তই করেন নি, আরবে দাসদের প্রতি যে নিচু দৃষ্টি দেওয়া হতো তার প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি যায়েদকে (রা.) তার সন্তান হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাকে বহু যুদ্ধে সেনানায়ক করেছেন এবং আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), খালেদ (রা.) এর মতো বড় বড় কোরেশ বংশীয় সাহাবীরাও তার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। যারা নেতৃত্ব মানতে চায় নি তাদের বিরুদ্ধে রসুলাল্লাহ কঠিনভাবে তিরস্কার করেছেন।
আমি ইসলামবিদ্বেষী অনেক মানুষ দেখেছি যারা অন্ধভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং শত্রুর দৃষ্টিতে ইসলামের ইতিহাসকে দর্শন করছে। ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোতে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে লেখা হয় ঠিক যেমন কোল্ড ওয়ারের সময় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। ইসলামবিদ্বেষীরা ঐ সব লেখা থেকেই তাদের রেফারেন্স ও যুক্তিগুলো লাভ করে। ফলে তারা নিজেদের মুক্তমনা মনে করলেও কার্যত একটি মতবাদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। আমার পাঠকদের কাছে আশা যে তারা নির্মোহভাবে সত্যকে আবিষ্কারের জন্য আলোচনা চালাবেন। মানবজাতির আদর্শিক সংকটকালে পথ বেছে নিতে, ঐক্যবদ্ধ হতে হলে চশমা খুলে সাদা চোখে দেখার মানসিকতা অপরিহার্য।
রসুল বা রসুলের কোনো সাহাবী কি দাসব্যবসা করেছেন? করেন নি। কেন করেন নি? রসুলের সময় মদীনায় কি দাস কেনা বেচার ইতিহাস দেখাতে পারবেন? পারবেন না। দাসদের মুক্ত করার জন্য কোর'আনে বহুবার বলা আছে। সে সময় আরবের জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশই ছিল দাস দাসী যাদের উপর সমাজব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল এবং তারাও তাদের মনিবদের উপর জীবিকা ও আশ্রয়ের জন্য নির্ভরশীল ছিল। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই সমাজের বুনন। কিন্তু এই সম্পর্কের ভিত্তি কী হবে, চুক্তি কী হবে সেটাই ইসলাম পরিবর্তিত করে দিয়েছে। যদি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না এনে কেবল দাসদের মুক্ত করে দিতে বাধ্য করা হয় তার পরিণামে সৃষ্টি হয় আরেক ভারসাম্যহীনতা। যেমন আজও আমেরিকায় নিগ্রোদেরকে সাদারা হীন দৃষ্টিতে দেখে। এ সত্য যারা এড়াতে চায় তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন।
ইসলাম মনিবদেরকে এই ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, দাসরা তাদের ভাই। বিশ্বনী (স) বলেন: “তোমাদের দাসরা তোমাদের ভাই। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যার অধীনে তার কোন ভাই থাকবে সে যেন তার জন্য সেইরূপ খাওয়া পরার ব্যবস্থা করে যেরূপ সে নিজের জন্যে করবে। এবং যে কাজ করার মত শক্তি তার নেই সে কাজ করার হুকুম যেন সে না দেয়। আর একান্তই যদি সে সেইরূপ কাজের হুকুম দেয় তাহলে সে নিজে যেন তার সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে।” [আল বুখারী]
.
এখানেই শেষ নয়। ইসলাম দাসদের আশা-আকাংখা ও অনুভূতি উপলব্ধির প্রতিও যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছে। বিশ্বনবী (সা.) বলেন: তোমাদের কেউ যেন (দাসদের সম্বন্ধে) এরূপ না বলে যে, আমার দাস এবং আমার দাসী; উহার পরিবর্তে বলতে হবে, ঐ আমার সেবক এ আমার সেবিকা।” [এ হাদীসের বর্ণনাকারী ছিলেন হযরত আবু হুরাইরা (রা)।]
.
হাদীসের এই শিক্ষা অনুযায়ীই হযরত আবু হুরাইরা (রা) যখন দেখতে পান যে, এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে এবং তার গোলাম তার পেছনে পায়ে হেটে যাচ্ছে, তখন তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন: তাকেও ঘোড়ার পিঠে তোমার পেছনে বসিয়ে দাও; কেননা সে তোমার ভাই; তোমার ন্যায় তারও প্রাণ আছে।”

.......দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ধর্মান্তরকরণ.......

আল্লাহ কেন বিশ্বনবীকে পাঠিয়েছেন তা জানাতে গিয়ে কোর’আনের সুরা ফাতাহর ২৮ নম্বর আয়াতে বললেন- ‘‘তিনিই তাঁর রসূলকে সঠিক পথনির্দেশ ও সত্যদ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন।’’
সুতরাং আল্লাহ চাচ্ছেন অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে, বিজয়ী করতে। অথচ সেই তিনিই আবার কোর’আনের সুরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে বলছেন- ‘‘দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’’ হাদীসেও তাই। বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রসুল যখন তাঁর উম্মাহকে দ্বীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোকে শেষবারের মত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন তিনি বললেন- সাবধান! দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। অর্থাৎ কোর’আনের ‘দ্বীনে জবরদস্তি নেই’- এ কথারই প্রতিধ্বনি।
এখানে কথা হচ্ছে, দ্বীনের ব্যাপারে জবরদস্তি করা যাবে না ও দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না- এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো দ্বীন কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না বা দ্বীন গ্রহণ করতে কাউকে জোর করা যাবে না, তাই নয় কি? অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে আল্লাহ নিষেধ করে দিলেন। অথচ আল্লাহ তাঁর রসুলকে পাঠিয়েছেনই অন্যান্য সমস্ত দ্বীনকে পরাজিত করে শেষ ইসলামকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
এমতাবস্থায় এই দুই আয়াতের সামঞ্জস্য রক্ষা হবে কীভাবে তা আমাদেরকে জানতে হবে। আমাদেরকে জানতে হবে দ্বীন ইসলামকে অন্যান্য সমস্ত দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করা এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করার মধ্যেকার সুক্ষ্ম অথচ বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ পাথর্ক্যটা কী? এই পার্থক্য যারা জানেন না তারাই ক্ষেত্রবিশেষে কেউ বিধর্মীদেরকে ইসলাম গ্রহণ করাতে শক্তি প্রয়োগের আশ্রয় নেন, আর কেউ ইসলামকে তলোয়ারের জোরে বিস্তার লাভ করার অপবাদ দেন।

জীবন ও ধর্ম

‘জীবন’ যদি প্যাসেঞ্জার হয় তবে ‘ধর্ম’ হচ্ছে ড্রাইভার। জীবন স্থবিরতা পছন্দ করে না। সামান্য স্থিরতা, গতিহীনতাও তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, বিরক্তির উদ্রেক করে। সে সবকিছুকে পেছনে ফেলে কেবল সামনে এগোতে চায়। বাকিটা ধর্ম অর্থাৎ ড্রাইভারের দায়িত্ব।
জীবনের অভিযাত্রায় ধর্ম যত শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে রাখতে পারে যাত্রা তত মঙ্গলজনক ও নিরাপদ হয়। আর ধর্ম ভারসাম্যহীন হলে, অন্ধ কিংবা বধির হলে যাত্রা বিপদজনক হয়, দুর্ঘটনা ঘটে।
আর যদি ধর্ম এতই জরাজীর্ণ ও রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ে যে, জীবনের গতির সাথে তাল মেলানো দূরের কথা ন্যুনতম কর্মদক্ষতাও সে হারিয়ে ফেলে, স্থবির পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে (গণ্ডিতে) পড়ে থাকে, তাহলে ওই পশ্চাদপদ গতিহীন ধর্ম থাকাও যা, না থাকাও তা।
জীবন তখন বাধ্য হয় স্টিয়ারিং নিজের হাতে তুলে নিতে। আনাড়ী-অনভিজ্ঞ হাত তাকে বারংবার দুর্ঘটনায় নিপতিত করে, চারদিক থেকে বিপদের কালো ছায়া নেমে আসে, যাত্রা বিঘ্নিত হয় চরমভাবে, কিন্তু সে থেমে যেতে পারে না। তাকেই চলতেই হয়।
সূর্য যেমন এক সেকেন্ডের কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ও আলো প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে পারে না, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেমন এক সেকেন্ডের জন্যও আকর্ষণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে না, তেমনিভাবে জীবনও এক মুহূর্তও থেমে থাকতে পারে না। কারণ চলার নামই জীবন।
ধর্ম ও জীবনের সম্পর্কটাই এমন যে, ধর্ম যদি জীবনকে লীড দিতে চায় তবে তাকেও জীবনের মতই গতিশীল হতে হবে। গতি ফুরালো তো ধর্মের গ্রহণযোগ্যতাও ফুরালো।

কারবালা: উম্মতে মোহাম্মদীর ব্যর্থতার পরিণতি

আজ থেকে ১৩৭৬ বছর আগে ইরাকের কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে নবীজীর প্রিয় দৌহিত্র হোসাইনের (রা:) বিষাদময় শাহাদাৎ বরণের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায় হয়ে আছে। এই দিনটিতে শিয়া সম্প্রদায় তাজিয়া মিছিলসহ বিভিন্ন মিছিল, মাতম ও শোকানুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে, ‘হায় হোসেন হায় হোসেন বলে’ বুক চাপড়ে, নিজের শরীর নিজে রক্তাক্ত করে শোক প্রকাশ করে। অন্যদিকে সুন্নিদের মধ্যে ভিন্ন চিত্র। তাদের কাছে এই দিনটির তেমন কোনো আবেদন পরিলক্ষিত হয় না। অন্যান্য সরকারি ছুটির মতই দেখা যায় এই দিবসটিকেও তারা সাধারণ একটি ছুটির দিন বলে মনে করে। ফলে দেখা যায় উম্মতে মোহাম্মদীর ইতিহাসের এই মর্মান্তিক ঘটনাটির প্রকৃত যে গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনীয় ছিল, তা না শিয়ারা অনুধাবন করতে পারে না সুন্নিরা। এদিকে আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ আক্রান্ত, রক্তাক্ত। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো একের পর এক মুসলিম দেশ দখল ও ধ্বংস করে চলেছে, লাখ লাখ মুসলিমকে হত্যা করছে, বাড়িঘর গুড়িয়ে দিচ্ছে, আবার এই জাতি নিজেরাও একে অপরকে কাফের, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিগতভাবে পৃথিবীময় মুসলিম জাতির এই যে দুর্দশা, এমন তো হবার কথা ছিল না। কেন এই করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের? এ প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা পেতে চাই তবে উম্মতে মোহাম্মদীর গৌরবগাঁথা ইতিহাসের পাশাপাশি আশুরার এই কলংকজনক অধ্যায়টিরও সঠিক পর্যালোচনা করতে হবে। 
.
আল্লাহর রসুল সারাটি জীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য। উম্মতে মোহাম্মদীর উপরও একই দায়িত্ব। কিন্তু যখন ইতিহাসে দেখি আল্লাহর রসুলের ওফাতের কয়েক দশক পর নবীজীর দৌহিত্রকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, তখন আরও একটি প্রশ্ন স্বভাবতই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যে, খোদ নবীর পরিবার-পরিজনই যদি এতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তবে অন্যদের অবস্থা কেমন ছিল? আজকের এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে ঘটনাটির সঠিক মূল্যায়ন করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
.
ইসলামের চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে আখেরী নবী, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় পৃথিবীতে এসেছিলেন, যে সময়কে আমরা বলি ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞানতার যুগ। এমন নয় যে সে যুগের মানুষ সম্পূর্ণ ধর্মবিমুখ হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহ বিশ্বাস করত না, এবাদত-বন্দেগী করত না ইত্যাদি। তা নয়। তৎকালীন আরবরা ধর্মকর্মে কারও চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করত, ক্বাবা তাওয়াফ করত, নামাজ পড়ত, রমজান মাসে রোজা রাখত, দান-খয়রাত করত, মানত করত, খাৎনা করত এবং নিজেদেরকে মিল্লাতে ইব্রাহীম বলে দাবি করত। কোনো ভালো কাজ শুরু করার আগে উচ্চারণ করত- বিসমিকা আল্লাহুম্মা। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে ধর্মকর্ম বলতে যা বোঝানো হয় তা ওই সমাজেও ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-আচরণ, এক কথায় অত ধর্মকর্ম থাকার পরও ওই যুগকে জাহেলিয়াতের যুগ বলার কারণ তারা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করত না। অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, রক্তপাত, শত্রুতা, জিঘাংসা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভরা ছিল তাদের সমাজ। সেখানে চলত ‘Might is Right’ ’ এর শাসন। শক্তি যার হাতে, ক্ষমতা যার হাতে, তার কথাই ন্যায় বলে সাব্যস্ত হত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, একতাবোধ, শৃঙ্খলাবোধ, আনুগত্যবোধ- কিছুই ছিল না। কৃষি বা ব্যবসা উভয়ক্ষেত্রেই তারা ছিল অনগ্রসর। অভাব, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর বর্বরতার দরুন তৎকালীন পৃথিবীতে তারা গণ্য হত সর্বাধিক উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত ও মর্যাদাহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে। সভ্য জাতিগুলো তাদেরকে দেখত অবহেলা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে।
.
আল্লাহর রসুল তাদেরকে ন্যায়-অন্যায় শেখালেন। ধর্ম-অধর্মের পার্থক্য জানালেন। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগী, আত্মোৎসর্গকারী বিপ্লবী হবার প্রেরণা যোগালেন। অনৈক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করলেন, শৃঙ্খলাবোধ শেখালেন। কীভাবে নেতার কথাকে দ্বিধাহীনভাবে, প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় সে শিক্ষা দিলেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যে আরবজাতিটির মধ্যে এমন বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধিত হলো যা সমকালীন বিশ্বে কল্পনারও অতীত ছিল।
.
মানবজীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজটি কেবল আখেরী নবী নয়, তাঁর পূর্বের নবী-রসুলগণও করে গেছেন। বিশ্বনবীর সাথে অন্যান্যদের পার্থক্য কেবল এই যে, অন্যান্যদের দায়িত্ব ছিল সীমিত পরিসরে, যার যার এলাকায় সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে শেষ নবীর দায়িত্ব পৃথিবীময় (ফাতাহ ২৮)। কিন্তু কাজ সবারই এক, সেটা হচ্ছে মানবজীবনে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর দেওয়া দ্বীনুল হক্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সেই প্রত্যাশিত ‘শান্তি’ আসবে বলেই এই দ্বীনের নামকরণ করা হয়েছে ইসলাম অর্থাৎ শান্তি। আল্লাহর রসুল তাঁর নবুয়্যতি জিন্দেগীতে যা কিছু বলেছেন ও করেছেন সবই সমাজের নিরাপত্তার জন্য, মানুষের শান্তির জন্য। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় কোনো মানুষের একার পক্ষে এতবড় দায়িত্ব সম্পন্ন করা অসম্ভব। তাই আল্লাহর রসুল সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমগ্র আরব উপদ্বীপে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার পর বাকি পৃথিবীতেও একইভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার, সুবিচার, সাম্য, মৈত্রী এক কথায় ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করলেন উম্মতে মোহাম্মদীর উপর, যে জাতিটিকে তিনি নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন। বারবার জাতিকে সতর্ক করলেন যাতে তিনি দুনিয়া থেকে চলে যাবার পরও তাঁর সুন্নাহ (শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) ছেড়ে দেয়া না হয়। বলেছেন- ‘যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করল সে আমার কেউ নয় আমিও তার কেউ নই।’ 
.
আল্লাহর রসুল জানতেন এই মহাদায়িত্ব পূরণ করার জন্য উম্মতে মোহাম্মদীর যে জাতীয় চরিত্র দরকার তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হচ্ছে ‘ঐক্য’। তাই কোনোভাবেই যাতে উম্মাহর ঐক্যে ভাঙ্গন না ধরে সেজন্য সারাজীবন তিনি জাতিকে হাজারো উপদেশ তো দিয়েছেনই, ঐক্যভঙ্গের কোনো কথা বা আচরণ দেখলেই তিনি রেগে লাল হয়ে যেতেন, সর্বশেষ বিদায় হজ্বের ভাষণে, যে ভাষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শেষবারের মত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন, সেখানে পুনরায় বললেন, ‘‘আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর যেমন পবিত্র, তোমাদের একের জন্য অপরের জান, মাল, ইজ্জত ততটাই পবিত্র। আমার পরে তোমরা একে অপরকে খুনোখুনি করে কুফরিতে ফিরে যেও না।’’ আরেকটি হাদীসে রসুলাল্লাহ বলেন, ‘‘আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন। আমি তোমাদেরকে সেই পাঁচটি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করছি।
(১) তোমরা ঐক্যবদ্ধ হবে
(২) (তোমাদের মধ্যবর্তী আদেশকারীর কথা) শুনবে
(৩) (আদেশকারীর হুকুম) মান্য করবে
(৪) (আল্লাহর হুকুম পরিপন্থী কার্যক্রম থেকে) হেজরত করবে
(৫) আল্লাহর রাস্তায় জীবন-সম্পদ দিয়ে জেহাদ (সংগ্রাম) করবে।
যারা এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে যাবে, তার গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন খুলে যাবে যদি না সে তওবা করে ফিরে আসে। আর যে জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করে তাহলে সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত হবে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমন কি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে [হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজি, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত]।’’ 
.
এখানেও একই কথা। ঐক্য নষ্ট করার অর্থ ইসলাম থেকে বহির্গত হয়ে যাওয়া। রসুলের এই শিক্ষাকে, ঐক্যের গুরুত্বকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলেই পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বর্বর, দাঙ্গাবাজ, অশিক্ষিত, অসভ্য ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত একটি জাতি মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে একটি সভ্য, ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আধুনিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছিল, একটি ‘সম্ভাবনাহীন উপাদান বা শূন্য’ (পি. কে হিট্টির ভাষায়) থেকে বিরাট এক বটবৃক্ষের জন্ম হতে পেরেছিল। আল্লাহর রসুলের ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতে গড়া জাতিটি তৎকালীন পৃথিবীর দুইটি সুপার পাওয়ার রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য পরাজিত করল এবং মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্ধপৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করল। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, শিল্প-সাহিত্যচর্চায় সমস্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন হলো- যে ইতিহাস লিখতে গিয়ে পাশ্চাত্যের খৃষ্টান পণ্ডিতরাও বারবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ওই জাতি যদি অর্ধপৃথিবীতে সত্যদ্বীন প্রতিষ্ঠিত করে থেমে না যেত, তবে বলাই যায় আরও কয়েক বছরের মধ্যে তারা বাকি পৃথিবীতেও সত্য, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর নবীর অর্পিত দায়িত্বকে পুরোপুরি সম্পন্ন করে ফেলতে পারত। কারণ তাদের সামনে দাঁড়ানোর মত কোনো শক্তি তখন পৃথিবীতে ছিল না। 
.
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে এমন সময় উম্মতে মোহাম্মদী তাদের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলল। আবু বকর (রা.), উমর (রা.) ও উসমান (রা.) এর খেলাফত পর্যন্ত জাতি ছিল ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু উসমান (রা.) এর শাসনামলের শেষের দিকে শুরু হলো জাতিবিনাশী অনৈক্য, যার জের ধরে খলিফা উসমান (রা.) শহীদ হলেন। জাতি ভুলে গেল ঐক্য নষ্ট করা কুফর, যারা করবে তারা কাফের, তারা ইসলাম থেকেই বহির্গত হয়ে যাবে, জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে যদিও তারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে। উম্মাহর জাতীয় জীবনে নেমে এলো ভয়াবহ বিপর্যয়। বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রসুল যে ‘ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত’ এর আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই বাস্তবে রূপ নিল। উষ্ট্রের যুদ্ধে আম্মা আয়েশা (রা.) মুখোমুখী হলেন হযরত আলী (রা.) এর বিরুদ্ধে (এটি একটি ইহুদি গোষ্ঠীর চক্রান্তের ফসল ছিল, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়)। তারপর সিফফিনের যুদ্ধে পুনরায় মুয়াবিয়া (রা.) মুখোমুখী হলেন আলী (রা.) এর বিরুদ্ধে। হাজার হাজার মুসলিমের রক্ত ঝরল মুসলিমদেরই হাতে। এই অনৈক্য, এই ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত জাতিকে এমনভাবে পেছনে টেনে ধরল যে, জাতি আর সামনে এগোতেই পারল না। যে প্রচণ্ড গতি নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অর্ধপৃথিবীর চিত্র পাল্টে দিতে পেরেছিল সেই জাতিই গতি হারিয়ে, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ভুলে গিয়ে এবং নিজেরা নিজেরা সংঘাতে জড়িয়ে স্থবির হয়ে গেল। কিন্তু ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের যে গরল তারা গলধঃকরণ করে ফেলেছে তার প্রতিক্রিয়া এত সহজে নিঃশেষ হবার নয়। ঐ শত্রুতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ এক প্রজন্ম থেকে সংক্রমিত হলো পরবর্তী প্রজন্মে। যে জাতির হাতে দায়িত্ব ছিল সমস্ত পৃথিবীতে ন্যায়, সাম্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষকে মুক্তি দেওয়া, তারা নিজেরাই মারামারি, খুনোখুনিতে মেতে উঠল। এই ভ্রাতৃঘাতী বিদ্বেষ কত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত কারবালার বিষাদময় হত্যাযজ্ঞ। 
.
আল্লাহর নবীর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, যিনি রসুলের কোলে বসে, পিঠে চড়ে খেলা করতেন, যাঁর মস্তকে আল্লাহর নবীর পবিত্র হাতের পরশ রয়েছে, যার সম্পর্কে আল্লাহর নবী বলেছেন যে, হাসান-হোসাইনের সাথে যে ব্যক্তি বিদ্বেষ পোষণ করল সে আমার সাথেই বিদ্বেষ পোষণ করল, নবীজীর সেই অতি আদরের দৌহিত্রের মস্তক ছিন্ন করতেও পাপীষ্ঠদের অন্তরাত্মা কাঁপে নি। জাতি তো সেদিনই দেউলিয়া হয়ে গেছে। এই জাতির পতনের পর্ব তো তখনই শুরু হয়ে গেছে। কারবালার প্রান্তরের ওই পৈশাচিক ঘটনার মাধ্যমে এই জাতির মধ্যে ওই যে ইয়াজীদী শক্তি খুঁটি গেড়ে বসল, তা দিনে দিনে আরও পোক্ত হয়েছে। আজ সারা বিশ্ব চালাচ্ছে ইয়াজীদের প্রেতাত্মারা। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে যে যেভাবে পারছে বিনাশ করে চলেছে। এদের দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। শিশুদের পাখির মত গুলি করছে, নারীদের সম্ভ্রম কেড়ে নিচ্ছে, বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে খোলা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারছে। আর যাদের দায়িত্ব ছিল দুনিয়াকে ইয়াজীদের প্রেতাত্মাদের হাত থেকে মুক্ত রাখা, তারা সেই দায়িত্বের কথা বেমালুম ভুলে গেয়ে একদল নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করছে, রক্তারক্তি করছে, বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসার চর্চা করে নিজেরা ধ্বংস হচ্ছে অন্যকেও ধ্বংস করছে, অন্যরা ইয়াজীদী শক্তির পদসেবা করছে। অথচ এখন দরকার জাতির দুর্গতি নিরসনে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।
.
আজ ২০১৬ সালের যে বিন্দুটিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাকে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে বিরাট এক ক্রান্তিকাল বলা যায়। সার্বিকভাবে মুসলিম নামক জনগোষ্ঠী গত কয়েক শতাব্দী থেকেই ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। আর এখন নিছক দুর্দশা নয়, এখন প্রশ্ন এই জাতির বাঁচা-মরার। অথচ এই মুসলিম জনগোষ্ঠীই একদা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, শিক্ষা-দীক্ষায় সবার শিক্ষকের আসনে বসেছিল। তাহলে এই করুণ পরিণতি কেন? কোথায় ভুল করেছি আমরা? ঠিক কোন জায়গাটায় পথ হারিয়ে আজকের এই অন্ধকার চোরাবালিতে আটকে রয়েছি আমরা? এর উত্তর আমাদেরকে জানতে হবে। ১৩০০ বছর ধরে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে হায়-হুতোশ ও মাতম কম হয়নি। তাতে কী লাভ হয়েছে? ন্যায় আজও পরাজিত, আর অত্যাচারিত যালেমরা দোর্দণ্ড প্রতাপে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর কারণ আমরা কারবালার ইতিহাসে পড়ে আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের পানি ফেলতে অভ্যস্ত, কিন্তু এই ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে অভ্যস্ত নই। যদি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতাম, যদি নির্মোহ পর্যালোচনা করে সমস্যার গোড়ায় প্রবেশ করতে পারতাম তবে মুসলিমদের জন্য সারা পৃথিবী কারবালায় পরিণত হতো না। এ জন্যই কাজী নজরুল বলেছেন, ‘‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাই না।’’ তাই আসুন বৃথা মাতম করা ছেড়ে ত্যাগের মহীমায় উজ্জীবিত হই এবং ফেরকা-মাজহাবের দেয়াল ভেদ করে সমগ্র জাতিকে পুনরায় সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রাম শুরু করি। এটাই হোক আশুরার অঙ্গীকার।

ক্বাবা ছুঁয়ে কোরাইশদের শপথ: মোহাম্মদের (সা.) বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকব

হেযবুত তওহীদ যখন প্রচলিত ধর্মান্ধতা, ‍কুসংস্কার, ধর্মব্যবসা ও ধর্মের নামে অপরাজনীতির অসারতা ধরিয়ে দিয়ে ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা তুলে ধরছে তখন অবাক হয়ে লক্ষ করি একদল ধর্মান্ধ কিছু না বুঝেই ‘ধর্ম গেল ধর্ম গেল’ জিগির তুলে দেয়। অথচ ধর্ম কী বস্তু তা তারা নিজেরাও জানে না, তাদের কথিত ধর্মগুরুরাও জানে না। ধর্ম বলতে তারা বোঝে বাপ-দাদার আমল থেকে যেটা পালন করে আসছে সেটা। আল্লাহ কী বলেছেন, রসুল কী করেছেন তা নয়, অমুক মাওলানা সাহেব যা বলেছেন সেটাই তাদের ধর্ম।
এই লোকগুলোকে যখন বলা হচ্ছে তোমরা যেটা করছো সেটা ইসলাম নয়, তোমরা আসলে আল্লাহর এবাদত করছ না, এবাদত করছ তোমাদের ধর্মগুরুদের, তখন তারা আগামাথা না ভেবেই ‘ইসলাম গেল’ ‘ইসলাম গেল’ রব তুলে দেয়। আরে ভাই ইসলাম থাকলে তো যাবে? নামাজ, রোজা, হজ্ব, সুন্নাতে খাৎনাকেই ইসলাম মনে করলে বিরাট ভুল হয়ে যাবে।
এগুলো ইসলামের আগেও ছিল। এগুলো পালন করা সত্ত্বেও কোরাইশরা আল্লাহর চোখে মুশরিক ছিল। আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা বলে বিশ্বাস তারাও করত। তা সত্ত্বেও তারা আল্লাহর রসুলের বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল। ক্বাবাকে ‍তারা এত শ্রদ্ধা করত যে, ক্বাবা পরিষ্কার করতে ঝাড়ু লাগাত না ক্বাবার অশ্রদ্ধা হবে ভেবে। দাড়ি দিয়ে ক্বাবা ঝাট দিত। আজকের অতি মুসলিমদের মতই তারা ধর্মকর্মে ছিল অনন্য। নিজেদেরকে ভাবত মিল্লাতে ইব্রাহীম। তবু ওরা মোশরেক, কাফের, আল্লাহদ্রোহী।
আল্লাহর রসুল যখন সত্য প্রচার শুরু করলেন আজকের ধর্মান্ধদের মত ওই কোরাইশরাও তখন ধর্ম গেল ধর্ম গেল জিগির তুলত। আজকে যেমন হেযবুত তওহীদের সদস্যদেরকে খৃষ্টান, মুরতাদ বলে অপপ্রচার চালানো হয়, তেমনি আল্লাহর রসুলকে বলা হত মুরতাদ। বর্তমানের ধর্মান্ধদের মতই কোরাইশরা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ত এই ভেবে যে, মোহাম্মদ (সা.) না আবার তাদের ধর্ম নষ্ট করে ফেলে, ঈমান ধ্বংস করে ফেলে। সবচাইতে হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে- আল্লাহর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করত কোরাইশরা।
হযরত ওমর (রা.) এর জীবনীর উপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র থেকে একটি ক্লিপ দিলাম। এতে দেখা যাচ্ছে খন্দকের যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে কোরাইশরা ক্বাবাঘর ছুঁয়ে শপথ নিচ্ছে যে, তাদের শেষ মানুষটি জীবিত থাকা পর্যন্ত তারা মোহাম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। বিষয়টা আজকের যুগে হাস্যকর মনে হলেও তৎকালীন আরবে ছিল ‘ফ্যাক্ট’। তখন পরিস্থিতি কেমন ছিল, কেন নামাজ-রোজা-ক্বাবা তাওয়াফ ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ও আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করার পরও আরবরা কাফের-মোশরেক ছিল, কেন আল্লাহর রসুলকে মুরতাদ ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল, কী কারণে কোরাইশ ধর্মগুরুরা আল্লাহর সত্য নবীকে ‘শত্রু’ বানিয়ে নিল, তা আমরা হেযবুত তওহীদ বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারছি।


.............জান্নাতী হুর...............

কোনো মেয়ে যদি এই প্রশ্ন তোলে যে, ছেলেরা জান্নাতে ৭০ জন হুর পাবে (হাদিস অনুসারে), কিন্তু আমরা কী পাব? তার জবাব হচ্ছে- আপনি জান্নাতে যা চাইবেন তাই পাবেন। আল্লাহ আপনার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ রাখবেন না। 
.

এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, জান্নাতে কারও অতৃপ্তি থাকবে না। সুতরাং জান্নাতী ব্যক্তি যা চাইবেন তাই পাবেন। সে হিসেবে আপনি ৭০ জন ছেলে (হুর) চাইলে তাই পাওয়ার কথা, কিন্তু আপনি তা চাইবেন কিনা- সেটাই আসল প্রশ্ন।
.
বিশ বছরের যুবক কিন্তু দশ বছরের কিশোরের দামী জুতা, দামী শার্ট দেখে ঈর্ষা করে না, মনে মনে ওই দামী জুতা ও শার্ট পাবার কামনা করে না, কারণ সে জানে ঐ শার্ট ঐ জুতা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। সে কামনা করবে এমন শার্ট যা তার সাইজের বা তার জন্য মাননসই হয়। জান্নাতে একজন মানুষ তাই কামনা করবে যা তার প্রাপ্য বা তার জন্য প্রযোজ্য; যা প্রযোজ্য নয় তা সে চাইবে না, পাবেও না। এভাবে প্রত্যেকের চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ মিলে যাবে, সবাই সন্তুষ্ট থাকবে।
.
পার্থিব চাহিদা, পার্থিব রুচি-অভিরুচি, পার্থিব ভালো লাগা-মন্দ লাগার ভিত্তিতে জান্নাতকে কল্পনা করা ভুল হবে। এমনও হতে পারে পৃথিবীতে যে জৈবিক কামনা-বাসনার ব্যাপার থাকে জান্নাতে সেটা থাকবেই না। আমি নিশ্চিতভাবে বলছি না যে সেটাই হবে, আমি কেবল সম্ভাবনার কথা বলছি। কারণ পৃথিবীতে নারী-পুরুষের জৈবিক কামনা-বাসনার প্রয়োজন হয় বংশবিস্তারের জন্য, মানবপ্রজাতির টিকে থাকার জন্য। কিন্তু জান্নাতে বংশবিস্তারের এই ধারাবাহিকতা রক্ষার দরকার নেই, সেখানে সবাই অমর।
.
সর্বপোরি একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, কারও প্রতি অবিচার করা আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব। কারণ অবিচার করলে তিনি আর ‘সুবহান’ বা ত্রুটিহীন থাকেন না। সুতরাং আল্লাহ কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না- এটুকু সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়।

পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী- বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)

প্রাক ইসলামী আরবরা ছিল ভিখিরির জাত। ন্যূনতম সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নৈতিকতাবোধ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, মানবিক উৎকর্ষতা, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ঐক্যচেতনা ইত্যাদি কিছুই তাদের ছিল না। শুধু ছিল বংশানুক্রমিক গৃহযুদ্ধ, গোত্রে গোত্রে হানাহানি, রক্তারক্তি, শত্রুতা, সীমাহীন অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, ধর্মবাণিজ্য, জেনা-ব্যাভিচার, চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, হুজুগপ্রবণতা, মাদকাসক্তি, দাসপ্রথা, কন্যাশিশু হত্যা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি। অর্থাৎ ভালোর মধ্যে কিছু না থাকলেও খারাপের মধ্যে কিছুই বাদ ছিল না তাদের। সেই চরম অনৈতিকতা ও বর্বরতায় লিপ্ত লোকগুলোকেই মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে বিশ্বনবী কোথায় নিয়ে দাঁড়া করালেন এবং তাঁর দেখানো পথনির্দেশ মোতাবেক তাঁর ওফাতের পর মাত্র কয়েক দশক না পেরোতেই ঐ আরবরাই তরতর করে উন্নতির কোন শিখরে গিয়ে পৌঁছল সে ইতিহাস আমরা সবাই জানি। ভুখা-নাঙ্গা আরবদের এই যে অকল্পনীয় মহাবিস্ফোরণ- এর জ্বালানি যুগিয়েছেন মাত্র একজন মানুষ, তিনি বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)। আর তা করতে গিয়ে ঐ মহাবিপ্লবী মানুষটিকে একটি চরম পশ্চাদপদ জাতির প্রতিটি দিকে, প্রতিটি অঙ্গনে প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার সাথে ‘অসম্ভব গতিশীল’ পদচারণা করতে হয়েছে। একটি শিশুর জন্মপ্রক্রিয়া থেকে মৃত্যুপরবর্তী অন্তেষ্টিক্রীয়া পর্যন্ত- মানবজীবনের হেন দিক নেই যা নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয় নি, কথা বলতে হয় নি।
তাঁকে ভাবতে হয়েছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে, পররাষ্ট্রনীতি ও স্বরাষ্ট্রনীতি নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে, পারিবারিক বন্ধন নিয়ে, এমনকি ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমস্যা নিয়েও। তাঁকে ইহকালের পাশাপাশি সমাধান দিতে হয়েছে পরকালের, দেহের পাশাপাশি আত্মার। হাজারো সমস্যা তাঁর সামনে হাজির করা হত। যার যত প্রশ্ন ছিল তাঁর সামনে অবলীলায় বলে ফেলতে পারত। যার যত দাবি-দাওয়া, প্রত্যাশা থাকত অকাতরে উত্থাপন করত। একেক মানুষের চিন্তাধারা, বিশ্বাস, কর্মজীবন ছিল একেকরকম। ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের রীতি-নীতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ওদিকে শত্রুশিবির গমগম করত ধারাবাহিক যুদ্ধের আয়োজনে। কখনও কখনও জাতির অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে যেত, যেমন খন্দকের যুদ্ধ বা অবরোধ! তথাপি শত প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে তিলে তিলে তিনি একটি জাতি গঠন করলেন। প্রথমত ভিন্নমতের, ভিন্ন বিশ্বাসের, ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের ও ভিন্ন জীবিকার মানুষগুলোকে কিছু ন্যূনতম শর্তের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করলেন, তারপর একটু একটু করে গড়ে তুললেন জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, বাজারব্যবস্থা, পারিবারিক ব্যবস্থা ইত্যাদি। তাঁকে অনৈক্যপ্রবণ মানুষগুলোর মধ্যে ঐক্যের চেতনা জাগাতে হয়েছে। বিশৃঙ্খল মানুষকে শৃঙ্খলাবোধ শেখাতে হয়েছে। ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যপ্রবণদের আনুগত্যপরায়ণ করতে হয়েছে। জ্ঞানচর্চাবিমুখ একটি জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানমুখী করতে হয়েছে। যে অস্ত্র ব্যবহৃত হত কেবলই প্রতিশোধমূলক শত্রুতার কাজে, সে অস্ত্রের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়েছে মানুষের কল্যাণের পথে।
এ গেল একটি দিক, বাহ্যিক দিক। অন্য দিকটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। জাতির বাহ্যিক পরিবর্তনের চেয়েও আত্মিক পরিবর্তন বেশি জরুরি এটা আল্লাহর রসুল ভালোভাবেই জানতেন। তিনি জানতেন যাদের নিয়ে তাঁর পথ চলা তারা খুব বেশিদিন হয় নি জাহেলিয়াতের যুগ অতিক্রম করেছে। সেই জাহেলিয়াত যাতে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে তারও নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়েছে তাঁকে। ভোগ্য দ্রব্য-সামগ্রির বস্তু হিসেবে বিবেচিত হত নারীরা। সেই নারীদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে তাঁকে। কেবল ব্যাভিচার নিষিদ্ধকরণই তাঁর শেষ কথা ছিল না, কোন প্রক্রিয়ায় সামাজিক-পারিবারিক জীবন দূষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ হবে সে উপায়ও তুলে ধরতে হয়েছে তাকে। যে সমাজে দাসীদেরকে মনে করা হত নিছক যৌন সামগ্রী, মনরঞ্জনের বস্তু, সেই সমাজকেই বিশ্বাস করাতে হয়েছে দাসীরাও তোমাদের মতই রক্ত-মাংসের মানুষ, তাদেরও হৃদয় আছে, তাদেরও দুঃখ-কষ্টবোধ আছে। তারা যন্ত্র নয়। তোমরা যে আল্লাহর সৃষ্টি, তারাও সেই আল্লাহর সৃষ্টি। সব মানুষ এক পিতা-মাতা আদম হাওয়ার সন্তান, আল্লাহর চোখে সবাই সমান। এই বিশ্বাস পোক্ত করার জন্য তিনি নিজেই একজন দাসীকে, মারিয়া কিবতিয়াকে (রা.) বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন।
আল্লাহর রসুল জানতেন কেবল দাসমুক্তির ব্যবস্থা করাই একমাত্র সমাধান নয়। ঐ মুক্তদাসেরা যতদিন সমাজের আর দশজন মানুষের মতই সমমর্যাদা ভোগ না করছে ততদিন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ফলে দাসদের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার মনস্তাত্ত্বিক এই লড়াইতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই মহামানব এমন কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন যা বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে চিরদিন। মক্কা বিজয়ের দিনে অর্ধনগ্ন হাবশী বেলালকে (রা.) ক্বাবার ছাদে উঠিয়ে বিশ্বনবী কোরাইশ আভিজাত্য ও অহংকারের মূলে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে বুঝিয়ে দিলেন- ‘‘এই হচ্ছে ইসলাম। এই হচ্ছে ইসলামের মূল্যবোধ। তোমরা যাদেরকে মানুষই মনে করতে না তারা আমার আল্লাহর কাছে এই ক্বাবার চাইতেও বেশি প্রিয়।’’ একইভাবে জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়ে বাঘা বাঘা কোরাইশ ও আনসারদেরকে রেখে ওসামা বিন যায়েদকে (যার পিতা এক সময় দাস ছিলেন) যুদ্ধের সেনাপতি বানানোর ঘটনাই কি কম তাৎপযপূর্ণ? এর মাধ্যমে রসুল উম্মতের জন্য আরও এক প্রস্থ শিক্ষা রেখে যান যে, ইসলামে নেতৃত্বের যোগ্যতা বংশীয় আভিজাত্য দিয়ে নয়, দক্ষতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। এগুলো একেকটি ঘটনা নয়, একেকটি মাইলফলক।

ক্বাবার ছাদে বেলাল (রা.)

এটা ইতিহাস যে, অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী কার্ল মার্ক্স সারাটা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানবজীবনের কেবল অর্থনৈতিক মুক্তির একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। সে তত্ত্বও ভারসাম্যপূর্ণ নয়, সম্পূর্ণ আত্মাবিবর্জিত সুতরাং অপ্রাকৃতিক। অথচ বিশ্বনবী কেবল অর্থনীতি নয়, কেবল জাতীয় নীতি নয়, কেবল আইন-কানুন-দণ্ডবিধি নয়, কেবল প্রশাসন পরিচালনা নয়, কেবল নারী অধিকার নিশ্চিতকরণ নয়, কেবল শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণ নয়, কেবল মানুষের জৈব চাহিদা পূরণ নয়, কেবল আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ নয়, কেবল ইহকালীন মুক্তি নয়, বরং মানবজাতির ‘সামষ্টিক’ জীবনের ‘পূর্ণাঙ্গ’ ও ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ দিক-নির্দেশনা দান করেছেন এবং মাত্র ২৩ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজ হাতে সেটার বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে গেছেন। জাহেলিয়াতের সমুদ্র থেকে আস্ত একটি জাতিকে একাই তীরে টেনে তুলেছেন। এ যেন কল্পনার পরিধিকেও ছাড়িয়ে যায়!
ইদানীং একটি শ্রেণি গজিয়েছে তারা অভিমানে গাল ফোলান আল্লাহর রসুল দাসপ্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন না কেন, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করলেন না কেন, যুদ্ধ-রক্তপাত নিষিদ্ধ করলেন না কেন ইত্যাদি নিয়ে। আল্লাহর রসুল কী কী করেন নি- এ নিয়ে গবেষণা করে মাথা খারাপ করার দরকার পড়ত না যদি তারা বুঝতে সক্ষম হতেন তিনি কী কী করেছিলেন, কোন অসাধ্যগুলো তাঁকে সাধন করতে হয়েছিল মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে। নারী অধিকারের প্রসঙ্গে বলতে হয়- ইউরোপে ফরাসি বিপ্লব হয়ে যাবার পরও নিছক ভোটদানের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে নারীদেরকে গিলোটিনে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তখন পর্যন্ত ইউরোপের অবস্থাই যদি এমন শোচনীয় হয় তবে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে কী ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর অষ্টাদশ বা উনবিংশ শতাব্দীর নারীরাই যদি এমন ব্রাত্যদশা ভোগ করে তবে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের একটি বর্বরতম জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরা কত বঞ্চিত ও অবহেলিত দিনাতিপাত করত তাও অনুমেয়। সেই অবস্থা থেকে বিশ্বনবী নারীদেরকে কোন অবস্থানে উন্নীত করেছিলেন তা ইতিহাস। জাতীয় ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণ তো নিশ্চিত হয়েছিলই, এমনকি বিশ্বনবী নারীদেরকে নিয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। নারী-পুরুষ একসাথে মসজিদে নববীতে সালাহ কায়েম করত। একসাথে হজ্ব করত। একসাথে বসে রসুলের আলোচনা, বক্তৃতা শুনত, কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করে জেনে নিত। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়েও রসুলের সাথে নারীদের পরামর্শ করার ঘটনা জানা যায়। মসজিদে নববীর পাশে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল যার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন একজন নারী, রুফায়দাহ (রা.)। হযরত উমার (রা.) এর খেলাফতের সময় বাজার দেখাশোনা করার দায়িত্ব পালন করেছেন একজন নারী, শেফা (রা.)। ওহুদ যুদ্ধে উম্মে আম্মারা (রা.) মুসলিম বাহিনীর পক্ষে যে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন আল্লাহর রসুল স্বয়ং।

ইয়ারমুক যুদ্ধে অস্ত্র হাতে মুসলিম নারী যোদ্ধা।



ওহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে উম্মে আম্মারা (রা.) অসাধারণ বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। পরবর্তীতে রসুলাল্লাহ (সা.) তার যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।

এ ইতিহাসগুলো কীভাবে নারীবাদীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় আমার বুঝে আসে না। এতবড় বৈপ্লবিক পরিবর্তন করলেন যে মানুষটি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাসূচক একটি শব্দ উচ্চারণ না করলেও কেন তিনি তেরোটি বিয়ে করলেন- এ নিয়ে হাজার হাজার লাইন লেখা হচ্ছে অবিরত। অথচ রসুল (সা.) না এলে তেরোটি বিয়ে কেন, নিছক একজন গোত্রপতি তেরশত যৌনদাসী রাখলেও কারও কিছু বলার ছিল না। ভুলে যাচ্ছেন কেন, ঐ যুগে দাস-দাসীর পরিমাণ দিয়ে সামাজিক মর্যাদা নির্ণিত হত।
একইভাবে রসুল (সা.) দাসপ্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন নি বলে যারা চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন তারাও অতি প্রায়ান্ধ দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে পারলে রসুলাল্লাহ দাসপ্রথার মূলে যে শক্ত কুঠারাঘাত করেছেন এবং মালিক-শ্রমিক সম্পর্ককে আধুনিক মূল্যবোধের ছাঁচে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন তা স্পষ্ট দেখতে পেতেন। যে মূল্যবোধ তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা আজকের যুগেও কেউ কল্পনা করতে পারে? মাত্র তিনটি শর্ত-
ক. কাউকে শ্রম দিতে বাধ্য করা যাবে না,
খ. শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি তার ঘাম শুকোনোর আগেই পরিশোধ করতে হবে,
গ. নিজে যা খাবে, পরবে, শ্রমিককেও তা খেতে ও পরতে দিতে হবে।
এই মূল্যবোধের কানাকড়িও কি আজকের কথিত আধুনিক সভ্যতায় বাস্তবায়িত হয়? হয় না। আল্লাহর রসুল দাসপ্রথাকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন মালিক-শ্রমিক ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, সেই সাথে ‘‘আল্লাহর চোখে সবাই সমান’’- এই মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে। অন্যদিকে যারা ইসলামে দাসপ্রথার গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছেন তাদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে ভালোবাসার, ভ্রাতৃত্বের, ত্যাগের কোনো স্থান নেই। এখানে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক শত্রুতার, বিদ্বেষের ও তীক্ততার। আদী দাসপ্রথার গায়ে রঙচঙ মেখে স্বাধীনতার মোড়ক পরিয়ে রাখা হলেও এই ভণ্ডামীর বিরুদ্ধে যারা একটি বর্ণও লেখার প্রয়োজনবোধ করেন না তারাই যখন ইসলামে দাসপ্রথা আবিষ্কারের অভিলাসে ইতিহাস ছাঁকতে বসেন তখন বিষয়টি হাস্যকর দেখায়। দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যেত? আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ ও সাদা-কালোর ব্যবধান আইন করে অস্বীকার করা হয়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। কিন্তু সাদা-কালোর ব্যবধান দূর করা সম্ভব হয় নি আজও। আজও সাদারা কালোদের হত্যা করলে বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামতে হয়। মনে রাখতে হবে- আইন করে মানসিক পরিবর্তন ঘটানো যায় না। অথচ বিশ্বনবীর দায়িত্ব ছিল মানুষের বাহ্যিক ও আত্মিক পরিবর্তন ঘটানো।

হাজারটা আইন করলেও এ সমস্যার সমাধান হবে কি?

আল্লাহর রসুলের সংগ্রামী জীবনকে যারা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তারা জানেন দাসপ্রথার মূলে ইসলাম কতটা শক্ত আঘাত হেনেছিল। সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি যে বিস্ময়কর জাতিটি গঠন করেছিলেন, তাঁর ওফাতের পর অর্ধদুনিয়ায় যে জাতি ন্যায়, সুবিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই জাতিটি যদি হঠাৎ লক্ষ্য ভুলে না যেত, তাহলে ঐ সময়ই পৃথিবী থেকে দাসপ্রথাসহ যাবতীয় কুপ্রথার কবর রচিত হয়ে যেত তাতে সন্দেহ নেই। আজকে যারা নারীমুক্তির আন্দোলন করছেন তাদেরও স্বপ্নপূরণ হয়ে যেত তখনই। দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয় নি। হয় নি যে, তার জন্য কি বিশ্বনবী দায়ী? কতটা অন্ধ হলে, কতটা বিবেকবোধ লুপ্ত হলে, কতটা সংকীর্ণমনা হলে মানবতার কল্যাণে একজন মানুষের সারা জীবনের অকৃত্রিম সাধনা ও আত্মত্যাগকে ভুলে গিয়ে, তাঁর নেতৃত্বাধীন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবকে পাশ কাটিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত বিয়ে-সাদী ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হওয়া যায়?

সত্যিই এ অন্ধত্বের কোনো তুলনা হয় না! কোনো উপমা হয় না!